#দূর_আলাপন
পর্ব-৬
অদ্রিজা আহসান
________________
অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল মাথা নুইয়ে। তিতিক্ষা একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তোমাকে তুমি করে বলে ফেললাম। মনে করনি তো কিছু?’ আফরিন হেসে ডানে বামে মাথা নাড়ল। প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় মনে মনে বোধহয় খানিক স্বস্তিও পেল।
মাঝে হঠাৎ যে নিরবতা নেমে এসেছিল, দুজনের কেউই তাতে কিছু মনে করল না। হয়ত দুজনের একজনও ব্যাপার টা ঠিক ধরনেই পারেনি। কিছু মুহুর্তের জন্য দুজনই যেন ভাবুক হয়ে উঠেছিল সেসময়।
আবার সেই নিস্তব্ধতা ফিরে আসছে দেখে তিতিক্ষা নিজেই কথা শুরু করল এবার। পুরো আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের রাজত্ব। মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে ভীষণ। তিতিক্ষা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে ওড়না টা আরেকটু ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,’তোমার বয়স কত আফরিন?’ খানিক থেমে বলল, ‘কিছু মনে কর না। এভাবে নাম ধরে ডাকছি তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভুল হয়ে থাকলে যেন শুধরে নিতে পারি।’
-‘কিছু মনে করি নাই আমি। আমার বয়স আসলে কত তা আমি নিজেই জানি না ঠিকমতো। তবে চাচি কইছে এই পৌষে আমার বয়স ঊনিশে পরব।’
-‘তাহলে ঠিক আছে। তুমি বয়সে আমার কিছুদিনের ছোটই হবে। শুধু আফরিন বলেই ডাকা যায় তোমায়। ‘বলে তিতিক্ষা ম্লান হাসল।
হাসল আফরিনও। বলল,’আপনি খুব ভালা মানুষ। আর নিনাদ ভাই কি না কিই কইছিল আমারে আপনের কথা……’
তিতিক্ষা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’কি বলেছিল তোমার নিনাদ ভাই? ‘
আফরিন ফের শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে বলে,’কইতো, আমি যেইখানে থাকি ওইখানে একটা নাগিনী আছে বুঝলি। আমারে দেখলেই খালি হিস্ হিস্ কইরা ফণা তুইলা ছোবল দিতে আসে। একেবারে কালনাগিনী সাপ। উউহ….কি ভয়ংকর! দেখলেই ডর লাগে আমার।’ কথার মাঝখানেই হঠাৎ থেমে মেয়েটি দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। ‘ছিঃ! ছিঃ! কিসব কইতাছি আমি! কিছু মনে কইরেন না আপনে। আমার মুখের লাগাম নাই। বড় বেহায়া মুখ আমার।’
দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে তিতিক্ষা বহু কষ্টে একটু হাসল। বলল,’শুধু এসবই? ভালো কথা কি কিছু বলে না আমার নামে?’
আফরিন অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’হু, কয়তো। ভালো কথাও কয়। বাড়িতে গেলে হে সারা দিন-মান আপনাগো কথাই খালি কইতে থাকে ঘুইরা-ফিরা।’
-‘তোমার সাথে বুঝি নিনাদ ভাইয়ের খুব ভাব?’
আফরিন লাজুক হেসে উত্তর দেয়,’হু, বাড়িতে গেলে তো নিনাদ ভাই সারাদিন আমার সাথেই গপ করে। আর কত কিছু নিয়া যায় আমার লাইগা…. ‘
তিতিক্ষা হঠাৎ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যার জানার সব জানা হয়ে গেছে তার। সকলকে দেখিয়ে বেরানো নিনাদের ভালোমানুষির পেছনে আসল রূপ তবে এই!
আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে তিতিক্ষা হঠাৎ ব্যাস্ত কণ্ঠে বলে,’ভেতরে যাই চল। বৃষ্টি নামবে এখনই।’ তারা ঘরে ফিরে আসে। তিহা কিংবা শিউলি ফুআম্মা কেউ তখন আর নেই সেখানে। রান্নাঘর থেকে কথা ভেসে আসছে। আফরিন সেদিকে পা বাড়ায়। তিতিক্ষাকে আসতে বললে সে বলে, ‘আসরের আযান দিয়েছে। নামায পড়ে তারপর যাই। তুমি নামায পড়বে না?’
