-‘আমরা যে তোমার জন্য এত করছি তার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে? আর কবে তুমি শোধরাবে! আর কতবার বোঝাতে হবে!’
নিজের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে রাগে গজগজ করতে করতে কথাটা বললেন আরাফাত হোসেন।
আজকে খাবার টেবিলেই জনাব আরাফাত হোসেন আর তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম নিজেদের মধ্যে ছোট একটা বিষয় নিয়ে ঝ’গ’ড়া শুরু করেছিলেন। তবে এখন সেটা সেই ছোট বিষয়ে সীমাবদ্ধ নেই। এখন সেটা চলে গেছে তাদের অতি আদরের কন্যা চমচমের পড়ালেখার দিকে।
স্বাভাবিক ভাবেই বাবা-মা নিজেদের একটা বিষয় নিয়ে ঝ’গ’ড়া করছিল। হঠাৎ করেই নিজের পড়ালেখার দিকে তা আসাতে চমচমের খাওয়া থেমে গেল। সামনেই তার টেস্ট পরীক্ষা। অথচ সে পড়ছে না। বাবা-মা এতক্ষণ একে অন্যের বিপক্ষে ছিলেন। হঠাৎ করেই দুজন তেলে জ্বলে মিল খেয়ে গিয়ে চমচমকে ধরেছেন। চমচমের খাওয়া শেষই বলা চলে। কিন্তু চা টা এখনও খাওয়া হলো না। এদিকে চা না খেলে আবার তার সারাদিন ভালো কাটবে না। আবার এখানে বসে থাকলেও বাবা-মায়ের কথার আগু’নে ঝ’ল’সে যাবে। বাবা-মায়ের একের পর এক অ’প’মা’ন’জ’নক কথা তার এক কান দিয়ে ঢুকছে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চা জিনিসটা বেরই হচ্ছে না মাথা থেকে। তাই সে কাপে চা ঢেলে নেয়। এক চুমুক মুখে দিতেই আনন্দে আহা করে ওঠে তার মন প্রাণ!
তাকে নিশ্চিন্তে চা খেতে দেখে তার মা বললেন,
-‘দেখেছ চিনির বাবা! তোমার মেয়ে কীভাবে চা খাচ্ছে। ওরে! তোর কানে কি ঢুকছে না আমাদের কথা!’
শেষ কথাটা বলেই মা চমচমের মাথায় একটা গাট্টা মা’র’লেন। এতে নাকে মুখে চা উঠে আসে চমচমের। কেঁশে একাকার অবস্থা হয় তার। বাবা-মা দুজনেই এবার বকাঝকা ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মা প্রায় কেঁদে দিবেন এই অবস্থা। পরিস্থিতি একটু ভালো হতেই বাবা চমচমের মাথায় হাত বুলিয়ে একশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে নিজের অফিসে চলে গেলেন। মাও কপালে চুমু খেলেন।
মুহূর্তেই বাসার গরম পরিস্থিতি হীম শীতল হয়ে গেল। একশ টাকা পেয়ে চমচমের এত আনন্দ লাগছে! সে মাকে বিদায় দিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো।
নিচে নামার পরই তার দেখা হলো মেহেদীর সাথে। তাদের পাশের বিল্ডিং এ থাকে মেহেদীরা। তারাও ছয় তলায়, চমচমরাও। মেহেদী তাকে দেখে বলল,
-‘এই চমচম শোনো তো!’
চমচমের বি’র’ক্ত লাগল। সে কথা বলতে চাইছেনা মেহেদীর সাথে। তবুও মেহেদী কথা বলবেই। আর মেহেদীর কথা শুনতে তার বি’র’ক্ত লাগে। কারণ মেহেদীর এক কথা, ‘চিনি কেমন আছে?’, ‘আজকে চিনিকে দেখলাম না, কোথায় ও?’, ‘চিনির কি মন খা’রা’প? না মানে সকালে ডাকলাম সাড়া দিল না।’
চিনি চমচমের বড় বোনের নাম। আর চিনিকে মেহেদী পছন্দ করে। চিনি তো মেহেদীকে দুই চোখে দেখতেই পারে না। চমচম একটু হলেও দেখতে পারে। কেননা, চিনির বদৌলতে সে মেহেদীর থেকে ছোট খাটো ট্রিট পায়। অবশ্য সেটা চিনি জানে না। চিনে জানলে চমচমের ঠ্যাং ভে’ঙে দিবে। চমচম মুখে মেকি হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
-‘কি খবর মেহেদী ভাইয়া?’
