#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মায়রা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই, মেহেভীন এবং আরহাম মায়রার কাছে আসে। আরিয়ান মায়রার পার্লস চেক করে দ্রুত মায়রাকে ভর্তি করায়। এইসময়ে অতি শোকে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো মায়রা। অভ্রের মা মুখ চেপে কেঁদে উঠে। আজ তার ছেলের এবং তার ছেলের বউয়ের এমন করুন পরিনতি তারই জন্যে। নিজের জন্যে এক রাশ ঘৃণা
সৃষ্টি হচ্ছে তার মনে। কতটা অন্ধ হয়ে পড়েছিলো।
গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার। মেহেভীনের মা তার মেয়ের কাছে কিছুটা এগোতে নিলে,তাতে বাঁধ সাধে মেহেভীন। রোষপূর্ন দৃষ্টিতে ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
‘ একদম এগোবেন না আপনি আমার দিকে। লজ্জা হয়না আপনার? আজ আপনার পাপের ফল আমি পেয়েছি। আজও পেয়েই যাচ্ছি৷এতোটা স্বার্থপর আপনি যে নিজের বোনের কথা ভাবেন নি। এমনকি নিজের সন্তানের কথাও ভাবেন নি। কোন মুখ নিয়ে আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন? আপনার লজ্জা লাগেনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ছিহ!
আমার ভাবতেও ঘৃণা হয় আমি এতোদিন আপনার মতো খারাপ মানুষের জন্যে কাতরিয়েছি। আপনার মতো মানুষের জন্যে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি। ‘
নয়না বেগমের চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠে। নিজের করা কৃতকর্মের জন্যে আজ মেয়েটার চোখেও সে
ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছেন। মেহেভীন অন্যদিকে ঘুড়ে
শক্ত গলায় বলে,
‘ আপনি বেড়িয়ে যান আমার চোখের সামনে থেকে। আপনার মতো নিকৃষ্ট মহিলার মুখ আমি কখনোই দেখতে চাইনা। ‘
নয়না কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যান। মেহেভীন এইবার ছলছল চোখে ইশরা বেগমের দিকে আকুলতার কন্ঠে বলে,
‘ খালা দোষ তো মা করেছিলো। তাহলে সেই শাস্তি আমাকে কেন দিয়েছিলে তুমি? আজ তোমারই জন্যে আমার সন্তানও আজ পৃথিবীতে নেই। অভ্রের
জীবন মরণ অবস্হা। এতো কিছু করে তুমি ঠিক কি পেলে? ‘
ইশরা বেগম নত হয়ে ভেজা গলায় বললেন,
‘ হ্যা আমারই দোষ। আমার নিজের প্রতিশোধের নেশা আজ সবার জীবন ধবংশ করতে চললো। নিজের কাছে নিজেকে শুধু ঘৃণিত মনে হচ্ছে। উপরে তো এক আল্লাহ আছেন তিনি সবই দেখছেন। তাই তিনি আমাকে ঠিক শাস্তি দিয়েছেন। তাই আজ আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। ‘
ইশরা বেগমের কথাটি শুনে মেহেভীন থমকে দাঁড়ায়।
ইশরা বেগম পুনরায় চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে বললেন,
‘ এখন আমার একটাই চাওয়া। আমার ছেলেটা আমার আয়ু পাক। আমি তো আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি৷ ‘
ইশরা বেগম কি যেন বিড়বিড় করতে করতে বেড়িয়ে গেলেন।
মেহেভীনের হৃদয়ের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। আস্তে করে বললো,
‘ আল্লাহর খেলা সত্যিই অদ্ভুদ। আল্লাহ কাউকে ছাড় দেননা। তার কাছে সবার হিসাব থাকে। ‘
____
মেহেভীন অনেক্ষন জুড়ে পাইচারি করছে অভ্রের জন্যে চিন্তা হচ্ছে তার। যা আরহাম অনেক্ষন যাবত লক্ষ্য করছে। কিছুক্ষন পরে ডক্টর বেড়িয়ে এসে বলে,
‘ এখন আপনার নিশ্চিন্ত থাকতে পারুন। অভ্র আহমেদ এখন ঠিক আছে। উনাকে আপাতত ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আশা করি কাল সকালের মধ্যে উনার জ্ঞান ফিরবে। ‘
ডক্টরের কথা শুনে সবাই যেন নিশ্চিন্ত হয়। মায়রাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মায়রার জ্ঞান ও সকালের আগে ফিরবে না।
রাতটা মেহেভীন, আরহাম এবং আরিয়ান হসপিটালেই কাটিয়ে দেয়।
আকাশে আজ মেঘ জমেছে। অধরের কোণে বৃষ্টির ফোটা অনুভব করতেই চোখমুখ খিচে ফেলে মেহেভীন। শীত শীত অনুভব হচ্ছে। অনুভব হওয়ারই কথা ডিসেম্বর মাস এখন। তার মধ্যে হাল্কা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সব মিলিয়ে কিছুটা শুষ্ক কিছুটা ঠান্ডা পরিবেশ।
এমন পরিবেশে চা হলে ব্যাপারটা বেশ জমে যেতো।
মেহেভীনের মনের ইচ্ছেটাই পূরণ হলো আরহাম এগিয়ে এসে ধোঁয়া উঠা চা মেহেভীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে ক্লান্ত সুরে বলে,
‘ মেহেভীন গরম গরম চা টা খেয়ে নাও। ভালো লাগবে। ‘
বলেই চেয়ার মাথা ঠেকিয়ে বসলো আরহাম। আরহামকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সারা রাত জেগে ছিলো।
আরহামের ফর্সা মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
দাঁড়িগুলো ও হাল্কা বড় হয়ে গিয়েছে। তবে আরহামের ফর্সা চাপা মুখে দাঁড়িগুলো যেন তাকে আগের থেকে সুদর্শন যুবকে পরিনত করে ফেলেছে।
আরহামকে কিছুক্ষন খুঁটিয়ে দেখে মেহেভীন চায়ের চুমুক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা মৃদ্যু আর্তনাদ করে উঠলো। চা টা একটু বেশিই গরম। আরহাম চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো। চোখ খুলে সর্বপ্রথম মেহেভীনের হাত থেকে চা টা নিয়ে হাল্কা ফু দিতে দিতে বললো,
‘ সাবধানে! আরেকটু হলেই মুখ পুড়ে যেতো। সাবধানতার সাথে চা টাও খেতে পারো না। স্টুপিড।’
‘ আপনি থাকতে আমি সাবধানে কাজ করতে যাবো কোন দুঃখে? আপনি আছেন তো আমার খেয়াল রাখতে। ‘
হাল্কা মৃদ্যু হেসে মেহেভীন কথাটি বলে। আরহাম ভ্রু কুচকেই হেসে ফেলে বলে,
‘ তবুও নিজের একটু খেয়াল রাখুন প্রেয়সী। আপনার করা প্রতিনিয়ত স্টুপিড কাজে আমার কাছে বকা খেতে কি আপনার ভালো লাগে?
