তুমি অতঃপর তুমি পর্ব ২৫+২৬

তুমি অতঃপর তুমিই
২৫
Writer Taniya Sheikh

শান কল কাটার পরপরই চিন্তিত ইমরোজ উপায়ান্তর না দেখে মোবারককে কল করে। মোবারককে দৌড়ের উপর রেখে ঘটনার যতটুকু সারাংশ বলা লাগে বলে। মোবারক ভয়ে শেষ। কাঁদো কাঁদো হয়ে ছুটতে লাগল। ওর এমন অবস্থা দেখে আসমা,মতিনও গেল পিছু পিছু। মোবারক, মতিনের সহযোগিতায় মেইন দরজার লক ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ওরা উপরে উঠে গেলেও আসমা যায়না। সে সোজা ছোটে ইমার রুমে। চব্বিশঘণ্টা হতে চলল। আসমা ইমাকে জাগানোর চেষ্টা করছে।

” স্যার,স্যার ও স্যার, দরজা খোলেন। শান স্যার।”

মতিন বোকার মতো চেয়ে আছে মোবারকের মুখের দিকে। মোবারক কাঁদছে। পাগলের মতো বিলাপ করছে দরজায় আঘাত করতে করতে।

” ভাইজান, স্যার দরজা খোলেনা ক্যান?”

” মতিন!” মোবারক আর কোনো শব্দই বের করতে পারল না। বাচ্চাদের মতো মতো শব্দ করে কাঁদছে সে। মতিনেরও এবার কান্না পেল। সে দেরীতেও হলে সব বুঝতে পেরেছে। দুজনে অনবরত দরজায় আঘাত করতে করতে বিলাপ করছে। এদিকে আসমার কয়েকবার ডাকে ইমা পিটপিট করে চোখ মেলে। সর্ব শরীর হাওয়ায় দোলা পাতার মতো বোধ হচ্ছে। আসমা চটজলদি ইমরোজকে কল করল। সে এখানে আসতে আসতেই স্বামী এবং ইমরোজ ভাইয়ের কথাবার্তা কিছুটা শুনেছে। তাই নিজে কিছু না বলে সরাসরি ইমাকে ধরিয়ে দেয় মোবাইল। সদ্য হুশ ফেরা ইমা হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল। ওপাশ থেকে ইমরোজ হ্যাঁলো হ্যালো করতেই আসমা উঁচু গলায় বলল,

” ভাবি কথা বলেন, জরুরি কথা। দেরী করলে সব শেষ হয়ে যাবে।”

” শেষ হয়ে যাবে! কী শেষ হয়ে যাবে?”

আসমার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। ইমার গলা শুনে ইমরোজ মোবাইলের ওপাশ থেকেই সব তড়িঘড়ি সারসংক্ষেপে বলল। একেতো অসুস্থ তারউপর এমন অঘটন! ইমার বাঁচা কুচা শক্তিটুকুও এবার শেষ। বিছানায় নড়তে চড়তে পর্যন্ত পারল না জবাব দেবে তো দূরের কথা। ইমরোজ উচ্চৈঃস্বরে আসমাকে ডাকল। আসমা মোবাইল কানে নিতেই দ্রুত ইমাকে ধরে উপরে নিতে বলে সে। আসমা তাই করে। সে বড়ো কষ্টে দূর্বল ইমাকে ধরে উপরে এসে দাঁড়ায় শানের দরজার সামনে।
মোবারক, মতিন ইমাকে দেখে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। ইমা বেশ বুঝতে পারে এদের কান্নার কারণ। ওর বুক জুড়ে প্রবল ঝড় বইছে। আসমা ধরে না রাখলে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই। মনের জোরে গলার জোর বাড়িয়ে ইমা দরজার সাথে ঘেঁষে দাঁড়ায়,

” শান, এই শুনছেন আপনি? দেখুন চুপচাপ বেরিয়ে আসুন বলছি। আমাকে কিন্তু চেনেন আপনি ! মেজাজ চটে গেলে আপনার খবর আছে। শান,শান।” ইমার গলা ধড়ে আসে। আসমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বসে পড়ে দরজা ঘেঁষে। হাত মুঠ করারও শক্তি নেই, সেখানে উঁচু গলায় ডাকবে কী করে আবার। নিচু গলায় তাই কাতর কণ্ঠে ডাকতে লাগল, ” শান প্লিজ দরজা খুলুন৷ শান।” দরজা খুট করে খুলে যায়। ইমার স্থির চোখের কোনা দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু পড়ল। উপস্থিত বাকিদের মুখগুলো জ্বলে ওঠে। হাসি- কান্নার মিশ্রণে সমস্বরে বলে,

” স্যার আপনি বেঁচে আছেন?”

” মোবারক, এসব কী শুরু করেছিস তোরা? যা নিচে যা।” ওদের কথা বিব্রত শান। শানের রুঢ় ধমকে লজ্জিত হয়ে তিনজনই নিচে নেমে গেল। তবে মনে মনে ওরা খুশি শানকে ঠিকঠাক দেখে। ওদের নেমে যাওয়ার ওর শান ইমার দিকে তাকায়। চুপচাপ সামনে দৃষ্টি মেলে বসে আছে সে।

” অসুস্থ শরীরে উপরে কেন এসেছ?”

ইমা জবাব দেয়না। শান ওর বাহুধরে টেনে তোলে। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কঠিন গলায় বলে,

” বলো?”

