#নীরদের_বিষাদিনী(অন্তিম পর্ব)
একজন সতের বছরের মেয়ে পাথরের উপর বসে সমুদ্রকে একমনে আঁকার চেষ্টা করছে।তিমিরের ন্যায় কেশগুচ্ছ সমীরণের ধাক্কায় মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে।পাঞ্চ ক্লিপটা অনাদরে গলার ওড়না আঁকড়ে ধরে আছে।পড়ন্ত বিকেলের আলোছায়াতে তাকে একদম বিষাদিনীর রুপ মনে হচ্ছে।নীরদ দূর থেকে উষ্ণ শ্বাস ছাড়লো নিজ কন্যাকে দেখে।এহেন রুপও কারো হয়?মাঝেমধ্যে ডাক্তার নিজেও হকচকিয়ে যায়।মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
“অরু মা কী করছো?”
ঠোঁট উল্টে নীরদকে জবাব দেয় অরু,
“দেখো বাবা সমুদ্রের মতো ছবিটা একটুও সুন্দর হচ্ছে না।তুমি বলেছিলে বিষাদ অনুভব করলে সব ছবি সুন্দর আঁকানো হয়।”
“দেখি।তাইতো ভালো হচ্ছে না।তার মানে এখন তোমার মনে বিষাদের কম আছে।নিশ্চয় কোনো কিছু নিয়ে খুব খুশি।”
নীরদের কথায় উচ্ছাসিত হলো অরু।লম্বা চুলগুলো খোঁপা করে বলল,
“কতোদিন পর আমরা ছুটি কাঁটাতে এলাম বলো তো।এজন্য মন ভালো।আবার খারাপও।মা সমুদ্রে নামতে দেয়নি।”
“আমার উপরেও রেড এলার্ট জারি করেছে।বলেছে ঠান্ডা লাগবে।”
নীরদ কথাটি অতি সন্তপর্ণে বলল।যেন দূরে থাকা রাফা না শুনতে পায়।অরু হতাশ হয়ে বলল,
“আব্বু কক্সবাজার এসেও সমুদ্র বিলাস হবেনা?”
নীরদ হেসে বলল,
“কেন হবেনা?অবশ্যই হবে।এখুনি নামবো আমরা সমুদ্রে।তোমার ভাই কোথায়?তাকে ডাক দাও।”
“মা কিছু বলবেনা?”
“আমি আছি তো।”
নীরদ যদিও মেয়ের মন রক্ষার্থে কথাটি বলল কিন্ত সে জানে রাফা সমুদ্রে নামা একটুও পছন্দ করবেনা।বেশ ঝ গ ড়াও করবে।কারণটা খুব বড়।কিছুদিন আগে স্বপরিবারে জ্বর এসে কাহিল অবস্থা হয়ে গিয়েছিল।অরু চিল্লিয়ে নিজের ভাইকে ডাকলো।বারো বছরের অনয় দৌড়ে মায়ের কাছ থেকে ছুটে গেলো।তিনজনের দিকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো রাফা।বুঝতে বাকী নেই সমুদ্র বিলাস চলবে এখন।
“ওরা কী সমুদ্রে নামবে আপু?ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
“বাদ দে রিনি।একটু তো মজা করবে।”
“তুমিও নামবে সমুদ্রে?”
“পাগল?শাড়ী পরে এসেছি।”
“আমি নামবো।আমার তো শাড়ীর প্যারা নেই।আসলে কোনোই ঝামেলা নেই।”
রিনির কথার অভ্যন্তরে চাপা দীর্ঘশ্বাস উপলব্ধি করতে পারলো রাফা।পাশ হতে জাবির ফোন থেকে একবার মুখ উঠিয়ে নিজের স্ত্রীকে দেখে নিলো।ইদানীং তার নজর কখনো রিনির উপর এসে থামেনা।ফোনটা রাফার কাছে দিয়ে অরুদের দিকে এগিয়ে গেলো রিনি।জাবিরকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো।এই দম্পতির অতীতের ঘটনাগুলো এখন শুধু সোনালী স্মৃতি।
“কী ভাবছো রাফা?”
