তুমি শুধু আমারই হও পর্ব – ২১

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা_সাথী

|২১|

উৎসব আজ পুরো পরিবার নিয়ে অর্নিদের বাসায় এসেছে। এতকিছুর পর অর্নি ওকে নিজ মুখে ভালোবাসি বলেছে, তাই ওকে এবার নিজের করে নেওয়ার জন্যই স্ব পরিবারে হাজির হয়েছে অর্নিদের বাসায়। অর্নিকে হারাতে চায় না ও। কিছুতেই না। অর্নি অবশ্য জানে না উৎসব ওরা আসবে আজ। তাই তো বিকেলের দিকেই টায়রার সঙ্গে শপিংয়ে বেরিয়ে পড়েছে। উৎসব ওরা অর্নিদের বাসার কাউকে না জানিয়েই এসেছে। সবকিছু শুনে মিসেস অদিতি অর্নিকে ফোন করতে চাইলে শায়লা বেগম বললো,
–“এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আমরা আছি তো। অর্নি আসুক না, মনমতো শপিং করেই আসুক। আমাদেরই তো ভুল আমরা কিছু না জানিয়েই হুট করে চলে এসেছি।”

মিসেস অদিতি হেসে বললেন,
–“আসলে আপনারা একটু জানিয়ে আসলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো৷ হুট করে__”

–“জানানোর স্কোপই তো পেলাম না। ঘন্টা খানেক আগে উৎসব হুট করেই জানালো। প্রথমে তো আমরাও অবাক হয়েছিলাম। এভাবে হুট করেই সবকিছু হয় নাকি? কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মেনে আসতেই হলো। ভাবলাম যে বিয়েটা দুদিন পর হবে সেটা আজ হলেই বা ক্ষতি কি?”

মিসেস অদিতি হাসলেন। আরো টুকটাক কথা বলে উঠে গেলেন কিচেনে। স্বল্প সময়ে যা যা আয়োজন করা যায় তাই করবেন। সামনে অবশ্য হালকা খাবার দেওয়া হয়েছে। এখন ভারী কিছুর আয়োজন করা প্রয়োজন। মিসেস অদিতি কিচেনে গিয়ে অর্নবকে ফোন করে জানালেন সব। অর্নবও মায়ের ফোন পেয়ে বেরিয়ে পড়লো অফিস থেকে।

সন্ধ্যার পর হাতে এক-গাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে গুনগুন করে গান করতে করতে বাড়ি ফিরলো অর্নি। ড্রয়িংরুমের সোফায় চোখ পড়তেই থেমে গেলো ও। উৎসব ওর পুরো পরিবার নিয়ে বসে আছে। ভ্রু কুঁচকে ফেললো অর্নি। উৎসব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্নির দিকে। অর্নি উৎসবের আব্বুকে সালাম দিলো। তিনি হেসে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করলো অর্নিকে। অর্নিও হাসিমুখে উত্তর দিলো। নূর উঠে এসে অর্নির সাথে ওর রুমে চলে এলো। অর্নি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“ব্যাপার কি? সবাই আজ আমাদের বাসায়?”

নূর হেসে একপাশ থেকে অর্নিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“ভাইয়ার আর তর সইছে না তোকে নিজের করে পাওয়ার জন্য।”

–“মানে কি?”

–“মানে ভাইয়া বিকেলে হুট করেই আব্বু-আম্মুকে জানালো ভাইয়া তোকে বিয়ে করতে চায়, আর আজকেই। প্রথমে আব্বু আম্মু ভাইয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ভাইয়া বুঝতে নারাজ৷ ভাইয়ার কথা হলো, আবার যদি তোদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখন? ভাইয়া তোর থেকে আর দূরে দূরে থাকতে পারবে না৷ সবথেকে বড় কথা যেখানে তোরা দুজন দুজনকে ভালোবাসিস, দুই পরিবার রাজি সেখানে এত দেরী করে হবে কি?”

