তুমি আমার প্রথম স্ত্রী নও নূর! স্বামীর বক্ষবন্ধনে আবদ্ধ নূরজাহান চমকে তাকালো তার স্বামী সরফরাজ চৌধুরীর দিকে। নূরজাহানকে আরো প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরল সে, নূরজাহানের কপালে একটা গাঢ় চুম্বন দিয়ে বলল-
“হ্যা, ঠিক শুনেছো তুমি!আমার প্রথম স্ত্রী তুমি নও নূর!
তোমাকে বিয়ে করার অনেক আগে আমি একজনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম। আমার প্রথম স্ত্রীর নাম জুবাইদা নাওয়াজ পাঠান!”
নূরজাহান হেসে দিল, সরফরাজের বুকে কিল দিয়ে বলে উঠলো –
” মিথ্যে বলছেন আপনি তাই না?”
” যদি বলি সত্যি ”
” বিশ্বাস হয় না যে!”
” বিশ্বাস করতে হবে যে, কথাটা আসলেই সত্যিই নূর ”
নূরজাহান ছলছল চোখে সরফরাজের দিকে চেয়ে আছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। সরফরাজ এমন কথা বলবে সে বিশ্বাস করেনি। সরফরাজ কিছু বলবে নূরজাহান নিজের গুটিয়ে নেওয়া শাড়ি শরীরে জড়িয়ে রুম থেকে দৌড়ে চলেগেল।শুয়ে থাকা অবস্থায় নিজের শার্ট ঠিক করে দাড়িয়ে পরল সরফরাজ। পিছন থেকে ডেকে উঠলো –
” নূরজাহান যেয়ো না,আমার কথা শুনো! “নূরজাহান শুনলো না ফিরে ও আসেনি সে রুমে,
সাহেবের প্রথম স্ত্রী আছে! কোথায় তার প্রথম স্ত্রী? প্রথম স্ত্রী যদি থাকে ও তাহলে কেন বলল না সে? বিয়ের আজ এতটা মাস চছর পেরিয়ে গেল একদিন ও তো বলেনি। এতটা দিন কি করে না বলে থাকল সে? এত বড় ধোকা সাহেব তাকে দিতে পারলো? নূরজাহান ছাদে এসে হাপিয়ে উঠলো। ছোটবেলা থেকেই মা তাকে কত কথা শুনাতো, বলতো-
“গায়ের দিক দিয়েই বড় হয়েছে আদব শিক্ষা কিছুই নেই! স্বামীর ঘর করবি কিভাবে? যে স্বভাব, স্বভাব বাদদিলাম কপালই তো ভালো না তোর! জন্মের সময় বাপ খাইছোছ!” ঠিক কখনো কখনো এভাবেই বাবার মৃত্যর কথা শুনতে হতো তাকে। প্রত্যেকটা সময় শুনতে হতো তার জন্মের কারনে বাবা ও নাকি মারাগেছে।কত খোটা আর লাঞ্চনা তাকে সহ্য করতে হতো সেই ছোট্ট বয়স থেকে। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে তাকে নিয়ে অনেককিছু বলাবলি করত। এত এত দুঃখের মাঝে তার সাহেব ছিল তার আপনজন যার একটু সোহাগ ছোট ছোট আবদার আর দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসাই ছিল তার জন্য অনেক। সেই ভালোবাসার মানুষটির মুখ থেকে আচমকা এমন কথা শুনে অবাক হলো সে। কারন মানুষটা কখনোই তার কাছ থেকে কিছুই লুকোয় না সবই হেসে হেসে বলে দেয়। আর সেই মানুষটা এতবড় একটা বিষয় গোপন করে রাখল!
নূরজাহানকে খুজতে খুজতে সরফরাজ ছাদে এসেগেছে। দেখল নূরজাহান ছাদের একপাশে চুপচাপ বসে আছে। নূর জাহানের পাশে গিয়ে বসে পরল সে। হাত দুটো ধরল,তারপর হাতের আজলে মুখটা ধরে ঠোটে বেশ গাড়ো করে চুমু দিয়ে বলল-
“বউ পুরো কথা শুনবে না,” এই বউ শুনবে না পুরো কথাটা?”
” শুনতে চাইনা ”
” এই বউ শুনতে চাওনা তোমার সাহেবের সেই স্ত্রীর কি হয়েছিল?”
নূরজাহান সরফরাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল-
” চাইনা শুনতে, শুনেছেন? ঠকিয়েছেন আপনি আমাকে! এত বড় একটা কথা কি করে লুকালেন আপনি আমার কাছ থেকে? সরফরাজ হয়তো ভাবেনি নূরজাহান এতটা ক্ষেপে যাবে। সরফরাজ নূরজাহানকে আবারো আদর করে বলল-
” রাজার যত পত্নী উপপত্নী থাকুক! মহারানি কিন্তু একজনই থাকে! আর সে রাজার থেকেই স্বীকৃতি পায়!