আমার কিন্তু আমার প্রেয়সীকে বকতে আমার ভালো লাগে না। ‘
‘ আমার কিন্তু ভালো লাগে। বিশেষ করে আপনার স্টুপিড ডাক টা।’
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মেহেভীন। আরহামের বুকে ভালো লাগার ঢেউ মুহুর্তই সৃষ্টি করতে যথেষ্ট
তার প্রেয়সী খিলখিলানো হাঁসির শব্দ। আরহাম গালে হাত দিয়ে শান্ত কন্ঠে মাত্রাধিক মুগ্ধতা নিয়ে বললো,
‘ প্রেয়সী তুমি হাঁসলে আমার বুকে মৃদ্যু ব্যাথা অনুভব হয়। সেই ব্যাথাতেও রয়েছে অজস্র ভালোলাগার অনুভুতি। এই অনুভুতির কি নাম দেওয়া যায় বলো তো? ‘
মেহেভীন হাসি বন্ধ করে দিয়ে লজ্জায় উঠে পড়ে। আরহাম পুনরায় চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে বসে।
বুকের ভিতরটা হঠাৎই খাঁ খাঁ করে উঠছে। বুকে কিছুটা ব্যাথাও অনুভব হচ্ছে। এই ব্যাথা নিতান্তই নিজের ভালোবাসার মানুষটির চোখে অন্য কারোর জন্যে এক চাপা আর্তনাদ। আরহাম স্পষ্ট খেয়াল করছে মেহেভীন বার বার কেবিনের কাঁচের জানালায় উঁকি দিচ্ছে। কাঁচের স্বচ্ছ জানালায় অভ্রের মুখটা দেখা যাচ্ছে। মেহেভীনের চোখ-মুখে অভ্রের জন্যে অস্হিরতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কেন যেন আরহাম না চাইতেও মেহেভীনের এই অস্হিরতাটা ভালো লাগছে না। ডক্টর কিছুক্ষন পর বেডিয়ে এসে মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ মিঃ অভ্র আহমেদ এর জ্ঞান ফিরেছে। মিসেস মেহেভীন হাসান তালুকদার অভ্র আহমেদ আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। ‘
ডক্টরের সম্পুর্ন কথা শেষ করতে দিলো না মেহেভীন। দ্রুত পায়ে হেটে অভ্রের কেবিনে চলে গেলো। একটিবার ও আরহামের দিকে তাকালো না। আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের পাশে কারো উপস্হিতি দেখতে পেয়ে, আরহাম তাকিয়ে দেখে আরিয়ান। আরিয়ান ভ্রু কুচকে বলে,
‘ তুই কী কোন বিষয় নিয়ে আপসেট ভাই? ‘
‘ জীবনটা খুব অদ্ভুদ তাইনা আরিয়ান? কেউ না চাইতেও ভালোবাসা পেয়ে যায় আর কেউ শত অপেক্ষা করেও ভালোবাসা পায়না। ‘
‘ তুই ঠিক কি বুঝাতে চাইছিস ভাই? ‘
আরহাম কিছুক্ষন নিরব থেকে অতি ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ মেহেভীন এখনো অভ্রকে ভালোবাসে এতোকিছুর পরেও। মেহেভীনের এই ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধাও করি। প্রথম ভালোবাসা কী আর ভুলা যায় বল?’
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
আরহামের কথায় চমকে গিয়ে আরিয়ান অবাক হয়ে বললো,
‘ তুই এইসব কি বলছিস ভাই? মেহু এখন অভ্র ভাইকে ভালোবাসে না। মেহু তো তোকে ভালোবাসে…’
আরিয়ানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আরহাম নিজেই বলে,
‘ আমি জানি মেহেভীন আমাকে ভালোবাসে না। আর আমি তো মেহেভীনের ভালোবাসা চাইনি। শুধু নিজের পাশে চেয়েছি। শুধু ওর হাত টা সারাজীবন ধরতে চেয়েছি। ওকে আগলে রাখতে চেয়েছি। আমি জানি মেহেভীন এখন ও ভালোবাসে অভ্রকে। এই ভালোবাসাকে আমি সর্বদা শ্রদ্ধা করবো, কিন্তু যতই হোক মেহেভীন তো আমার ভালোবাসার মানুষ আমার স্ত্রী। একটা কষ্ট থেকেই যায় বুকের গভীর থেকে। আমি আমার ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা পাইনি। ‘
আরিয়ান কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। আরহামের
বেঞ্চিতে আগের ন্যায় বসে থাকে। সে জানে অভ্র অসুস্হ তাও তার কষ্ট হচ্ছে।
‘ ভাই তুই কিন্তু ভুল বুঝছিস। ‘
আরহাম আগের ন্যায় উত্তর দিয়ে বললো,
‘ মেহেভীনের চোখে আমি অভ্রের জন্যে আলাদা এক টান অনুভব করেছি। আমি ভুল হতে পারি না।’
আরিয়ান বুঝতে পারলো আরহামকে শত বুঝিয়ে লাভ নেই। আরহামকে শুধু একজনই বুঝাতে পারবে।
___________
মেহেভীন অভ্রের কেবিনে ঢুকে দেখে অভ্র আরেকপাশ ঘুড়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটো ফোলা।
মুখশ্রীটা নিষ্প্রান শুকিয়ে আছে। মেহেভীন একটা চেয়ার নিয়ে, অভ্রের বেডের পাশে বসলো। আলতো সুরে ডেকে বললো,
‘ অভ্র। ‘
অভ্র ঘুড়লো। সামান্য হাঁসলো। এই হাসিতে আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই। আছে শুধু বিরহ। এই বিরহের শেষ আদোও কোথাও আছে।?
‘ এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। হয়তো এখনো আমার আয়ু আছে। না চাইতেও বেঁচে গেলাম।’
অভ্রের কথার প্রেক্ষিতে মেহেভীন উৎকন্ঠা হয়ে বললো,
‘ অভ্র আত্মহত্যা কোন কিছুর সমাধান নয়। আমি সবকিছুই শুনেছি। তুমি না চাইতেও আমার সাথে অন্যায় করেছো কিন্তু তাই বলে এইভাবে আত্মহত্যার
পথ বেঁচে নিবে? তুমি অনুশোচনা করছো নিজের কৃতকর্মের জন্যে এইটাই যথেষ্ট। হ্যা আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমিও তোমাকে একসময় ভালোবাসাতাম। ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
মেহেভীনের কথার মাঝেই অভ্র শুকনো গলায় বললো,
‘ এখন ভালোবাসো না?’
মেহেভীন তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
‘ এই প্রশ্ন করাটা বোকামি নয়? ‘
অভ্র চুপ হয়ে যায়। মেহেভীন উঠে দাঁড়িয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের দিকে ইশারা করে বললো,
‘ সূর্যটাকে দেখতে পারছো অভ্র? রাতের কালো অন্ধকারকে ঢেকে দিয়ে সূর্য তার আলো দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করে তুলেছে। না চাইতেও সূর্যের প্রতি বড্ড টান অনুভব হয়ে যায় আমাদের।
আরহাম সাহেব ও আমার কাছে ঠিক সূর্যের মতো।
যে তার আলো দিয়ে আমার অন্ধকার জীবনটাকে আলোকিত করে তুলেছে। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি অনেক ভাগ্যবান। উনি নিজের ভালোবাসা দিয়ে আমার মনের গহীনে জায়গা করে নিয়েছেন। যেথায় নেই অন্য কারো বসবাস।’
অভ্রের ভিতর থেকে সুদীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। মেহেভীন অভ্রের হাত খানা শক্ত করে ধরে বলে,
‘ মায়রা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। জীবনটা অনেক মূল্যবান অভ্র। এই মূল্যবান জীবনে তার সাথেই গোটা জীবন পাড় করো যে তোমাকে নিজের থেকেও ভালোবাসে। দেখবে জীবনটা কতটা সুন্দর।
একসময় আমারোও বাঁচতে ইচ্ছে করতো না কিন্তু আজ করে। শুধুমাত্র আরহাম সাহেব এর জন্যে।’
অভ্র মেহেভীনের হাতেই মাথা রেখে চোখের পানি বিসর্জন দিতে থাকে। এই দৃশ্য এড়ায়না আরহামের চোখে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে পিছনে ঘুড়ে দাঁড়ায়।
মেহেভীন অভ্রের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ জীবনটাকে গুছিয়ে নাও অভ্র। কিছু কিছু সম্পর্ক অপূর্ন থাকাই ভালো। ভালো থেকো। ‘
মেহেভীন আর পিছে ঘুড়ে তাকায়নি দরজা দিয়ে বেড়িয়ে আসে। কিছু কথা অভ্রকে বলা উচিৎ ছিলো।যা সে বলে কিছুটা শান্তি পাচ্ছে। মেহেভীন দরজা পেড়িয়ে ফেলে আসে তার সমস্ত অতীত। হয়তো পিছনে ঘুড়লে সে দেখতে পেতো এক জোড়া
চোখ কতটা মায়া নিয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।
মেহেভীন বেড়িয়ে এসে শুনতে পায় আরহাম নাকি অফিসে চলে গিয়েছে। মেহেভীনের কেমন একটা খটকা লাগে আরহাম তো তাকে কখনো না বলে অফিসে যাইনি তাহলে আজ কি হলো?