“অনেককিছু জাবির ভাই।”
রিনি চলে যেতেই রাফার পাশে এসে বসলো জাবির।যদিও দূরত্ব বজায় রেখে।
“অনেকদিন পর তোমার সাথে কথা হলো রাফা।ফোন করলে একবারও তো তুলো না।এতোটা পর ভাবো?”
“আপন ছিলেন কবে জাবির ভাই?”
“অতীত মনে করে দেখো।এক সময় আমিই সবথেকে আপন ছিলাম।”
জাবিরের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো রাফার।তবে মুখে মোলায়েম হাসি বজায় রেখে বলল,
“আমাদের অতীত মনে করার বয়স আছে জাবির ভাই?”
জাবির হা হুতাশ করে শুধালো,
“আসলেও নেই তাইনা?জানো আমি তুমি বে ই মা নি করেছো আমার সাথে?”
“কেমন?”
“এইযে আমার ও রিনির বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বাড়ীতে জানালে কখনো বিয়ে করবেনা।যারা দেখতে আসতো তাদের ভা গি য়ে দিতে।কিন্তু কী হলো হুট করে বিয়ে করে বসলে।তাও আবার নীরদকে?”
“আমরা দুজনকে ভালোবাসে বিয়ে করেছি।”
“অসম্ভব।তোমাদের ওভাবে কখনো দেখা হয়নি।আমি জানি সেটা।”
রাফা উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়নি ওভাবে ভালোবাসা।বিয়ের আগে কদাচিত দেখা হতো। তখন থেকেই অনুভূতি কিংবা বিষাদের শুরু।আমরা দৃষ্টির সীমানায় না থাকলে কী হবে বলেন?মনের আঙিনায় ঠিকই একত্রে ছিলাম।তবে বিশ বছরের অতীত হঠাৎ আজ কী মনে করে উঠালেন?”
জাবির বিরক্ত হলো।নিজের বয়স্ক চুল টেনে বলল,
“আমি ও রিনি একটুও সুখি নেই জানো।একটা সন্তানের জন্য কতোটা লড়েছি।সেটা হয়নি দেখে আফসোস হয়না।কিন্ত দুজন এখন মনের দিক থেকে অনেক দূরে দূরে থাকি।বললে না অতীত কেন উঠালাম?আসলে অতীতের সেই মানসিক শান্তিটা নেই।একটুও নেই।তুমি নেই এজন্য বোধহয়।”
“অতীতের কথা এলো যখন তখন কিছু বিষয় না বললেই নয়।আপনাদের বিয়ের পর যখন প্রথমবার বাসায় আসা হলো সেদিন কী কী বলেছিলেন আমাকে মনে আছে?অবশ্যই থাকার কথা।বড় কঠিন করে ওই দিন রোগাটে উপাধি দিয়েছিলেন।আশ্চর্যের বিষয় জানেন।সেই সময়টাতে দারুণভাবে দিন দিন কু ৎ সি ত হয়ে যাচ্ছিলাম।অপর দিকে রিনির সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো ছিল।আমি মূলত মানসিক শান্তিটা পাচ্ছিলাম না।নির্ঘুম কতো যে রাত কাঁটিয়েছি।মজার ব্যাপার জানেন তখন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ ছিলনা।তিনি আমাকে পছন্দ করতেন আমি জানতাম।সাহস পাচ্ছিলাম না।আসল কথা বিশ্বাসটুকু ছিলনা।দীর্ঘ এক বছর পর হসপিটালে আবার যখন তার সঙ্গে দেখা হলো ঠিক তখুনি বুঝতে পারলাম বিষাদ না পেলে বাঁচতে পারবো না।আমার ডাক্তারকে প্রয়োজন।দেখেন আজ ভালো আছি।শান্তিতে আছে।অরু,অনয় আমাদের ঘর উজ্জ্বল করে রেখেছে।দিনশেষে সত্যিই একটা কথা খুব ভালো করে বুঝতে পারি।ডাক্তার আমাকে আনন্দে রেখেছেন।তার ভাষ্যমতে বিষাদে রেখেছেন।”
কথাগুলো বলার সময় রাফার চোখেমুখে এক উজ্জ্বল রেখা প্রকাশ পেয়েছিল।জাবির অবাক হয়ে সেটি দেখলো।রাফা নামক মানুষটিকে এতো সহজ কখনো দেখেনি।নিজের দুঃখকে আরো মেলে দিলো জাবির,
“রাফা,একটা কথা জানো।আমরা ভালো নেই।বড্ড একা দুজনে।সন্তান আসলেও মেটার করেনা।যদিও দিনশেষে শূন্য বাড়ীতে মন কেমন করে।রিনি এখন আলাদা ঘরে থাকে।আমি এখনও বুঝিনা এতো এতো ভালোবাসা কীভাবে শেষ হয়ে গেলো?”
