তোর নেশালো শহরে পর্ব ১২

#তোর_নেশালো_শহরে
#Eshika_Khanom
Part: 12

মুখে পানির ছিটা পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠল এরোন। যথেষ্ট চমকে গিয়েছে সে। এরোন তার আশেপাশে তাকালো, তাকিয়ে শুধু এরিককেই দেখতে পেল। এরিক দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে এরোনের দিকে। এরিকের চোখমুখ ফোলা লাগলো তার কাছে, মনে হয় এরিক অনেক কেদেছে। এরোন আশেপাশের আরেকবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
আমি কি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম?
-হুম গভীর ঘুমে ছিলি মনে হয়।
-ওহ তার মানে ওটা স্বপ্ন ছিল।
-কি স্বপ্ন?
-আরে আমি একটু আগে দেখছিলাম মিহি হঠাৎ করে নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। ডক্টর বলছিল মিহি নাকি কোমায় চলে গিয়েছে।
-বেশি দুশ্চিন্তা করেছিলি তাই এমন বাজে স্বপ্ন দেখেছিস তুই।
-তাই হবে। মিহি কোথায়?
-নামাজের ঘরে।
-নামাজ পড়ছে?
-হুম।
-তুই পড়েছিস?
-হ্যাঁ আমিও পড়ে নিয়েছি। তুইও যা পড়ে নে নামাজ।
-হুম যাই, খেয়াল রাখিস এদিকটার।
-তা তো রাখবই।
-আর তোরা খেয়েছিস?
-না খাইনি আমরা। তুই নামজ পড়ে আয়, একসাথে খাব।
-ঠিক আছে। আর রাহির কি অবস্থা এখন?
-আল্লাহর রহমতে রাহির জ্ঞান ফিরেছে। রাহিকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। ওকে নার্স খাইয়ে ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। এখন রাহি অনেকটা সুস্থ। ডক্টর বলেছেন দুইদিন রাহিকে এখানে রাখবে তারপর ডিসচার্জ করে দিবে।
-আলহামদুলিল্লাহ।
-যা নামাজে নাহলে ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে।
-হুম যাচ্ছি।

এরোন চলে গেল নামাজ পড়তে। এরিক রাহির কেবিনে ঢুকে ওর পাশে গিয়ে বসে রইল। মন দিয়ে এরিক রাহিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। গোলাপী দুই ঠোঁট, টানা টানা চোখ, গালে ছোট একটা তিল আর হালকা কোকড়া চুল, রাহি যেন নিশ্চিত এক স্বর্গ থেকে প্রেরিত অপ্সরা। মিহি আর রাহিকে পার্থক্য করা যায় তাদের চুল দিয়ে। মিহির চুল কোকড়া নয় তবে রাহির চুল হালকা কোকড়া। এরিকের হৃদয় ছুয়ে গেল রাহির সৌন্দর্য। ঘুমের মধ্যে থাকা রাহির মিষ্টি চেহারা এরিকের বুকে তীরের মট বিধলো। খুব ইচ্ছে হল এরিকের রাহিকে একটি ছুয়ে দেখার। রাহির কপালে থাকা চুলগুলো আস্তে করে সরিয়ে দিল এরিক। এরপর এরিক রাহির কপালে তার অধর ছুয়ে দিল। রাহির এক হাত নিজের হাতের মধ্যে বন্দী করে নিজের বুকে নিয়ে রাখলো।

আর কতক্ষন এখানে এভাবে জায়নামাজে বসে থাকবে তুমি? মিহিকে প্রশ্ন করল এরোন।
-আমার যতক্ষন ইচ্ছে।
-এখন একটু চলো না আমার সাথে প্লিজ।
-কোথায় যাব?
-আমার খুব খিদে পেয়েছে, চল ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নিই।
-আমার তো খিদে লাগেনি, আপনি খেয়ে নিন।
-এরিকও খায়নি, একসাথে খাবে, চলো না প্লিজ সোনা।
-সোনা?
-হুম সোনা।
-আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে একটা ধাতব পদার্থ মনে হয়?
-মানে?
-সোনা তো ধাতুই তাইনা। এটা মুদ্রা ধাতু।
-আরে ধ্যাত মেয়ে এই সোনা ওই সোনা না।
-তবে কোন সোনা?
-সেটা এখন বুঝাতে পারবা না সোনা। এখন এসব বাদ দাও, চল আমার সাথে।
-আচ্ছা জায়নামাজটা গুছিয়ে রাখি তারপর যাই।
-ঠিক আছে।
____________________________