ইমা অসহায় চাহনীতে মুখ তুলতেই চোখ চলে যায় সোজা শানের বিছানায়। সম্পূর্ণ বিছানা অগোছালো। চাদরটা পড়ে আছে ফ্লোরের উপর। কী হতে যাচ্ছিল ভাবতেই ইমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। শানের টিশার্টের কলার টেনে ধরে বলল,

” মরতে গেছিলি, কী রে বল?”

সহসা জবাব দিতে পারেনা শান। অন্যদিকে মুখ ঘুরাতেই ইমা আরো জোরে কলার টেনে চিৎকার করে ওঠে,

” কাওয়ার্ডের মতো এমন করতে তোর একটুও বাধল না? আমি তো কোনো কাওয়ার্ডকে ভালোবাসিনি। তাহলে এমন কাজ করার চিন্তা কী করে এলো তোর মাথায়, কথা বলছিস না কেন, কথা বল?” দু’হাতে এলোপাথাড়ি চড়,কিল মারতে মারতে শীঘ্রই শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসে। শান দু’হাতে ইমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।

” আ’ম সরি।”

” তুই সবসময়ই এমন আ’ম সরি, আ’ম সরি করিস। ছাড় আমাকে। ছাড় বলছি।”

” ইমা শান্ত হও।”

” তুই আমাকে শান্ত হও বলার কে? যা না, গিয়ে মর। ছাড় বলছি।”

শান ছাড়ে না। ইমা কাঁদতে কাঁদতে একসময় থেমে যায়। একদম নিস্তেজ হয়ে রয় শানের বুকের মধ্যে। কোলে তুলে বিছানায় এনে বসাতেই ইমা গলা জড়িয়ে ধরে,

” আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবিনা।”

অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে শানকে। মরতে গিয়েও ফিরে এসেছে। তখন মনে হয়েছে ইমরোজের কথা ঠিক। এ নিয়ে যতদিন ইমার মুখোমুখি হতে না পারবে নিজের সাথে কিছুই করবে না। শান মনের সকল ব্যথা মনে রেখে এক চিলতে হাসল। বড়ো বিবর্ণ সে হাসি।

” স্বামীকে তুই তোকারি করা বেয়াদবী তারপরও কেন করলে আবার?”

” তো কী করব? স্বামী আহাম্মকি করলে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবো? আমি পারব না।”

” আমি আহাম্মক!”

” আবার জিগায়। শুধু আহাম্মক,মহা আহাম্মক।” রাগে মুখ শক্ত করে তোলে ইমা। শান সরে বসবে বলে নড়তেই ইমা থাবা মেরে ধরে। চোখ পাকিয়ে তাকাতেই শান গম্ভীরমুখে বলে,

” ছাড়ো ইমা।” ইমা ছাড়ে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, জেদি ভঙ্গিতে। শান সেটা অগ্রাহ্য করতে পারেনা। চুপচাপ মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে সে।

প্রচণ্ড ভাদুরে গরম শেষে যখন এক পশলা বৃষ্টি পড়ে,কেমন অনুভূতির জন্ম হয়! অবর্ণনীয় তাই না? শানের চিন্তায় অস্থির ইমরোজের মনটাও হঠাৎ দোদুল্যমান নারিকেল পাতার মতো ঝিরিঝিরি দুলছে সেই মেয়েটির মিষ্টি গলার স্বর শুনে৷ মেয়েটি ইতস্তত করে কথা বলছে৷ ইমরোজের মনে হলো মেয়েটির মতো ওরও কেমন লজ্জা লজ্জা ভাবের উদয় হচ্ছে। কিন্তু কেন? সে একজন ম্যাচিয়ুর্ড পার্সন। সত্যি তো!এসব সিলি ফিলিংস তার মানায় না। মনকে স্থির করে গম্ভীরগলায় বলল,

” প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড,আমি একটু ব্যস্ত আছি। ইম্পর্টেন্ট কিছু হলে দ্রুত বলুন।”

” না,মানে আপনার ব্লেজার আমার কাছে রয়ে গেছে। ওটা তো ফেরত দিতে হবে আপনাকে,তাই কল করেছিলাম। সরি আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম বলে। যখন ফ্রী হবেন আমাকে বলবেন আমি গিয়ে দিয়ে আসব ওটা।”

মেয়েটি কল কেটে দিল। রাগ করেছে বোধহয়। ইমরোজের খারাপ লাগলেও সেটা ঝেরে ফেলে দিল। মোবারককে একটা কল করা উচিত। ভাবনা মতো কাজটা করল তাড়াতাড়ি।

মেয়েটি ভেবেছিল ইমরোজ আবার কল করবে। ক্ষমা চাইবে ওমন রূঢ় আচরণের জন্য। কিন্তু তার ধারণা ভুল। রাগে,ক্ষোভে আছড়ে ভাঙল মোবাইল। মাহিব দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,

” ও নিজেকে কী ভাবে? সামান্য একজন পুলিশ অফিসার হয়ে এতো দেমাগ? মৌটুসিকে চেনে নাই। একবার যখন বলেছি ওকে আমার প্রেমে পড়তে হবে, তখন হবেই।”

