#দূরত্ব!…..
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্ব- দুই
নূরের রাগের সাথে মিশে আছে স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা যা সরফরাজ দূর থেকেই বুঝতে পেরেছে।
সরফরাজ সবকিছুই দেখছে। দুজনে বয়সের তফাৎ কম করে হলেও তিন বছর! রুমকির বয়স পনেরো আর নূরজাহানের বয়স আঠারো। দুজনের সম্পর্কটা ননদ আর ভাবী কম বান্ধবীর মত। সরফারজ ঢাকা থেকে এসেছে দুদিন পর। খালি বাড়িতে দুজন অল্পবয়সি মেয়েদের একা রেখে যাওয়া ঠিক নয় তাই কাজের লোক সখিনার মাকে রেখে গিয়েছিল। এত বড় বাড়িটাতে এই দুটো মেয়ে কেমন করে থাকবে, দেশের অবস্থা ও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সরফরাজ তার রাগিনীকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য সামনে গেল।
নূরজাহান ঘাটের উপরে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে কাচাঁ আমের টুকরো গুলো থেকে এক টুকরো আম মরিচগুঁড়োতে মিশিয়ে খাচ্ছে, খাওয়ার তালে তালে চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। পানি গুলোকে মুছে আড় চোখে তাকিয়ে দেখল,রুমকি তারদিকে চেয়ে আছে। নূরজাহান রুমকির উদ্দেশ্যে বলল-
–” দেখলি মরিচেরগুড়ো গুলো কি ঝাল! খেয়ে আমার সব জ্বলে যাচ্ছে!”
–” কই আমার কাছে তো ঝাল লাগছে না!”
–” তোর কাছে ঝাল লাগছে না?”
–” না, বেশি ঝাল নেই তো ভাবি!”
সরফরাজ দুজনের পিছনে এসে দাড়ালো, দাড়িয়ে বলতে লাগল
–” রুমকি এই ঝাল তো মরিচগুঁড়ার ঝাল নয়রে!এটা তো অন্যকিছু পুড়ে যাওয়ার ঝাল! এই ঝাল পানি দিয়েও কমবে নারে। তারপর ও চেষ্টা করে দেখতে পারিস ”
নূরজাহান রাগান্বিত চোখে সরফরাজের দিকে তাকালো।
তারপর গটগট পায়ে ঘরে চলেগেল সে। সরফরাজ তার যাওয়ার দিকে চেয়ে হেসে দিল। রুমকি ভাইয়ের হাসি দেখে অবাক হয়েগেল।
রুমকি –“মিয়া ভাই, ভাবী হঠাৎ ওমন ভাবে রেগে গেলো কেন? কি করেছো তুমি?”
–” তা তোর জানতে হবে না,”
–” ভাবী আজ সারাদিন রেগেছিল এতটা রাগিয়ে না দিলেই পারতে তুমি! বেচারীর মুখে আজ কোন হাসিই ছিল না ” বলেই রুমকি চলেগেল।
সরফরাজ আর সেদিকে মাথা ঘামালো না। দিঘির পাড়ে বসে পরল সে। আর ভাবতে লাগল সেদিনের কথা, যেদিন তার মা অর্কলে তাকে ছেড়ে চলে যায়। সরফরাজের মা তার ছোট বোন রুমকিকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়।
বাবা পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে একজন ব্যবসাহী ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে স্ত্রী জহুরাকে রেখেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবসার কাজে চলে যেতেন। বাড়ি এসে শুধু কিছু টাকা আর গয়না দিয়ে যেতেন। স্ত্রীর দেখাশুনা করার সময় তার হয়ে উঠতো না।সন্তান সম্ভবা স্ত্রী জহুরাকে সেই বছর ব্যবসার কারনে দেখে যেতে পারেননি। রুমকির জন্মের কিছু দিন আগেই আসার কথা ছিল তার। ঠিক সময় তিনি আসতে পারলেন না তার ব্যবসা তখন বেশ ভালোই চলছে। ওরকম ব্যবসা লোকেদের হাতে দেয় কিভাবে?সব গুছিয়ে আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়।সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না, ছিল ছোট্ট সরফরাজ। মাঝরাতে মায়ের আর্তচিৎকার আর কষ্টগুলো তার চোখেই ভাসতে লাগল। সেইদিন সে সাক্ষী হলো এক করুন মৃত্যর! স্বামী আর পরিবারহীন এক নারীর দূর্বিষহ জীবন! সরফরাজের বাবা তসলিম উদ্দিন চৌধুরী এলেন ভোর বেলায়। এসেই দেখেন বাড়ির কাজের লোক আর আত্মীয়দের ভীড়, বাড়ির ফটকে পা দিয়েই তিনি অবাক হয়েগেলেন। একপাশে স্ত্রীর লাশ আরেকপাশে দুই সন্তান মায়ের জন্য কাদছে। অবুঝ রুমকি হয়তো জানেই না তার মা জহুরা আর এই পৃথিবী বাসিন্দা নয়। তসলিম উদ্দিন চৌধুরী সেদিন অনেক ভেঙ্গে পরেছিলেন। দুই মা হারা সন্তানকে কে আগলে রাখবে? এসব ভাবতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছোট্ট রুমকি আর ছেলে সরফরাজকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে তার সঙ্গে নিয়ে যাবেন।
সরফরাজ এ নিয়ে অনেক রাগারাগি করেছিল। বাবার সঙ্গে তার এক সপ্তাহ কথা হয়নি। বোনকে নিয়ে সেই বছর তাকে যেতে হয় পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তান। জীবনের সাতটা বছর তার কাটে পশ্চিম পাকিস্তান তথা এখনকার স্বাধীন পাকিস্তানে । তারপর অবশ্য জীবনের মোড়টা অনেকখানি বদলে যায় তার।
সরফরাজ দিঘীর জলের দিকে তাকিয়ে, ভাবতে লাগল তার পুরোনো দিনের কথাগুলো। ঘাড়ের কারো হাতের ছোয়া পেতেই পিছন ফিরে দেখল, রুমকি দাড়িয়ে আছে,
রুমকি–” মিয়া ভাই যাও নি এখনো? বসে আছো কেন এখানে?”
–” যাব, একটু খোলা হাওয়ায় বসে থাকি, ভালো লাগছে না, তুই যা! আর শোন খেয়েছিস? তোর ভাবি খেয়েছে তো নাকি?”
–” হুম খেয়েছে তো আমরা খেয়েছি, তুমি খেয়েছো?”
–” হুম খেয়েই এসেছি, চল ঘরে চল!”
নূরজাহান সবই দেখছে বারান্দায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে। দু ভাই বোন যখন ঘরের দিকে ফিরে আসতে লাগল।
তখন নূর ঘরের ভিতর ঢুকে পরল। একবার মনে হলো রুমকি কে ডেকে বলেদিবে রান্নাঘরে সাহেবের জন্য আলাদা করে ভাতের প্লেটে ভাত বেড়ে রেখেছে সে। কিন্তু কিছুই বলেনি সে, বুঝতে দিবে না সে! থাকুক ভাইবোন দুজন মিলে। বলবে না কথা দুজনের সঙ্গে।
নূরজাহান বিছানায় শুয়ে পরল তাড়াতাড়ি, সরফরাজ রুমে এসে জিরিয়ে ছিল বেশখানিক আগে যখন নূরজাহান আর রুমকি ঘাটেছিল। তাই সে পাশে এসে খানিক বসল। ব্যবসার অনেক কাজ জমে আছে, এই তো ঢাকায় নতুন যে জায়গা সে কিনেছে সেখানকার পাশেই একটা বাড়িতে ভাড়া নিয়েছে সে।ব্যবসার কাজে দুজনকে রেখে যেতে মন মানে না আর।ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত সরফরাজ নূরজাহানের পাশে শুয়ে পরল।
সাঁঝের বেলা যেন ঘনিয়ে আসছে। বৈশাখ মাসের এই দিনগুলোতে কড়া রোদের তাপ ও কম নয়। উত্তাপ কমে বেলা ফুড়িয়ে এলো। নূরজাহান ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে,
উঠেই দেখে সরফরাজ ঘুমাচ্ছে তার পাশে। সরফরাজকে না জাগিয়ে নিজেই উঠেগেল সে। শাড়ির আচঁলে টান পরতেই বিরক্তিতে ভ্রু- কুচকে উঠলো নূরজাহানের।
সরফরাজ –” রাগ ভাঙ্গলে এক কাপ চা পেতে পারি?”
