#তোমাকে_চাই (০২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
সাহেরা বেগম ঘন্টা খানিক পরে আবার এলেন মেয়ের রুমে। মেয়েকে নিতে। কিন্তু অনন্যা থ হয়ে সেখানেই বসে আছে। জড়বস্তুর ন্যায়। পাংশুটে মুখে। অনুভূতিহীন হয়ে। জেদে কিংবা রাগের বশে অনেক কিছুই আমরা বলে ফেলি। আদৌও কি মন থেকে বলি কিংবা প্রিয় মানুষটাকে বলতে বলতে মন থেকে মুছে ফেলতে পারি? পারি না তো। অন্তঃস্থলে তার অস্তিত্ব রয়ে যায়। মস্তিষ্কে থাকে তার বাস।
তিনি এসেই তাগাদা দিয়ে বললেন,
‘ওরা তোকে দেখার জন্য বসে আছে। আর তুই এখনো রেডি হসনি? সেই কখন বলে গেলাম রেডি হতে।’
ফাঁকা ঢোক গিলে মায়ের দিকে তাকায় সে। টলমল চোখ। পলক ফেললেই বাঁধ ভাঙবে।
‘আমি কি বোঝা হয়ে গেছি আম্মু?’
‘না তো। কিন্তু সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে মা।’
‘আব্বু কি করে এই ঈদের দিন হুট করে পাত্রপক্ষকে আসতে বলে?’
‘হুট করে না তো মা। প্রস্তাব এসেছে পনেরো রোজার পর। তোর আব্বু এই কয়দিন ছেলে এবং ছেলের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছে। ভালো পরিবার। ছেলেও ভালো। ভালো পজিশনে জব করে। আর কোনো বাজে অভ্যাসও নেই। প্রত্যেক মা বাবাই এমন একজন ছেলে চায় তাদের মেয়ের জন্য।’
বলতে বলতে অনন্যার চুলগুলো বেঁধে দিলেন তিনি। পুনরায় বললেন,
‘এভাবেই মিষ্টি লাগছে তোকে।’ তারপর ঘোমটা টেনে বলেন ‘চল।’
পলক ফেলে অনন্যা। অপ্রাপ্তির অশ্রু স্পর্শ করে গাল। তার মা দেখার আগেই অতি সন্তর্পণে মুছে ফেলে সে।
সাহেরা বেগম একটু সামনে যেতে অর্পা অনন্যার হাত টেনে ধরে। আবদারের স্বরে বলে,
‘ওরা বেশি টাকা দিলে কিন্তু আমায় ওই হ্যান্ডপার্সটা কিনে দিতে হবে।’
বোনের দিকে অনিমেষ চেয়ে থেকে মলিন হাসে সে। তারপর পা বাড়ায় বসার ঘরের দিকে।
______________________
অনাকাঙ্ক্ষিত পাত্রের জায়গার তৌকির কে দেখে স্তব্ধ, হতভম্ব অনন্যা। চোখেমুখে হাজারও বিস্ময়। অবিশ্বাসের রেখা। বার বার মনে হচ্ছে অক্ষিভ্রম। অথচ তৌকির স্বাভাবিক। একজন অপরিচিত মানুষ যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবেই বসে আছে। তার আচরণও তেমন।
অনন্যা কে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা কাশলো তৌকির। হতভম্ব অনন্যাকে দেখে বেশ মজা পাচ্ছে সে। কাশির শব্দে সম্বিত ফিরে পেল অনন্যা। সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় সে।
মাথা নুইয়ে হাত কচলাচ্ছে। ব্যাপারটা না বোধগম্য হচ্ছে আর না বিশ্বাস। সবটাই কেবল অবচেতন মনের কল্পনা অনুভূত হচ্ছে।
‘আপনাদের যা জানার প্রশ্ন করতে পারেন।’
বলে উঠলেন অনন্যার বাবা আলী আকবর।
‘একজন শিক্ষিত মেয়েকে নাম, ঠিকানা এসব জিজ্ঞেস করা বোকামি। আমি এসব জিজ্ঞেস করবো না। আমার প্রশ্ন হাতে গুনা কয়েকটা।’
তারপর কোমল স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করেন,
‘মা, নামাজ পড়ো? রোজা রাখো?’
