#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ৪
#রেহানা_পুতুল
ঝিনুকের ব্যক্তিত্ববোধ আর জেদ আরশাদকে শুধু বিস্মিতই করেনি,ভাবনার অতলে তলিয়ে দিলো।
আরশাদ একিস্থানে কিয়ৎক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিন্তা করছে, ঝিনুকদের বাসায় গিয়ে মোবাইল দিয়ে আসব কিনা। নাহ। একদম না।
কিন্তু বাসার সবাই যখন ওর মোবাইলে ফোন দিতে চাইবে। তখন? ওহ গড! কি একটা আপদ কপালে জুটিয়ে দিলে। এই ত্যাঁদড়কে একদম টলারেট করা যায়না। ধুর। দিবইনা। বাসায় ঝাড়ি খাবো। তবুও এই মেয়ের কাছে মাথা নোয়াবোনা।
যেই ভাবা সেই কাজ। আরশাদ চলে গেলো সেখান থেকে। দুদিন পরে ঝিনুক গ্রামে চলে গেলো অবকাশ যাপনের জন্য। সাথে কোন মোবাইল নেই। ঝিনুক যখন যে আত্মীয়দের কাছে থাকে। তখন তার বাবা,মা, বোন তাদের মোবাইলে ফোন দিয়ে ঝিনুকের সাথে কথা বলে।
নানুদের ,খালাদের, ফুফুদের সবার বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝিনুক। সঙ্গি হিসেবে যখন যাকে পাচ্ছে তাকেই সাথে নিচ্ছে। ভুলেই গেলো তার যে বিয়ে হয়েছে। যে সে অন্যের অধীনে। সমবয়সী কাজিনদের নিয়ে হারিয়ে গেলো হারিয়ে যাওয়া বালিকা বয়সের দুরন্তপনায়।
পৃথিবীর সমস্ত চঞ্চলতা ঝিনুকের সারা চিত্তে ভর করেছে। পাখি ডাকা ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ার পরশ গায়ে বোলাতে বোলাতে হেঁটে যায় বাড়ির সামনের দিকের বহু পথ। দু চোখ বন্ধ করে নেয় মাটির সোঁদা গন্ধ। ছিঁড়ে নেয় পথের পাশে ফোটে থাকা নাম না জানা পুষ্পকলি। আলতো করে চেপে ধরে গালের একপাশে। আনমনে মিষ্টি হাসে।
পুকুরে ছায়াঘেরা শান বাঁধানো ঘাটে যখন গোসল করতে যায় ঝিনুক। তখন পুকুরের পানিতে ঝুঁকে থাকা আমগাছের শাখা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে পুঁটিধরা মাছরাঙ্গা পাখির মতো । অবাধে সাঁতরে চলে যায় পুকুরের এপাড় থেকে ওপাড়ে। সবাই মিলে পানিতে হৈ হুল্লোড় করে। যেন জল উৎসবে মেতেছে ঝিনুকের দল।
মধ্য দুপুরে ঘরের পিছনে মাচার উপরে উড়াউড়ি করতে থাকে নানান রঙের ফড়িং আর প্রজাপতি। ঝিনুক তাদের পিছনে ছুটে ছুটে ঘেমে লাল হয়ে যায়। দু একটাকে ধরেও ফেলে।
ক্লান্ত বিকেলের অবসরে উঠানে খেলতে থাকে তার আগের খেলাগুলোই। ডাংগুলি, রুমাল চুরি, রজ্জুলম্প, লুডু,সাতগুটি,ব্যাডমিন্টন।
প্রতিটি মানুষের ভিতরে একটি চঞ্চল শিশু ঘুমিয়ে বাস করে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই সে জেগে উঠে। উদ্ভাসিত করে তার স্বরূপ। তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনা জগতের কোন দূর্বার শক্তি।
রাতে ঘুমাতে গেলে কাজিনেরা ঝিনুকের কাছে তার রাজকুমারের গল্প শুনতে চায়। ঝিনুক চালাকি করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।
______
প্রায় পনেরো দিন পরে জামান খান আরশাদকে ডাক দিলেন নিজেদের রুমে। আরশাদ এলো বাবার ডাকে। জোবেদা বেগম বিছানার এক পাশে মুখ আঁধার করে বসে আছেন।
আরশাদের বুঝতে বাকি রইলোনা কাহিনী কি। তবুও না বোঝার ভান করলো। মুখে ছল করা হাসির প্রলেপ এঁকে জিজ্ঞেস করলো,
আম্মু কি হয়েছে?
জোবেদা বেগম মুখ গোঁজ করে বসে আছেন। মুখে কোন রা নেই।
জামান খান বললেন,
কি হতে আর বাকি কি? তোর মা যে তোকে বলল বউকে মোবাইল কিনে দিতে। দিয়েছিস?
আরশাদ ভেজা বিড়ালের মতো কাইঁকুইঁ করতে লাগলো। বাবা ইয়ে মানে…
এক শব্দে জবাব দে বলছি। ইয়েস অর নো?
