তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব ১২

তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব- ১২
Writer Taniya Sheikh

ইমার শরীর অসাড় অসাড় বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে৷ কান্নার তোড়ে দেহ কাঁপছে, হিচকি উঠছে। পাশে বসে নিরবে ড্রাইভ করছে শান। সে মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল ইমাকে সত্যিটা সহজে বলবে না। কিন্তু বিধিবাম! বিরহ,বিচ্ছেদ তার সইল না। ইমাকে এ’কদিন দেখতে না পেরে,কথা বলতে না পেরে তার পরাণ পাখি দাপাদাপি করছিল একপ্রকার। ভুগছিল নিদ্রাহীনতায় । আজ এতোকাছে পেয়ে বহুকষ্টে নিজেকে সামলে শুধু দু’দন্ড কথা বলার আশায় এসেছিল। তার আশা যে তরতর করে এমন লোভী হয়ে উঠবে তা সে ভাবে নি। ভালোবাসায় লোভী হতে নেই,ধৈর্য্য হারা হতে নেই। শান জেনেও আজ সে ভুল করল। ইমার দিকে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে ওর। ইমার কান্নার জল দাহ্য পদার্থ হয়ে হৃদয় পুড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো তাই শানের।

” গাড়ি থামান বলছি। থামান গাড়ি।” হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে ইমা। ইমার দিকে তাকাতে পারছে না শান৷ অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে তাকে। সামনে তাকিয়েই তাই শীতল গলায় বললো,

” ইমা, রিলাক্স। ”

ইমার যেন এবার প্রচন্ড রাগ হলো। দ্বিগুন জোরে চেঁচিয়ে বললো,

” তোর রিলাক্সের খেতা বালিশ। গাড়ি থামাবি না লাফ দিমু?”

” তুই তোকারি কেন করছ? মানলাম ভুল হয়েছে,আ’ম স্যরি।”

” তোর সরি তুই নে। গাড়ি থামা আমি ঐ ওভার ব্রিজ থেকে লাফ দিয়া জান দিমু৷ এই নষ্ট,কলঙ্কিত জীবন রেখে কী হবে আর। সব শেষ আমার। সব শেষ।”
শান ভ্রুকুটি করে ইমার দিকে একপলক চেয়ে। ইমা দু’হাতে চোখ মুছছে আর কাঁদছে ফুঁপিয়ে। শান বিরক্ত হয়ে বললো,

” এমন বিহেভ করছ কেন? জাস্ট একটা কিস ই তো ছিল।”

কান্নাসিক্ত নয়ন বড় বড় করে ইমা বললো,

” জাস্ট একটা! ছি!ছি! তওবা, তওবা। আল্লাহ গো! এই লোক কত্ত খারাপ। এই আমাকে নামান বলছি। আমি গাড়ির তলে মাথা দিব। নামান! নামান।” গাড়ির দরজায় লাথি দেয় ইমা। কাঁচের উপর চাপড়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগল। শান বেশ বিব্রত।

” ইমা শাট আপ।”

” ধমক দেবেন না। কিছু হইলে শাট আপ! শাট আপ! এই আপনি অন্যের বউয়ের সাথে এসব কেন করলেন?” ইমা শব্দ করে কাঁদছে নাক টেনে টেনে। চোখ দু’টি থেকে অগ্নি ঝরছে যেন। এতোক্ষনে শান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে মুচকি হেঁসে বিস্মিত হলো এমন স্বরে বললো,

” অন্যের বউ মানে? ”

” অন্যের মানে আরেকজনের বউ আমি৷”

ইমা বাহুদিয়ে ঠোঁট টেসে কান্না দমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বৃথা সে চেষ্টা। সে আরেকজনের বউ কথাটা মনে করতেই হৃদয় বিদীর্ণ হলো তার। জোয়ারের জলের মতো চোখের কোনা বেয়ে জল পড়ছে।

” হোয়াট! মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে তোমার?” ভ্রুকুটি করল শান।

” আমার তো আগে থেকেই নষ্ট এবার আপনারও হবে। এতো করে বললাম ঠিক হচ্ছে না।ঠিক হচ্ছে না। না উনি শুনলেন না। উম্মা! উম্মা শুরু করে দিলেন। বদ লোক। এখন আমার কী হবে? ও আল্লাহ একি হলো? আমি মরে যাব। সত্যি সত্যি মরে যাব।”

ইমা দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে। গম্ভীরমুখে ইমার মুখটা দেখল আড়চোখে শান। জ্যাম ছেড়েছে। আবার চলছে গাড়ি। ইমা দু’হাতে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। খুলছেই না দরজা। খুলবে কী করে। লক করা তো! ইমা একসময় হাল ছেড়ে দেয়। ঝুঁকে করতলে মুখ ঢেকে কাঁদছিল সে। গাড়ি থামল শানের এপার্টমেন্টের নিচে এসে। শান ঘুরে বসে ইমার এক হাত টেনে ইমাকে বুকে জড়িয়ে নিল। ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম ভালোবাসায়। ইমার কান্নার গতি যেন আরও বাড়ল। ক্রন্দনরত অবস্থায় ফুঁপিয়ে বললো,

