নীলাম্বুর গহীনে পর্ব ৫

#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৫
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
ভোর ৪ টা। আকাশ পথ আঁধার আলোয় পরিপূর্ণ ও মিশ্রিত। তবে আলো থাকা সত্ত্বেও পূব আকাশে লালচে রঙা সূর্যের হদিস মেলাও দুষ্কর। দূর থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে রুবাইয়ার কর্ণ ধারে। দক্ষিণা হাওয়ার বেগ গভীর থেকে মিষ্টতায় পরিণত হচ্ছে। কেমন যেন একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব বাতাসের মাঝে। চোখ কচলে চারিদিকে নজর বুলাতেই নিজেকে বেলকনির চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল রুবাইয়া। কিন্তু সে বেলকনিতে কী করছে? তাঁর তো এই মুহূর্তে বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কথা! পরক্ষনেই মনে পড়ল গতরাতের কথা…. ঘুম না আসার কারণে সে তো ইচ্ছে করেই বেলকনিতে এসেছিল। আর তখনই হয়তো নিজের অজান্তেই এখানে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘাড় এদিক ওদিক করে হাইম তুলে চেয়ার ছেড়ে রুমে এলো রুবাইয়া। বিছানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিলেও ফিরিয়ে নিল। বড্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। সামান্য হলেও পানি মুখে দিয়ে গলা ভেজাতে হবে। নয়তো আর ঘুম হবে না।দরজা খুলে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ার টেনে বসল। দুই ঢোক পানি খেয়ে উঠে যেতেই নজর পড়ল বাবা মায়ের দরজার নিচে। ভেতরে আলো জ্বলছে। তারমানে বাবা মা সজাগ। আচমকাই রুবাইয়ার মনে প্রশ্ন এলো, ‘ তাঁর মা কি এ জীবন নিয়ে সুখী? না-কি নিতান্তই ভদ্রতামি? লোক দেখানো সুখ! আচ্ছা, মা’র মনের কোনো এক কোণেতে কি এখনো সমুদ্রের বাস আছে? দীর্ঘশ্বাস আছে? অপ্রাপ্তির জালে ভরা ভাঙা হৃদয় আছে?’
মনের অজান্তেই বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল রুবাইয়া। আর পা বাড়ালো নিজ রুমে।
.
ইউশরা গোসল সেরে সেই কখন থেকে আশরাফকে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু আশরাফের উঠার নাম গন্ধও নেই। নাক ডেকে ঘুমিয়ে বিভোর। এরই মাঝে ফজরের আযান কানে ভেসে এলো ইউশরার। তাই আশরাফের পেছনে অগত্যা সময় নষ্ট না করে ওজু করে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে দু পাতা কোরআন শরীফ পড়ে ভেজা চুল ছেড়ে দরজা খুলে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। তিন বার্নারের চুলো। ফ্রিজ থেকে তরকারির পাতিল সব নামিয়ে চুলো জ্বালালো। এক চুলোয় ভাত, এক চুলোয় চায়ের জন্য গরম পানি ও আরেক চুলোয় গতকালের রান্না করা মুরগী গোস্ত গরমে বসালো। চিনি, গুঁড়া দুধ পরিমাণ মতো অন্য একটি ছোট পাতিলে ঢেলে, চা পাতা হাত নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল পানি বলক উঠার। পানি বলক উঠতেই হাতে থাকা চা পাতা ঢেলে দিল ইউশরা। ওমনি পেছন থেকে ‘মা’ শব্দটি কানে বেজে উঠল। পেছনে ঘুরে বলল,
” রুবাইয়া! এত সকালে? কী ব্যাপার? কিছু বলবি? খিদে পেয়েছে? কিছু বানিয়ে দেব?”
রুবাইয়া রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” কেন? আমি কি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারি না? নিষেধ আছে? ”
” না তা না, কিন্তু তুই তো স্বাভাবিকভাবেই এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠিস না। তাই আর কি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ”
” ও…. আসলে ঘুম আমার আরও আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তাও শুয়েছিলাম। শুয়ে শুয়ে এ’কাত ও’কাত করছিলাম। হঠাৎই রান্নাঘর থেকে থালা বাসনের টুংটাং শব্দ এলো, আন্দাজ করতে পারলাম তুমি উঠে পড়েছ। আর তুমি তো অলয়েজ ভোরেই উঠো। সেজন্য মোটামুটি শিউরও ছিলাম। তাই হাতমুখ ধুয়ে সোজা তোমার কাছে চলে এলাম।”
” ভালো করেছিস। এখন থেকে ভোরে উঠতেই চেষ্টা করবি। যেন নামাজ পড়ে সকাল টা শুরু করতে পারিস। ”
রুবাইয়া মুচকি হাসল। বলল,
“ইনশাআল্লাহ মা।”
ইউশরাও স্মিত হেসে তরকারির জাল কমানোর উদ্দেশ্যে নিচু হতেই ছাড়া চুলগুলো সামনে এসে পড়ল । এই মুহূর্তে তাঁর বড্ড লজ্জা করছে। ইচ্ছে করছে মরে যেতে। এত ভোর বেলা যুবতী মেয়ে মায়ের ভেজা চুল দেখা, সত্যি ভয়ংকর লজ্জার সামিল। তড়িঘড়ি করে ইউশরা ছাড়া চুলগুলো টেনে শক্ত ভাবে খোপা করল। ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলল,
” চা হয়ে গিয়েছে। চা দেব? খাবি?”