আফরিন সহসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইতস্তত হেসে বলে,’মাঝে মাঝে তো পড়ি। আচ্ছা, খারান ওযু কইরা আসি।’
বাড়িতে প্রতিটা বিকেল তিতিক্ষার কাটে ছোটনের সাথে। হোক ঘুম, খেলা কিংবা ঘুরাঘুরি। বিকেল হলেই তিতিক্ষা কে ছোটনের চাই। তিতিক্ষা নামায শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছোটনের খোঁজে এদিক সেদিক তাকায়। এবাড়ি আসার পর থেকে ছোটনের দেখা আর পায় নি সে। একঝলক না দেখলে মন এখন শান্ত হবে না আর। তিতিক্ষা সামনের ঘরে উঁকি দেয়। নাহ, আর কেউ নেই। ওইতো ছোটন একা ঘুমিয়ে আছে বড় সোফাটায়। তিতিক্ষা তার পাশে এসে বসতেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। খুলে যায় দরজা। নিনাদ মাথা থেকে টুপি নামিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে ভেতরে আসে। তিতিক্ষা কে যেন সে দেখেই নি, এমনি ভাবে সে আফরিনকে ডাকতে থাকে। অদূরে বসে তিতিক্ষা সহসা ঘোমটার আড়াল থেকেই আড়চোখে সেদিকে চায়। এই দুজনের ব্যাপার টা কি, আজ সে দেখে তবে ছাড়বে। আফরিন এগিয়ে আসতেই হাতে থাকা ঠোঙা টা সে আফরিনের হাতে তুলে দিয়ে ঘুরে দরজা লাগাতে উদ্যত হয়। আফরিন সেখানে দাঁড়িয়েই ঠোঙা খোলে। ভেতরে জিলাপি দেখে ভ্রু কুচকে বলে,’ওমা, এত জিলাপি আনছেন কেন্?
জিলাপি না আপনের দুই চোক্ষের বিষ। সাপের মত নাকি দেহা যায়? তাইলে আজকে আবার কি হইল?’
নিনাদ এসব কোনো কথার উত্তর না দিয়ে আফরিনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে চলে গেল সেখান থেকে। আফরিন দৌড়ে ফুআম্মার কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়েও বলে একই কথা ।
জিলাপি দেখে যদিও তিতিক্ষার চোখ চকচক করে উঠেছিল ক্ষনিকের জন্য, তবু সে নিজেকে সামলে নিল। হতাশ হয়ে মুখ ফেয়াল সেদিক থেকে। ছোটনের মাথায় এলোমেলো আঙুল চালাতে লাগল। নাহ! তার চাওয়া মতো কিছুই হল না। ভেবেছিল নিনাদ, আফরিনের কথায় অস্বাভাবিক কিছু অবশ্যই থাকবে। আর সে খপ করে হাতেনাতে ধরে ফেলবে তাদের। অথচ নিনাদ তো কথাই বলল না। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল গটাগট হেঁটে। তিতিক্ষা হঠাৎ ভাবে, ব্যাপার টা এমন নয় তো, যে তাকে দেখেই নিনাদ এই মাত্রাতিরিক্ত নির্লিপ্ততা দেখাল! সে-ই তো ওর স্বভাব। নইলে কি আর ভার্সিটিতে শ’খানেক ললনা সামলাতে পারে একাই?
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। তিতিক্ষা, তিহা দুজনেই চিন্তান্বিত। এই বৃষ্টি না থামলে তারা আজ ফিরবে কি করে! এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এল। বাবা বাড়িতে একা আছেন। তিহা,তিতিক্ষা, ছোটন এই তিনটি প্রাণীর চিন্তান্বিত মুখের দিকে চেয়ে খানিক করুণা করেও বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখাল না। এদিকে তিতিক্ষা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল। একে তো বাবার চিন্তা তার ওপর বিকেলের সেই ব্যাপার টার পর থেকেই তার মন কেমন বিষিয়ে উঠেছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরার কথাও ভাবল দুএকবার! সন্ধ্যার প্রায় এক প্রহর কেটে যাবার পর অর্থাৎ রাতের প্রথম প্রহরে বৃষ্টি তার গতিতে কিছুটা লাগাম টানল। একে তো বৃষ্টি, তার ওপর আবার ছুটির দিন। সেজন্যই বোধহয় রাস্তাঘাট অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা ছিল। নিনাদ তাদের একা ছাড়তে পারল না এই অবস্থা দেখে। একটা ক্যাব ডেকে সে নিজেও উঠে গেল তাদের সাথে।
বাড়ির সামনে ক্যাব থামতেই সবার আগে তিতিক্ষা বেরিয়ে বৃষ্টির মাঝেই গটাগট হেঁটে ভেতরে চলে গেল। পেছন ফিরল না একবারও। ঘরে এসেই দ্বোর বন্ধ করল সে।
তিহা একপ্রকার জোর করেই নিনাদ কে নিয়ে এল ভেতরে। সেই ভিজেছে সবচেয়ে বেশি। ক্যাবের খোঁজে তখন রাস্তায় নামতে হয়েছিল তাকে।
তিতিক্ষার ঘরের সামনে এসে বিরক্তি মেশানো স্বরে ব্যাস্ত হয়ে তিহা বলল,’এখন দরজা বন্ধ করলি কেন আবার? ছেলেটা ভেজা গায়ে বাইরের ঘরে বসে আছে। গামছা-টামছা কিছু একটা দে। এদিকে ছোটনের চুলও ভেজা। আজই না আবার জ্বরে পড়ে। ওর বাবা আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে জানলে….’