সবশুনে অর্নি অসহায় চোখে তাকালো নূরের দিকে। ছেলেটা কি পাগল? এভাবে কেউ বিয়ের কথা বলে? একটুও লাজ-লজ্জা নেই ছেলেটার। নূর অর্নিকে বললো,
–“তাহলে আমার ভাবী হওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?”

–“আচ্ছা দোস্ত এত তাড়াহুড়ো করার সত্যিই কোনো দরকার আছে? আমার নিজের বিয়ে নিয়ে কত্ত প্ল্যান ছিলো জানিস? তোর ভাইয়ের জন্য দেখছি এখন সেসব কিছুই পূরণ হবে না আমার।”

–“ইচ্ছে তোমার পূরণ করার দায়িত্ব আমার।”

দরজার কাছ থেকে কথাটা বললো উৎসব৷ অর্নি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো উৎসবের দিকে। এ্যাশ কালার পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পড়েছে উৎসব৷ পাঞ্জাবীর হাতা ফোল্ড করা। কি কিউট লাগছে ছেলেটাকে। উৎসব ভিতরে ঢুকে বললো,
–“ওভাবে কি দেখছো?”

অর্নি হকচকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো৷ উৎসব মুচকি হাসলো। উৎসব আবারো বললো,
–“তোমার বিয়ে নিয়ে যা যা প্ল্যানিং আছে, সব পূর্ণ করবো আমি। কিন্তু আপাতত আমার বউ হয়ে আমার ইচ্ছে পূর্ণ করো তুমি। ব্যাস এতটুকুই।”

টায়রা আর নূর মিলে অর্নিকে রেডি করিয়ে দিলো। বেবি পিংক কালারের শাড়ি পড়ানো হয়েছে অর্নিকে। দুজনে মিলে অর্নিকে ড্রয়িংরুমে এনে উৎসবের পাশে বসিয়ে দিলো। নূর গিয়ে বসে পড়লো রুশানের পাশে। নিহাল আর শান্ত’র পুরো পরিবারও উপস্থিত আছেন এখানে অতঃপর দুই পরিবারের সম্মতিতেই ঘরোয়া ভাবে উৎসব আর অর্নির বিয়ে সম্পন্ন হয় আজ। অর্নির ইচ্ছেমতো অর্নব আর ওর বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করা হবে।

অর্নি রুমে বসে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। এতক্ষণ যেন দম আটকে বসে ছিলো সবার সাথে৷ নূর আর রুশান এসে বসলো অর্নির দুই পাশে। নূর বললো,
–“তুই তো এখন থেকে আমার ভাবী রাইট? আচ্ছা তোকে ভাবী বলবো নাকি নাম ধরে ডাকবো? সম্পর্কে তো আমার থেকে বড় হয়ে গেলি এখন কি তুমি বা আপনি করে বলতে হবে তোকে? ভাবছি আমি এসব।”

অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো নূরের দিকে। নূর বললো,
–“কি? ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”

অর্নি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমি বাঁচি না আমার জ্বালায় আর তুই আমাকে এরমাঝেও আবার জ্বালাতে এসেছিস?”

রুশান অর্নির মাথায় টোকা মেরে বললো,
–“তোর আবার কি হইছে?”

–“এমনিতেই উৎসব ভাইয়ের জ্বালানোর শেষ ছিলো না আমাকে। উনার মনমতো না চললেই ধমকি-ধামকি শুরু করে দিতো৷ অধিকারবোধ দেখাতো প্রখর ভাবে। আর এখন? এখন তো উনার বিয়ে করা বউ, আমার কপালে আর কি কি আছে আল্লাহ ভালো জানেন।”

অর্নির কথায় নূর আর রুশান হাসলো। নূর বললো,
–“আমার ভাইয়া তোর সাথে হম্বিতম্বি করলেও তোর প্রতি ভাইয়ার ভালোবাসাটা কিন্তু বরাবরের মতোই প্রখর।”