তৌকিরের মায়ের প্রশ্নে হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাকায় অনন্যা। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
‘একটা সংসার সামলাতে পারবে, মা? পুরো একটা সংসার নিজের মতো করে সুন্দর করে সাজাতে পারবে? পড়াশোনা নিয়ে আমার কিংবা আমাদের কারো আপত্তি নেই। সমাজে বাঁচতে হলে প্রতিটা মেয়েরই পড়াশোনা জানা জরুরি। আসলে ছেলের বাবা ছেলের উপর সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে অবসরে আছেন। আমিও আমার সমস্ত দায়িত্ব ছেলের বউয়ের উপর দিয়ে অবসরে যেতে চাই। পারবে সংসার সামলাতে?’
অনন্যা আড়চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকায়। এমন হুট করে তাকানোতে অপ্রস্তুত হলেন তিনি। খানিক বাদে মৃদু হাসলেন।
অনন্যা ঢোক গিলে। ধীর গলায় আওড়ায়,
‘আপনি একটু একটু করে দেখিয়ে দিলে সব পারবো।’
তাহেরা শেখ আর কথা বাড়ালেন না।
ঘটক তার পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের হাসলেন। একটা মিষ্টি টুক করে মুখে পুড়ে নিয়ে বলেন,
‘আমি আগেই বলছি মেয়ে লাখে একটা। এমন শান্তশিষ্ট মেয়ে আর পাবেন না।’
তারপর তৌকিরের বাবা জহির উদ্দীন কে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,
‘ভাই সাহেব, আপনার প্রশ্ন থাকলে করেন। যা প্রশ্ন করবেন মেয়ে মাশা-আল্লাহ সব উত্তর দিতে পারবে।’
‘আমার কিছু জানার নেই। ছেলের বউ সব সময় থাকবে তার শ্বাশুড়ির সাথে। আমি যেমন খাঁটি সোনা এনেছি। সেও আমার ছেলের জন্য খাঁটি সোনাই আনবে।’
‘তারপরও আপনার কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন।’
আলী আকবর কথায় তিনি না বোধক মাথা নাড়েন। অর্থাৎ উনার কোনো প্রশ্ন নেই।’
‘তাহলে ছেলে মেয়ে দু’জনকে আলাদা করে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। ওরা নিজেদের মতো করে কিছুক্ষণ কথা বলুক।’
ঘটকের কথায় সায় জানালো সবাই । আলাদা করে কথা বলার জন্য অনন্যার রুমে পাঠানো হলো দুজনকে।
_______________________
সময় গড়ালো। অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই। অনন্যা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। হাত ভাঁজ করে অভিমানী মেয়েটাকে দেখছে তৌকির। যে ভুল করেও তার দিকে তাকাচ্ছে না। বুঝলো অভিমানের দরজা খুব শক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
‘আপনি কি বিয়ে তে রাজি না? আপনার পরিবার কি কোনো প্রকার জোর করছে? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিয়েতে রাজি না। আপনি কাউকে ভালোবাসেন?’
তৌকিরের কন্ঠে শ্লেষ, রসিকতার ছোঁয়া।
তৌকিরের খোঁচা দেওয়া কথা শুনেও কোনো হেলদোল নেই অনন্যার। গম্ভীর মুখ অন্যদিকে চেয়ে আছে।
তপ্ত শ্বাস ফেলে তৌকির।
‘রাগ কমেনি এখনো?’