‘ তোর বর পাগল হয়ে গেছে। আজেবাজে চিন্তা পুষে রেখে তোর উপর অভিমান করে অফিসে চলে গিয়েছে।’
আরিয়ানের কথায় বেশ খানিকটাই অবাক হলো মেহেভীন। অতঃপর আরিয়ান সবকিছু খুলে বললো। সবকিছু মেহেভীন আলতো হেসে আনমনে বলে উঠলো,
‘ আমার আরহাম সাহেবের অভিমান হয়েছে। সেই অভিমান এবং তার ভুল ধারণাকে ভেঙ্গে দিতে হবে এইবার। মেহেভীন এইবার উনাকে মেহেভীনের ভালোবাসার গভীরতা বুঝিয়ে দিবে। ‘
_________________
আরিয়ান হসপিটালের সব কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আসতেই তার ফোন বেজে উঠে। আরিয়ান তাকিয়ে দেখে ফারিয়া। ফোনটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ফারিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ ডাক্তার সাহেব বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ‘#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব-৫৮
#Jannnatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
হাতে কোন পুরুষের ঠান্ডা পুরুষের স্পর্শে মেহেভীনের শিড়দাড়ায় নতুন অনুভুতির স্রোত বয়ে যায়। মেহেভীন পিছনে ঘুড়ে তাকায় না। সে জানে আরহাম এসেছে। আরহাম শুকনো মুখে মেহেভীনের
হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহেভীন কিছুক্ষন আগে রান্না করতে গিয়ে, গরম চামচে হাত দিয়ে দিয়েছিলো। তখন সেখানে আরহাম অফিস থেকে কেবল আসছিলো। মেহেভীনের চাপা আর্তনাদ শুনতে পেয়ে, দ্রুত মেহেভীনকে কিছু না বলে উপর থেকে ওষুধের বক্স নিয়ে আসে। অতঃপর মেহেভীনের হাতে ওষুধ লাগিয়ে দেয় যেন ফোসকা না পড়ে যায়। মেহেভীন শুধু ড্যাবড্যাভ করে আরহামের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এইবার আরহাম মেহেভীনকে ‘ স্টুপিড ‘ নামক উপাধী দিয়ে বকাঝকা না করলেও, মুখে বেশ গম্ভীর্য রুপ ধারণ করে রেখেছে। মেহেভীন আরেকটু ভালো করে পর্যবেক্ষন করে দেখলো গাম্ভীর্যপূর্ন চেহারায় তার বরের ফর্সা মুখটি কিছুটা লাল আকার ধারণ করে। বেশ ভালো লাগে দেখতে। মেহেভীন আরহামকে পর্যবেক্ষন করলেও, আরহাম একবারও মেহেভীনের দিকে তাকায়নি। ওষুধ লাগানো হয়ে গেলে, কাধের ব্যাগটা নিয়ে সোজা উপরে সিড়ি বেয়ে উঠে চলে যায়। মেহেভীন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলে,
‘ বাহ আমার আরহাম সাহেবের এতো অভিমান? মেহুরে এই অভিমান ভাঙ্গতে তোকে অনেক কাঠখোড় পুড়াতে হবে। ‘
মেহেভীন নিজের হাতেই চুমু দেয়। এই হাতে তার বর তাকে কতটা যত্নের সাথে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে।
মেহেভীন আবারো মুচকি হেসে নাঁচতে নাঁচতে রান্নাঘরে চলে যায়। নতুন প্রেমে পড়লে বোধহয় সবার মনেই আলাদা ভালো লাগা জন্ম নেয়। সবকিছুই তখন ভালো লাগে নতুনভাবে।
_____________
এদিকে,
ফারিয়া কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে নিজের বিয়ের কথা শুনে। সর্বপ্রথম সে আরিয়ানকেই ফোন করে জানায় কথাটি,কিন্তু ফোনের অপাশ থেকে আরিয়ানের কোনপ্রকার পতিক্রিয়া না পেয়ে ফারিয়ার অভিমান হয়। অভিমানে বুকটায় ধক করে উঠে। তা কি আরিয়ান বুঝতে পারছে? ফারিয়া অভিমানসিক্ত গলায় বলে,
‘ ডাক্তার সাহেব আপনি শুনছেন তো? ‘
অপাশ থেকে আরিয়ান খাপছাড়া হয়ে বলে,
‘ হ্যা হ্যা শুনছি তো। কি যেন বলছিলে? ‘
আরিয়ানের এমন খাপছাড়া কথায় ফারিয়ার ভিতরে থাকা অভিমানগুলো ফারিয়ার আখিতে এসে ধরা দেয়। অশ্রু হয়ে গাল বেয়ে পড়তে থাকে। আচ্ছা আরিয়ান কি কিছু বুঝে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করছে?
ফারিয়া কিছুটা তেজি গলায় বলে,
‘ আপনি কি শুনতে পারছেন ডাক্তার সাহেব আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ‘
‘ হুম শুনলাম তো। এখন লক্ষী মেয়ের মতো বিয়ে করে নাও। ‘
আরিয়ান খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাটি বললো।
ফারিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বললো
‘ আপনার কি এতে কিছু যায় আসবে না তাইনা?
হওয়াটাই স্বাভাবিক আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে না। কি নাম যেন শাকচুন্নি নাকি পেত্নি কি একটা যেনো। সেই যাই হোক। আপনি থাকুন আপনার পেত্নি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। আমিও বিয়ে করে ফেলবো এখন। কখনো আপনাকে ফোন দিয়ে ডির্স্টার্ব করবো না। ‘
কথাটি বলেই ফারিয়া ফোনটা রেখে দেয়। আরিয়ানের বুকটা অদ্ভুদ্ভাবে কেঁপে উঠে ফারিয়ার কান্নার আওয়াজে। ফারিয়ার কান্না সে কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা, কিন্তু আজ পরিস্হিতির স্বীকার সে
সহ্য না করেও উপায় নেই।
ফারিয়া ফোনটা রেখে কাঁদতে থাকে। ফারিয়ার মা মেয়েকে কাঁদতে দেখে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,
‘ এইভাবে কাঁদছিস কেন তুই? ‘
‘ মা আমি কী এতোটাই পর হয়ে গিয়েছি যে তুমি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো। ‘
মেয়ের কথা শুনে ফারিয়ার মা হেসে ফেললেন। ফারিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের সহিত বললেন,
‘ এইসব কি কথা মা? অনেক ভালো সমন্ধ এসেছি। কি করে মানা করি বল? দেখবি ছেলেটা তোকে
অনেক রাখবে। আচ্ছা তোর কী কোন পছন্দ আছে ব্যক্তিগত? ‘
ব্যক্তিগত পছন্দের কথা শুনে ফারিয়ার মুখটা চুপশে যায়। ভেসে উঠে আরিয়ান চেহারা,কিন্তু আরিয়ান তো তাকে ভালোবাসে না। ফারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘ যা ইচ্ছে করো। আমার তাতে আপত্তি নেই।’
ফারিয়া কথাটি বলেই উঠে চলে গেলো।
____________
চোখ পিটপিট খুলে মায়রা তাকিয়ে দেখে সে অভ্রের রুমে। সে চট করে উঠে বসে। সে ঠিকই দেখছে
সে এখন অভ্রের রুমে রয়েছে। কিন্তু কীভাবে? সে যতটুকু জানে সে তো হসপিটালের বেডে তাহলে অভ্রের রুমে কী করে এলো? মায়রার ভাবনার মাঝেই অভ্র ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকলো। মায়রা দেখে ফোনটা কেটে মিষ্টি হাঁসি উপহার দিলো। মায়রা ভরকে গেলো। অভ্রের আবার কি হলো?কিন্তু মায়রা এই ভেবে মনে মনে খুশি হলো যে অভ্র ঠিক আছে। অভ্র কিছুটা রশিকতার ছলেই বলে,
‘ হসপিটালে তো তুমি আমাকে দেখতে গিয়েছিলে,কিন্তু নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেলে। আমিই তারপর তোমাকে ডিস্টার্চ করে নিয়ে আসলাম। ‘
‘ আসলে আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ‘
মাথা নিচু করে জবাব দিলো মায়রা। অভ্র কিছুক্ষন হাঁসলো। যাকে বলে প্রাপ্তির হাঁসি।
‘ অনেক ভালোবাসো আমাকে তুমি তাইনা? ‘
মায়রা অভ্রের প্রশ্নের জবাব দিলো। বিছানা উঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা স্লান গলায় বললো,
‘ অভ্র তুমি কী ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছো?