এ কথাটা অস্বীকার করার মতো সাধ্য অর্নির নেই৷ উৎসব অর্নিকে সত্যিই সবথেকে বেশি ভালোবাসে। ওর নিজেকে ধন্য মনে হয় উৎসবের মতো একটা ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে বলে৷ উৎসবের ভালোবাসা পায় বলে৷

উৎসব আর অর্নি, অর্নির ঘরের ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ অর্নি দুই হাতে ব্যালকোনির গ্রীল আকঁড়ে ধরে দাঁড়িয়েছে৷ উৎসব অর্নির হাতের উপর হাত রাখতেই অর্নি চমকে তাকালো উৎসবের হাতের দিকে৷ উৎসব বললো,
–“এত চুপচাপ কেন আজ?”

অর্নি সামনে তাকিয়ে বললো,
–“আপনার সামনে কবেই বা বকবক করেছি আমি উৎসব ভাই?”

উৎসব রাগী চোখে তাকালো৷ অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যরি__”

উৎসব বললো,
–“অর্নি___”

–“হু?”

–“তুমি আমার বিয়ে করা বউ, এটা এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।”

–“আমারো না। আচ্ছা এভাবে হুট করেই বিয়ের কথা মাথায় এলো কেন? আমাকেও কিচ্ছু জানালেন না।”

–“জানি না, ইচ্ছে হলো তোমাকে নিজের করে নেওয়ার তাই আর দেরী করলাম না৷”

অর্নি কিছু বললো না। উৎসব অর্নির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“আর তাছাড়া এখন আর তোমাকে স্পর্শ করতে কোনো কারন লাগবে না। সমাজ কি বললো, মানুষ কোন চোখে দেখলো আমাদের এসবের পরোয়া করতে হবে না। যদিও বা আগেও এসবের পরোয়া করিনি আমি।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। উৎসব মুচকি হেসে সরে দাঁড়ালো। উৎসব আচমকাই প্রশ্ন করলো,
–“অর্নি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে না আজ?”

উৎসবের এমন প্রশ্নে অর্নি থতমত খেয়ে গেলো। কি জবাব দিবে ভেবে পেলো না৷ উৎসব আবারো বললো,
–“এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে, আমরা একসাথে থাকতেই পারি৷ আমি কিন্তু তোমাকে সাথে করে নিয়েই যাবো৷ রেখে যাবো না আর এ বাসায়।”

অর্নির কিছু একটা হলো। দ্রুত অন্যদিকে ফিরে তাকালো৷ বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে উৎসবের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“মাথা ঠিক আছে আপনার? কিসব বলছেন?”

–“কি এমন বললাম? আমি শুধু বলেছি আমার বউকে আমি সাথে করে নিজের বাসায় নিয়ে যাবো।”

–“উঁহু, একদম না। ভুলেও এ কথা কাউকে বলতে যাবেন না৷ একেই তো হুট করে এসে বিয়ে করে ফেললেন এতেই প্রচুর শকে আছি৷ আর কোনো শক নিতে পারবো না আমি।”

উৎসব অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“কিন্তু আমি যে আমার বউকে ছাড়া আর থাকতে পারবো না।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
–“এতদিন তো দিব্যি ছিলেন। যেই আজ বিয়ে হলো অমনিই বলছেন বউ ছাড়া থাকতে পারবেন না।”

উৎসব অর্নিকে ঘুড়িয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো,
–“ইউ নো না? বিয়ের আগে শত শত বছর বউকে ছাড়া থাকা যায়। বাট বিয়ের পর একরাতও বউকে ছাড়া থাকা যায় না।”

অর্নি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
–“ছাড়ুন তো আমায়, এতসব বোঝার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।”