নো।
তাহলে সেটা তুই তোর মাকে জানাসনি কেন? তোর মা জানে তুই কিনে দিয়েছিস। কারণ তুই একটা জিপি নাম্বার ও দিয়েছিস তোর মাকে বউর নাম্বার বলে।
জোবেদা বেগম বললেন , জানি বউ গ্রামে গিয়েছে সেই কবেই। আজ তোর দেয়া নাম্বারে বারবার ফোন দিলাম। কিন্তু যাচ্ছেনা। ভাবলাম কোন সমস্যা হলো কিনা। তার মাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ,
আরশাদ যে বউকে মোবাইল কিনে দিলো সাথে নেয়নি? তার মা আকাশ থেকে পড়লো। জানালো, না আপা কোন মোবাইল দেয়নিতো। দিলে আমার মেয়ে অবশ্যই আমাকে দেখাতো।
শুনে আমার মাথা কাটা পড়লো। কি অপমানিত হলাম চিন্তা কর তুই। পরে নয়ছয় বুঝিয়ে বিদায় নিলাম তার মায়ের থেকে।
তুমি থামো জোবেদা। এই বলে পুত্রের দিকে চাইলেন। আরশাদ এক ঝলক নেত্র পল্লব উল্টিয়ে পিতাকে দেখলো। পিতার চাহনিতে এক পাহাড় কাঠিন্যতা ভর করেছে।
অনর্গল বলে যাচ্ছেন, মোবাইল দেসনি কেন কিনে? যখন বিয়ের সেন্টারে ঠিক করা বউ উপস্থিত হলোনা। এবং এই মেয়েকে ঠিক করে তোকে জানালাম। একটা ভালো মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। বিয়ে করবি? তখন বলিসনি বাবা তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো ?
আমি এটা অস্বীকার করছিনা বাবা।
তাহলে তোর সমাস্যাটা কোথায়? ঝিনুক আমাদের স্টাফের মেয়ে বলে? মধ্যবিত্ত ঘরের বলে? অতি মর্ডান নয় বলে? কোনটা বল? মেয়েটার সাথে দুদিন না কাটাতেই তোর এত অরূচি ধরে গেলো তার প্রতি?
আরশাদের মেজাজ এবার চড়ায় উঠলো। সাধ্যমতো মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করলো। দৃঢ় স্বরে নিরস ভঙ্গিতে বললো,
বাবা তোমরা যা ভাবছো তা একদম সত্যি নয়। আমাদের সবার পছন্দ করা মেয়েকে ঘরে তোলা গেলোনা। আমার মনের অবস্থাটাও তোমাদের রিয়েলাইজ করা দরকার। এক মিনিট। বলে আরশাদ লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের রুম গিয়ে একটি বাক্স নিয়ে এলো। ছুঁড়ে মারলো বিছানার উপরে। এই দেখো মোবাইল। আম্মু যেদিন বলছে তার পরেরদিন এই নিউ মোবাইল সেট কিনে তার জন্য নিয়ে যাই।
কিন্তু সে মোবাইল নেয়নি। আমাকে ইনসাল্ট করেছে। পাশের দোকানের ভিতর থেকে কিছু মানুষ তাকিয়েছিলো তখন। বেঁচে গেলাম শুধু সেটা আমার জন্য অপরিচিত এলাকা বলে।
জোবেদা বেগম ও জামান খান একে অপরের মুখের পানে চাইলেন।
কন্ঠকে খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জোবেদা বেগম, কি বলিস তুই! মোবাইল না নিয়ে প্রত্যাখান করলো। এটাতো নেয়া যাচ্ছেনা কিছুতেই। তুই শুরু থেকে বলতো?
মোবাইলের প্যাকেট আর ফ্রুটসের ব্যাগ তার হাতে দিলাম। সে বলল,কি দরকার ছিলো টাকা খরচ করে আমার জন্য মোবাইল কেনার।
আমি রিপ্লায় দিলাম, আমার জন্য দরকার নেই। আম্মু বলছে তাই কিনেছি। জাস্ট এইই বাক্য শুনেই সে রেগে গেলো। মোবাইল আমার হাতে দিয়ে বলল তার ও দরকার নেই আমার টাকার দেয়া মোবাইলের। তারপর চলেই গেলো।
শুনলে কথা জোবেদা? সদ্য বিয়ে হওয়া একটা স্ত্রীকে এমন কথা বললে মোবাইল ফেরৎ দেওয়াটাই বাঞ্চনীয়। শুধু আমাদের আত্মসম্মান আছে। তাদের নেই? সেতো বুঝে নিয়েছে তুই তাকে অপছন্দ করিস। তাই নিতে বিবেকে বাঁধলো। ভারী গলায় বললেন জামান খান।
জোবেদা বেগম বলল, তাদের বাসায় গিয়ে দিয়ে আসতি?
