তুমি আছো তুমি রবে পর্ব -০২

#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ২
#রেহানা_পুতুল

শুধু কাঠ কাঠ গলায় বললো,
নাস্তা খেয়ে জলদি তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে তোমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিব ড্রাইভার দিয়ে।

বয়েই গিয়েছে আমার আপনাদের বাসায় থাকতে। আমি নিজেই আজ চলে যেতাম আমাদের বাসায়। বলে ঝিনুক তার ব্যাগ নিয়ে নিলো। চেইন খুলে ভিতরে উঁকি মেরে দেখে আবার চেইন বন্ধ করে দিলো।

আরিশা নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলো। ভাইয়া ফ্রেস হয়েছো? তোমাদের দুজনের নাস্তা।

হুম হয়েছি। ডাইনিংয়ের কি হয়েছে?
শুকনো গলায় জানতে চাইলো আরশাদ।

কিছুইনা। মা বললো তোমরা দুজন আরাম করে রুমেই নাস্তা করতে।

আরশাদ মুখ গোমড়া করে বোনের দিকে চাইলো। আরিশা চোখ দিয়ে ইশারায় বলল ভাইকে,কিছুই করার নেই। মানিয়ে নেয়ার ট্রাই করো।

তুইও বোস আমাদের সাথে।

ওক্কে। খাচ্ছি। তিনজনে নাস্তা করছে একসাথে। আরিশা গরম পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরে দিতে দিতে,
ভাইয়া আমি কিন্তু ওকে ভাবি বলতে পারবোনা। নাম ধরেই ডাকবো। কি পিচ্চি আর কিউট দেখতে। ও আমার এক বছরের জুনিয়র হবে মে বি।

তোর যা ইচ্ছে হয় বলিস। আমার কোন আপত্তি নেই।

এই মেয়ে তোমার আপত্তি আছে নাম ধরে ডাকলে? জানতে চাইলো আরিশা।

না নেই। নিচু গলায় জানালো ঝিনুক।
তোমার নামটা কে রেখেছে ঝিনুক? দারুণ নাম।
আমার আব্বু।
ওহ আচ্ছা।

পাশের বাসার দুজন ভদ্রমহিলা এলো ঝিনুককে দেখতে। জোবেদা বেগম এসে ঝিনুককে নিয়ে গেলেন তাদের সামনে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঝিনুক তাদের সালাম দিলো। তারা ঝিনুকের প্রশংসা করলেও একটা জায়গায় কিছু শোনাতে কার্পণ্য করেননি।

ভাবী যত যাই বলেন,আপনাদের টাকায় যাদের পেটের ভাত যোগাড় হয় এমন একটা মেয়েকে…
থামেন প্লিজ বলে,তাদের কথা না ফুরোতেই জোবেদা বেগম ফুঁসে গেলেন। তারা সুবিধা করতে না পেরে উঠে চলে গেলো।

পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে এমন কিছু নেগেটিভ চিন্তাভাবনার লোক বাস করে। যাদের পেটের ভাত হজম হয়না অন্যের দূর্বলতা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দুচার কথা না শোনাতে পারলে।

ঝিনুক মুখ কালো করে ফেললো এমন অযাচিত কিছু শুনে। জোবেদা বেগম একমাত্র পুত্রবধুর সামনে লজ্জায় পড়ে গেলেন। ঝিনুকের হাত ধরে নিজের বেডরুমে নিয়ে গেলেন।

মন খারাপ করোনা বৌমা। ও হ্যাঁ তোমাকে আমার যখন যেটা ইচ্ছে হয় সেভাবেই ডাকবো।

ঝিনুক কণ্ঠে আদুরেপানা ভাব এনে বলল,কোন সমস্যা নেই মা। আমার জন্য আপনারা মানুষের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছেন।

জোবেদা বেগম ঝিনুককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আরেহ মেয়ে বলে কি। আমরা মানুষের খাই না পরি? পাছে লোকে কিছু বলেতে কান দিতে নেই। বুঝলে।

হুম। মা আমি পড়াশোনা করতে চাই।

অবশ্যই তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। তুমি তোমাদের বাসায় থাকবে সবসময়। সময় সুযোগ বুঝে এ বাসায় আসবে।

তাহলে আপনাদের ড্রাইভার দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেন।

বোকা মেয়ে বলে কি। আরশাদের সাথে যাবে তুমি। এমন সময় আরশাদ এলো তার মায়ের রুমে।

এই আরশাদ শুন। বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে। ওর মা বা পরিবারের অন্যরা তোকে দেখেনি। তুই ঝিনুককে নিয়ে যা। বিকেলে চলে আসিস। ও ওখানেই সবসময় থাকবে।