মাহিব বিস্মিত চোখে তাকাল মৌটুসিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে। এ যেন মৌটুসি নয় সামিরা! কিছুক্ষণ কী ভেবে হেসে ফেলল। গাঢ় চুম্বন করল মেয়েটির ঠোঁটে। বিছানা উপর দুজনে বসল। মৌটুসির রাগ এখনো কমেনি৷
জীবনে একবার হলেও নাকি প্রেমে সবাই পড়ে। মাহিবের ধারণা ছিল সে সবার মতো না। প্রেম,ভালোবাসার মতো আবেগ তার নেই। কিন্তু সে ভুল ছিল। ভুল ভেঙেছে মৌটুসিকে কাছে পেয়ে। মাহিব আজকাল বড্ড বেশিই কাছে চাচ্ছে ওকে। অন্য সব মেয়ে থেকে আলাদা মৌটুসি। গত দু’বছর একসাথে থাকার পরও মাহিবকে ধরে রাখার মতো আবেগ দেখায় না৷ নিজের মতো চলে; মাহিবের ইচ্ছামতো কাছে আসে,দূরে যায়। অন্য সব মেয়ের মতো বিয়ে,বিয়ে করে লাফায় না দু’দিন পর পর। মাহিব মৌটুসির কাজে প্রসন্ন। আজকাল ওকে দিয়ে ব্যবসায়ীক,ব্যক্তিগত অনেক কাজই সে করাচ্ছে। ধীরে ধীরে দৈহিক নৈকট্য ছাড়িয়ে মনের কোনে জায়গা করে নিচ্ছে মৌটুসি। পাশে পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে মৌটুসি। মাহিব অপলক চোখে দেখছে। পাছে ওর চোখে এসব পড়ে যায় তাই চট করে দৃষ্টি নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হুইস্কির ছিপ খুলে গ্লাসে ঢালে।

” পেশন্স রাখো। ভুলে যেও না ইমরোজ চতুর পুলিশ অফিসার। হুটহাট একটা মেয়ের প্রেমে ও কখনোই পড়বে। ধৈর্য্য ধরে তোমাকে এগোতে হবে।”

এক প্যাগ বানিয়ে আবার এসে বসল বিছানায়। গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে আনতেই পাশ থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় মৌটুসি। একবারে সবটা গলায় ঢেলে মুখ বিকৃত করে বলে,

” হুমম, তবে জান তুমি সিওর থাকো। ওকে তো আমি আমার প্রেমে নাকানিচুবানি খাওয়াবোই। তারপর তুমি যা চেয়েছ তাই হবে। ”

” দেখো আবার তুমিই না,,!” বাকিটা বলার অবসর মৌটুসি দিল না। মাহিব ঐ বাহুতে হারিয়ে গেল আরো একবার।

ইমার জোরাজুরিতে অনিচ্ছাস্বত্বেও ইমাকে কোলে নিয়ে নিচে নামে শান। নিচে বসে থাকা মোবারক মুখ টিপে হাসছে তাই দেখে।

” বলেছিলাম মোবারক নিচে আছে।” চাপা স্বরে বলল শান। ইমা বলল,

” তাতে কী?”

” তাতে কী! তোমার লজ্জা করছে না?”

” একেবারেই না।” সত্যি বলতে লজ্জা তো ইমারও লাগছে। কিন্তু শানকে কাছে কাছে রাখার এরচেয়ে ভালো উপায় মাথায় আসেনি। তাছাড়া এই শরীরে হেঁটে নিচে নামার কষ্টটা করবে না বলেও এহেন আইডিয়া কাজ লাগিয়েছে। শান কাউচে বসিয়ে উঠে দাঁড়াবে তখনই গলার অংশের শার্ট টেনে ধরে ইমা।

” যান কই?”

” উপরে।”

” এতো শখ কেন মরার? কোথাও যাবেন না,আমার খিদে পেয়েছে খাবার তৈরি করুন।”

” আমি এখন পারব না। মোবারককে বলে দিচ্ছি ও বাসা থেকে তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে।”

” না, বলেছি মানে না। আপনি আমার জন্য রান্না করবেন নয়তো আমি খাব না।”

শানের এবার বিরক্ত লাগছে। সে ইমার সামনে কিছুতেই থাকতে চাচ্ছে না। একটু একা থাকার জন্য এতো পীড়াপীড়ি করছে, অথচ এই মেয়েটা একা ছাড়ছেই না।

” তুমি যা ভাবছ তেমন কিছুই করব না আমি। ছাড়ো আমার শার্ট।”

” ওসব করাকরির সাবজেক্ট বাদ। এখন আমি খাব। সুতরাং কিচেনে যান।”

শান জোর করে হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।

” তোমার সমস্যা কী! ইম্যাচুউরের মতো বিহেভ কেন করছ? বললাম তো আমার ভালো লাগছে না, আমাকে একা থাকতে দাও।”

শানের ধমকে লজ্জায় কাঁদো কাঁদো হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকে ইমা। মোবারক বিব্রতবোধ করে এদের স্বামী স্ত্রীর মান অভিমানের সাক্ষী হয়ে।

” আমার শাশুড়ি আসবে আজ। স্যার আমি তাকে আনতে গেলাম।”

শান কোনো জবাব দেয় না। কোমরে হাত রেখে চোয়াল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমার দিকে পিঠ করে। মোবারক ক্ষণকাল সেখানে অপেক্ষা না করে চলে যায়। নিজের অযাচিত ব্যবহারে অনুশোচনা হয় শানের। ইমার দিকে ঘুরে তাকায়। আ’ম সরি বলতে গিয়েও আঁটকে যায়। দু’চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ইমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলে,

” আচ্ছা কী খাবে বলো?”