এবারেও নীরব অনন্যা।
‘আমি জানি তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। কিংবা ঠকে যাওয়ার ভয় থাকাটাও স্বাভাবিক । আজকাল প্রেমিকরা কিছু একটা করার সাথে সাথে প্রিয় মানুষটাকে বধূ সাজিয়ে ঘরে তুলে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন।’
অনন্যা এবারে মুখ তুলে তাকায় তৌকিরের মুখের দিকে। তৌকির পুনরায় বলে,
‘তোমায় কখনো বলা হয়নি। আজ বলছি কিছু কথা। আমি এসএসসি দেওয়ার কয়েকমাস আগে বাবার বড় ধরনের এ*ক্সি*ডেন্ট হয়। বাবার অবস্থা আশংকাজনক ছিল। কেউ ভাবেনি বাঁ*চবে। আমাদের ভিটে সাথে কিছু জমি বন্ধক রেখে বাবার অপারেশন করা হলো। অসুস্থতার বাবার চাকরি চলে গেল। সেই থেকে নামে আমাদের পরিবারে নামে ধ্বস। শুরু হয় আর্থিক টানাপোড়েন। বাবার পিছনে জমানো সব অর্থ শেষ হয়ে গেল। বাবার সাথে সাথে থাকতে গিয়ে আমার আর এসএসসি দেওয়া হলো না। রেজাল্টের দিন সবাই যখন হাসি মুখে বাড়ি ফিরছিল আমি তখন মন খারাপ করে বসে ছিলাম। রেজাল্ট আমারও পাওয়ার কথা ছিলো। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাবা আমায় বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন।’
অতীত মনে করে গলা ভারী হয় তৌকিরের। খানিকক্ষণ চুপ থাকল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। একটু স্বাভাবিক হতে আবারও বলতে লাগল,
‘বলেছিলেন আমি জীবনে অনেক বড় হবো। এরপর থেকে শুরু হয় আমার জীবনের লড়াই। আমার পড়াশোনা কিংবা চাহিদার প্রেশারটা অসুস্থ বাবাকে দিতাম না৷ ওই বয়সে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। টিউশনি করে খরচ চালাতাম। সাংসারিক টানাপোড়েনেও এই পর্যন্ত এসেছি। এখনো বাবা ঔষধ খেলে ভালো থাকে। না হয় যন্ত্রণায় কাতরায়। অনার্সের ফাইনাল ইয়ারে খবর পেলাম বন্ধকের টাকা না পেলে চাচা বাড়ি বিক্রি করে দিবেন। আমি বাবাকেও কিছু বলেনি। সোজা চাচার পায়ে পড়ে রইলাম। বললাম যে করেই হউক আমি সব শোধ করবো।তারপরও যেন কাউকে আমাদের ভিটে বিক্রি না করে। চাচা বললেন, “তুই এত টাকা কোথায় পাবি?” চোখ বন্ধ করে বলেছিলাম, “আমার বাবা দোয়া করেছে আমি জীবনে অনেক বড় হবো।” এরপর অনার্স শেষ করার সাথে সাথে চাকরিটা কিভাবে যেন হয়ে গেল। এতটুকু বুঝেছিলাম সব আল্লাহর রহমত। আল্লাহ কাউকে ভাতে মা*রে না। সেই থেকে প্রতি মাসে একটু একটু করে চাচার সমস্ত ঋণ শোধ করছি। আর বছর দেড়েক কিংবা দুই বছর টাকা দিলে মোটামুটি একটা লাইনে চলে আসবে সব। বাবা এসবের কিছুই জানে না। ভিটের দলিলটা আমি বাবাকে কোনো এক বিশেষ দিনে উপহার দিতে চাই। আমি আমার বাবার খুশিটা দেখতে চাই। কেননা বাবা ওই ভিটের আশা ছেড়ে দিয়েছে। আমি চাইনি আমাদের টানাপোড়েন তুমি দেখ। তাই কখনো এসব নিয়ে তোমার সাথে আলোচনাও করিনি। একটা চিন্তা মুক্ত সংসার দিতে চেয়েছিলাম তোমায়। কিন্তু তুমি তো তুমি। আমার কাছাকাছি আসার জন্য বড় উতলা হয়ে আছো। বয়স বেশি বলে আমি তোমায় দূরে ঠেলে দিবো না। দূরে ঠেলে দিবো বলে ভালোবাসিনি আমি।’
অনন্যা গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ এই কয়দিনে সমস্ত টানাপোড়েন শেষ?’
‘না তো।’
‘তবে বিয়ে করতে এলে যে?’