আরশাদ বড় সন্তান হওয়ায় মা বাবার কথার অবাধ্য তেমন হতে পারেনা। তবুও সুবোধ বালকের মতো বলল,
মা আমিও চাই ঝিনুক মন দিয়ে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাক ওদের বাসায় থেকে। আমি আজ না গেলে হয়না মা। পরে যাবো প্রমিজ। ওকে ড্রাইভার দিয়ে আসুকনা মা।

আরশাদের বাবা জামান খান এগিয়ে এসে বললেন,
এ কেমন কথা আরশাদ। তুই কবে থেকে এমন কান্ডজ্ঞানহীন হলি? পরশ তার মেয়েকে আমাদের ঘরে ঠেলে পাঠায়নি। আমি তার কাছ থেকে তার মেয়েকে উপহার হিসেবে চেয়ে এনেছি। সেই উপহারের অমর্যাদা হোক এটা অন্তত আমি চাইনা। আমাদের মুসলিম সমাজে রেওয়াজ হলো,
বিয়ের পর স্বামীই তার স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যায়। তুই গাড়িতে করে বৌমাকে নিয়ে যাবি। এই আমার আদেশ।

জামান খানের হুকুমের মাঝে বাগড়া দেয়ার দুঃসাধ্য এখানে কারো নেই। ঝিনুক গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। আরশাদ রাগে গজগজ করতে করতে নিজের বেড়রুমে চলে গেলো।

মিনিট দশেক বাদেই আবার মায়ের রুমে এসে ঝিনুককে উদ্দেশ্য করে,
চলো ঝিনুক। আমি নিচে যাচ্ছি।

ঝিনুক তার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে এলো রুমে গিয়ে। জোবেদা বেগম ও জামান খানকে পা ধরে সালাম দিলো। তারা দুজনই ঝিনুকের মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করলেন।

আরিশার থেকেও বিদায় নিলো। আরিশার বেশ মন খারাপ হলো ঝিনুকের জন্য। তারপর সে চারতলা বাড়ির সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গেলো।

আরশাদ গাড়িতে বসে আছে। ঝিনুক গাড়ির দরজা খুলে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
আমি কোথায় বসবো?

আমার কোলে বসো। ফাজিল একটা। অন্ধ নাকি? জায়গা দেখতে পাওনা? ক্ষুব্ধ হয়ে বলল আরশাদ।

জিজ্ঞেস করায় অপরাধ হয়ে গেলো? আপনিইতো রাতে বলে দিয়েছেন যেন আপনার থেকে দূরে দূরে থাকি। তাই জানতে চাইলাম। এই বলে ঝিনুক গাড়িতে ঢুকে আরশাদের পাশে বসলো।

তুমি মাকে বলছ নাহ,যেন আমিই তোমাকে নিয়ে যাই তোমাদের বাসায়?

কাঁদো কাঁদো হয়ে ঝিনুক বলল,
আল্লাহ কি বলেন এসব? আমি বরং বলছি একাই যাবো।

তুমি যে কি চীজ তা একরাতেই আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে। আমার সাথে কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবানা ভুলেও। আমি তোমাকে তোমাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবো। তোমার সম্পূর্ণ খরচপাতি সব বহন করবো। কিন্তু তোমাকে বহন করা আমার পক্ষে জাস্ট ইমপসিবল।

ড্রাইভার কই ঝিনুক বলল?

তোমাদের বাসার জন্য যা যা প্রয়োজন সেসব আনতে পাঠিয়েছি।
ওহ আচ্ছা। অভয় দিলে একটা কথা বলি ভাইয়া?

হুম। বলো।

আপনিই বলছেন কাউকে বুঝতে দেয়া যাবেনা আমাদের মাঝের দূরত্বটা। কিন্তু আপনি যেভাবে চলছেন তাতে আপনিই ধরা খেয়ে যাবেন। আপনার পরিবার কেমন। তা আপনিই ভালো জানেন।

তাহলে কি করলে সাপ ও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবেনা? সে উপায় জানা আছে?

শুনুন, আপনি সুন্দরভাবে ফরমালিটি মেইনটেইন করবেন মিথ্যা অভিনয় করে। যে মেয়েটা আপনার ভয়ে পালিয়েছে। তাকে বিয়ে করলে যেভাবে তার বাবার বাসায় গেলে চলতেন। ঠিক আমাদের বাসায় ও সেভাবেই চলবেন। পারবেন না?