ইমা নীরবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শান সেদিকে হেলে তাকিয়ে বলে,

” চিকেন স্যুপ,চিকেন পাস্তা, একস্ট্রা চিজ দেওয়া পিজ্জা, বিফ স্টিক, প্যানকেক,বার্গার ? কী খাবে তাই বলো?”

ইমা জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শান হাত ধরে। চোখে পড়ে ইমার হাতের ব্যান্ডেজ রক্তে মাখামাখি।

” ইমা, একটু কেয়ারফুল থাকতে পারো না? দেখো আবার ব্লিডিং হচ্ছে।”

” হোক তাতে আপনার কী? যান আপনি আপনার কাজে।ছাড়েন আমাকে।”

” থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো যদি আবার মুখে মুখে তর্ক করেছ তো। বসো বলছি।”

শানের চড়া ধমকে ভীত হয়ে বসে পড়ে ইমা। ফার্স্ট এইড বক্স এনে তাড়াতাড়ি ইমার হাতটা নতুন করে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়।

” এবার বলো কী খাবে?”

” কিছুই খাব না। পেট ভরে গেছে আপনার ধমক খেয়ে।”

” ইশশ রে কী আহ্লাদি মার্কা বউ পেয়েছি আমি! একটা ধমকে সে কেঁদে কেটে একাকার। এই মেয়ে কাঁদবে না বলছি। বলো কী খাবে? যদি না বলছ তো খামারে রেখে আসব গোরু-ছাগলের সাথে।”

ইমা তবুও কথা বলে না। শান উঠে দাঁড়িয়ে ইমাকে কোলে তুলে নেয়,

” গোরু -ছাগলের সাথে থাকার শখটা আজ তোমার পূরণ করেই দেই,চলো।”

” আমি তেহারি খাব, তেহারি।”

চোখ খিচে জোর গলায় বলে শানের গলা জড়িয়ে। শানের এবার সত্যি সত্যি হাসি পেল। ইমাকে নামিয়ে রেখে কিচেনে যায়। ইমা মনে মনে হাজারটা বকা দিল শানের এই ব্যবহারে। শানকে ফ্রিজ খুলতে দেখে অসুস্থ গলায় বলল,

” গোরুর সিনার মাংসের তেহারি সেই মজা। দুই পাশে চর্বিযুক্ত মাংস, মাঝে চিকন হাড্ডি। এক এক মুঠো পোলাওয়ে এক এক টুকরা মাংস। সব শেষে প্লেটের হাড্ডি চিবোতে কী যে মজাআআ!” শানকে রাগত ভঙ্গিতে সামনে দাঁড়াতে দেখে কথা থামিয়ে ভাবুক চেহারা ধরে অন্যদিকে তাকায় ইমা।

” এখন গোরুর সিনার মাংস কই পাব আমি?”

” শাহজাহান বউয়ের জন্য তাজমহল বানিয়েছে আর কেউ কেউ বউয়ের জন্য এক কেজি সিনার মাংসও সংগ্রহ করতে পারে না। আবার তারা বউ ভালোবাসে বলে জাহির করে। সব মিথ্যা, সব মায়া।”

” নাটক বন্ধ করো। শরীরের দিকে খেয়াল করেছ? অসুস্থ তুমি৷ এই অবস্থায় ওসব খাওয়ার দরকার নেই। আমি স্যুপ তৈরি করে দিচ্ছি সেটাই খাও।”

” ইয়াক! কেউ তাকে বলো,আমি মনেপ্রাণে বাঙালী। ওসব ইংলিশ খাবার আমার অসুস্থতা সারাবে না বরং বাড়িয়ে দেবে৷ যা বলেছি তাই রান্না করে দিলে দেবে নয়তো আহা! শাহজাহান! আহারে কী প্রেম!”

” এক নাম্বারের ড্রামাবাজ। ওকে ফাইন, তোমার কথায় হবে। তার আগে হালকা পাতলা কিছু খেয়ে নাও।”

” আচ্ছা তাহলে থাই স্যুপ আগে দিয়েন৷ বহুদিন খাইনা। পারলে ক’টা ওন্থনও বানিয়েএএএ!”

শান কটমট করে তাকিয়ে কপাল চাপড়ায়। কিচেনে ফিরে যেতেই ইমা জিহ্বা কামড়ে মিটিমিটি হাসে।

” ইংরেজদের দু’শ বছর ঠাঁই দিতে পারলে একবেলা তাদের খাবারও ঠাঁই দেওয়া যায়,বাঙালীদের মন উদার হয় বুঝলেন?”