‘এসেছি, কারন আমার একজন সহযোদ্ধা প্রয়োজন। একজন সহযোগী প্রয়োজন। একজন সহধর্মিণী প্রয়োজন। যে আমায় বিপদে ভরসা দিবে। সাহস যোগাবে। যার সান্নিধ্যে আমি একটু স্বস্তি পাবো। সমস্ত দুশ্চিন্তা সাইডে রেখে যাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালে একটু মানসিক শান্তি পাবো। একা একা লড়াই করতে করতে ক্লান্ত আমি।’
ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনন্যা।
‘নির্লজ্জের মতো উনাদের কাছে গিয়ে বলেছো বিয়ের কথা?’
হাসে তৌকির।
‘মায়ের সাথে অনেকটা ফ্রী আমি। মাকে একটু ইঙ্গিত দিলে বুঝে যায়। সেদিন রাস্তায় রাগারাগি করার পর ভীষন রাগ হয়েছিল আমার। সবার সামনে এতো পাগলামি করায় অভিমানও হয়েছে। রাতে ঠান্ডা মাথায় তোমার দিকটা ভাবলাম। তুমি তোমার জায়গায় ঠিক। আমার টানাপোড়েনের কথা চিন্তা করে তোমায় অপেক্ষা করালে তো চলবে না। মাকে শুধু এতটুকুই বলেছি ছোট্ট জীবনের এই লড়াইয়ে আমার একজন সহযোদ্ধা প্রয়োজন। ব্যস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমার কথা জেনে নিলো। তারপর ঘটক ধরে তোমাদের বাড়ি প্রস্তাব পাঠায়। তোমার ঈদের আনন্দকে দ্বিগুণ করার জন্য আমি এবং আমার পরিবার হাজির। বাবা মাকে একটা কথা বলেছে একটু আগে। মনে আছে? আমার খাঁটি সোনা। এই কথাটা কিন্তু সব স্বামী তার স্ত্রীকে বলে না কিংবা বলতে পারে না।’
অনন্যার পাশে গিয়ে বসে তৌকির।
‘তুমি জানো আমার মা আসলেই খাঁটি সোনা। বাবার যা অবস্থা ছিলো অন্যকেউ হলে হয়তো ফেলে চলে যেতো। এতো অভাব অনটনের মাঝেও মা এটা ওটা করে সংসার টিকিয়ে রেখেছে। বাবার যত্ন নিয়েছে। কোনোদিন টু শব্দ করেনি।’
অনন্যার হাতটা শক্ত করে ধরে তৌকির। হাতের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,
‘অনন্যা, আমিও কোনো এক সময় বুক ফুলিয়ে বলতে চাই তুমি আমার খাঁটি সোনা। হবে আমার খাঁটি সোনা? হবে আমার সহযোদ্ধা? আমার সহধর্মিণী? আমার মনের রাণী? হাজারো বিপদের মাঝে একটু আশ্রয়স্থল?’
টলমল চোখ অনন্যার। এই অশ্রু কষ্টের না। আর না অপ্রাপ্তির। এই অশ্রু সুখের। এই অশ্রু তৃপ্তির। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দের। কল্পনাকে বাস্তবে রূপে দেখবে সেই খুশির।
তৌকিরের চোখে চোখ রাখে সে। স্থির চোখের মনি। টলমল চোখে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো সে।
‘তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। ফিরিয়ে দিলে যে নিজের প্রতি নিজের অবিচার করা হবে।’
বিস্তর হাসল তৌকির। সম্পর্কটার একটা নাম হবে সেই আনন্দে। বুকের বা পাশে অনন্যার হাতটা রাখে। চোখ বুঁজে বলে,
‘যদি শারীরিক সৌন্দর্য বিলীন হয়ে শরীরের রূপ হয় যাচ্ছেতাই,
তারপরও বলবো আমার কেবল তোমাকে চাই।
যদি এই জনমের পরে থাকে আরো কোনো জনম আর বিধাতা দেয় ঠাই,
সেই জনমেও আমার কেবল তোমাকেই চাই।
একসাথে বৃদ্ধ হওয়ার পরে ভাঁজ পড়া হাতে হাত রেখে বলতে চাই ,
আমার শুধু তোমাকেই চাই।’
___________________সমাপ্ত___________________