তাহলে আমাকে দিয়ে দাও। আমি কালকে কোর্টে
সাবমিট করে দিবো। তাছাড়া কালকে আমার ক্যানাডার ফ্লাইট। তোমাকে আমি সারাজীবনের জন্যে মুক্তি দিয়ে চলে যাবো অভ্র। ‘
মায়রার কথাট শুনে অভ্র ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা ছিড়ে ফেলে দেয়। মায়রা অবাক পানে অভ্রের দিকে তাকাতেই,অভ্র মায়রার হাত দুটো ধরে করুন কন্ঠে বলে,
‘ অনেক ভুল করেছি আমি মায়রা। তার শাস্তিও পেয়েছি। হ্যা এইটা ঠিক আমি মেহুকে ভালোবাসি, কিন্তু মেহু তো আমাকে ভালোবাসো না। মেহু যাকে ভালোবাসে তার সাথেই সুখে থাকুক এইটাই কামনা।
আর আমাকে যে ভালোবাসে আমি চাই তাকে মন প্রান উজাড় করে ভালোবাসতে। প্লিয থেকে যাও মায়রা। কোনদিন অভিযোগ করতে দিবো না তোমাকে। ‘
মায়রা হু হু করে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো।
অভ্র প্রশান্তি হাঁসি দিয়ে বললো,
‘ আমি বাকিটা জীবন তোমাকে এবং আমাদের অনাগত সন্তানকে সুখে কাটাতে চাই। দিবে আমাকে সেই সুযোগ? ‘
মায়রা উত্তর দিলো না। অভ্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চললো। মায়রার কান্নাটাকেই সম্মতি হিসেবে ধরে নিলো অভ্র।
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
_______
আজ কিছুটা রাত হয়ে গিয়েছে আরহামের। অফিসে কিছু জরুরী মিটিং ছিলো। ড্রইং রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় ড্রইং রুম কেমন অন্ধকার। সামান্য আলো বিদ্যমান। রাহেলা সবকিছু গুছিয়ে বের হচ্ছিলো তখনি রাহেলার দিকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করে আরহাম বললো,
‘ বাড়িটা এতো নিষ্চুপ লাগছে কেন? সবাই কোথায় রাহেলা? ‘
‘ ভাইজান বড় সাহেব আর বড় ম্যামসাহেব তো আইজকা গেরামার বাড়ি গেছে। কি যেন একটা কামে। কালকে ফিরবো। আর আরিয়ান ভাইজান তো হাসপাতালের কামে আইজকা হাসপাতালেই থাকবো। বড় ভাবি উপর আছি। আমি এখন যাই কেমন? দেরী হইয়া যাইতাছে বাসায় যাইতে হবে।’
রাগেলা কথাটি বলেই তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলো। আরহাম ও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উপরের দিকে এগিয়ে গেলো। উপরের দিকে একদম অন্ধকার হয়ে রয়েছে। এই অন্ধকারের উৎস কোথায়? আরহাম আরেকটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো সমস্ত ঘরেই অন্ধকার। ছাদে আলোর উৎস পেতেই আরহাম সেদিকে এগিয়ে গেলো। ছাদেই এসে সে এক মুহুর্তের জন্যে চোখ আটকে গেলো ছাদে থাকা গোলাপী তাতের শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। সে ভিবানে বসে গোলাপের পাপড়িতে পা ভিজিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তার মায়াবী মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এক আলাদা উজ্জ্বলতা উঁকি দিচ্ছে সেই মুখশ্রীতে।সে আর কেউ নয় আরহামের একমাত্র স্ত্রী তার প্রেয়সী। মেহেভীন আরহামের উপস্হিতি টের পেয়ে মেহেভীন পিছনে ঘুড়ে দেখে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে।
একদম ফরমাল ড্রেসাপে। চুলগুলো কপালে কেমন লেপ্টে রয়েছে। মেহেভীন তার বরকে দেখে মুচকি হাঁসে। আরহাম বুকে হাত দিয়ে দেয়। মেহেভীনের একটা হাঁসিই যেন যথেষ্ট তার বুকটা ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়ার জন্যে। আরহামের নজর আরেকটু ভালো করে পুরো ছাদের দিকে যেতেই, সে দেখতে পায় ছাদের একদম কর্নারে একটি ছোট্ট রুম আছে। যেই রুমটাকে একদম গোলাপ ফুলে দিয়ে সাজানো হয়েছে। তার মাঝখানে বেডে ছোট্ট করে লেখা আছে,
‘ Meherham forever ‘.
আরহাম নিজের অজান্তেই স্মিত হাঁসে। মেহেভীনের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘ হঠাৎ এইসব আয়োজন কিসের জন্যে? ‘
মেহেভীন পর পর ঘন শ্বাস ফেলে। বুকটা কেঁপে উঠছে বার বার। সে যা বলতে চাইছিলো আরহামকে
তা কেন যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগছে। এইদিকে আরহাম মেহেভীনের দিকে অধিক আগ্রহে নিয়ে তাকিয়ে আছে মেহেভীন তাকে ঠিক কি বলতে চায়। কিছুক্ষন চুপ থেকে মেহেভীন কিছুটা সাহস সংচয় করে আলতো সুরে বলে,
‘ আপনি কী বুঝেন না আরহাম সাহেব? আমার মনে ঠিক কি চলছে? ‘
আরহাম ভ্রু কুচকে বলে,
‘ না বললে কীভাবে বুঝবো?’