মামি এরিক কোথায়? আফিয়াকে প্রশ্ন করল হিয়া।
-এরিক তো হাসপাতালে।
-কি হয়েছে এরিকের? ও হাসপাতালে কি করে?
(উত্তেজিত হয়ে)
-আহারে হিয়া এতো চিন্তা করো না। এরিকের কিছু হয়নি। রাহি এক্সিডেন্ট করেছে তাই রাহির সাতগে এরিক, এরোন আর মিহি আছে।
-এরিক কেন ওখানে? ওর বোন আছে না? ওর বোন মিহিই থাকুক না ওর সাথে। এরিককে কি পেয়েছে ওরা দুইজন? এরিককে আর এরোন ভাইয়াকে সাথে নিয়ে ঘুরে কেন ঘুরে ম্যাডামরা?
-ঠিক করে কথা বল হিয়া। এরিক প্রথমত রাহির বন্ধু, তারপর আবার খালাতো ভাই। এরোনও রাহির খালাতো ভাই। ওরা দুইজন সাথে থাকবে না তো কে থাকবে?
-তোমার কি সত্যিই মনে হয় মিহি আর রাহি এরোন ভাইয়া আর এরিককে খালাতো ভাই মনে করে?
-সেটা তাদের ব্যাপার। যদি নাও মনে করে তবে তো কোনো সমস্যা নাই। আমি জানি এরোন মিহিকে ভালোবাসে।
-কি? (অবাক হয়ে বলল হিয়া)
-হুম এরোন মিহিকে ভালোবাসে। আর আমি যতটুকু বুঝতে পারি রাহি আর এরিকও একে অপরকে ভালোবাসে। তাই তারা যদি নিজের ভালোবাসাকে আপন করে পেতে চায় তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই।
-মামি এসব কি বলছ তুমি? তুমি জানো আমি এরিককে ভালোবাসি।
-মারে আমিও জানি তুই এরিককে ভালোবাসিস। কিন্তু দেখ রাহি আর এরিক একে অপরকে ভালোবাসে। যদি তোর সাথে আমি এরিকের বিয়ে দেই তাহলে তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
-মামী তুমি এটা করতে পারোনা। এরিক শুধু আমার, তুমি এরিক আর রাহির বিয়ে দিতে পারো না।
-হিয়া বুঝার চেষ্টা কর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি রাহি সুস্থ হিয়ে ফিরলে আগামী সপ্তাহেই এরোন মিহি আর এরিক রাহির বিয়ে দিয়ে দিব।
-তুমি এরোন ভাইয়া আর মিহির বিয়ে দিয়ে দাও, দরকার পড়লে আজই দিয়ে দাও আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু এরিক শুধু আমার, শুধুই আমার। ( চিৎকার করে)
-আওয়াজ নিচু কর হিয়া। (ধমকের সুরে বললেন আফিয়া)

তখন রুমে প্রবেশ করল হিয়ার না হেনা। সে বলল,
কি হয়েছে হিয়া? আমি তোমার গলার আওয়াজ এতো দূর পর্যন্ত পাচ্ছি কেন? তোমার সাহস কি করে হয় তোমার মামীর সাথে এভাবে কথা বল
হিয়া উত্তরে বলল,
আমি এখন জোরে কথা বললেই দোষ তাইনা আম্মু? তোমার আর মামীর না কথা হয়েছিল এরিক আর আমার বিয়ে দিবে? তাহলে আজ কেন মামী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী সপ্তাহে এরিক আর রাহির বিয়ে দিবে।
হেনা অবাক হয়ে বলল, এসব কি শুনছি আমি ভাবি? হিয়া এসব কি বলছে?
আফিয়া বললেন, হিয়া যা বলেছে ঠিকই বলেছে। আমি আগামী সপ্তাহে এরোন মিহি আর এরিক রাহির বিয়ে দিব বলে ঠিক করেছি।
হেনা তার মেয়ে হিয়াকে বলল,
হিয়া তুমি তোমার রুমে যাও। আমি আর ভাবি ঠান্ডা মাথায় এই ব্যাপারে কথা বলছি।
হিয়া বলল, না আমি কোথাও যাব না। যতক্ষন না তোমরা আমায় শিউর করছ যে আমার সাথেই এরিকের বিয়ে দিবে সেটা না করা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।
হেনা এবার হিয়ার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় দিল। তারপর বলল,
এই মেয়ে তোকে বলেছি না আমি এখানে থেকে চলে যেতে। যা নিজের রুমে যা।