তিতিক্ষা বাধ্য হয়ে পানসে মুখে দরজা খুলল। দেয়ালের এপাশ থেকেই টাওয়েল টা ছুড়ে মারল নিনাদের সামনের সোফায়। সাথে সাথে ঘুরে হাটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলা ধরিয়ে কেতলিতে পানি বসাল চায়ের জন্য।
নিনাদ বসার ঘরে একাই বসে ছিল। তার চুল, গাল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পড়নের সাদা পাঞ্জাবি টাও ভিজতে বাকি নেই। এই ভিজে জবজবে শরীরে অন্যের বাড়িতে, অন্যের সোফায় বসতে খারাপ লাগে। কিন্তু না বসে উপায়ও নেই। নাহয় এ নিয়েও তিহা ঠিক ঝগড়া বাঁধাবে তার সাথে। নিনাদ যখন ভিজে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে এসব ভাবছিল তখনই আচমকা টাওয়েল টা তার সামনের সোফায় এসে পড়ে। নিনাদ একমুহূর্তের জন্য ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। তারপর বুঝল এটা ছোট গিন্নির কাজ।
মাথা মুছতে মুছতেই নিনাদের নাকে এসে লাগল দার্জিলিং থেকে আনানো প্রকট সুঘ্রাণ বিশিষ্ট চা পাতার গন্ধ। বৃষ্টির ভেজা গন্ধ যেন সেই ঘ্রাণকে আরও প্রবল করে তুলছে। এই চা-পাতার ঘ্রাণ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চামচ নাড়ানোর ক্ষীণ আওয়াজ, ঘরের থমকে থাকা আবহাওয়া নিনাদকে বারবার এখানে আসতে বাধ্য করে। তার ওই নির্জন কুটিরে তো এমন সুখ নেই! কিন্তু কিসেরই বা তার অভাব? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর ক্ষনে ক্ষনে নিনাদের কানে এসে ঠেকে। সে হল ‘মানুষের অভাব’। তার ঘরে মানুষ নেই। এমন কেউ নেই যে দিনভর হেঁটে বেড়াবে চারিদিক জুরে, রাগ করে রান্নাঘরে ধুপ ধাপ আওয়াজ তুলে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবে সময়ে অসময়ে, এমন বৃষ্টির দিনে এভাবেই দার্জিলিং টি বানাবে, চামচের টুংটাং শব্দ তুলে বাড়িঘর মুখরিত করবে। নিনাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে।
তিতিক্ষাদের ওবাড়ি থেকে আসার দুদিন পর একরাতে মারুফ সাহেব মেয়েকে ডেকে পাঠালেন কথা বলার জন্য। ঘরের মানুষের গোপন বৈঠকও বলা যায়। যতই হোক তিহা এখন বিবাহিত। এবাড়িতে সে মেহমান। তাই সব বিষয়ে তাকে জরানো ঠিক নয়।
রওশানের মতো মারুফ সাহেবও নিনাদে মুগ্ধ ছিলেন। বাবা মা হারা ছেলে বলে খানিক করুণাও এসে মিশেছিল সেই মুগ্ধতার সাথে। তিনি আরামকেদারায় শুয়ে এক হাতের ওপর অন্য হার রেখে গুনগুন করে কিসব ভাবতে ভাবতে মেয়েকে একটা হঠাৎ প্রস্তাব করলেন। ‘তিতি, নিনাদের ফুফু শুনলাম তোমাদের খুব যত্ন করে খাইয়েছে সেদিন। তিহার সাথে নাকি খুব ভাব। এযুগে আজকাল এতটা কে করে বল?’
তিতিক্ষা বাবার পাশে বিছানায় বসে গম্ভীর মুখে বলল, ‘হু’
মারুফ সাহেব গুনগুন করে হাত নাড়াতে নাড়াতে ফের বললেন, ‘ নিনাদও চলে যাচ্ছে। ছেলেটাকেও তো একদিন এনে ভালো মন্দ খাওয়ানো দরকার। ওদের বরং দাওয়াত করে দিই আসার জন্য। কি বল?’
তিতিক্ষা সহসা মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। মুখ শক্ত করে মনে মনে বেজায় চটে গিয়ে বলল,’আবার সেই দাওয়াত! আমি মরে যাই, মরে যাই আমি!’
মারুফ সাহেব মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বললেন,’কি হল তিতি! করে দেই দাওয়াত। কি বল?’
-‘হু, করো দাওয়াত। ‘
-‘নিনাদের ফুফু। ভদ্রমহিলা প্রথমবার আসবেন আমাদের বাড়িতে। দেখো যত্ন আত্তির ত্রুটি যেন না হয়। নিনাদও তো চলে যাবে বাইরে। সেখানে কি খায় না খায়। ওর যা যা পছন্দ সব জেনে নিয়ে তারপর রান্না করো। কেমন?’
-‘হু’
-‘আসতে বলি কবে বলত? পরশু? ‘
-‘তোমার যেদিন ইচ্ছে। ‘ হঠাৎ সাদা হয়ে ওঠা মুখ নাড়িয়ে মিনমিনে স্বরে তিতিক্ষা বলে। তারপর আচমকা উঠে পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে। চাপা স্বরে বলে, ‘তুমি বসো বাবা। আমি চা নিয়ে আসছি।’
চলবে……