পারবো। কিন্তু সে আমার ভয়ে পালিয়েছে কে বলল তোমাকে? তোমার এত বেশী ঠোঁট কাটা স্বভাব কেন? তোমার ত জনমেও বিয়ে হবেনা এ বদ স্বভাবের জন্য। ঠান্ডা গলায় বলল আরশাদ।

নইলে পালাবে কেন? আমার ঠোঁট কাটা স্বভাব পিচ্চিকাল থেকেই। বিয়ে ত হয়েছে। আর কয়বার হবে?

ড্রাইভার চলে আসলে তারা চুপ হয়ে গেলো। আধঘন্টা পরে ঝিনুকদের বাসায় পৌঁছে গেলো। ড্রাইভারকে বলে দিলো বিকেলে গিয়ে যেন আরশাদকে নিয়ে আসে। ঝিনুকের পরিবার ভীষণ উচ্ছ্বসিত আরশাদের অমায়িক ব্যবহারে। তারাও জামাই আদরের এতটুকু ঘাটতি রাখেনি।

আরশাদ দুপুরে লাঞ্চ সেরে কাজের অজুহাত দেখিয়ে বিকেলে চলে এলো তাদের বাসা থেকে।

ঝিনুকের বাবা ঝিনুককে প্রশ্ন করলো,
বুঝলামনা জামাই আমাদেরকে মা বাবা বলে ডাকলোনা কেন? আগেও পরশ চাচা বলতো। আজও তাই বলল।

সেটা হয়তো কথার টানে চলে এসেছে আব্বু। ঠিক হয়ে যাবে সামনে।

ঝিনুক বলল,আব্বু আমার যে বিয়ে হয়েছে এটা কি বেশী মানুষ শুনে গিয়েছে?

ঝিনুকের মা এগিয়ে এসে হ্যাঁ সবাইকেই আমরা ফোন করে করে জানিয়ে দিয়েছি। বিয়েশাদির বিষয় আনন্দের বিষয়। লুকানোর কিছুই নেই এখানে। কেন ঝিনুক কোন সমস্যা হয়েছে সেই বাসায়?

নাহ আম্মু। উনাদের বাসার সবাই ভীষণ ভালো। আমাকে অনেক আদর করছে। আমার পড়াশোনা ভালোভাবে চালিয়ে নিতে হলে আমাদের বাসায় থাকতে হবে। তাই উনাদের সম্মতিতেই চলে এলাম।

এস এস সি পরিক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে স্কুলে বিদায়ী অনুষ্ঠান আজ। এই স্কুলের যেকোন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আরশাদ ও। ঝিনুকের বিশ্বাস ছিলো আরশাদ অন্তত আজ থাকবেনা। আরশাদ একটু আড়ালে আড়ালেই ছিলো। ঝিনুক যেন না দেখতে পায় সেজন্য।

তাদের ক্লাসের অনেকেই যার যার মত করে আবৃত্তি, গান, নাচ,কবিতা,গল্প বলা, অভিনয় করে মঞ্চ কাঁপিয়ে তুলছে।
ক্লাসের মুনিয়া নৃত্য করলো। সবুজ, এলমা, আবৃত্তি করলো। এশা অভিনয় করলো।
শিক্ষকগণ ও যে যা পারে তাই করলো। এবার ঝিনুকের পালা। সবার দৃষ্টি ঝিনুকের দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে।

আচমকা ঝড়ের মতো ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝিনুকের মনের আকাশে ভারি মেঘের ঘনঘটা। তবুও সবার অনুরোধে ঝিনুক স্টেজে উঠে দাঁড়ালো। মাইক্রোফোন হাতে নিলো।

“কৃষ্ণচূড়া রং মেখেছে ফাগুনের লালে
ফাগুনের এই আগুন ঝরা দিনে।

এমনই এক ফাগুনের দ্বিপ্রহরে
হেঁটেছি খানিকটা পথ তোমায় ভেবে।

ফাগুনের আগুন লেগেছে গায়ে
আমিও একলা ফাগুন হলেম
আগুন ঝরা রোদ্দুরে।

ফাগুন দিনের আগুন হয়ে
তোমার স্মৃতি মন্থনে।

একলা আমি হাঁটছি পথে
উদাসী তোমার বিহনে। ”

মুখরিত করতালিতে পরিবেশ আনন্দময় ও উপভোগ্যময় হয়ে গেলো।
আরশাদ পিছনে বসে বিমুগ্ধ হয়ে নিবিষ্ট চিত্তে দুচোখ বন্ধ করে শুনেছিলো ঝিনুকের আবৃত্তি।

ঝিনুকের সারামুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো আরশাদকে দেখামাত্রই।

চলবে…২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here