“হয়তো নিজেদের মধ্যে সব চাওয়া পাওয়া শেষ।এজন্য জীবনে কিছু আক্ষেপ,চাওয়া থাকতে হয়।”
“তোমার সাথে আমি ভুল কিছু করেছিলাম।তাই এই বয়সে এমন হলো।মনে হয় কী জানো?আমি তুমি এক হলে ভালো থাকতাম।”
রাফা স্মিত হেসে বলল,
“আমি ভালো আছি।”
‘বিষাদিনী’ দূর হতে পুরুষালি কণ্ঠে চমকে উঠলো দুজনে।রাফাকে হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকছে নীরদ।ঠোঁটের হাসি চওড়া করে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে রাফা নামের মানুষটি।স্বল্প পথ কিন্তু কতোকিছু ভাবছে।যেখানে সব জীবনের পাওয়া।এইতো বেশ আছে সে।ডাক্তারের বিষাদিনী হয়ে।সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে মেয়ে,ছেলেকে মিথ্যা শাসানোর ভঙিতে রাফা বলল,
“ইশ,দুজনে বালুমেখে ভূত হয়ে আছে।জ্বর এলে সামান্য তম সেবা পাবেনা।”
দুটো বাচ্চা বাবার মুখের দিকে তাঁকালো।নীরদ এমনভাবে হাসলো যে হাসিতে ভরসা খুঁজে পাওয়া যায়।রাফা আরো একবার রা গ দেখিয়ে বলল,
“এইযে ডাক্তার ওরা আপনার সন্তান।বন্ধু না।কীভাবে ভিজে আছেন।দেখি আমার কাছে আসেন তো।”
নীরদ সুলভ বালকের মতোন রাফার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।নিজের আঁচলখানা দিয়ে তার শরীরের জলকণা মুছে দিচ্ছে।কপালে হাত ঠেকালো।চিন্তিত হয়ে বলল,
“গা গরম হয়ে আছে।নিশ্চয় আপনার জ্বর আসছে ডাক্তার।”
নীরদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো জবাব দেয়,
“একদম ভুল বিষাদিনী।বিষাদ লাগছে আমার।তুমি আশেপাশে থাকো।দেখবে ঠিক আছি আমি।”
ব্যস,এই কথাটি যথেষ্ট ছিল বিষাদময় এই নারীর জন্য।নিজের সবথেকে কাছের পুরুষটির কাঁধে মাথা ঠেকালো।চোখ বন্ধ করে সে জীবনের অপূর্ণতা গুলোকে স্মরণ করার চেষ্টা করছে।ভাগ্যিস কিছু না পাওয়া ছিল জীবনে।এজন্যই তো সে নীরদের বিষাদিনী হয়ে উঠতে পেরেছে।বেশ আছে সে।
(সমাপ্ত)