মেহেভীন এইবার স্পষ্ট গলাতেই বললো,
‘ আপনার মনে একটা ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে আরহাম সাহেব। তা এইবার ভেঙ্গে দেওয়ার সময় হয়েছে। দেখুন আমি এতো কিছু গুছিয়ে বলতে পারেনা আপনার মতো।শুধু একটাই কথা বলবো আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি আমার অজান্তেই আমার মনের গহীনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘
মেহেভীন কথাটি বলেই সেই ফুল সজ্জিত রুমে চলে গেলো। বুকটা ভয়ে ধরফর করছে তার। আরহাম কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে যা শুনলো তা কী আদোও সত্যি ছিলো? নাকি সে কোন ভ্রমে রয়েছে। অবশেষে তার প্রেয়সীও তাকে ভালোবেসে ফেললো। কথাটি ভেবেই আনমনে হাঁসে আরহাম। এগিয়ে যায় সেই ফুলসজ্জিত রুমের দিকে। রুমে কোনপ্রকার লাইটের আলো নেই। শুধু চারিদিকে ক্যান্ডেলের আলো। সেই আলো তে আরহাম স্পষ্ট দেখতে পারছে মেহেভীনের লজ্জামাখা মুখশ্রী।
আরহাম এক পা দু করে এগিয়ে মেহেভীনের ললাটে ধরে বললো,
‘ সব বুঝলাম, কিন্তু হঠাৎ বাসররাতের মতো রুম সাজানোর মানে টা কী? ‘
মেহেভীন নিষ্চুপ। লোকটা কি বুঝেও এখন না বুঝে থাকবে নাকি? মেহেভীন কি নিজ থেকে তাকে বলবে নাকি? মেহেভীনের রাগ হলো। যাকে বলে প্রবল বেগে রাগ।
‘ আমি জানিনা। ‘
কথা টি বলে মেহেভীন চলে যেতে নিলে, তাতে বাধ সাধে আরহাম। মেহেভীনের হাত টেনে নিজের কাছে এনে,মেহেভীনের কানে নেশাক্ত গলায় বলে,
‘ আমাকে পাগল করে তুমি কোথায় যাচ্ছো প্রেয়সী?নিজে থেকে কাছে আসতে চাইছো আমি কী করে ছেড়ে দেই বলো? আজকে তুমি তোমার আরহাম সাহেবের ভালোবাসা কতটা গভীর তা হারে হারে টের পাবে। ‘
আরহামের নেশাক্ত গলায় বলা কথাটি যেন মেহেভীনের বুক বেধ করে হৃদয়ে গিয়ে লাগলো। সারা শরীরটা অদ্ভুদ ভাবে কেপে উঠছে। আরহাম পাজকোলে তুলে নেয় তার প্রেয়সীকে এগিয়ে নিয়ে যায় বিছানার দিকে। বিছানায় আলতো করে শুয়িয়ে দিয়ে মেহেভীনকে। বদ্ধ রুমে দুই নর-নারীর শ্বাস -প্রশ্বাস শুনা যাচ্ছে শুধু। দুজনের হৃদয়ে আজ একসাথে কম্পিত হচ্ছে। আরহাম মেহেভীনের ললাটে ধরে কপালে চুমু খায়। মেহেভীনের হাতগুলো নিজের হাতের আয়ত্তে নিয়ে গেলো। মেহেভীন চোখজোড়া আবেশে বন্ধ করে নিলো। কেননা আজ সে তার স্বামীকে বাঁধা দিবেনা। নিজেকে সম্পূর্নরুপে সমপর্ন করবে তার স্বামীর কাছে।
আরহাম গভীর ভালোবাসার স্পর্শে মেহেভীনকে মত্ত রাখলো। উজার করে দিলো তার বুকে জমানো সমস্ত প্রেমকে।
মিউজিক বক্সে আলতো করে বেজে চলেছে,
Tumhe apna banane ka junoon
Sar pe hai, kab se hai
Mujhe aadat bana lo ik buri
Kehna ye tumse hai
Tumhe apna banane ka junoon
Sar pe hai, kab se hai
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ঘাড়ে কারো উষ্ম স্পর্শ পেতেই কেপে উঠে মেহেভীন।
আড়মোড়া হয়ে অপরপাশে ঘুমিয়ে পড়ে তবুও সেই স্পর্শ প্রখর হয়ে চলছে সময়ের সাথে। মেহেভীন চাইলেও ঘুমাতে পারেনা। ছটফট হয়প উঠে পড়ে। আরহাম তা দেখে বাকা হাঁসে। মেহেভীন বিরক্ত নিয়ে বললো,
‘ আপনি বার বার ডির্স্টাব করছেন কেন আরহাম সাহেব? রাতে তো ঘুমাতেই পারিনি। এখনোও কি ঘুমাতে পারবো না?’
‘ কেন গো? রাতে কি এমন হয়েছিলো? যে তুমি ঘুমাতেই পারলে না। ‘
আরহামের বেশরমমার্কা কথা শুনে, মেহেভীন নাক পূনরায় লাল আকার ধারণ করলো। রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় কুকড়ে উঠে সে। মাঝে মাঝে তার মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়ে বসে,
‘ এতো ভালোবাসা এতো প্রেম আরহাম সাহেব কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন এতোদিন? ‘
মেহেভীন কথাটি ভেবে আরেকদফা লজ্জা পায়।
তা দেখে ক্ষীন্ন হাঁসলো আরহাম। মেহেভীনের কাছে গিয়ে মেহেভীনের গলায় ঠোট ছুইয়ে কন্ঠে মাদকতা এনে বললো,
‘ ম্যাডাম ফ্রেশ হয়ে আসুন। আর হ্যা একটা শাড়ি পড়ে আসবেন। গোসল সেরে যখন ভেজা চুলে আপনি শাড়ি পড়ে আমার সামনে দাঁড়াবেন তখন কিছুক্ষন প্রান জুড়িয়ে দেখবো। ‘
মেহেভীন নইয়ে পড়লো লজ্জায়। তা দেখে আরহাম আবারোও বললো,
‘ দ্রুত পা চালিয়ে যান। আপনি এখন যেই অবস্হাতে আছেন তাতে আমার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা দায় হয়ে পড়েছে। আমি কিন্তু অতো ভালো হই। ‘
আরহামের কথা শুনে নিজের দিকে চোখ গেলো মেহেভীন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে আরহামকে অসভ্য উপাধী দিয়ে দ্রুত পা বাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
(লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি)
মেহেভীনের চুল বেশ বড় না হলেও বেশ ঘন। পিঠ ছুইছুই করে সেই চুলগুলো। আরহাম মেহেভীনকে বেড়োতে দেখে কিছুক্ষন নিষ্প্রান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার প্রেয়সীর দিকে। অন্যদিনের তুলনায় আজকে তার প্রেয়সীকে একটু বেশিই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। আরহাম এগিয়ে গেলো। মেহেভীন সবুজ রংয়ের শাড়ি পড়ে সাদা তোয়েলে দিয়ে চুল মুছার প্রয়াশ করছিলো। আরহাম তাতে বিঘ্ন ঘটালো। অত্যন্ত নিবিড় শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বললো,
‘ আমি মুছিয়ে দেই মেহেভীন? তুমি বসো থাকো।’
আরহাম শীতল কন্ঠে বলা অনুরোধকে নাখোচ করার সাধ্যি কি আদোও মেহেভীনের আছে? সে চুপচাপ বসে পড়ে শান্তভাবে। আরহাম পরম যত্নে আয়নার দিকে তাকিয়ে তার প্রেয়সী চুল মুছে দিতে থাকে।
_____________
শাড়ি পড়ে বিছানার কোণে বসে আছে ফারিয়া। নাক ফুলিয়ে কাঁদছে। কান্না তার থামছেই না। আজকে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। একেবারে নাকি আন্টিই পড়িয়ে চলে যাবে। কথাটি শুনার পর থেকে
ফারিয়ার মাথা কাজ করছে না। ইচ্ছে করছে আরিয়ানের কাছে ছুটে চলে যেতে এবং শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘ ডাক্তার সাহেব শুনছেন? আমি আপনাকে বড্ড ভালোবাসি। আমার জন্যে কি আপনার কিকোন ফিলিংস নেই? থাকলে বলুন। আমার যে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। অন্য কাউকে কীভাবে বিয়ে করবো আমি?’