” ইমা মুখ বন্ধ করে বসে থাকো। তোমার এসব পাগলের প্রলাপ শোনার ধৈর্য্য আমার নেই৷ শান্তিতে কাজ করতে দাও আমাকে।”

” ভালোর তো জামানায় নাই, হু।” এতোক্ষণ বকবক করে মাথা ধরে গেছে ইমার। বসে থাকতে না পেরে কাউচেই শুয়ে পড়ল। অচিরেই ঘুমিয়ে গেল অসুস্থতায়।
তুমি অতঃপর তুমিই
২৬
Writer Taniya Sheikh

মানুষ মাত্রই বিশেষ কিছুর প্রতি আকৃষ্ট থাকে। এই বিশেষ আকর্ষণ মাঝে মাঝে বড়ো ধরনের দূর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাহিব যাকে স্রেফ স্বল্প সময়ের মোহ হিসেবে দু’বাহুতে ঠাঁই দিয়েছিল, আজ সেই মোহ মোহিনী হয়ে হৃদয়ে খোদিত হচ্ছে। একবার চাচ্ছে মৌটুসি নাম্নী মোহিনী তার হৃদয়ে খোদিত না হোক। কিন্তু সে চাওয়াটা খুবই দূর্বল। এই প্রথম তার কামনার চোখের সাথে সাথে প্রেমানুভূতি জাগা মনটাও চাইছে মৌকে। শুধুমাত্র বিছানা সঙ্গীনি নয় জীবনসঙ্গিনী করার অভিপ্রায়ে মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে থেকে থেকে। এই চাওয়াতে একমাত্র বাধা সামিরা, তার বাগদত্তা। মাহিব অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসে- একথা রটলে সামিরার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবেনা৷ সামিরার কথা মনে পড়তেই মাহিবের প্রেমিক স্বত্বা কেমন ম্লান হয়ে পড়ে,জেগে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ,নিষ্ঠুর এক পুরুষ। সে আবেগে ভাসতে চায়না। বরং হাসিল করার কামনায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মাহিব দ্বৈতসত্তা ধারণ করে ক্রমেই। তার ধূর্ত মস্তিষ্ক দারুন এক বুদ্ধির সঞ্চার করে। তাতেই যেন বিভৎস এক হাসি ফুটে ওঠে চোখে -মুখে।

দেশে করোনার প্রকোপ বাড়ায় লকডাউনে সমগ্র দেশ। যাতায়াত মাধ্যম অচল। অদেখা এক জীবনঘাতি ভাইরাসের ভয়ে মানুষ ভীতবিহ্বল। সকলের মনে সংশয়, দুশ্চিন্তা। ইমরোজের মা ইমরোজকে নিয়ে চিন্তিত। ছেলে তার এখন প্রায় সারাদিনই ডিউটিতে বহাল। লোকে কতকিছু বলছে,মিডিয়া তোলপাড় হচ্ছে অথচ ছেলেটার মধ্যে একবিন্দু ভয়ডর নেই। এদিকে নাতি পুতি তো দূরের কথা এখন পর্যন্ত ছেলের বউটাও দেখা হলো না। আমেনা বেগমের মনে কেন যেন ভয় জাগে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন আজ ছেলেকে আচ্ছামতো ধরবেন৷ জিজ্ঞেস করবেন,কেন ইমরোজ এখনো বিয়ে করতে চায়না। একটা মাত্র ছেলে তার। তারও তো ইচ্ছা হয় পুত্র বধূর মুখ দেখার, নাতি পুতির সাথে খেলার। চোখ ছলছল করে ওঠে কথাগুলো মনে মনে আওয়াতেই। আহসান সাহেব মসজিদে গিয়েছিলেন। অন্যদিনের মতো উজ্জ্বল মুখে ফিরে এলেন না। স্বামীর পাণ্ডুর মুখশ্রী দেখে এগিয়ে গেলেন আমেনা বেগম,

” কী হয়েছে?”

” আর বলোনা, শুনলাম মসজিদও নাকি বন্ধ করে দেবে। বাসায় বসে নামাজ পড়তে হবে যতদিন পরিস্থিতি অনুকূলে না আসে। বাপের জন্মে যা শুনিনি, দেখিনি তাই হচ্ছে এখন।” দুঃখভারাক্রান্ত মনে কথাগুলো বলে হাতমুখ ধৌত করতে গেলেন। ওয়াশরুম থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে বসার ঘরে বসতেই ইমরোজ ঢুকল। দুপুরে খাবে বলে ফিরেছে সে। বাবাকে দেখামাত্র বলল,

” মন খারাপ কেন?”

রান্নাঘরে খাবার গরম করছিলেন আমেনা বেগম। ছেলের গলা আওয়াজ শুনে দরজার কাছে এলেন।স্বামী কিছু বলার পূর্বেই বলে ওঠেন,

” কেয়ামত মনে হয় আর বেশি দূরে নাই,বাপ। কী শুরু হচ্ছে আজকাল। আল্লাহর ঘর বন্ধ করার সাহস কেমনে পায় মানুষ!” আমেনার বেগমের মনের সকল ক্ষোভ যেন এই বাক্যেগুলোয় প্রকাশিত হয়। ইমরোজ ভ্রুকুটি করে বাবা-মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলল,

” তোমাদের সমস্যা কী? কিছু না বুঝেই কথা বলো? মসজিদ বন্ধ করছে কে বলেছে?”

