তিক্ত বুকের বাঁপাশ পর্ব -২৭ ও শেষ

#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৭(প্রপ্তিময় সুখ)

“মিষ্টার আরিয়ান চৌধুরী, আপনার ছেলে বেডে নেই। তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।”

প্রায় ছয় ঘন্টারও বেশি সময় হয়ে গেছে নম্রমিতাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও ডক্টরদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে একজন করে নার্স কিছু প্রয়োজনের জন্য বাহিরে আসছেন। পরিবারের সকলের উৎকণ্ঠা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে নিরস মুখে আবারও ঢুকে পড়ছেন ওটির মধ্যে। এদিকে রাফিদের জ্ঞ্যান ফেরেনি। তাই অযথা সেই রুমে কাউকে ভীড় করতে বারণ করেন ডক্টর। ফলস্বরূপ সকলে নম্রমিতার সুখবরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ওটির বাইরে। ইতিমধ্যেই হুট করে রাফিদের নিখোঁজ হাওয়ার ঘটনা আরও একবার নাড়িয়ে দেয় পুরো পরিবারকে। এবার শক্তপোক্ত আনোয়ারা খাতুনও হু হু করে কেঁদে ওঠেন। পরিবারের প্রাণভোমরা এই দুটো মানুষ। অথচ আজ কেউই ভালো নেই। জীবন তাদের থেকে কিসের হিসেব নিচ্ছেন, জানা নেই তার।

একজন নার্সের দেখানো পরিষ্কার আর ফাঁকা একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছে রাফিদ। অতঃপর পরিষ্কার একটুকরো কাপড় বিছিয়ে নামাজে দাড়ায় সে। নামাজের প্রতিটা সুরার সাথে সাথে তার চোখ হতে নির্গত হয় অশ্রুধারা। নামাজের মাঝেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে দুই হাত মেলে ধরে সৃষ্টিকর্তার দরবারে।

“ইয়া মাবুদ, আমি তোমার কাছে দ্বিতীয়বারের মতো কিছু চাইতে এসেছি। শেষবার অভিযোগের সুরে বলেছিলাম, নম্রমিতা কেনো আমার হলোনা! কি দোষ ছিল আমার ভালোবাসায়! কেনো তুমি তাকে আমার না করে অন্য কারোর ঝুলিতে ঢেলে দিলে! তাকে আমার দেওয়ার গুজারিশ করেছি বারংবার। তুমি আমায় নিরাশ করোনি। সময়ের ফেরে নম্র আমার হয়েছে। আমার ভালবাসা ফিরে এসেছে আমার কাছে। আজ আমি সেই ভালোবাসা আবারো ফিরে পেতে এসেছি মাবুদ। হে রহমানের রহিম, তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার জীবিত অবস্থায় তাকে মৃত ঘোষণা কোরোনা। আমি সহ্য করতে পারবো না। দরকার হলে আমার আয়ুষ্কালও তাকে দিয়ে দাও। কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায় এমন কিছু শুনিও না। হে মাবুদ, আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো, আমার প্রাণভোমরা সে। তাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আমি! তুমি তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আর কিচ্ছু চাইনা। কখনও কিছু চাইবো না। শুধু আমার নম্রকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও তাকে।”

কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে রাফিদের। অসুস্থ শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ ঠিকমতো বসে থাকতে পারছেনা। ছেড়ে দিচ্ছে শরীর। অতঃপর কাঁদতে কাঁদতেই এক সময় লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। নার্সের কথামতো রুমে ঢুকে রাফিদকে অজ্ঞান অবস্থায় পান আরিয়ান চৌধুরী। অস্থিরচিত্তে ডক্টরকে ডাক দেন তিনি। আবারও শুরু হয় রাফিদের ট্রিটমেন্ট।

একনাগাড়ে আরও দুটো ঘণ্টা পেরিয়েছে। রাফিদকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলস্বরূপ গভীর ঘুমে সে। বসে থাকতে থাকতে মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো তোহার। রণকের কাঁধে মাথা দিয়ে মাত্র চোখ বুঁজেছে সে। এমতাবস্থায় হুট করে অফ হয় ওটির লাইট। আরুশি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,

“আমার আপু, আমার আপু। আপু আছে তো! অপারেশন শেষ, কিন্ত আমার আপু!”

তিনজন ডক্টর বেরিয়ে আসেন একসাথে। তাদের মুখ থমথমে। তাদের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে নম্রমিতার মা। আরুশি দুইহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। পরিবারের সকলেরও খানিকটা আন্দাজ হয়ে গেছে ঘটনা। আরিয়ান চৌধুরী কিছু বলে ওঠার আগেই ভেসে আসে সদ্যোজাত বাচ্চার কান্নার শব্দ। পিছনে তাকাতেই লক্ষ্য করেন নার্সের কোলে তোয়ালে প্যাঁচানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা করুণ সুরে কাঁদছে। সেও বুঝি বুঝতে পেরেছে তার মায়ের ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা! তার বিদায়বেলার আগাম বার্তা কি সেও পেয়েছে!