হিয়া কাদতে কাদতে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে গিয়া দরজা লাগিয়ে ভাঙচুর করতে লাগলো। চিৎকার করে কাদতে লাগলো সে। এভাবে কিছুক্ষন থাকার পর বাথরুমে চলে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে শাওয়ারের পানির নিচে বসে নিজের চুল টেনে ধরে কাদতে লাগলো।

অন্যদিকে হেনা আফিয়াকে বললেন,
আমার মেয়ের গায়ে আজ হাত তুলতে বাধ্য হয়েছি ভাবি আজ আমি। মেয়েটা এখনো কাদছে তা আমি জানি। আমার নিজের হাত নিজেরই কেটে ফেলতে ইচ্ছা করছে ভাবি হিয়াকে মারার জন্যে। তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনো ভাবি, আমার মেয়েটার সাথে এমন করো না। মেয়েটা শেষ হয়ে যাবে। পাগল হয়ে যাব আমার হিয়া। এরোনের বউ মিহিকে কর তাতে আমার সমস্যা নাই তবে নিজের ছোট ছেলের বউ হিসেবে আমার মেয়েটাকে মেনে নাও। আমি তোমার পায়ে ধরি ভাবি।

এই বলে হেনা ফুপ্পি কাদতে কাদতে আফিয়ার পায়ে ধরতে বসল। আফিয়া দূরে সরে গিয়ে হেনাকে উঠিয়ে বলল,
কি করতে যাচ্ছিলে এটা তুমি হেনা? পাগল হয়ে গেলে নাকি?
-ভাবি প্লিজ আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিও না।
-কিন্তু আমি এরিককে কথা দিয়েছিলাম হেনা। আমার ছেলেটা রাহিকে ভালোবাসে আর রাহিও এরিককে ভালোবাসে। তোমার মেয়ের ভালোবাসা তো একতরফা, একতরফা ভালোবাসা নিজের জীবনে ধ্বংস বয়ে আনে হেনা। আমি তিনটে জীবন নিজের চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেই কিভাবে তুমি বলো?
-তার মানে তুমি আমার কথা শুনবে না? আমার মেয়েটার কথা ভাববা না তোমরা?
-আমার হাত পা বন্দী হেনা। আমার কিছু করার নাই।
– আমি ভাইকে বলব। ভাইয়াই এর সিদ্ধান্ত নিবে।
– তোমার ভাইয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে হেনা। তোমার ভাইই এটায় পূর্ণ মত দিয়েছে।
– ভাইয়াও এমন করল? বাহ খুব ভালো।
আফিয়া হেনার কাধে হাত রেখে বলল, আমদের ভুক বুঝো না হেনা।
হেনা আফিয়ার হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বলল, আর কি বুঝাবুঝির আছে ভাবি? পা ধরতেও গিয়েছিলাম তোমার তবুও তুমি শুনলে না। আর ভাইয়া? ভালোই হাত করেছ ভাইয়াকে।
-হেনা আমার কথা শুনো।
-আর কিছু শুনার নাই আমার ভাবি। অনেক হয়েছে। থাকো তোমার ছেলে আর ছেলের বউদের নিয়ে তুমি।

হেনা চলে গেল আফিয়ার রুম থেকে। সে হিয়ার রুমে গিয়ে দেখলো সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে রেখেছে হিয়া। খুব খারাপ লাগলো তার নিজের মেয়েটার জন্যে।সে যতই সম্পত্তির জন্যে এরিকের সাথে হিয়ার বিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু হিয়া তো এরিককে সত্যি ভালোবাসে।
__________________________