আফসোস ফারিয়া চাইলেও বলতে পারছে না। ভিতরের কষ্ট তাকে ভিতরেও চেপে রাখতে হচ্ছে। সে কি দম বন্ধ করা কষ্ট! এই কষ্টের তো শুরু কেবলমাত্র। এই মরনব্যাধী কষ্ট বোধহয় তাকে আজীবন সহ্যই করে যেতে হবে। দরজার অপাশ থেকে দরজায় কড়া নাড়লো ফারিয়ার মা। অস্হিরতার সুরে বললেন,
‘ কিরে ফারিয়া আর কতদূর বল তো? এইবার তো আয় মা। পাত্রপক্ষ তো চলে এসেছে। ‘
‘ পাত্রপক্ষ’ চলে এসেছে শুনে বুকটা ধক করে উঠলো ফারিয়ার। কোনরকম পা চালিয়ে দরজা খুললো। মেয়েকে দেখে খুশি হয়ে ফারিয়ার মা ফারিয়ার থুত্নি ধরে বললেন,
‘ বাহ আমার মেয়েকে লাল শাড়িতে তো বেশ মানিয়েছে। কারো নজর না লাগুক। মাশা-আল্লাহ। ‘
ফারিয়া শুকনো হাঁসলো। ড্রইং রুম থেকে ফারিয়ার বাবা উচু গলায় হাক ছেড়ে বললেন,
‘ কই গো ফারিয়ার মা? মেয়েকে নিয়ে আসো। ‘
ফারিয়ার মা ফারিয়াকে নিয়ে আসলেন। ফারিয়া
এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিয়াকে ছেলের পাশে বসানো হলো। ফারিয়া খানিক্টা দূরুত্ব বজায় রেখে বসে আছে। ছেলেটা বার বার ফারিয়ার কাছে আসার চেস্টা করছে, বরাবরই ফারিয়া মাথা নিচু করেই সরে যাচ্ছে। ছেলেটাকে তার চরম অসভ্য মনে হচ্ছে। এখনো ছেলেটাকে সে এক পলকের জন্যে দেখিই নি।
‘ আমার দেবর অরফে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর জন্যে কিন্তু ফারিয়াকে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে।’
পরিচিত কারো গলা পেয়ে চমকে যায় ফারিয়া। উচু হয়ে দেখতে পায় সামনের সোফায় মেহেভীন,আরহাম এবং আরহামের বাবা-মা। এই মুহুর্তে তাদের দেখে বেশ অবাক হয় ফারিয়া। যেন সে তাদের আশাই করেনি।
তখনি কেউ ফিসফিস করে বলে,
‘ আমার শোকে এতেটা কাতর হয়ে গিয়েছিলে যে,
আমার বাড়ির লোকেদের দিকে তাকালে তো নাই আমাকেও দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। ‘
(লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি)
ফারিয়া আরিয়ানের দিকে অবাক পানে তাকায়।
আরিয়ান এইবার সবার অগোচরে ফারিয়ার কোমড় জড়িয়ে, ঠান্ডা গলায় বলে,
‘ কি ভেবেছিলে? এই আরিয়ান হাসান তালুকদার তার ভালোবাসাকে এতো সহজে ছেড়ে দিবে?উহু ম্যাডাম এতো সহজ নয়। একবার যখন আপনি নিজের মায়ায় আরিয়ান হাসান তালুকদারকে জড়িয়ে ফেলেছেন। সেই মায়ার জাল থেকে আপনি চাইলেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।’
‘ তাহলে আমাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়েছেন তাইনা?’
অভিমানের সুরে ফারিয়া কথাটি বলে। আরিয়ান
বাঁকা হেসে বলে,
‘ সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে একটু কষ্ট দিতে হয়েছে। বুঝলে মিস? ‘
ফারিয়াও সকলের আগোচরে আরিয়ানের কলার চেপে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ একটু কষ্ট? জানেন কতটা কষ্ট পেয়েছি আমি? ওকে বিয়েটা জাস্ট হোক তখন আমিও বুঝিয়ে দিবো। শাস্তির জন্যের রেডিও হোন মিঃ আরিয়ান হাসান তালুকদার। ‘
আরিয়ান ও দুষ্টু হেঁসে বলে,
‘ ঠিক আছে আমিও প্রস্তুত হবু মিসেস আরিয়ান হাসান তালুকদার। ‘
ফারিয়া হেঁসে ফেললো। অতঃপর আরিয়ান ফারিয়াকে আংটি পড়িয়ে দিলো। সবাই একসাথে ‘আলহামদুল্লিলাহ। ‘ বললো। পূর্নতা পেলো আরেকটি ভালোবাসা।
__________
সুখে শান্তিতে বেশ আনন্দের সাথেই পাড় হচ্ছে মেহেভীন এবং আরহামের সুখের সংসার। অভ্র এবং মায়রার সাথেও তারা আস্তে আস্তে করে মিশে যাচ্ছে পুরোনো অতীত ভুলে।
একদিন আরহাম তার অফিসে বসে কাজ করছিলো তখনি তার ফোন বেজে উঠে। সে ফোন রিসিভ করে শুনতে পায়। ফোনের ওপাশ থেকে মেহেভীন নিশব্দে কাঁদছে। সঙ্গে সঙ্গে আরহামের বুক মোচর দিয়ে উঠে। আরহাম দুশ্চিন্তার গলায় বলে,
‘ মেহেভীন কি হয়েছে? আমাকে বলো?’
ফোনের ওপাশ থেকে মেহেভীন নিশ্চুপ। আরহামের ভিতরে ভয় ঢুকে যায়। সে আর কিছু না ভেবে, নিজের ব্লেজার হাতে নিয়ে এক মুহুর্তও দেরী করেনা।ছুটে যায় নিজের বাসার উদ্দেশ্য।
বাসায় এসে দ্রুত নিজের রুমে এসে দেখে,মেহেভীন খাটের কিনারে হাতে কিছু রিপোর্ট নিয়ে চুপচাপ বসে নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আরহাম মেহেভীনের কাছে গিয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে করুন গলায় বলে,
‘ মেহেভীন কি হয়েছে আমাকে একবার বলো? কেউ কিছু বলেছে? কাঁদছো কেন? আমাকে খুলে বলো।’
মেহেভীন আরহামের দিকে রিপোর্টটা আরহামের দিকে এগিয়ে দেয়। আরহাম খুলে দেখে কিছু মুহুর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। রিপোর্টে স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে,
‘ মেহেভীন মা হতে চলেছে। ‘
আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই,মেহেভীন ভেজা গলায় বলে,
‘ আমি আবারোও মা হতে চলেছি আরহাম সাহেব। আমাদের ভালোবাসার প্রতীক পৃথিবীতে আসতে চলেছে। ‘
সঙ্গে সঙ্গে আরহাম মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরে। দুজনেই আজ নিরবে কাঁদছে। সুখের কান্না। দুজনের মুখেই আজ যেন কোন ভাষা নেই।
____________________
সময় স্রোতের ন্যায়। সে কখনোই কারো জন্যে অপেক্ষা করেনা। হাঁসি-কান্না সুখ- দুঃখে পাড় হয়ে গেলো মেহেভীন এবং আরহামের সংসার জীবনের ছয়টি বছর। এই ছয় বছরে অনেককিছু বদলেও গেলেও, মেহেভীনের প্রতি আরহামের অসীম ভালোবাসা আগের থেকেও দ্বিগুনভাবে বেড়ে চলেছে। গাড়ির হর্নের শব্দে মেহেভীন বুঝতে পারে এতোক্ষনে আরহাম চলে এসেছে অফিস থেকে। আরহাম গাড়ি থেকে বেড়িয়ে অফিসের ফাইল দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। আরহাম
এখন আগের থেকেও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে এতোবছরে নিজের প্রচেষ্টায় নিজের স্বপ্নের কম্পানি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। শহরে সবাই তাকে এখন এক নামে চিনে।
আরহাম বাসায় ঢুকতেই, তার পাঁচ বছরের ছেলে আরভীন দৌড়ে আসে। আরহাম তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো,
‘ আমার ছেলেটা বুঝি আমায় মিস করছিলো?’