হুট করে তিনজন ডক্টর একসাথে বলে ওঠেন, “কংগ্রাচুলেশন মিষ্টার চৌধুরী। বাচ্চা আর মা দুজনের গ্র্যান্ড ওয়েলকামের ব্যবস্থা করুন।”

একেবারে থ হয়ে গেছেন আরিয়ান চৌধুরী। খুশীর মাত্রা এতোটা বেশি যে, এই মুহূর্তে তার ঠিক কেমনভাবে রিয়েক্ট করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছে না। উপস্থিত সবাই আরও একবার কেঁদে দেয়। যে কান্নার মাঝে নেই কোনো বেদনা, বরং যা আছে আছে তা প্রাপ্তি আর উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ।

“আজ সত্যিই মিরাকেল হয়েছে। বাচ্চাকে সুস্থভাবে বের করা গেলেও পেশেন্টকে কোনোভাবেই স্টেবেল করা যাচ্ছিল না। এমনকি একসময় তার হার্টবিটও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মনে মনে তাকে মৃত ঘোষণাও করে ফেলি। কিন্তু বিধাতার লীলাখেলা বোঝা যে বড্ডো মুশকিল। হয়তো কারোর ভালোবাসার জোরের সাথে পেরে ওঠেনি তার সিদ্ধান্ত। কারোর আবেগে লুটিয়ে পড়া কান্না দেখে হুট করেই বদলে ফেলেন সিদ্ধান্ত। জোরে শ্বাস টেনে ওঠে পেশেন্ট। নাও, শি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। তবে অনেক কেয়ারফুলি রাখতে হবে তাকে। অনেক বেশি ধকল গেছে এই কয়েকমাসে তার উপর দিয়ে। শরীরে নূন্যতম শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।”

৩৩.

ছয় বছর পর,

কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে ছোটো নুরির পিছনে পুরো রুম জুড়ে ছোটোছুটি করছে নম্রমিতা। নুরি কখনও ব্যালকনিতে আবার কখনো বেডের এপার থেকে ওপার ছুটে বেড়াচ্ছে। তাকে খাওয়াতে গিয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা নম্রমিতার। বিগত ত্রিশ মিনিট ধরে অর্ধেক খাবারটাও শেষ করানো যায়নি। ক্লান্ত হয়ে বেডে বসে পড়ে নম্রমিতা। নুরি মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। অতঃপর জেদী কণ্ঠে বলে ওঠে,

“আব্বু না আসলে আমি খাবোনা। খাবোনা মানে খাবোনা। একটুও নাহ।”

এইটুকু মেয়ের এমন একগুঁয়েমি আর জেদ দেখে বরাবরই অবাক হয় নম্রমিতা। তার ধরনা, একমাত্র রাফিদের জন্যই মেয়েটা দিনকে দিন এমন বাঁদর হচ্ছে। তার জেদ ক্রমাগত বাড়তেই থাকছে। রাগী দৃষ্টিতে নুরির দিকে তাকায় নম্রমিতা। কণ্ঠ খানিকটা উঁচু করে বলে ওঠে,

“বয়স মাত্র ছয়। অথচ তোমার সব কথা আমাদের শুনে চলতে হবে! এতো জেদ কোথা থেকে আসে! যেমন জেদ দেখিয়েছ, তেমন আজকে সারাদিন না খেয়েই থাকবে। একটা খাবারও পাবেনা আর।”

মায়ের উঁচু কণ্ঠের আওয়াজে কাঁচুমাচু হয়ে যায় নুরির মুখ। চোখে ভীড় করে অশ্রুকণারা। কাঁদো কাঁদো মুখে তাকায় নম্রমিতার দিকে। তবুও মন গলেনা নম্রমিতা। শব্দ করে হেঁটে বের হয়ে যায় রুম থেকে। মুখভঙ্গি দারুন কঠোর।

“আমার নুরি পাথর কি আজও বকা খেয়েছে আম্মুর কাছে?”