এখন কেমন লাগছে রাহি? রাহির জ্ঞান ফেরার পর যখন সে একটু বসল তখন রাহিকে প্রশ্ন করল মিহি।
-আপি তুমি দোয়া করেছ আর আমি সুস্থ না হয়ে থাকতে পারি?
-শুধু আমিই তো একা দোয়া করিনি রাহি। এরিক অনেক কেদেছে তোর জন্যে।
-হুহ কুমিরের কান্না।
-উহু, একদমই না। এরিকের চোখে আমি যে তোর প্রতি ভালোবাসা দেখেছি সেটা কি তুই দেখতে পারিস না?
-না পারি না। ( অভিমানী কন্ঠে)
-পারিস পারিস, শুধু আমাদের দেখাতে ইচ্ছে হয় না।
-একদম বাজে কথা বলবা না তো।
-এটা বাজে কথা?
-হুম এটা বাজে কথা।
-আচ্ছা তুই কেন এরিকের প্রতি এতো রেগে আছিস বল তো?
-কোনো কারণেই না।
-বোন রে আমি নিজেও দেখতে পারি তোর চোখে এরিকের প্রতি ভালোবাসা।
-তোমার চোখে সমস্যা আছে, ডক্টর দেখাও। (অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে)
-এদিকে তাকা, শুন আমার কথা। (রাহির মাথা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল)
-বল (চোখ নিচের দিকে নামিয়ে)
-কি হয়েছে তোদের মধ্যে? আর তুই এরিককে সবার সামনে থাপ্পড় মেরেছিলি কেন?
-আমায় অশ্লীল চিরকুট লিখার জন্যে।
-এরিক লিখেছে?
-হুম।
-এতো শিউর কিভাবে?
-শেষে E লিখা ছিল।
-তো?
– কি?
– E দিয়ে কি শুধু এরিকেরই নাম? এরোনের নামও তো সেটা দিয়েই শুরু।
– কিন্তু এরিকই লিখেছে ওটা।
– কেন তোর মনে হয় ওই লিখেছে?
– কারণ ও আমায় প্রপোজ করেছিল আর আমি রিজেক্ট করেছি।
– যাহ এরিক এটা করতেই পারেনা।
– পারে।
– কেন?
– আমি ওকে রিজেক্ট করেছি যে।
– কেন রিজেক্ট করেছিস?
– ও হিয়াকে জড়িয়ে ধরে থাকলে, ওর হিয়ার সাথে সম্পর্ক থাকলে আমি কি করব আর?
– ও হিয়াকে জড়িয়ে ধরেছিল? তুই ঠিক দেখেছিস?
– হুম হিয়া এরিককে জড়িয়ে ধরেছিল।
– এরিক ধরেছিল?
– উম নাহ।
– তাহলে? এরিক তোকেই ভালোবাসে। হিয়াকে নাহ।
– তুমিতো সবজান্তা তাইনা?
– উহু তবে আমি আমার বোন আর এরিকের মনজান্তা।
– আচ্ছা ঠিক আছে। এবার চুপ থাকো তো।
– হ্যাঁ একদিন কথা বলার জন্যে আমায় পাবিই না।
– আপুউ?
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি চুপ।
– না কথা বল।
– নাহ ( গাল ফুলিয়ে)
– বল না?

রাহি মিহিকে এবার জড়িয়ে ধরে। তারপর সুরসুরি দিতে থাকে। তারপর দুজনেই হেসে দেয়। এরপর আবার গল্প করতে থাকে। আর তাদের দূর থেকে কাধে কাধ মিলিয়ে দেখতে থাকে দুই জোড়া চোখ। এরোন আর এরিক মিষ্টি হাসতে থাকে এদের দুই বোনের খুনসুটি দেখে।

চলবে…….

(কাল ব্যস্ততার জন্যে গল্প দেইনি। তাই আজ আগের চেয়ে একটু বড় করে গল্প দিয়েছি। পরীক্ষা দিয়ে এসে লিখেছি। জানিনা কেমন হয়েছে? জানানোর দায়িত্ব আপনার। টাটা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here