রাতের ডিনার সেরে উৎসব ওরা চলে গেছে। অর্নি মায়ের হাতে হাতে সব কিছু গোছগাছ করে নিজের রুমে চলে গেলো। উৎসব সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো ওকে। সবাইকে বলতেও চেয়েছিলো, কিন্তু অর্নি রাজি হয়নি। তাই উৎসবও জোর করেনি৷ এত দিন তো দূরে দূরে থেকেছে, থাকুক না আর কয়েকটা দিন ক্ষতি কি? আর ক’টা দিন যাক, ঠিকই কোনো না কোনো ভাবে অর্নিকে নিয়ে যাবে ও বাসায়। মনে মনে ভেবে রেখেছে উৎসব।

বিছানায় এসে গাঁ এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো অর্নি। রাতের খাবারটাও খেয়ে ঘুমায়নি। উৎসব ওরা খাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার জোরাজোরি করেছিলো কিন্তু অর্নি পরে খাবে বলে আর খায়নি৷ শপিং থেকে ফেরার সময় টায়রা আর অর্নি দুজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে পেটভর্তি খেয়ে এসেছে। তাই সে সময়ে ক্ষুধা ছিলো না। মাঝ রাত্রিরে ঘুম ভেঙে যায় অর্নির। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেয়ালঘড়িতে দেখলো দুইটা বাজে৷ পেটের মধ্যে ইদুর দৌড়াচ্ছে এখন। তাই কিচেনে চলে গেলো খাবার আনতে। ফ্রোজেন রুটি বের করে ভেজে নিলো। আর গরুর গোশত বের করে গরম করে নিলো। তারপর খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখলো উৎসবের অনেকগুলো মিসড কল। অর্নির ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। এই ছেলে নির্ঘাত বেশ চটে আছে ওর উপর ফোন রিসিভ না করায়। অর্নি ভাবলো ফোন দিবে। কিন্তু আবার মনে হলো উৎসব হয়তো ঘুমিয়ে আছে এখন ফোন দিলে ঘুম নষ্ট হবে। তাই টেক্সট করলো,
–“স্যরি, আপনারা যাওয়ার পরই সবকিছু গোছগাছ করে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর ফোনটাও সাইলেন্ট মুডে ছিলো তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি।”

অর্নি টেক্সট করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে উৎসব ফোন করলো। অর্নি বেশ অবাক হলো। এতরাত হয়েছে এখনো ঘুমায়নি? অর্নি দ্রুত ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে উৎসব বললো,
–“এদিকে আমার ঘুম হারাম করে ওপাশে মহারানী শান্তির ঘুম দিচ্ছিলো তাই না?”

–“স্যরি আসলে__”

–“ইট’স ওকে। এখনো জেগে কি করছো?”

–“ডিনার করছি___আপনি এখনো ঘুমাননি কেন সেটা বলুন?”

–“বউ পাশে না থাকলে ঘুম হয়?”

–“এই মাঝরাত্রিরে আপনার আবার শুরু হলো বাজে বকা?”

উৎসব ইনোসেন্ট গলায় বললো,
–“বাজে বকছি কোথায়? বিয়ে করেছি অথচ বউ পাশে নেই। বউয়ের থেকে দূরে আছি এটা কার ভালো লাগে বলো?”

–“এত কথা না বলে ঘুমান।”

–“আচ্ছা শোনো না__ভালোবাসি বউ।”

উৎসবের মুখ থেকে ‘ভালোবাসি বউ’ শুনে মুচকি হাসলো অর্নি। তারপর লাইন কেটে দিলো। উৎসবও মুচকি হেসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। এবার একটু শান্তিতে ঘুমানো যাবে। অর্নি খাওয়া শেষে প্লেট কিচেনে রেখে আবারো শুয়ে পড়লো। এখন ঘুম আসবে না কিছুতেই। তাই ফোন নিয়ে এফবিতে লগইন করলো। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করে ম্যারিড দিলো, সাথে উৎসবের আইডি অ্যাড করে দিলো। মূহুর্তেই লাইক কমেন্টস এ পোস্ট ভরে যাচ্ছে। অর্নি একেক জনের রিয়্যাকশন দেখে মুচকি হাসছে।

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here