বেডের শেষপ্রান্তে আধা শোয়া আধা বসা অবস্থায় দুই পা বিছানার নিচে ঝুলিয়ে রেখে পড়াশোনায় ব্যাস্ত নুরি। মুখটা একেবারে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। রাফিদ সদ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই বুঝতে পারে মেয়ের অভিব্যাক্তি। আজও নিশ্চয়ই নম্রমিতার কাছে বকা খেয়েছে সে। রাফিদের আদুরে কণ্ঠ শুনে জোরে জোরে কেঁদে দেয় নুরি। একদৌড়ে ছুটে গিয়ে কোমর পেঁচিয়ে জাপ্টে ধরে তাকে। কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে সে।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর। রাফিদের কাঁধে মাথা রেখে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে আছে নম্রমিতা। ফুরফুরে শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ। শরীর জুড়ে কেমন যেনো এক ঝিম ধরা অনুভূতি। অনুভূতি শিয়রে পৌঁছে গেলে যেমন অবশ হয়ে পড়ে শরীর, তেমনই এক অনুভূতিতে ছেয়ে আছে তার দেহ মন। বড্ডো ভালো লাগছে। আবেগে রাফিদের হাতখানি আরও খানিকটা শক্ত করে চেপে ধরে সে। ঠোঁটের হাসি চওড়া হয় রাফিদের। দুষ্টুমিরা কিলবিল করতে থাকে মাথায়। অতঃপর একহাতে নম্রমিতার কোমর জড়িয়ে ধরে আরও খানিকটা কাছে টেনে নেয়। মোহনীয় কণ্ঠে বলে ওঠে,

“নম্র, আমার একটা ইচ্ছে অপূর্ন আছে আজও।”

“কি ইচ্ছে?”

“খোলা আকাশের নিচে আমাদের দ্বিতীয় বাসর।”

“ছিঃ! অসভ্য।”

“ওরে আমার সভ্যবতি। আপনার মতো সভ্য হলে এতদিনে আর মা ডাক শুনতে হতো না আপনাকে।”

“হয়েছে হয়েছে। রুমে চলো এবার। নুরি একা ঘুমিয়ে আছে।”

“উহু, একদমই নাহ। মাঝরাতে ছাদে এসে চন্দ্রবিলাস করার ইচ্ছে জেগেছিলো তোমার। আমি সঙ্গ দিয়েছি। এবার আমাকে একটু আমার চন্দ্রে পাড়ি দিতে দাও!”

“বুড়ো বয়সে এসব আদিখ্যেতা করতে লজ্জা করেনা তোমার!”

“একটুও নাহ।”

বেশ খানিকটা সময় রাফিদের কোলে বসে নম্রমিতা কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর মুখে হাসি ফুটিয়ে মুখোমুখি বসে রাফিদের। উল্লাসি কণ্ঠে বলে ওঠে,

“ওকে, আমি রাজি। তবে আমারও একটা শর্ত আছে।”

“কী?”

“নুরির তো ছয় বছর হয়ে গেল। তুমি কী চাওনা ওর একটা ভাই আসুক!”

রাফিদ এক ঝটকায় কোল থেকে সরিয়ে দেয় নম্রমিতাকে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় নম্রমিতা।আক্রোশে ফেটে পড়ে রাফিদ। আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। থমথমে মুখে নেমে যেতে নেয় ছাদ হতে। নম্রমিতার আবেগের পসরা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই কথাটুকু বলার জন্য ঠিক কতখানি সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে সেটা একমাত্র সেই জানে। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার। ছাদের কার্নিশ ধরে মেঝেতে বসে পড়ে সে।
#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৮( তিক্ত বুকের বাঁপাশের প্রশান্তি)
#অন্তিম_পর্ব

মুষলধারে বৃষ্টির মাঝে রাফিদ দাঁড়িয়ে আছে খোলা আকাশের পানে চেয়ে। আচমকা ছাদের ওই প্রান্ত থেকে দৌড়ে আসে নম্রমিতা। বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতো আছড়ে পড়ে রাফিদের উপর। দুইহাতে শক্ত করে চেপে করে কোমর।

“আর কখনও বলবোনা এমন। প্লীজ তাকাও আমার দিকে।”

রাফিদ নিরুত্তর থাকতে চেয়েও পারলো না। উল্টো ঘুরে জোরসে জড়িয়ে ধরলো নম্রমিতাকে। একেবারে বুকের সাথে চেপে। পারে তো একেবারে ঢুকিয়ে নেয় বুকের ভেতর। কণ্ঠ তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা। বলে,

“নুরির জন্মের সময় যে অবস্থা আমার উপর দিয়ে গেছে, দ্বিতীয়বার হলে নির্ঘাত মৃত্যু। সেই পুরানো দিনের আঘাতগুলো বারবার এভাবে কেনো জাগিয়ে তোলো নম্র! আমার যে কষ্ট হয়! পাগল পাগল লাগে।”

নম্রমিতা বিড়াল ছানার মতো আরো খানিকটা লেপ্টে গেলো রাফিদের সাথে। অতঃপর প্রশান্তিতে দুই চোখ বুঁজে স্মৃতির পাতা হাঁতড়ে বেড়ায়।