” আপনি জানেন না আমার বাস্তবতা। আমার সাথে এমন কেন করলেন? কেন? এই মুখ আমি কাউকে দেখাতে পারব না আর।”

কোনো প্রত্যুত্তর না করে শান ইমাকে কোলে তুলে নেয়। অদূরে দাঁড়ানো দারোয়ানকে গাড়ির চাবি দিয়ে উঠে পড়ে লিফটে। ইমার কান্না বর্ষার শ্রাবনধারা। এই ঝিরিঝিরি, এই মুশলধারায় ঝরছে। রুমে এসে ইমাকে বসার ঘরের সোফায় বসাল শান। ফ্যাকাশে অবনত মুখমণ্ডলে সিক্ত হয়ে গুটিশুটি মেরে সোফায় শুয়ে রইল ইমা। শান নিজের রুমে ঢুকল। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা কাগজ এনে ইমার সামনে ধরে সে। ইমা চোখ তুলে তাকিয়ে আছে নির্বাক। চোখ সরিয়ে নেয় শান। জোর করে তুলে বসায় ইমাকে। তারপর কাগজটি ওর হাতে গুঁজে দিয়ে আবার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ইমা কপাল কুঞ্চিত করে ফুপাচ্ছে কাগজটা হাতে ধরে। ধীরে ধীরে কাগজের ভাঁজ খুললো। চোখ গিয়ে পড়ল সোজা তার নামটাতে” ইসরাত জাহান”
ইমা চোখ মুছে সুক্ষ্ণ চোখে দেখল কাগজটা। পুরো কাগজটা পড়ে তার শরীর কাঁপছে এবার। মাথায় উপর মনে হলো আকাশ ভেঙে পড়েছে। ভয়, সংশয়ের সাথে সাথে প্রশান্তির হাওয়ায় দুলে উঠল মন। শানের রুমের বন্ধ দরজায় তাকিয়ে হাঁ করে রইল। এই লোক তাকে খুঁজে বের করল কীভাবে? তার যে বড়ো মিসটেক হয়েছে। বরের নামটা সেদিন খেয়াল করেনি সে। স্পষ্ট করে তাতে লেখা “শান নিহান খান”। এখন হঠাৎ মনে পড়ে গেল কাজীর বলা সব কথা। ইমা কপাল চাপড়ে উঠে দাঁড়ায়। বিরবির করে,

” থাক মরব না। স্বামীই তো ছিল। স্বামী ওসব,, ” বাকিটা মুখে আনতে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যায় ইমা। কাগজটা হাতে নিয়ে মেইন দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। এখানে এক মুহূর্ত আর থাকবে না। সত্যিটা জানার পর তো না ই। আজই দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। বুক ফেটে ফের কান্না আসতে চাইল। শানকে সে মন থেকে চেয়েও আপন করতে পারবে না। এই কষ্ট তাকে ভেঙেচুরে একাকার করছে। নিজেকে সামলে ইমা দরজার লক সাবধানে খুলতেই পেছনে শানের রুমের দরজা খোলার শব্দ এলো। ইমা ভীরু নয়নে মূর্তিমান দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে শানের গায়ের সুবাস। খুব কাছে আসতেই ইমা ঘুরে দরজার সাথে মিশে দাঁড়াল। অবনত মুখে সভয়ে ঢোক গিলে বললো,

” আমাকে যেতে দিন। ”

” যাও!”

ইমা চোখ তুলে তাকাতেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে,প্রচন্ড জোরে শীতল সমীরণ বয়৷ সামনের জানালা ভেদ করে একপশলা বৃষ্টিতে ভিজে যায় ব্যালকনির বাইরের রুমটা। অদূরে দাঁড়ানো দুটি দেহ থেকে মনে, মন থেকে দেহে খেলে যায় শিহরণ। প্রকৃতির মতোই উত্তাল হয়ে ওঠে কামনা-বাসনা। দু’টি দেহ এক হয় নিমেষেই। তারা যেন পৃথক ছিল না কোনোদিনই, কোনোদিনই।

ইমাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে শান। ইমার চোখে ঘুম নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে বিমুগ্ধ নয়নে শানের ঘুমন্ত মুখখানা দেখছে সে। শানের সরু উন্নত নাক হালকা স্পর্শ করে ঠোঁটে নিচের তিলটাতে আঙুল রেখে মৃদু স্বরে বলে,

” আমার রাজপুত্র।” ঘুমন্ত শানের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটতেই ইমা ঘাড় ঘুরিয়ে জিহ্বা কামড়ে বালিশে মুখ গোঁজে। তখনই শানের হাতটা আরও শক্ত বাধনে বেঁধে নিল তাকে। কর্ণলতিকায় তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল ইমা। সে ব্যথা দ্রুতই ভালোবাসার প্রলেপে ম্লান হয়। শান ইমার কানে মুখ রেখে চাপাস্বরে বলে,

” তাহলে পালাতে চাচ্ছিলে কেন আমাকে রেখে?”