” শুনলাম তো।” আহসান মিয়ার গলার স্বর নমনীয়। ইমরোজ শক্ত গলায় বলে,

” বাবা তুমিই তো বলতে, শোনা কথায় কান দিতে নেই। তাছাড়া বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে দুরুত্ব মেইটেইন করা অপরিহার্য। মসজিদে সেটা সম্ভব হবে না বলেই আপাতত সেখানে জামাত পড়া নিষেধ করতে পারে। এর অর্থ এই নয় মসজিদ বন্ধ করে দিচ্ছে। কে কখন কোভিড বহন করছে তা কী বুঝবে তুমি? একজনের কারনে মসজিদের বাকি দশজন আক্রান্ত হতে পারে,তারপর তাদের পরিবার, তারপর তাদের সংস্পর্শে আসা আরও লোক।”

” মরতে হবে হবেই, আজ মরি আর কাল মরি। তাই বলে আল্লাহর ঘর,,!” আমেনা বেগমের কথা থেমে যায় ইমরোজের চোখের আগুন দেখে।

” মরতে তো হবেই মানে কী মা? আজব তোমরা। তোমাদের কথা শুনলে মনে হয়, পৃথিবীতে বাঁচার জন্য নয় মরার জন্য এসেছ। জীবন আল্লাহ পাকের দেওয়া উপহার। উপহার মানুষ আনন্দে চিত্তে গ্রহণ করে, বহন করে। নিজের সাথে সাথে অন্যকে সুরক্ষিত রাখা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। এই কথাটা ভুলে যাও কেন? প্রয়োজনে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। এটাও তেমন একটা পদক্ষেপ। বোঝার চেষ্টা করো বিভ্রান্ত না হয়ে।”

ইমরোজ ফ্রেশ হয়ে সোজা রুমে চলে যায়। স্বামী স্ত্রী এক পলক মুখ চাওয়া চাওয়ি করে চুপ করে থাকে। আমেনা বেগম ফিরে যায় রান্নাঘরে। খাবার টেবিলে চারজন একসাথে খেতে বসে। ইমরোজের বোন আশার বিয়ে হয়েছে। স্বামী ডিফেন্সে চাকরী করে। দু’মাস আগে হংকং মিশনে গেছে সে। আশা তিন মাসের গর্ভবতী হওয়ায় আমেনা বেগম মেয়েকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। নিজে সরাসরি ছেলেকে কিছু বলতে পারছেন না বিধায় মেয়েকে দিয়ে বলাবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু মেয়ে তার আরও ভীতু। কয়েকবার ইশারা করার পর আশা ভাইকে বলে,

” ভাইয়া, শান ভাই কেমন আছে?”

” হ্যাঁ, ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ।”

” শুনলাম ইমা ভাবি ফিরে এসেছে?”

” হুমম।” আমেনা ইশারায় আসল কথা বলার তাগিদ দেয় মেয়েকে। আশাকে ইতস্তত করতে দেখে ইমরোজ আড়চোখে তাকায়। খেতে খেতে বলে,

” কিছু বলবি?”

” হ্যাঁ, না মানে।”

ইমরোজ এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বোনকে দেখে। তারপর বাবা-মাকে। তাদের চেহারা পড়তে কষ্ট হয়না ইমরোজের। মুখটা ম্লান করে মুখ নামিয়ে চুপচাপ খায়। আমেনা বেগমের সেটা পছন্দ হয়না। নীরবতা ভাঙেন অভিমানি সুরে,

” তোর খালাত ভাই নাসিফ তো তোর বয়সী। চার বছরের একটা ছেলে আছে ওর। শুনলাম আবার নাকি আরেকটা হবে। শানকে দেখ। সেও তো বিয়ে করেছে। পোড়া কপাল আমার! একমাত্র ছেলের বিয়েটাও মনে হয় দেখে যেতে পারব না৷ দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। আমাদের কথা কী ভাবতে ইচ্ছা করেনা তোর?”

” মা, আবার কেন শুরু হলে তুমি?”

” আবার কেন শুরু হলে মানে কী? আজ আমাকে তুই বল,বল কেন বিয়ে করতে চাস না।”

” আহা! কী করছ। ছেলেটাকে খেতে দাও।”৷ আহসান সাহেব স্ত্রীকে বাধা দেন নির্লিপ্ত ভাবে। মনে মনে তিনিও স্ত্রীর কথার সাথে একমত তবুও খাবার সময় কথাটা নিয়ে তর্কাতর্কি ঠিক তার পছন্দ না। স্বামীর নির্লিপ্ততায় আরও চটে যান আমেনা বেগম,

” হ্যাঁ, তাই তো। খাও তোমরা। আমার কী! আমি কেন এসব বলি? যার যা ইচ্ছা হয় করো।”

মাকে আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতে দেখে ইমরোজের গলা দিয়ে খাবার নামে না। কিছুক্ষণ ভাবুক চেহারায় নিচু মুখে বসে থাকে। অর্ধেক খাবারের মধ্যে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়। আহসান সাহেব,আশা বাধা দেয়। আমেনা বেগম ছেলে খেলো না বলে শব্দ করে কাঁদেন। ইমরোজ রুমে ফিরে আসে। ইউনিফর্ম গায়ে দিতে দিতে আয়নার সামনে একবার নিজেকে দেখে নেয়। নিজেকে সে দেখতেই ভুলে গেছে। দায়িত্বের চাপে ভুলে গেছে নিজের প্রয়োজনীয়তা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বসার ঘরে মা এখনো উু উু করে কাঁদছেন।

” মা কাঁদছ কেন?”