অতীত,

জ্ঞ্যান ফেরার সাথে সাথে পরিবারের সবাইকে একজোট অবস্হায় তার কেবিনে দেখে মলিন হাসে নম্রমিতা। পুরো শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। নিস্পলক চাহনিতে দেখে সকলের খুশির রেশ। অনুভব করে তাদের আদুরে আলিঙ্গন। তবুও নম্রমিতার চোখ খুঁজে বেড়ায় বিশেষ একজন মানুষকে। তার একান্ত ব্যাক্তিগত সেই মানুষটাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তার মন। অগত্যা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে,

“রাফিদ কই? সবাইকে এখানে দেখছি, কিন্তু ওকে তো দেখছি না! বাবুকে কোলে নেবেনা! রাগ করেছে আমার উপর!”

আনোয়ারা খাতুন যত্নসহকারে হাত বুলিয়ে দেন নম্রমিতার মাথায়। অতঃপর চাপা স্বরে বলেন,

“আমার ছেলেটা ভালো ছিলোনা রে মা! তার প্রাণভোমরা যে মানুষটা, তার কষ্টে সে কিভাবে ঠিক থাকে বল! ঘুমের মেডিসিন দেওয়ায় এখন নিস্তেজ সে।”

আনোয়ারা খাতুনের কণ্ঠে চাপা বিষাদ। নম্রমিতার একাধারে যেমন কষ্ট লাগছে সেই সাথে ভালোলাগার অনুভূতিও হচ্ছে বেশ। হয়তো তার জীবনের প্রথমাংশের সময়ে ছিলো অনেকখানি তিক্ততা, তবে সময়ের গতিবিধিতে তা আজ প্রাপ্তির খাতায়। বুকের ভেতরের তিক্ততার লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই। বিশুদ্ধ ভালোবাসার স্বচ্ছতা ধুয়ে মুছে ফেলেছে সকল তিক্ততা।

কড়া মেডিসিনের ফলে ঘুমে জুড়ে আসছে চোখ। অথচ বুকের কাছে কী যেনো ভারী ভারী ঠেকছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলতো চোখ খুলে তাকায় নম্রমিতা। আবিষ্কার করে রাফিদের উষ্ণ শরীর। আলতো করে মাথা ঠেকানো তার বুকে। গলার কাছটা অনেকটা ভেজা ভেজা। নম্রমিতা আদুরে গলায় বলে ওঠে,

“ইশ! পাগলটা এখনও কেমন করছে দেখো! আমি ঠিক আছি তো। এখনও কান্না করতে হয়!”

চকিতে চোখ তুলে তাকায় রাফিদ। অশ্রুসিক্ত চোখ আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে খানিকটা কেশে স্বাভাবিক করে নিজেকে। অতঃপর চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে ওঠে,

“ককই কান্না করছি! ভুল দেখেছো।”

রাফিদের মিথ্যা ধরা পড়ে গেলেও আর লজ্জা দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলোনা নম্রমিতা। হালকা হেসে দুইহাত বাড়িয়ে আবারও তাকে বুকে আসার আহ্বান জানায়। রাফিদও বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপটি করে প্রিয়তমার উষ্ণ আলিঙ্গনে মিশে রইলো।

বর্তমান,

মাঝরাতে ভিজে চুপচুপে দুই মানব মানবী মেতেছে একে অন্যেতে। বৃষ্টির ছন্দ পতনের সাথে সাথে ওঠানামা করছে তাদের উষ্ণ আলিঙ্গনের। ছাদের ছোটো চিলেকোঠার ঘরে হয়েছে আজ তাদের ঠাঁই। হয়তো বৃষ্টি ভেজা শীতল শরীরের উষ্ণতা প্রয়োজন, তাই এ আয়োজন। বাহিরের বৃষ্টির বেগের সাথে হয়তো বেড়ে চলেছে প্রিয়তমের সোহাগ।

৩৪.

দাদির ঘরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে রিফাত। আজ সে বেশ বড়সড় এক অন্যায় করেছে। এতক্ষণে হয়তো তোহা জেনেও গেছে সে ব্যাপারে। মায়ের মারের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দাদির ঘর। সেই ভাবনা নিয়েই দাদির ঘরে এসে লুকায় রিফাত।

“রিফাত, রিফাত। কই তুমি? সামনে আসো শুধু একবার। আজ পিঠের সবকটা ছাল আমি তুলে নেবো তোমার। সামনে এসো বলছি।”

মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে দাদির শাড়ির আঁচল ধরে আরও গুটিশুটি মেরে তার পিছনে লুকিয়ে পড়ে সে। ভয়ে মুখটা কাঁচুমাচু। তোহা পুরো বাড়ি খুঁজে যখন রিফাতকে কোথাও পেলনা, অবশেষে আসলো শাশুড়ির রুমে। অতঃপর কন্ঠে রাগ বজায় রেখে ভদ্রতার সহিত বললো,