আর সেই মহারানি হলে তুমি নূর। যত রানী এই সরফরাজের জীবনে আসুক বুকে থাকবে শুধু তুমিই ”
সরফরাজ উঠে চলেগেল, নূরজাহান নিজের মুখে হাত চেপেঁ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পরল। চাপা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে ফেলছে। কন্ঠ নালী যেন প্রচন্ড আক্রোশে চেপেগেছে। নূরজাহান কাদতে কাদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে তার ঠিক নেই। সরফরাজ নিচ থেকে এসে দেখে তার প্রিয়তমা স্ত্রী ছাদের মেঝেতে পরে রয়েছে। ঘুমিয়ে পরেছে সে ততক্ষণে। নূরজাহানকে কোলে করে খাটে শুইয়ে দিল সে। নূরজাহানের মুখের দিকে তাকালে তার পুরো শরীর যেন একটা আলাদা শিহরণ বয়ে যায়।
নূরজাহানের সঙ্গেই তার পাশের খালি জায়গাটায় শুয়ে পরল সে। নূরজাহানকে ছাড়লো না নূরজাহানের হাতটা টেনে এনে তার হাতের ভিতর রেখেদিল। নূরজাহানের পাশ ফিরে তার অস্রু ভেজা চোখগুলোর দাগ বসে যাওয়া গাল গুলিতে হাত বুলিয়ে দিল। ঘুমন্ত নূরজাহান কেপেঁ কেপেঁ উঠছে, আর তা প্রাণ ভরে দেখছে সরফরাজ।
সকালবেলা সরফরাজ খুব তারাতারি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিল। কাজ জমেগেছে অনেক তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ঘুমন্ত নূরজাহানের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বোন রুমকির ঘরে উকি দিল।রুমকি ও ঘুমচ্ছে তাকে আর না জাগিয়ে বেড়িয়ে গেল সে।
নূরজাহান ঘুম থেকে উঠে পরেছে, চুলগুলোকে হাত খোপা করে পাশ ফিরে দেখলো সরফরাজ নেই। পরে মনে পরল কাল রাতের ঘটনা! কাল রাতেই তো সরফরাজের সঙ্গে তার একদফা ঝগড়া হলো। সরফরাজের রাতের কথাগুলো মনে পরতেই বিষিয়ে উঠলো তার মন। মানুষটার ঐ একটা কথাই যেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে তার পুরো শরীর। বিছানা ছেড়ে উঠে গেল সে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।
___________________________________________
দীঘির পাশে বিরাট বড় আমগাছ। শান বাধানো ঘাট,
ঘাটের এপাড় থেকে ওপাড়ে শুধু কানায় কানায় থৈ থৈ জল। দুটো মেয়ে বসে আছে সেই ঘাটে, একটি কিশোরী ও একটি পূর্ণ যুবতী নারী! হাতে কাচাঁ আম আর লবণ মিশ্রিত মরিচের গুড়া। মনের আনন্দে দুজনই বসে বসে আম খাচ্ছে। হঠাৎ আম গাছটিতে একটি পাখি ডেকে উঠলো,
– “বউ কথা কও! বউ কথা কও!”
মেজাজ গরম হয়ে যায় যুবতী কন্যার! এই ডাক যে তার পরম ভালোবাসার মানুষটির সে ও রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এভাবেই ডেকে উঠে মাঝে মাঝে!কিন্তু আজ যে তার রাগ ভাঙ্গবে না! আজ মানুষটি চরম ভুল করেছে! তার শাস্তি তাকে ভোগ করতে হবে।পাখিটির উপর রাগ করে ডিল ছুড়ে মারলো । পাখিটি যেন আরো চেচিয়ে উঠলো। তার মিষ্টি কন্ঠে ভুবন ভুলানো আবারও সেই ডাক দিয়ে উঠলো-
“বউ কথা কও! এই বউ কথা কও!”
–
“যুবতী মেয়েটি চিৎকার করে বলে উঠলো মজা নিচ্ছিস?
বলবো না কথা!”
কিশোরী মেয়েটি বলল-” ভাইয়ের রাগ পাখির উপর ঝাড়ছো? কাজটা কি ঠিক?”
যুবতী মেয়েটি-“আমি কি শুধুই রাগ দেখাই? সব ছেড়ে চলে যাবো, তোর ভাইকে ও রেখে যাবো তোকে ও রেখে যাবো রাগ আর দেখাবো না!”
দূর থেকে নূরের রাগান্বিত চেহারা দেখছে সরফরাজ।
হাসি ও পাচ্ছে খুব, পাখির উপরে রাগ ঝাড়ছে শুধু তার কন্ঠ নকল করায়।
কি রেগে আছে মেয়েটা, নূরের রাগের সাথে মিশে আছে
স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা যা সরফরাজ দূর থেকেই বুঝতে পেরেছে। সরফরাজ সবকিছুই দেখছে। দুজনে বয়সের তফাৎ কম করে হলেও তিন বছর! রুমকির বয়স পনেরো আর নূরজাহানের বয়স আঠারো। দুজনের সম্পর্কটা ননদ আর ভাবী কম বান্ধবীর মত। সরফারজ ঢাকা থেকে এসেছে দুদিন পর। খালি বাড়িতে দুজন অল্পবয়সি মেয়েদের একা রেখে যাওয়া ঠিক নয় তাই কাজের লোক সখিনার মাকে রেখে গিয়েছিল। এত বড় বাড়িটাতে এই দুটো মেয়ে কেমন করে থাকবে, দেশের অবস্থা ও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সরফরাজ তার রাগিনীকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য সামনে গেল।
#দূরত্ব!…..
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্ব- এক
চলবে।
গল্পটি আমার এক শ্রদ্ধেয় মানুষের জীবনি নিয়ে লিখেছি। স্ত্রীর প্রতি এত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা আমি আর কারোর মধ্যে দেখিনি। কালকের শেষ হওয়া গল্পে অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন স্ত্রীকে সত্যিই কেউ এভাবে ভালোবাসে? মনে রাখে স্ত্রীর সব কিছু? তাদের জন্য আজকের এই গল্প। আশা করি ভালো লাগবে আপনাদের। ভালো লাগলে কমেন্ট ও লাইক অবশ্যই দিবেন। আর গল্প কেমন হলো জানাবেন।