‘ হুম ড্যাড অনেক। বাট তার আগেও একটা নিউজ আছে।’
‘ কি নিউজ? ‘
‘ আমি আজকে ক্লাসে টপ করেছি। তুমি বলেছিলে টপ করলে তুমি ফ্রাইডে তে আমার সাথে সারাদিন ক্রিকেট খেলবে। প্রমিজ করেছিলে কিন্তু। ‘
আরহাম তার ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
‘ আমার প্রিন্স আমার কথা রেখেছে এখন তো আমাকেও আমার কথা রাখতে হবে তাইনা? ডোন্ট ওয়ারি তোমার ড্যাড তার প্রমিজ রাখবে। ‘
আরভীন আরহামের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ রেইলি ড্যাড আই লাভ ইউ জাস্ট।’
‘ আরভীন তোমার চাচ্চু ফোন করেছে। ‘
‘ সত্যি মাম্মাম? ‘
‘ হুম। ‘
মেহেভীন কথাটি বলে আরভীনের হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়। আরিয়ান ফোন করেছে শুনে আরভীন দ্রুত কোল থেকে নেমে ফোন নিয়ে দ্রুত উপরে চলে যায়।
চাচ্চুর কাছে সে এখন আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসবে।
আরিয়ান বর্তমানে তার কাজের সূত্রে অস্ট্রেলিয়ায় তিন মাসের জন্যে গিয়েছে। ফারিয়াও আরিয়ানের সাথে গিয়েছে। তাদের দুজনের ঘর আলো করে
মেয়ে এসেছে। যার বয়স এখন এক বছর। নাম আলো।
আরভীনের সব আবদার তো তার ড্যাড এবং তার চাচ্চুর কাছেই। শুধু তাই নয় অভ্রের কাছেও সে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসে। আরভীন সকলেরই নয়নের মণি। এইসবকিছু দেখে মেহেভীন একদিন আরহামকে উদ্দেশ্য করে বলেই ফেলেছিলো,
‘ আরহাম সাহেব আপনার তিন ভাইয়ের অতি আদরে আমার ছেলেটা আবার যেন বাদর না হয়ে যায়।’
আরভীন চলে যেতেই, আরহাম মেহেভীনের কোমড় জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে,
‘ ইচ্ছে করে ছেলেকে ফোন ধরিয়ে দিলে তাইনা? যেন
আমার আদর পেতে পারো। আসলে ছেলেকে দেখে আজকাল তুমি জেলাসি হচ্ছো প্রেয়সী। ইটস নট গুড। ‘
মেহেভীন আরহামের বুকে মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে বলে,
‘ হয়েছে আপনার কথা শেষ? কি শুরু করেছেন?
বাবা-মা বাইরে গিয়েছেন। এসে দেখলে কি ভাব্বে?’
আরহাম কথার জবাব দেয়না বরং মেহেভীনের দিকে আরেকটু ঝু্ঁকে যেতেই,মেহেভীন আরহামের ঠোটে হাত দিয়ে, কিছুটা গম্ভীর সুরে বলে,
‘ আপনি কী জানেন আরহাম সাহেব? আপনি দিনের পর দিন অসভ্যের কাতারে নাম লিখাচ্ছেন। ‘
আরহাম স্মিত হেসে শীতল গলায় জবাব দিলো,
‘ নিজের বউয়ের সাথে রোমান্স করাটা যদি অসভ্যতামি হয়, তাহলে আমি তা বার বার করতে রাজি। ‘
মেহেভীন হেসে ফেলে। আরহাম ও আরেকদফা হাসে। তখনি ফোন বেজে উঠে মেহেভীনের। মেহেভীন ফোন রিসিভ করে এমন কিছু যা শুনে মুহুর্তেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। সে সময় নষ্ট না করে দ্রুত আরহামকে বলে তাকে এবং আরভীনকে নিয়ে অভ্রের বাড়িতে নিয়ে যেতে।
(লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি)
_____________
অভ্র মায়রাকে পরম আনন্দে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
সে আজ প্রচন্ড পরিমানে খুশি। হওয়ারই কথা। কেননা মায়রা আবারোও কনসিভ করেছে। মায়রার স্হীর হয়ে বসে আছে। তার মুখে কোন খুশির ঝলকের দেখা নেই। অভ্র মায়রার মুখ দেখে বললো,
‘ তুমি কী এখনো একটুও হাঁসবে না মায়রা? ‘
মায়রা জবাব দেয়ন। চুপ হয়ে বসে থাকে। অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে মায়রা এতো বড় খুশির সংবাদ পেয়েও চুপ হয়ে থাকবে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজকের দিনে প্রতিবছরই মায়রার মুখের হাসি উধাও হয়ে যায়। আজকে তাদের প্রথম সন্তানের জন্মদিন। অভ্র এবং মায়রার ঘর আলো করে তাদের ছোট্ট মেয়ে জন্ম নিয়েছিলো, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেই বাচ্চা মেয়েটি অভ্রদের বাসা থেকেই ছয় মাস বয়সে চুরি হয়ে যায়। অভ্র অনেক চেষ্টা করেও তাদের মেয়ের কোন খবর পায়নি। আজ প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো তবুও সেই ক্ষতটি অভ্র এবং মায়রা দুজনেই বয়ে চলেছে। আজ তাদের মেয়ের জন্মদিন ছিলো। আজকেই তারা জানতে পারলো তাদের মাঝে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।
আরভীন, মেহেভীন এবং আরহাম অভ্রের রুমে আসলো। আরভীন এসেই
‘ অভ্র পাপাই। ‘ বলে
অভ্রের কোলে বসে পড়লো। আরভীনকে দেখে অভ্র আরভীনকে জড়িয়ে ধরলো। আরভীন অভ্রের পরম আদরের। মায়রাও আরভীনকে অনেক ভালোবাসে। আরভীনের মাঝেই যেন তারা তাদের সন্তান হারানোর কষ্টটা কিছু হলেও ভুলতে পারে। মেহেভীন আরভীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ বাবাহ তুমি আপাতত বাইরে গিয়ে খেলা করো।’
আরভীন বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ ঠিক আছে মাম্মাম। ‘
আরভীন বাইরে চলে যেতেই, মেহেভীন মায়রার কাছে এসে বললো,
‘ মায়রা আপু এইবার একটু স্বাভাবিক হও। এতো বড় খুশির সংবাদ পেলে। ‘
মায়রা অনুতাপের গলায় বলে,
‘কীভাবে স্বাভাবিক হবো মেহেভীন? তোমাকে আমি বলে বুঝাতে পারবো না আমি কতটা অপরাধবোধে
রয়েছি। শুধু মনে হয় আমাদের মেয়েটা হয়তো আমাদের করা পাপের জন্যেই আজ আমাদের সাথে নেই। ‘
মায়রার কথা শুনে অভ্র মাথা নিচু করে বলে,
‘ মায়রা তো ঠিকই বলেছে। আমাদের পাপির শাস্তি আমরা হয়তো আজীবনই পেয়ে যাবো। যেমন আমার মা টাও শেষ বয়সে কতটা যন্ত্রনা নিয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো। আমরা আমাদের মেয়েকেও হারিয়ে ফেললাম। ‘
আরহাম অভ্রের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
‘ অনেকসময় মানুষ পরিস্হিতির স্বাকীর হয়ে অনেক ভুল অনেক অন্যায় করে ফেলে। কিন্তু সেই পুরনো অন্যায়ের করা কথা ভেবে জীবনটাকে থমকে রাখা কী ঠিক অভ্র? ‘
অভ্র সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