“আম্মা, আপনাকে না কতোবার বলেছি, ওই বাঁদর ছেলেটাকে একদম আস্কারা দেবেন না। আজকে স্কুলে কি কান্ড করেছে জানেন? প্রিন্সিপাল কল করেছিলো।”

“ছাড়ো না বৌমা। বাচ্চা মানুষ। এই বয়সে বদমাসি করবে না তো কখন করবে? বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে সব।”

“না আম্মা। আজকের ও অন্যায় করেছে। আজ কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। এইটুকু একটা ছেলে, মাত্র চার বছর বয়স। এই বয়সেই মেয়েদের ফুল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার না নিলে চড় থাপ্পড়ও দিচ্ছে। ভাবতে পারছেন আপনি! কী ডেঞ্জারাস হচ্ছে দিনকে দিন!”

তোহার অভিযোগ শুনে ঠোঁট টিপে হাসেন তিনি। কিন্তু মিছে মিছে খানিকটা গাম্ভীর্যের ভাব বজায় রেখে রিফাতকে হাত ধরে টেনে আনেন সামনে। অতঃপর খানিকটা নমনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,

“আমাদের রিফাত কি এমন কিছু করেছে?”

“আমার কী দোষ দাদিআম্মা! নুরিকে তো আমার ভালো লাগে অনেক। আমি ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সাথে কেনো কথা বলবে? আমি আছি না! যা কথা বলার আমার সাথেই বলবে ও।”

“নুরি তো তোমার থেকে বড়ো আব্বা। এভাবে মারতে হয়না।”

“বেশ করেছি মেরেছি। আরও মারবো। আমার কথা শোনেনি কেনো! কতো করে না করেছিলাম স্কুলে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে। আমি তো ওর বি.এফ, যা বলার আমাকে বলবে। অন্য কারোর সাথে কেনো কথা বলবে! আবার যদি এমন করে পা ভেঙ্গে দেবো নুরি পাথরের। আর স্কুলে আসতে পারবে না। কি মজা হবে।”

ছেলের কথা রীতিমত ভিমরি খায় তোহা। বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় রিফাতের দিকে। সেইসাথে রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,

“বি.এফ! এই ছেলে, এসব কী ভাষা! বয়স কতো তোমার! মেরে পিঠের ছাল তুলে নেবো একেবারে।”

তোহার রাগী কণ্ঠের উচ্চস্বরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয় রিফাত। কান্নারত কণ্ঠে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“নুরি তো আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। ঠিক আছে, আর কখনো নুরিকে ভালোবাসবো না। আমার খেলনাও দেবো না। একটা কথাও বলবো না। পচা মেয়ে একটা। মামাবাড়িও যাবনা। সবাই পচা, অনেক পচা।”

কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে যায় রিফাত। তোহা পিছু নেয়না। কারণ বাবার মতোই রাগ, জেদ তার। কিছুতেই কোনো কথা বলবে না এখন। খানিকটা সময় দিলে নিজে থেকেই সব ভুলে গিয়ে ফিরে আসবে। অতঃপর শাশুড়ির পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সে। আচমকা কিছুক্ষন আগের ঘটনার কথা মনে করে শাশুড়ি বৌমা একসাথে হেসে ওঠে উচ্চস্বরে।

৩৫.

প্রকৃতি শান্ত। আকাশ মেঘলা হলেও গুমোটভাব নেই। ফুরফুরে বাতাস হুড়মুড় করে এসে বাড়ি খাচ্ছে রুমের জানালা দিয়ে। খানিকটা শীত শীত আবহাওয়া। কেমন যেনো শান্তির এক আচ্ছাদন। এতো এতো শান্তির মাঝেও অশান্ত তোহার মন। প্রতিনিয়ত ভেতরে ভেতরে পুড়ছে সে। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। রণকের বুকে মাথা দিয়েও আর আগের মতো শান্তি পায়না যে! তাও একটু শান্তির খোঁজে বারবার অবশ দেহটার কাছে ছুটে যায় সে। মাঝরাতে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ছুটে আসে এই রুমে। যেখানে শায়িত অবস্থায় রয়েছে তার প্রিয়তম। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে কান্নারা। আর কতো! একটা বছর তো কম সময় নয়! রনক কী আর কখনও তাকে আগের মতো জড়িয়ে ধরবে না! সময়ে অসময়ে একটুকরো ভালোবাসার আবদার নিয়ে উপস্থিত হবেনা তার দুয়ারে!