আমেনা বেগম জবাব দেন না। তার আরও বেশি কান্না পায়। ইমরোজ এবার মৃদু হেঁসে পাশে গিয়ে বসে। আজ বহুদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরে। বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকা শিশুর মতো কাঁদে আমেনা বেগম। ইমরোজের মন বিগলিত হয়। মা ছেলে এহেন আবেগপূর্ণ মুহূর্ত বাবা মেয়ে মিস করে না। দু’জনে মুচকি হাসে,প্রশান্তির হাসি। অবশেষে মায়ের চোখের জল মুছে হাসি ফোটায় ইমরোজ। সে বিয়ে করতে রাজি হয়। তার পরিবার যেই মেয়েকে পছন্দ করবে সে তাকেই বিয়ে করবে। আমেনা বেগম উচ্ছ্বাস দমিয়ে রাখতে পারেনা৷ ছেলে বেরোতেই লেগে পড়ে মেয়ে খুঁজতে। একটা মেয়ের সন্ধানও পেয়ে যায় দিনশেষে। আমেনা বেগমের দূরসম্পর্কের এক বোনের মেয়ে। সমস্যা হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। এখন বিয়ে তো দূরের কথা মেয়ে দেখাদেখি করতেও রাজি হবেনা ইমরোজ। সে বিয়েতে রাজি হয়েছে তবে সেটা যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর হয় বলে জানিয়েছে। তাই আপাতত মেয়েটির ছবি, এবং আনুষঙ্গিক খোঁজ খবরে লেগে পড়েন আমেনা বেগম।

ইমা এখন বেশ সুস্থ। তবুও অসুস্থতার ভান ধরে পড়ে আছে। এছাড়া উপায় কী শানকে কাছাকাছি রাখার। শানের প্রতি রাগ,ক্ষোভ এখনো তার কমেনি,বরং বেড়েছে শানের বর্তমান আচরণের কারনে। ইমরোজ যতই বলুক তার বাবা ভাইয়ের মৃত্যুতে শানের হাত নেই,সে শুধু অজ্ঞাতে তাদের ধরে এনেছিল। তবুও সে দোষী ইমার চোখে। ইমা অপেক্ষা করছে সব কথা শুনবে বলে,কিন্তু শান সেই যে মুখে কুলুপ এঁটেছে তো এঁটেছেই। কেন সে ইমাকে সত্যিটা বলছে না? ইমার সামনের কুয়াশা কেন সরাচ্ছে না? এসব কী শানের অপরাধী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়! সে যদি সত্যিই নির্দোষ হতো তবে তাদের দুরত্ব কমার বদলে বাড়াচ্ছে কেন? কেন ঐ মেয়ে নিজেকে শানের বাগদত্তা দাবী করেছিল? কেন বলেছিল, শান তার সাথে আছে কেবল অনিচ্ছায়, হুকুম পালন করতে।পৃথিবীর কোনো স্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বী চায়না। ইমার যখনই মনে হয় শানের বলা সব কথা কেবল দায়িত্ববোধে সৃষ্ট, তখনই কষ্টে বুক ভারী হয়ে আসে। একবার মনে হয় শানের ভালোবাসা মিথ্যা নয়, পরক্ষনেই মনে পড়ে মেয়েটার কথা। সে না চাইতেও শানকে অবিশ্বাস করে,নিজেকে কষ্ট দেয়। আজকাল তো অবিশ্বাসের ভীত পোক্ত হচ্ছে। শানকে অচেনা মনে হয়। কাছের আসার আগ্রহ দেখতে পায়না,পায় দূরে সরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা। তখন মনে হয় চারবছর আগের মেয়েটি সঠিক বলেছিল। শান তাকে ভালোবাসে না, সে কেবল আজ্ঞাবহ ভৃত্যের ন্যায় মালিকের কথায় ইমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছিল। সময়ের ব্যবধানে আজ সেই চেষ্টা নেই। এসব কথা গলায় দলা পাকিয়ে ক্রোধ বাড়ালেও সহজে ঠোঁটে আসেনা। তবে ইদানীং দলাটা আলগা হচ্ছে শানকে সামনে পেয়ে। সব কথা বলবে বলে অধীর হয়ে উঠছে।

” ইমা, তোমার ওষুধ।” পাশে দাঁড়ান শানকে দেখে মুখ ফিরিয়ে ইমা বলে,

” রেখে যান।”

” এখনই খাও নয়ত ভুলে যাবে।”

ইমা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,

” ভুলে গেলে কী হবে? মরে যাব? আমার মৃত্যুতে পৃথিবীর কোনো পরিবর্তন হবে না, আর না পরিবর্তন হবে কারো ভেতর।”

কথাটা বলে আড়চোখে শানকে একপলক দেখে। স্থির,অবিচল ভাব শানের। ইমার অভিমানে কান্না পায়। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয় শান। ওষুধ, পানি সামনে ধরে বলে,

” সবসময় এসব না বললেই কী নয়! নাও খেয়ে নাও।”

রাগ সংবরণ করতে পারেনা ইমা। চেঁচিয়ে ওঠে,

” বললাম তো পরে খাব রেখে যান।”

” চেঁচাবে না,ইমা।”

” একশবার চেঁচাব। কী করবেন আপনি?”