-‘আমার খবর তো ভালোই। কিন্তু তোমাদের খবর ভালো তো! না মানে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চিৎকার চেঁচামেচির শুনলাম। চিনিকে বকা ঝকা করা হলো নাকি?’
চমচমের এবার বেশিই বি’র’ক্ত লাগল। মনে মনে বলল, ‘লোকের ঘরে কি হচ্ছে তোর জানার কীরে! তুই কি এখন পাশের বাসার দ’জ্জা’ল আন্টি হবি নাকি? অবশ্য তুই বিল্ডিং এর। আন্টি না হলেও আন্টির ছেলে তো! স্বভাব আর কত ভালো হবে!’
তবুও মুখে বলল,
-‘না না। আপাকে কি কখনো বকে নাকি! আমাকেই বকছিল।’
-‘ওহ। এটাই আন্দাজ করছিলাম। তবুও মনটা আনচান করছিল। বোঝোই তো! চিনিকে আমি কতটা ভালোবাসি!’
-‘জ্বি জ্বি।’
-‘তা তোমাকে বকেছে কেন? আবার কোনো কা’ন্ড ঘটিয়েছ? নাকি পড়ালেখা করছ না! কোনটা?’
-‘দ্বিতীয়টা।’
-‘আহা! তোমাকে কতবার বলব একটু পড়ালেখা করো মন দিয়ে! চিনির বোন হয়েও কেন তোমার এই অবস্থা পড়ালেখা নিয়ে? শোনো! এসব দু’ষ্টমি ছাড়ো আর পড়তে বসো। সামনেই এইচএসসি না?’
-‘হুম।’
-‘মন দিয়ে পড়ালেখা করবে। গোল্ডেন জিপিএ পেতেই হবে। যাও এখন কলেজে যাও। রিকশা ডেকে দিব! দাঁড়াও একটা রিকশা ডেকে দেই!’
-‘না না রিকশা লাগবে না। আমার আরেকটা বান্ধবী আসবে ওর সাথেই যাব। এই তো একটু সামনে গেলেই ওদের বাসা।’
-‘আচ্ছা সাবধানে যেও।’
মেহেদী চলে গেল। আর চমচম ফট করে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। রা’গে তার দাঁত কিড়মিড় করছে। আর সে এই ই’ত’রের সাথে কথা বলবে না। এত বড় সা’হ’স এই মেহেদীর! তার পড়ালেখা নিয়ে কথা শোনায়!
——————
আজকের দিনটাই ভালো কাটল না চমচমের। সকাল থেকেই তার পেছনে ঝা’মে’লা বাবা লেগে রয়েছে। কলেজেও আজকে প্রথম পিরিয়ডে পড়া না পারায় দাঁড়িয়ে ছিল, শেষ পিরিয়ডে কথা বলায় মা’র খেয়েছে।
কলেজ থেকে বের হতে কোনো রিকশাও পেল না। এই গরমের মধ্যে হেঁটে আসতে হলো এতটা পথ! গেইট দিয়ে ঢুকতেই পাশের বিল্ডিং থেকে ডাক পড়ল। তাকিয়ে দেখল মেহেদীদের বাড়িওয়ালী নিগার আন্টি ডাকছে। তিনি চমচমদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হোন। চমচমকে ভীষণ আদর করে। চমচমের দ্বিতীয় মা বলা যায় তাকে। তাকে দেখে চমচমের মুখে হাসি ফুটল। নিগার খানম চমচমকে বললেন,
-‘এই চমচম! এত দেরি করলি কেন আজকে? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। বিরিয়ানি করেছি। গরম গরম আছে এসে খেয়ে যা। জলদি!’
-‘আসছি!’
চমচমের ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু নিগার খানমের মুখের উপর না বলতেও ইচ্ছা করছিল না। আন্টি আবার খুব ইমোশনাল। দেখা গেল ক’ষ্ট পেয়ে বসে আছেন এই ছোট ব্যাপার নিয়ে।
বাসায় এসে গোসল নিয়ে হালকা গোলাপী রঙের একটা সুঁতি থ্রী পিস পরে নিল। আজকে কেন যেন একটু থ্রী পিস পরার ইচ্ছে জেগেছে। অন্যদিন সে কুর্তি, টি-শার্টই পরে।
মাকে বলে বাসা থেকে বের হয়ে সে পাশের বিল্ডিং এ আসে। সেই বিল্ডিং এর সামনের বিশাল জায়গা জুড়ে লেখা ‘Snow Drop’। এই বিল্ডিং এর নামটা চমচমের বেশ ভালো লাগে।
চার তলায় এসে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেল। নিগার খানম চমচমকে দেখে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-‘মা শা আল্লাহ্! আমার চমচমকে আজকে কত সুন্দর লাগছে। আমার তোকে এই থ্রী পিসেই ভালো লাগে। কেন যে ওসব প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে ঘুরিস!’