ডেলিভারির পর চারমাস কেটেছে। নম্রমিতা প্রায় পুরোপুরি সুস্থ। ছোটো নুরি এই কয়দিনে মায়ের চেয়ে বেশি বাবাকে পেয়েছে। তাই হয়তো সে বাবার প্রতি আসক্ত বেশি। পরিবারের সকলের অন্তঃপ্রাণ নুরি। নুরি হলো কুড়ানো একটুকরো সুখ। তাইতো রাফিদ প্রথমবারের মতো মেয়েকে কোলে নিয়ে এই নামেই ডেকেছিল। অজস্র আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলো তাকে। রাফিদের আদরে অতিষ্ট হয়ে নুরি একপর্যায়ে জোরেশোরে কেঁদে ওঠে। রুম ভর্তি সকলে রাফিদের পাগলামো দেখে উচ্চস্বরে হেসেছিলো বটে।

দুই পরিবারের আলোচনায় আগামী মাসেই পূর্ণাঙ্গভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত হয় তোহা আর রনকের। তোহাও এই পর্যায়ে পুরোনো ট্রমা কাটিয়ে উঠে মন থেকে খুশিতে হয় সবকিছুতে। আগে থেকে মোটামুটি সবরকম কেনাকাটা করা থাকায় অল্পদিনের মাঝে আয়োজন করতে খুব একটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়না তাদের। হলুদের দিন সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে রনক আসে, শুধুমাত্র তোহাকে হলুদ লাগাবে বলে। এতো লোক সমাগমের মাঝে রনককে নিজের রুমে দেখে হতবাক তোহা। বিস্ময়ে কিছু বলে ওঠার আগেই উন্মুক্ত স্বল্প মেদযুক্ত পেটে শীতল ছোঁয়া পেতেই শিউরে ওঠে তোহা। রনকের মুখে মিটিমিটি হাসি। তোহার বুকের মাঝের ড্রিম ড্রিম শব্দের কম্পাঙ্ক বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। অথচ ভাবলেশহীন রনক। নিজের কাজটুকু শেষ করে তোহাকে চোখ টিপ দিয়ে যে পথে এসেছিলো সেই পথেই ফিরে যায় সে। দ্রুত ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যায় তোহা। ভীত চোখে নীচে তাকাতেই রনককে সুস্থভাবে হেঁটে বেরিয়ে যেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।

সকাল থেকে বেশ কয়েকটা শাড়ি পরে আবারও খুলে দিয়েছে নম্রমিতা। রুমের অবস্থা বেহাল। চারিদিকে এটা সেটা ছড়ানো। বিয়েবাড়ি মানেই অগোছালো থাকবে সবকিছু। কিন্তু নম্রমিতা সেই ধাঁচের মেয়ে নয়। সবসময় সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার অভ্যস্ত সে। আজ হটাৎ করে রুমের এই করুন অবস্থা দেখে সরু চোখে তাকায় রাফিদ। বেডের এককোনে চুপচাপ বসে আছে নম্রমিতা। মাথা নীচু করে কী যেনো ভাবছে। সেই সাথে ভারাক্রান্ত মন। রাফিদ নিঃশব্দে নম্রমিতার পাশে গিয়ে বসে। এরপর তার একহাত পুরে নেয় নিজের হাতের মুঠোয়। শব্দ করে চুমু খায় নম্রমিতার ডান হাতের পিঠে। নম্রমিতা কিছু বলেনা।

“শাড়ি পছন্দ হচ্ছেনা? আমি পছন্দ করি দিই?”

চোখ তুলে তাকায় নম্রমিতা। চোখের কোনে পানি জমেছে। রাফিদ বিচলিত হয় খানিকটা। আলতো হাতে মুছিয়ে দেয় নম্রমিতার চোখের পানি।

“আমাকে দেখতে অনেক খারাপ হয়ে গেছে তাইনা? পেট কেমন মোটা হয়ে গেছে। আর একটুও ভালোলাগেনা, তাইনা?”

নম্রমিতার কথায় রাফিদ হালকা হাঁসে। এ কথা সত্য যে আগের চেয়ে দেহগত সৌন্দর্য্য অনেকখানি কমে গেছে নম্রমিতার। প্রেগনেন্সির সময় যে ঝড়ঝাপটা গেছে তার উপর দিয়ে! তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিদ বলে ওঠে,