” ভয় করে আমার। পেয়ে হারানোর ভয়ে আমি সব পাওয়াকে দূরে ঠেলে দেই। আমাকে একা ছেড়ে যাবেন না তো? এভাবে সব দিয়ে আবার শূন্য করলে আমি মরে যাব। সত্যি বলছি।”

ইমা ঘুরে শানের গলায় মুখ গুঁজে রইল। মনটাতে হঠাৎ বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে অজানা আশংকায়। শান নিরবে দু’হাতে ইমাকে আরও গভীর আলিঙ্গনে বাঁধে। এতো গভীর যে বিষন্নতা, শঙ্কা সহসায় দূরীভূত ইমার মধ্য থেকে।

মাহিব বারে বসে আয়েশ করে মদ্যপান ও ডান্স দেখায় মগ্ন।যে তিনটে মেয়ে নাচছে তারমধ্যে একটাকে তার আজ মনে ধরেছে। শ্বেতশুভ্র গায়ের রং,কচি লতার মতোই দুলে দুলে নাচছে ষোড়শী মেয়েটি। শামীমকে কল করতেই ছুটে এলো সে। মাহিব ইশারায় মেয়েটাকে দেখিয়ে হোটেলের ভিআইপি কক্ষে চলে এলো। এখানকার নিয়মিত কাস্টমার সে৷ নরম বিছানায় গা এলাতেই শামীম সভয়ে এসে দাঁড়াল সামনে। মাহিব নেশায় ঢুলুঢুলু চোখ মেলে বললো,

” কিছু বলবি?”

” বস ওদের প্রেম তো মাখোমাখো৷”

মাহিব মুচকি হেঁসে বসল বিছানায়। বললো,

” মাত্র মাখোমাখো? আরও গাঢ় হতে দে। এতো গাঢ় যে, দু’জন নয় একজন হয়ে যাবে। তখনই তো খেলা জমবে। এক ঢিলে দুই পাখি ট্টাহ!” জিহ্বা উপরের তালুতে লাগিয়ে শব্দ করে এক চোখ টিপে ফের বলে,” তাছাড়া আমার শতরঞ্জের রাণী আসতেও তো বাকি এখনও। রাণী ছাড়া খেলা ঠিক জমে না বুঝলি তো।” মাহিব হোঁ হো করে হেঁসে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে৷ বার ডান্সার মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। মাহিব তুড়ি বাজিয়ে কাছে ডাকে মেয়েটাকে। একপলক শামীমের দিকে চেয়ে ভীরু পদে এগিয়ে যায় সেদিকে মেয়েটি। শামীম চিন্তা মগ্ন। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এতো সহজে শানকে মাহিব ছাড়বে না সে জানে। কিন্তু করবে টা কী? কী পৈশাচিক বুদ্ধি এঁটেছে কে জানে? এদিকে সে নিজ চোখে শানের এপার্টমেন্টের নিচে একটু আগে শানের কোলে দেখে এসেছে মেয়েটিকে। সামনের দৃশ্য অবলোকনে ছেদ পড়ে শামীমের ভাবনায়। একটু আগের মেয়েটি বিবস্ত্র এখন। এটা স্বাভাবিক, সে এসব দেখেছে বহুবার বসের রুমে। কিন্তু আজ কেন যেন চোখে লাগছে। মেয়েটি মাহিবের বাহুডোরে অথচ দৃষ্টি শামীমের দিকে স্থির। মেয়েটির স্বচ্ছ কাকচক্ষুর গভীরে ডুবতে ডুবতে নিজেকে সামলে নিল শামীম। বেরিয়ে এলো চোখ নামিয়ে। করিডোর ধরে নেমে গেল নিচে। নিচে নামতেই মোবাইলটা বেঁজে ওঠে। শামীম মোবাইল হাতে নিতেই দেখল স্ক্রিনে”চুমকি” লেখাটা ভাসছে। শামীমের ভার ভার মাথাটা দ্রুতই হালকা হলো। হাসল এক ঝলক। মোবাইল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠল ,

” আয়িএএএ মেহেরবান। ব্যায়ঠিয়ে জানে জান,
শখ ছে লিজিয়ে জি ইশকি কি ইমতেহান,,

চলবে,,,

একটা কথা গতপর্বের নিচে লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। ঐদিন ১৮+ দেখে অনেকের মনে অনেক ভাবনা উদয় হয়েছিল বোধহয়। আমি তো গল্প শুরুর প্রথমেই পোস্ট করে বলেছিলাম গল্পটা ১৮+হবে। অনেকে হয়ত পোষ্ট টা পড়েনি। যার কারনে ভেবেছিলাম এখন থেকে ১৮+ এলার্ট দিয়ে দিব প্রতি পর্বের উপরে। কিন্তু অনেকের কমেন্ট দেখে সে সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। এখন যে যেখান থেকেই পড়ছেন কথাটা স্মরণ রাখবেন এটা ১৮+ গল্প। ১৮+ মানেই কিন্তু কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল হবে এমন নয়। জাস্ট কিছুটা এডাল্ট বিষয় থাকবে তবে শালীনতা বজায় রেখে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here