শান প্রসঙ্গ এড়াতে চায়। নির্বিকার মুখে বলে,

” খেতে বলেছি খাও।”

” না, খাব না।”

শানের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। চোখের পলক পড়েনা। ইমা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। শানের মনে হয় ইমার চোখে ক্রোধ নয়, ভীষণ ঘৃণা। সে শানের শাস্তি চায়, কঠিন শাস্তি। শান কাজই তো এমন করেছে,শাস্তি না চেয়ে উপায় কী! নিজেকে শাস্তি দেয় শান। ইমার চোখে চেয়ে যে অসহনীয় ব্যথা ওঠে তার চাপে হাতের গ্লাস ভেঙে যায়। রক্তাক্ত হাতটা দেখে ইমা চমকে ওঠে। শান চমকায় না। চমকানোর মতো কিছুই নেই ওর। ইমার বাধা উপেক্ষা করে চলে আসে নিজের রুমে। রক্ত ঝরা হাতটার দিকে চেয়ে চোখ জ্বলে,বুক জ্বলে। দরজায় আঘাত পড়ছে। ইমার গলা শুনতে পায় শান। চট করে যেমন-তেমন করে হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দরজা সামান্য খুলে মুখ বের করে প্রশ্ন করে,

” কী হয়েছে? ”

ইমার কান্না থেমে আসে,উদ্বিগ্নতা কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। শান জোর গলায় আবার প্রশ্ন করতেই মৃদু কেঁপে ওঠে ইমা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শানের কলার চেপে ধরে। ইদানীং এই কাজটাই সে করছে। বড্ড অস্বস্তি হয় শানের। ইমার হাত ছাড়িয়ে পেছনে মুড়ে ধরে খুব করে। ইমা ব্যথা গিলে শানকে বকছে। তার নিরর্থক বকাবকিতে স্পষ্ট সে কষ্ট পেয়েছে। শান সেটাই বুঝতে চায়। কিসের কষ্ট? ঘৃণিত মানুষের ব্যথায় কিসের কষ্ট তোমার ইমা! মুখে বলে,

” বার বার একই রকম অভদ্রতা আমার পছন্দ না,ইমা।”

” তোর পছন্দের খেতা বালিশ। ছাড় বলছি আমার হাত।”

” যতক্ষণ তুই তুকারী বন্ধ না করবে ছাড়ব না। সরি বলো।”

” সরি আমার,, ” শান পেছনে মুড়ে ধরা হাতটা আরও জোরে টেনে ধরতেই ব্যথায় কণ্ঠরোধ হয়ে যায় ইমার। তবুও জেদ কমে না। পা দিয়ে শানকে দূর্বল করবে বলে পা ছুড়াছুঁড়ি করে। শান মৃদু হাসে। সে হাসি ইমা দেখে না। উল্টো করে মুখোমুখি জড়িয়ে ধরতেই ইমার মুখ নত হয়ে যায়। শান গম্ভীরমুখে বলে,

” ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে নিচে চলে যাবে। বলো যাবে। ” ইমা কোনো জবাব দেয়না৷ নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে শান ছেড়ে দাঁড়াতেই ইমা দু’হাতে শানকে ঠেলে বিছানায় ফেলে দেয়। ওর বুকের উপর চড়ে বসে বলে,

” এতো ভাব কেন তোর? কেন আমার আবেগ, অনুভূতিকে বাজারের পণ্যের মতো ব্যবহার করছিস? খুব ভালোবাসিস সামিরাকে? এতোই যখন ভালোবাসা তোদের তাহলে আমার সাথে ভালোবাসার নাটক কেন করলি,বল? ধোঁকাবাজ,মিথ্যাবাদী?” ইমা দু’হাতে এলোপাথাড়ি শানকে আঘাত। শান হতবুদ্ধি হয়ে দেখছে শুধু। সামিরা! ইমা সামিরার কথা কী করে জানে? সামিরার সাথে ওর সম্পর্কের কথায় বা কেন বলছে? শানের মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। বিস্মিত শানকে নিচে ফেলে ঝুকে দু’হাতে ইমার হাত চেপে ধরে। সে ইমাকে দেখছে, ইমার চোখে সামিরাকে দেখছে।

চলবে,,

দেখেন আপনারা যেন বিড়ম্বনায় না পড়েন তার কারনে বিভিন্ন সময় গল্প না দেওয়ার কারণ উল্লেখ করে পোস্ট করি। আপনরাই বলেন, বার বার পেজে আসেন,খোঁজেন তাই যেন বলে দেই কবে গল্প দেবো। এখন আমি তো রোবট না। রক্তমাংসে গড়া মানুষ।বিভিন্ন সময় অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমি গল্প দিতে পারিনা। আমি ইচ্ছা করে অসুস্থ হইনা,ইচ্ছাকরে মোবাইলও নষ্ট করিনা। আর না এসব বলে জাহির করি আপনাদের জন্য গল্প লিখে এহসান করছি। লেখালেখি করতে ভালোবাসি বলেই ঝামেলা এড়িয়ে লেখার চেষ্টা করি। আমার জন্যে লিখি।আপনাদের ভালোবাসা পূর্ণ উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে লিখি। আপনাদের লেখা উপহার দিতে ভালোবাসি বলেই লিখি। খারাপ লাগে আপনারা অনেকে বিষয়টা নেগেটিভলি নিলে। এই গল্প আগে যেভাবে দিতাম সেভাবেই দিব। এর সাথে দশটা গল্প শুরু করলেও এই গল্প লেখায় সমস্যা হবে না। আমার মোবাইল এখনো ঠিক হয়নি। চার্জে দেই আবার কিছুক্ষণ পর শেষ হয়ে যায় চার্জ। এভাবেই ফাঁকে ফাঁকে লিখছি গল্প। মনের খায়েশে লিখছি। লেখালেখির নেশায় পড়ে লিখছি।
চলবে,,,

দিন দিন কমছে দেখছি এই গল্পের চাহিদা। কমলে আর কি করার! এখন থেকে গল্পটা কিন্তু একদিন পরপর পাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here