“দেহের প্রেমে পড়লে, আজ তুমি অন্য কোথাও থাকতে নম্র। তাকিয়ে দেখো আম্মুর দিকে, বয়সের ফলে চামড়া ঝুলে গেছে। চোখে মুখে কুঁচকানো চামড়া। অথচ আব্বু আজও নিয়ম করে তার কপালে চুমু খায়, ভালোবাসে তাকে। দৈহিক সৌন্দর্য্যই যদি সব হতো, তবে আজ তাদের মাঝে থাকতো যোজন যোজন দূরত্ব। নম্র, তুমি আমার কাছে প্রথম দিনের মতো সুন্দর আর পবিত্র। কলঙ্ক তো চাঁদেও আছে, তাও সৌন্দর্য্যের উপমায় আমরা তাকেই বেছে নিই। কলঙ্কহীন সৌন্দর্য্য ফকফকা সাদা রঙের মতো, একেবারে ফ্যাকাশে। দৃষ্টির আকর্ষণে আসেনা।”

খানিকটা সময় কাটে একান্ত, তাদের প্রেমময় ক্ষণে। এরপর নম্রমিতার হাতে একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি ধরিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় রাফিদ।

বিদায়বেলা, বড্ডো কঠিন সময়। তোহার বিদায় বেলায় সকলের সাথে নুরিও কেঁদেছে বেশ। নিষ্পাপ শিশুমনও বোধহয় বুঝেছিল, আজ থেকে ফুফির কোলে আর সে চড়তে পারবে না। পাবেনা এতো শতো আদর ভালোবাসা। রাফিদের বুকের ভেতরটা দুমড়ে আসে। সেদিনের ছোটো বোনটাকে আজ অন্যের হাতে তুলে দিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও নিয়তিকে যে মেনে নিতেই হয়! তোহাকে গাড়িতে তুলে রাফিদ শক্ত করে আলিঙ্গন করে রনককে। অতঃপর নীচু গলায় বলে ওঠে,

“দুঃখকে কখনও তার ধারে কাছে আসতে দিয়নি। যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। তবে ওর জেদ নেই, আছে শুধু অভিমান। আমার বোনের বাচ্চাসুলভ মনের যত্ন নিও। শুধু এটুকুই চাইবো সারাজীবন তোমার কাছে।”

“সজ্ঞানে কখনও তার কিংবা তার মনের অযত্ন হতে দেবোনা, কথা দিলাম।”

ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় তোহার। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে বাস্তবে। এই অসময়ে রাফিদের কল পেয়ে বেশ অনেকটাই অবাক হয় তোহা। চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ফোন কানে ধরতেই ভেসে আসে রাফিদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

“তোহা, খুব বেশি ব্যস্ত না থাকলে এখনি বাড়িতে আয়। ভীষণ দরকার।”

রণকের বুক থেকে মাথা তুলে ললাটে চুমু খায় তোহা। অতঃপর রিফাতকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে চৌধুরী বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

নম্রমিতা মাত্রই ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে। ইতিমধ্যে রাফিদের কল পেয়ে মুচকি হাসে। রিসিভ করে মশকরাসূচক কিছু বলার আগেই রাফিদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তাকে বাড়ি ফিরতে বলে ফোন রেখে দেয়। অবাক হয় নম্রমিতা। বর্তমানে সে একটা কলেজের প্রফেসর। মা আর বোনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। রাফিদ এ বিষয়ে কখনও আপত্তি করেনি। বরং চাচা চাচীর আসল চেহারা জানার পর থেকে পরোক্ষভাবে আরুশিকে সাহায্য করে ওই বাড়ি ছাড়তে। সেইসাথে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা আসতো তাদের একাউন্টে। যার সবটাই রাফিদ আড়ালে থেকে করেছে।

রুমে তিনজন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। রাফিদ মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবছে। নম্রমিতা আর তোহা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কী কারোরই বোধগম্য হচ্ছে না। ঠোঁটদুটো গোল করে বেশ জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাস ছাড়ে সে। অতঃপর রুক্ষ কণ্ঠে বলে ওঠে,

“রণকের অ্যাকসিডেন্টটা পরিকল্পিত ছিলো।”

আঁতকে ওঠে তোহা। কথাটা যেনো ধাক্কা লাগে বুকে এসে। চোখের কোনে এসে ভীড় জমায় অনাকাঙ্ক্ষিত জলরাশিরা।

“নম্র, তোমার মনে আছে আমার আর তারিনের পিকগুলোর কথা? যেটা তোমার ফোনে পাঠিয়েছিলো কেউ!”

“হ্যা। কিন্তু ওর সাথে ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্টের কী সম্পর্ক!”