মায়রা আবারোও মেহেভীনকে বলে,
‘ যে যাই বলুক আমি তো জানি আমার জন্যে আমার বাবা তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো। আমি তোমাকে পথের কাটা মনে করতাম বলে আমার বাবা তোমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছিলো। তোমার কষ্টটা আজ আমি এই ছয়বছরে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। তাছাডা আমি এবং অভ্র তো কম অন্যায় করেনি। ‘
মায়রা কথাটি বলেই কেঁদে দিলো। মেহেভীন মায়রার হাত ধরে কান্নার সুরে বলে,
‘ নিজেকে সামলাও মায়রা আপু। অতীতকে পিছনে ফেলে জীবনে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। অতীত শুধু আমাদেরকেই কষ্টই দেয়। অতীতকে আকড়ে ধরে থাকা মানে নিজের জীবনের কালো অধ্যায়কে নতুনভাবে আগমন করা। তাই বলছি মায়রাপু মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাদের আরেকটি সুযোগ দিয়েছে। নতুনভাবে সব শুরু করো। ‘
মায়রা মেহেভীন কথা মনোযোগ সহকারে শুনে, মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
_____________________
রাত প্রায় ২টো বাজে। আরহাম এখনো অফিস থেকে ফিরেনি। আরভীন তার দাদু এবং দিদার ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহেভীন আরহামের জন্যে টেবিলে খাবার রেখে,টেবিলেই আরহামের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ নিজেকে হাওয়ায় ভাসতে দেখে, নিজের আখিজোড়া খুলে মেহেভীন নিজেকে আরহামের কোলে আবিষ্কার করে। মেহেভীন চিৎকার করতে নিলে, আরহাম মেহেভীনের ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে বলে,
‘ ডোন্ট সাউট। ‘
আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে উপরের রুমে নিয়ে যায়। অতঃপর সাদা কিছুটা লালের মধ্যে একটি কাতান শাড়ি নিয়ে আসে। মেহেভীন শাড়িটির দিকে কিছুক্ষন স্হীর হয়ে তাকিয়ে থাকে। অসম্ভব সুন্দর কাতান শাড়িটি। মেহেভীন শাড়িটি নিয়ে চেঞ্জিং রুমে চলে যেতে নিলে, আরহাম তাতে বাধা দিয়ে বলে,
‘ উহু। আজকে আমি আমার প্রেয়সীকে নিজ হাতে সাজাবো। ‘
কথাটি বলে আরহাম নিজে মেহেভীনকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। অতঃপর নিজ হাতে মেহেভীনকে সাঁজিয়ে দেয় একদম ছবির মতো। সাঁজানোর পর আরহাম কিছুক্ষন তার প্রেয়সীর দিকে মুগ্ধ পানে তাকিয়ে থাকে। লাল টকটকে শাড়িতে মেহেভীনকে আজ নতুন নববধুর মতো লাগছে। চিকন ঠোটজোড়া গোলাপী আকাড় ধারণ রয়েছে। ফর্সা মুখটাও রক্তিম হয়ে রয়েছে। লজ্জার ছাপ রয়েছে তাতে। আরহাম কিছুক্ষন চেয়ে থাকে আনমনে বলে,
‘ প্রেয়সী তোমাকে হাজারোবার দেখলেও আমার চোখের তৃষ্ণা নিবারণ হবে না। এতোটাই অদ্ভুদ সুন্দর তুমি। ‘
অতঃপর মেহেভীনকে নিয়ে গাড়ি করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। মেহেভীন বুঝতে পারছে না আরহাম হঠাৎ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে মেহেভীনের লক্ষ্য করে দেখলো বাতাসে তার বরের চুলগুলো সামান্য উড়ছে। আরহামের উজ্জ্বল ফর্সা মুখে চমৎকার হাঁসি বিরাজমান। আরহাম আগের থেকেও সুদর্শন হয়ে উঠেছে।আরহাম নিজের গাড়ি থামিয়ে দেয়। প্রথমে আরহাম এবং অতঃপর মেহেভীন গাড়ি থেকে বেডিয়ে পড়ে। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে মেহেভীন অবাকের শীর্ষে পৌছে যায়। সামনে থাকা পুকুরের দিকে তার চোখ আটকে যায়। সামনে রয়েছে পদ্মফুলে ভরপুর পুকুর। চারিদিকে অন্ধকারকে আলোকিত করছে জোনাকি পোকা উড়ে চলেছে।
এতো সুন্দর মনোরম দৃশ্য দেখে মেহেভীন আবেগ্লুত হয়ে, আরহামকে জডিয়ে ধরে বলে,
‘ ধন্যবাদ আরহাম সাহেব এতো সুন্দর জায়গায় আমাকে নিয়ে আসার জন্যে। ‘
আরহাম মুচকি হেসে বলে,
‘ তোমার পছন্দ হয়েছে প্রেয়সী। ‘
‘ একদম। ‘
এইবার আরহাম পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়। পুকুরের থেকে পদ্মফুল নিয়ে এসে, মেহেভীনের কাছে এসে আবদারের সুরে বলে,
‘ প্রেয়সী আজ তোমার ঘন কালো চুলগুলোকে ছেড়ে দেও। আমি তাতে পদ্মফুল গুজে দিবো। ‘
মেহেভীনের উত্তরের অপেক্ষা করলো না আরহাম। নিজেই মেহেভীনের চুলগুলো খুলে দিয়ে, মেহেভীনের কানে পরম যত্নে ফুল গুজে দিয়ে, মেহেভীনকে পুনরায় কোলে নিয়ে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়ে। অতঃপর প্রেন্টিং খাতায় রং তুলি দিয়ে আরহাম নিজের নিঁখুত
শিল্পীর হাত নিয়ে, নিজের প্রেয়সীর ছবি একেঁ ফেললো। পদ্মদুলে লাল টুকটকে শাড়ি পরিহিতা মেহেভীন। মেহেভীন আরহামের বুকে মাথা গুজে বলে,
‘ এতো ভালোবাসেন কেন আরহাম সাহেব? জানেন? মাঝে মাঝে খুব ভয় করে। মনে হয় এই ভালোবাসা আমি হয়তো হারিয়ে ফেলবো। আমাকে কখনো ভুলে যাবেন না তো?’
আরহাম অত্যন্ত শীতল গলায় জবাব দেয়,
‘ তোমাকে কী করে ভুলবো প্রেয়সী? তোমাকে ভুলে যাওয়া মানে তো নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া। তুমি আমার মনে ঠিক কোথায় আছো জানো? তুমি_আছো_মনের_গহীনে। মনের অত্যান্ত গহীনে যার বসবাস তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় এই জন্মে।
ভালোবাসি প্রেয়সী। ‘
‘ ভালোবাসি আরহাম সাহেব। ধন্যবাদ আরহাম সাহেব আমার জীবনের আসার জন্যে। আমার অন্ধকারে আচ্ছাদিত জীবনে এক মুঠো ভালোবাসা রং নিয়ে এসে, রঙ্গিন করে তুলার জন্যে।’
আরহাম শক্ত করে তার প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে আনমনে গাইতে থাকে,
চেয়েছি পেয়েছি থেকো মন গহিনে
পারে না বাঁচে না মন তুমি বিহনে
চেয়েছি পেয়েছি থেকো মন গহিনে
পারে না বাঁচে না মন তুমি বিহনে
সমাপ্ত।।
আরহাম এবং মেহেভীন সারাজীবন সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দিকে এইটাই কাম্য 💖।
লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি