#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_তৃতীয়
হসপিটালে রাতের অন্ধকারে কেউ হঠাৎ বেলীর গলার চে°পে ধরল। শক্তপোক্ত হাতে গলা চে°পে ধরায় বেলীর নিঃশ্বাস মুহূর্তেই আটকে এলো। ঘুমের মধ্যেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল বেলী। শরীর সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো খুলতেই যেন, শরীরটা অবশ হয়ে আসল। শক্তপোক্ত হাতের মানুষটা যে বড্ড চেনা। লাইটের হালকা আলোয় নীলাভ্রর রাগান্বিত চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বেলী। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা এই মুহূর্তে থামিয়ে দিয়েছে বেলী। কিন্তু, সামনে থাকা মানুষটার হাত এখনো বেলীর গলা চে°পে রেখেছে। এই মুহূর্তে শারীরিক যন্ত্রণার চাইতে, মানসিক যন্ত্রণাটা বেশি হচ্ছে। কিছুতেই যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কিন্তু মন মস্তিষ্ক বার বার বিভিন্ন প্রশ্ন করে চলেছে। চোখ দুটো নীলাভ্রর মুখ পানে স্থির হয়ে আছে। বেলীর দুই চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ করেই নীলাভ্র বেলীর গলা ছেড়ে দিলো। গর্জন করে বলে উঠল,
“তুই আমাকে ঠকিয়েছিস, বেলীপ্রিয়া৷ তুই আমাকে ঠকিয়েছিস। ভীষন বাজে ভাবে ঠকিয়েছিস। তোকে আমি বাঁচতে দিব না।”
বলে আবার গলা চে°পে ধরল। হিংস্রভাবে চে°পে ধরল এবার। নিঃশ্বাসটা এই বুঝি বন্ধ হয়ে গেলো? শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গলা ফা°টিয়ে চিৎকার করে উঠল বেলী,
“নীলাভ্র ভাই, আমি আপনাকে ঠকাইনি।”
কথাটা লাফ দিয়ে বলেই উঠে বসল। বেলীর চিৎকারে কড়িডোর থেকে ছুটে আসল রিতা আর ইশু। রুমে ঢুকেই দেখে বেলী কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। সারা শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। চোখ দুটো থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। রিতা বেলীর এই অবস্থা দেখে ‘থ’ মে°রে দাঁড়িয়ে আছে। ইশু গিয়ে ছুটে বেলীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বেলী অনবরত বলতেই আছে,
“আমি আপনাকে ঠকাইনি। বিশ্বাস করুন, ঠকাইনি।”
ইশু বুঝতে পারছে বেলী কিছু একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তবুও বেলীকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বার বার বেলী একই কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটা মুখে যতই নিজেকে শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন? ভেতর থেকে মেয়েটা ভে°ঙে গেছে। সম্পূর্ণ ভে°ঙে গেছে। নিজেকে শক্ত করতে একটু তো সময় লাগবেই। ইশু বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। নমনীয় কণ্ঠে বলল,
“খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শান্ত হয়ে যা, প্লিজ। এতটা ভে°ঙে পড়তে নেই, বোন।”
বেলী কথাগুলো শুনল কি-না ? কে জানে? আগের ন্যায় বলল,
“তুই নীলাভ্র ভাইকে বল, প্লিজ। আমি তাকে ঠকাইনি।”
বলে হুহু করে কান্না করে উঠল। ইশুকে শক্ত করে চে°পে ধরে কাঁদতে লাগল। ইশুর চোখের কোনেও পানি। বেলীকে কিছু বলে স্বান্তনা দেওয়ার সাহস পেলো না। শুধু চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে উঠল,
“ভাইয়্যু দেখ, কী অবস্থা করেছিস মেয়েটার? মেয়েটা যে জীবন্ত লা°শ হয়ে গেলো ভাইয়্যু। তুই কোথায় ভাইয়্যু? ভালো আছিস? তুই তো তোর বেলীপ্রিয়াকে ছাড়া থাকতে পারিস না। তাহলে, এভাবে কেন ছেড়ে গেলি? প্লিজ ফিরে আয় ভাইয়্যু। ফিরে এসে প্রমাণ করে দে, তুই ঠকাসনি তোর বেলীপ্রিয়াকে। প্লিজ ফিরে আয়, ভাইয়্যু। প্লিজ।”
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ইশুর ভেতর থেকে কান্নাগুলো তীব্র বেগে বেরিয়ে আসল। বেলীর সাথে সাথে ইশুও কাঁদছে। আর রিতা দরজার সামনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ভর্তি নোনাজল নিয়ে মেয়ের দিকে অসহায় চাহনী দিয়ে আছে। কিছু সময় রুমের ভেতরে নিরবতা চলল। বেলী হেচকি তুলে কাঁদছে। ইশু দুই হাতে চোখের জলটুকু মুছে নিলো। শান্ত, শীতল কণ্ঠে বেলীকে শুধাল,
“জানিস তো বেলী? আমরা কেউ কাউকে ঠকাই না। উল্টা আমরা নিজেরাই ঠকে যাই। সময় আর পরিস্থিতির কাছে। সময় আর পরিস্থিতির উপর আমাদের কারোর হাত নেই। তারা আমাদের ঠকিয়ে যায়। ভালোর জন্য বোধহয়। আমাদের ভালো হলেও আমরা কিছু বলতে পারিনা। আবার খারাপ হলেও বলতে পারিনা। শুধু ঠকে গিয়ে শান্ত হয়ে যাই। নিরব হয়ে যাই। যখন আমরা নিরব হয়ে যাই। তখন সেই সময়েই আবার আমাদের নিরবতার পুরষ্কার দেয়। তখন আমরা বুঝতে পারি, আসলে যা হয়েছে ভালোর জন্য।”
বেলী কথাগুলো শুনল। মন দিয়ে শুনল। কিছুটা মাথায় গেঁথে নিলো। তারপর ইশুকে ছেড়ে দিলো। সামলে বসল নিজেকে। চোখের অশ্রু ফোটা মুছে নিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আসলে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চিন্তা করিস না। আমি ঠিক আছি।”
ইশু যেন একটু স্বস্তি পেলো। মেয়েটা মুহূর্তেই চট জলদি নিজেকে সামলে নিলো। রিতা এবার কাছে এসে বসল বেলীর। আলতো হাতে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
“কিছু খাবি, মা?”
বেলীর মুখে আগের মতোই হাসি রইল। বলল,
“না। আচ্ছা এখন কয়টা বাজে মা?”
ইশু সাথে সাথে উত্তর দিলো,
“রাত ৯টা বাজে। তুই ঘুমিয়েছিলি বলে, আজ রাতটা ডাক্তার হসপিটালেই থেকে যেতে বলেছে। কাল সকাল সকাল আমরা বাসায় চলে যাব।”
বেলী গায়ের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলে উঠল,
“তোরা বাসায় চলে যা। আমি একা থাকতে পারব। কোনো সমস্যা নেই।”
রিতা আর ইশু কিছুতেই বেলীকে একা রেখে যেতে চাইছিল না। কিন্তু বেলীর জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হলো। তারা চলে যেতেই বেলী বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়াল। রুমের পশ্চিম দিকে জানালাটা খুলে দিলো। সাথে সাথে শীতল হাওয়া এসে লাগল বেলীর গায়ে। খানিকটা কেঁপে উঠল মেয়েটা। জানালার গ্রীলে মাথা ঠেঁকিয়ে ডুব দিলো অতীতে। ভয়ঙ্কর সেই অতীত…
“দুই মাস আগের সেই দুপুরে”
রাকিবের ফোন কে°টে দিয়েই বেলী ফোন দিলো তানিশাদের বাসায়। অনেকবার রিং হওয়া স্বত্তেও কেউ ধরল। তবুও বেলী হাল ছাড়ল না। আবার ট্রাই করার সাথে সাথে কেউ ফোনটা রিসিভ করল। কণ্ঠস্বরটা বেলী ঠিক চিনল না। তবুও প্রশ্ন করে বসল,
“তানিশা। তানিশা কোথায়? প্লিজ তানিশাকে একটু ফোনটা দিবেন?”
সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে কান্নারত স্বরে উত্তর আসল,
“তানিশা তো নেই। তানিশা আজ মা°রা গেছে।”
আর কিছু শোনার মতো শক্তি হলো না বেলীর। মাথাটা সাথে সাথে ঘুরতে শুরু করল। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ঘুরে পড়ে গেলো নিচে। আর যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল। পাশে অসহায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বসে আছে নীলাভ্র। বেলীর জ্ঞান ফিরে আসতেই মুহূর্তেই সব মনে পড়ে গেলো। চিৎকার করে উঠে বসল। নীলাভ্রর আকঁড়ে ধরে পা°গলের মতো বলতে শুরু করল,
“তানিশা। তানিশা। তানিশা…। ”
আর কিছু বলতে পারছে না। উচ্চারণ হচ্ছে না বিষা°ক্ত শব্দটা। নীলাভ্র এতক্ষণে সবটা জেনেছে। রাকিবের থেকে খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল। আর এসেই বেলীকে সেন্সলেস অবস্থায় দেখতে পায়। বেলীকে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বেলী কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। খালি পাগলের মতো বলে যাচ্ছে,
“ওরা সবাই মিথ্যা কথা বলছে, নীলাভ্র ভাই। আমাকে প্লিজ তানিশার কাছে নিয়ে চলুন। আমি এক্ষুনি যাব ওর কাছে।”
নীলাভ্র কিছুতেই বেলীকে শান্ত করতে পারল না। বাধ্য হয়ে ওই মুহূর্তেই রিতাকে সবটা জানিয়ে ছুটল তানিশাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় ৩/৪ ঘন্টা জার্নি করে বিকেল ৪টায় এসে পৌঁছাল তানিশাদের বাসায়। সারাটা রাস্তা বেলী এক মুহূর্তের জন্যও কান্না থামায়নি। পা°গলের মতো কেঁদেছে। তানিশাদের বাড়িতে পা রাখতেই বেলী থেমে গেলো। আর পা চলল না। বাড়ি ভর্তি লোকের সমাগম দেখে বুকের ভেতরটা আরো একবার কেঁপে উঠল। কয়েকপা পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলেই, নীলাভ্র ধরে ফেলল। একটু কঠিন স্বরে বলল,
“তুই কি তানিশাকে দেখতে চাস না-কি চাস না? যদি তুই আর একবার কান্না করিস তাহলে এক্ষুনি তোকে নিয়ে আমি চলে যাব। নিজেকে শক্ত রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বেলী প্রতিউত্তরে শুধু অসহায় চাহনী দিলো নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্র বেলীর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাড়ির উঠানে ভীড় ঠেলেই ভেতরে ঢুকতেই চোখের সামনে সাদা কাফনে প্যাঁচানো লা°শ দেখতে পেলো। একজন মহিলা লা°শটার মুখের কাপড় সরাতেই, তানিশার ঘুমন্ত চেহারাটা বেলীর চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুহূর্তেই বেলী জোরে ‘তানিশা’ বলে চিৎকার করে উঠল। হাটু ভে°ঙে নিচে বসে পড়ল। এবার আর নীলাভ্র ধরল না। নীলাভ্র নিজেই এই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছে না। হাসি-খুশি মেয়েটা আজ লা°শ হয়ে সুয়ে আছে। নাহ! এ দৃশ্য সহ্য করা বড্ড কঠিন!….
#চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন দয়া করে। এখন থেকে কয়েক পরেব অতীত চলবে। একটু ধৈর্য নিয়ে না পড়লে কিছু বুঝবেন না। যাদের ধৈর্য নেই তারা দয়া করে শেষ হলে পড়ুন। নয়ত ভালো লাগবে না।
আসসালামু আলাইকুম ]