নূরজাহান কিছু না বলেই চলেগেল। খানিক বাদেই এক কাপ চা এনে সামনে ধরলো। সরফরাজ মুচকি মুচকি হেসে চা টা হাতে নিয়ে নিল।
সরফরাজ –” চা তে নুন হয়েছে বেশ, এত নুন কেউ দেয়?” সরফরাজ চায়ের কাপ রেখে মুখটাকে কুচকিয়ে ফেলল।
নূরজাহান অতি আগ্রহে বলে উঠলো
—” কই আমি তো চিনিই দিয়েছি, লবন কোথায় পেলেন? ভুল করে আবার লবন দিয়ে ফেলেছি কি আমি?” দেখি দেখি আমাকে দিন। আমি আবার বানিয়ে আনছি।
সরফরাজ হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল-
–” আরে আরে এত ব্যাস্ত হচ্ছো কেন? চা তে চিনি ঠিকই ছিল, কিন্তু তোমার মুখে মধু নেই, একদম রসকস হীন গিন্নি তুমি!”
–” আপনি ইচ্ছে করে এমন করেছেন?”
–” হ্যা ”
–” কেন করলেন এমন?”
–” যদি বলি তোমার এমন বিষণ্ন মুখ দেখতে ভালো লাগে না যে!”
–” আমার এমন গোমড়া মুখের কারন ও তো আপনি সাহেব! আপনি যদি এত বড় কথাটা আমার কাছে না লুকাতেন আমি কি এমন করতাম? আমার স্বামী আপনি, আমি হাজারো কষ্ট বয়ে বেড়াতে রাজি। কিন্ত আপনার দেওয়া আঘাত আমি সইতে পারবো না! আমার জীবনের এক টুকরো সুখ যদি থাকে আর এক টুকরো সুখ ও যদি জিবনে পাই বা পাবো তাও আপনার কাছ থেকেই। কিন্তু আপনি যদি এভাবে আমাকে ঠকিয়ে যান। আমি কি করে এগুলো সহ্য করবো? বলুন!”
–” আমি জানি, তুমি আমাকে সবচেয়ে বিশ্বাস করো, আর সব শুনার পর তোমার ভুল টাও ভেঙ্গে যাবে।”
নূরজাহান চোখের পানিগুলোকে মুছে নিচ্ছে।
–” উঠো তোমাকে কিছু দেখাতে হবে!”
নূরজাহানের হাতটি ধরে সরফরাজ নিয়েগেল পাশের রুমে। যেখানে সরফরাজের একটা আলাদা লাইব্রেরি আছে। পুরোনো এই বনেদি বাড়িটিতে অনেক কিছুই আছে। জমিদার বাড়ি, এই বাড়ির আশপাশের লোকজন ছাড়া তেমন কেউই নেই, সরফরাজের বড় দাদুরা দেশ ভাগের সময় ভারতের কলকাতায় চলেগেছেন। তার নিজের বাবা ও তো পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হতে চেয়েছিল। তবে সরফরাজের একবাক্য দেশ ত্যাগ সে করতে পারবে না কোন কালেই।
লাইব্রেরির থাকে থাকে সাজানো বই, বইয়ের পাশে আছে পত্রিকা। পুরোনো এক আলামারি থেকে কিছু চিঠি বেড় করলো সে।
চলবে।
আজকের পর্বটা হয়তো কিছুটা এলোমেলো হয়েগেছে। পরবর্তী পর্বে গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করবো।
ভুলভ্রান্তি হলে ক্ষমা করবেন। আর কমেন্ট করে জানাবেন গল্প কেমন হচ্ছে!