ওরেব্বাপস! তুমি গিয়ে দিয়ে আসো। কি দেমাক তার। আবার আমি যাবো তেলাতে।
এছাড়াও এই মেয়ের সমস্যা হলো মুখে কিছুই আটকায়না। চটাং চটাং কথা বলে। খুবি অভদ্র। আমাকে বিয়ের রাতেই বলে গুন্ডা। সকালে বলে বানর। পারলে আমি তার দুঁঠোট সেলাই করে দিতাম নয়তো সুপারগ্লু লাগিয়ে দিতাম।
এটাকে তুই এভাবে দেখছিস কেন? ধরেনে ঝিনুক স্পষ্টবাদী মেয়ে। যখন যা মনে হয় তাই বলে দেই রাখঢাক না করেই।
গালে হাত দিয়ে বসে আছে জামান খান। সারামুখে উৎকন্ঠার ছাপ।
জোবেদা বেগম বলছে, এই মেয়েটা যে গ্রামে গেলো।
তার আত্মীয়স্বজন আমাদের সম্বন্ধে ধারণা করবে,
নামেই বড়লোক। আসলে পুরাই ছোটলোক। বউকে একটা মোবাইল কিনে দেওয়ার ঔচিত্যবোধে নেই।
তুই কালকের ভিতরেই তাদের গ্রামের এড্রেস নিয়ে মোবাইল সুন্দরবন কুরিয়ারে বা কন্টিনেন্টালে পাঠিয়ে দিবি। আর শোন বাবা, ও গ্রাম থেকে এলে বাসায় নিয়ে আসিস। পাশাপাশি থাকা হলে দেখবি সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে মন বসে যাবে তার উপর। মানুষ একটা কুকুরকে পাললেও মায়া লেগে যায়। আর ওতো একজন মানুষ।
আচ্ছা দেখি কি করা যায়। বলে আরশাদ পা ঘুরিয়ে রুম থেকে চলে যাচ্ছে। অমনি জামান খান শোন বলে আদেশ দিলো, সামনের দিকে আর যেন কোন কিছু না শুনি উল্টাপাল্টা।
জোর করে মন বসানো যায় বাবা?
যায়না। তবে ভিতর থেকে চেষ্টা ও করতে হবে মন বসানোর জন্য। ও কোন মাটির হাঁড়ি নয় যে ভেঙ্গে ফেলবি। কাগজ নয় যে ছিঁড়ে ফেলবি। বেলুন নয় যে উড়িয়ে দিবি। জলজ্যান্ত মানুষ। সুতরাং তাকে নিয়ে পজেটিভলি ভাব রুমে গিয়ে নিরালায়। দেখবি ভালো লাগছে।
তাকে নিয়ে ভাবার মতো আমার ঝুলিতে কিছুই নেই। অত বেহুদা সময় ও নেই আমার, বলেই আরশাদ দফদফ পায়ে চলে গেলো নিজের রুমে।
আরশাদ পরেরদিনই ঝিনুকের বাবার থেকে গ্রামের কুরিয়ার এড্রেস নিলো। এবং মোবাইল সেটটি পাঠিয়ে দিলো।
বাসায় সবাইকে জানিয়ে দিলো এটা। জোবেদা বেগম পুত্রবধুর সাথে কথা বলে অভিমান ভেঙ্গে দিয়েছেন। মায়ের মতো শাশুড়ীর মনে আঘাত দেয়াটা সমীচীন হবেনা। চাইলে মোবাইলটা গ্রাম থেকে ফেরৎ দেয়াও যাচ্ছেনা। নয়তো এই মোবাইল মরে গেলেও ইউজ করতোনা এই ঝিনুক। নিজেকে কোনমতে প্রবোধ দিলো ঝিনুক।
এদিকে রাতে আরশাদ একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্ল্যান করছে ঝিনুককে নিয়ে ,
তোর জন্য বারবার কথা শুনতে হচ্ছে। তুই ঢাকায় আস। তোকে বাসায় নিয়ে আসবো আম্মুর ইচ্ছেনুযায়ী। আর এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করবো। যেন তুই নিজে থেকেই বিদায় নিতে বাধ্য হোস। তোকে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো ক্ষেপিয়ে তুলবো আমার বিরুদ্ধে। তখন আমাকে ঘৃণা করেই তুই পালাবি। এছাড়া নো ওয়ে।
এদিকে জামান খান স্ত্রীকে বলছে, আরশাদের মনে যেন বউর জন্য ভালোবাসা জন্মে। বউকে দিয়ে তেমন কাজকর্ম করানোর চেষ্টা করো।
জোবেদা বেগম জবাব দিলো ,
আমিও তাই ভাবতেছি কিভাবে কি করা যায়। দেখি আগে বউ আসুক। তারপরে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া এ দুটোকে এক করা মহামুশকিল হয়ে যাবে।
আরিশা চিন্তা করছে, ভাবিকে কিছু হট টিপস দিবো বাসায় আসার পরে। সেগুলো এপ্লাই করবে ভাইয়ার উপরে। আর তখনি শুরু হবে দুজনার রোমান্টিসিজম। উফফস! লাভ ইউ ঝিনুক।
চলবে… ৪