“সজীবের কথা মনে আছে! যে তোমাকে বলেছিলো আমার আর তারিনের সম্পর্কের কথা! আমার আর তারিনের পিক একমাত্র তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে তার ক্যামেরায় ছিলো। তাই কৌশলে তার অগোচরেই এক বন্ধু মারফত অনেকদিন ধরে বিষয়টা নিয়ে খোঁজ চালাচ্ছিলাম। অবশেষে তোমার ডেলিভারির কয়েকদিন আগেই জানতে পারি এসব সজীবের কাজ। কিন্তু আসল কারণটা স্পষ্ট ছিলোনা। এরপর তোমাকে নিয়ে আর তোহা বিয়ে নিয়ে এতোটাই ব্যাস্ত হয়ে যায় যে বিষয়টা মাথা থেকে পুরোপুরিভাবে বের হয়ে যায়। হুট করেই রণকের অ্যাক্সিডেন্টের কিছুদিন আগে সজীবের সাথে দেখা হয় কাকতালীয়ভাবে। সেখানেই চেপে ধরি তাকে। অবশেষে যা জানলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।”

এতক্ষন থম মেরে বসে রাফিদের সমস্ত কথা শুনছিল তোহা। অবশেষে অধৈর্য্য হয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠে,

“তার জন্য রণকের ক্ষতি করলো কেনো? তাকে তো আমি চিনিও না!”

মাথা নত করে নেয় রাফিদ। তোহার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হচ্ছে না তার। নিচু গলায় বলে,

“সজীব প্রথম থেকেই নম্রকে পছন্দ করতো। ঠিক পছন্দ নয়, ওই কাছে সব মেয়েই একরাতের খেলার জিনিস। নম্রকে পেতে চাইতো সবসময়। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে সাময়িক সময়ের জন্য তার লালসা ডুবে গেছিলো। হুট করেই আবারও যখন আমার সাথে বিয়ে হলো নম্রর, নতুন করে সেই লালসা চেপে বসে তার। নম্রকে পেতে মরিয়ে হয়ে পড়ে। সে কারণেই আমাদের মাঝে ভাঙ্গন ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এরপর যখন সফল হলোনা, তখন ওর টার্গেট হয়ে পড়িস তুই। তোর মাধ্যমে এই বাড়িতে ঢুকতে চেয়েছিল। এরপর নম্রকে পাওয়া ওর জন্য সহজ হয়ে যেতো। কিন্তু হুট করেই রণকের সাথে তোর বিয়ে হয়ে যায়। আর সেই সময় ও দেশের বাহিরে ছিলো। আসার পর সবটা জেনে রনককে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে রনক বেঁচে গেলেও কোমায় চলে যায়।”

রাগে মুখশ্রী কঠোর হয়ে ওঠে নম্রমিতার। দাঁতে দাঁত চেপে হিশহিশিয়ে বলে ওঠে,

“ওই জানোয়ারটার ফাঁসি হওয়া উচিৎ। এতো অন্যায় করার পরও কিভাবে লাগামহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে সে!”

“প্রকৃতি ছাড় দেয় ছেড়ে দেয়না। সে নিজের করা অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছে। এইচ. আই. ভি রোগে আক্রান্ত সজীব। যার কোনো চিকিৎসা নেই। এতো এতো অর্থ, প্রাচুর্য্যও বাঁচাতে পারলো না আজ তাকে।”

মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে তোহা। রাফিদ আর নম্রমিতা করুন চোখে তাকায় তার দিকে। তোহাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা নেই তাদের কাছে। তোহা অপেক্ষা করবে রণকের। সারাজীবন অপেক্ষা করবে। আজও তার মনে পড়ে রণকের অভিমানী কণ্ঠ। তার দুষ্টুমিভরা আবদারগুলো। রনক কোনোদিনও আগের মতো সুস্থ হবে কিনা তোহার জানা নেই। তবে সে প্রতীক্ষায় কাটাবে আজীবন।

“প্রিয়তম, আমার তিক্ত বুকের বাঁপাশ
তুমি ছাড়া নেই আমার কোনো অবকাশ।”

নম্রমিতাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে রাফিদ। খানিকটা সময় কাটে নিরবতায়। উষ্ণ বুকের ঠিক মাঝখানে তপ্ত ঠোঁট ছোঁয়ায় নম্রমিতা। গাঢ় এক চুম্বন এঁকে দেয় রাফিদের বুকের মাঝে। অতঃপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলে ওঠে, “ভালোবাসি।”

প্রাপ্তির হাসি হাঁসে রাফিদ। এতগুলো বছর তারা কাটিয়ে দিল একসাথে। অথচ কেউ কাউকে ভালোবাসি বলেনি। বরং প্রতিনিয়ত অনুভব করিতে গেছে একে অপরের ভালোবাসার গভীরতা।

“প্রিয়তমা, আমার প্রাণভোমর তুমি। আমার তিক্ত বুকের বুকের বাঁপাশের প্রশান্তি তুমি। হাজারো তপ্ততার মাঝে মুষলধারে বৃষ্টির মতো প্রশান্তি তুমি। আমার রিক্ত জীবনের সিক্ততা তুমি। আমার জীবন, মরণ, স্বপ্ন সবটুকুই তুমি। শুধুই তুমি।”

#সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here