চমচম মৃদু হাসে। নিগার খানম তাকে টেনে নিয়ে গেলেন ডাইনিং এ। সেখানে আগে থেকেই আইমান, অনামিকা বসা ছিল। চমচমকে দেখে দুজনেই মিষ্টি হাসে। অনামিকা বলল,
-‘চমচি! কি দারুন লাগছে আজকে তোকে। ঘুরতে বের হবি? আমরা সবাই বের হবো।’
আয়মান ও বলল,
-‘হ্যাঁ, চল না চমচম। তুই সাথে গেলে মজা হয়।’
অন্যসময় হলে চমচমকে বলা লাগত না। নিজেই জোর করত যাওয়ার জন্য। তবে আজ মনটা ভালো নেই। তাই বলল,
-‘না যাব না।’
তখনিই ওপর থেকে আব্রাহাম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,
-‘বাহ! তুই যাবি না? মানা যাচ্ছে না ব্যাপারটা। তোর কাজই অন্যদের ঘুরতে যাওয়াতে বা পা ঢোকানো। তুই যাবি না তা হয়?’
চমচম অবাক চোখে আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ব’দটা এখন বাসায় কি করছে! বলল না এক মাস হলে থাকবে! সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আজকের দিনের সবচেয়ে বা’জে পরিস্থিতির সামনে সে পড়েছে এখন।
নিগার খানম চমচমের প্লেটে বিরিয়ানি তুলে দিয়ে বললেন,
-‘ওর কথা শুনিস না তো! জানিসই তো তোকে রা’গানোর জন্য বলে এসব।’
-‘হু জানি।’
আব্রাহাম এসে চমচমের সামনের চেয়ারটা টেনে বসল তারপর বলল,
-‘ওকে রা’গিয়ে আমার কি! আমি যা সত্যি তা-ই বলছি।’
চমচমের এত রা’গ হচ্ছে। এই লোক অন্য সময়ে এত চুপচাপ আর গম্ভীর হয়ে থাকে অথচ এখন যখন চমচমের মন ভালো নেই তখন সে তাকে কথা শোনাচ্ছে। ইচ্ছে করেই করছে! সে দুই লোকমা বিরিয়ানি মুখে দিল। সত্যি বলতে তার খেতেও ইচ্ছে করছে না। তাই বসা থেকে উঠে পড়ল দুই লোকমা খেয়েই। নিগার খানম বললেন,
-‘উঠে পড়লি যে!’
-‘আর খেতে পারব না আন্টি। ভালো লাগছে না।’
-‘কেন? বিরিয়ানি খেতে তোর ভালো লাগবে না! নাকি খেতে ভালো হয়নি।’
-‘খেতে সত্যিই ভালো হয়েছে। কিন্তু আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না।’
-‘রা’গ করে চলে যাচ্ছিস তবে! আব্রাহাম তোকে এখন আমি মা’র’ব? তুই মেয়েটাকে এসব কেন বললি! মেয়েটা ক’ষ্ট পেয়েছে এখন!’
চমচম হাত ধুঁয়ে নেয় এরমধ্যে। হাত টিস্যু পেপার দিয়ে মুছতে মুছতেই সে বলল,
-‘যার তার কথা শুনে আমি রা’গ করিনা, ক’ষ্টও পাই না। আমার সময় কোথায় এসব হাম রো’গীকে নিয়ে মাথা ঘামানোর! আমি এখন যাই আন্টি। শরীরটা ভালো লাগছে না। ঘুমাবো একটু।’
চমচম চলে গেল। আব্রাহাম এক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। চমচমের কথাটা শুনে তার এত বেশি রা’গ হচ্ছে! চমচম তার কাছে বরাবরই বে’য়া’দ’ব আর অ’ভদ্র একটা মেয়ে! চমচম এমন অনেক কথা তাকে বলে। অথচ আজকের কথাটা তার হজমই হচ্ছে না। তবে সে চুপচাপ খাওয়া শেষ করল। এই মেয়েকে এত পাত্তা দিয়ে লাভ নেই। ছোট ভাই বোনদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা তার। একটু পরেই বের হবে। ভালোই হয়েছে চমচম সাথে যাবে না। একে নিয়ে কোথাও গেলে মাথা খেয়ে ফেলে একদম!
#চলবে।
#দখিনের_জানলা (পর্ব-১)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন প্লিজ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিন্ধুর নীল সপ্তাহে দুই দিন দিব। পরের পর্ব কখন দিব সেটাও আগে জানিয়ে দিব।)