ইউশরার লজ্জার কারণ রুবাইয়া বুঝতে পারলেও প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,
” দিবে…দাও। তবে আমি কিন্তু একা খাবো না। দু’জন মিলে খাবো। তোমার জন্যেও নিও।”
” আচ্ছা বেশ নিব। তুই গিয়ে ড্রয়িং রুমের বেলকনিতে বস। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি। ”
” আচ্ছা মা। ”
রুবাইয়া চলে যেতেই চোখ বুজে বুক চেপে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল ইউশরা। মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে ট্রে তে করে হাফ প্ল্যাট ড্রাই কেক আর দু কাপ চা নিয়ে এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে।
ওদিকে রুবাইয়া ইউশরাকে বেলকনির ভেতর আসতে দেখে বেলকনিতে রাখা গাছগুলো ছেড়ে চেয়ারে এসে বসল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল,
” আজ অনেকদিন বাদে ভোরবেলা একসাথে চা খাবো তাই না মা? ”
” হুম, ভালো লাগছে না?
” হ্যাঁ অনেক…. ”
“তুই-ই তো উঠিস না। কত ডাকি… কিন্তু ঘুম বলে কথা ছাড়তে তো পারিস না। পুরোই বাপের ডুপ্লিকেট হয়েছিস।”
” শুধু কি আমি? তোমার ছেলেও তো ঘুমে পাগল। ”
” সেই…..আমার মত কেউ হলি না।দুটোই বাপের কার্বনকপি হলি। ”
ইউশরার কথা শুনে রুবাইয়া দাঁত কেলিয়ে দিল। সেই সাথে ইউশরাও তাল মেলালো। চা খেতে খেয়ে হঠাৎই রুবাইয়ার গতকালের কথা মনে পড়ল। চায়ে চুমুক দেয়ার ফাঁকে বলল,
” মা! ”
” হুম। ”
” তারপরের টুকু বলবে না? সমুদ্র সেদিন কী বলেছিল……”
ইউশরা বেশ চমকে গেল! এই ভোরবেলা মেয়ের মাথায় এগুলো ঘুরছে! অবশ্য বয়স টাই এরকম। না চাইতেও বারংবার প্রেম জনিত ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খায়। আর যদি হয় বাস্তব জীবনী তাও মায়ের তাহলে তো কথাই নেই।
তাই ব্যাপারটি স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে ইউশরা বলল,
” এখন? এখন তো চুলোয় ভাত। কথার তালে ভুলে গেলে ভাত পুরো শেষ হয়ে যাবে। তারউপর তোর বাবা অফিস যাবে। তাকে ডেকে উঠাতে হবে। খাওয়াতে হবে। মেলা কাজ রে সোনা। তোকে না-হয় পড়ে সময় করে শোনাবো। ”
” না মা পরে না, এক্ষুনি শুনব। আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি এসব ভেবে ভেবে। আর তুমি ঘড়ির দিকেই দেখো কেবল সাড়ে ৪ টা বাজে। বাবা উঠতে উঠতে মিনিমাম ৬ টা বাজবে। হাতে এখনো দেড় ঘন্টা আছে। অনেকটা সময়। বলে ফেলো না মা। ”
” কিন্তু……..”
” প্লিজ মা! ”
ইউশরা চায়ের কাপে শেষ চুমুক টি দিয়ে কাপটি টেবিলের উপর রাখল। চেয়ারে এলিয়ে বসল। বলল,
________________
সমুদ্র আমার ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
” তুই কারো নজর কাড়তে পারিসনি কে বলেছে? আন্দাজের উপর কখনো কথা বলবি না বুঝলি? আর হ্যাঁ , বাসায় গিয়ে আজই বলে দিস তোর পাত্র ঠিক হয়ে গিয়েছে। যে তোর সাথেই পড়ালেখা করে। দেখতে শুনতেও খারাপ না। বর্তমানে বেকার হলেও ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খুবই ভালো। তোকে আরাম আয়েশেই রাখবে। আর হ্যাঁ, ছেলের নাম যদি জিজ্ঞেস করে বলে দিস সমুদ্র। ”
সবাই হা হয়ে তাকিয়েছিল সমুদ্রের দিকে। আর আমার তো বন্ধ মুখ একেবারে খোলা। চোখ দুটো যেন বেড়িয়ে আসবে আমার। কিন্তু সমুদ্র খুবই স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বলে আমার পাশে এসে বসল। আমি যেন এক অন্য সমুদ্রকে দেখেছিলাম সেদিন। গর্ভে বুক ভরেও আসছিল আবার চোখে জলও।
ওসমান ভ্রু কুচকে বলল,
” সমুদ্র তুই কি ঠিকাছিস? না মানে তোর মুখ দিয়ে এসব কথা….আচ্ছা, তুই কী ইউশরাকে প্রপোজ করলি না-কি বিয়ের প্রস্তাব দিলি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আর শুধু আমি কেন? আমার তো মনে হয় এখানের কেউই কিছু বুঝতে পারেনি।”
সমুদ্র আমার হাত ধরে বলল,
” প্রপোজ কোনটা আর বিয়ের প্রস্তাব কোনটা আমি জানি না রে। তবে এটা জানি, এই যে ইউশরার হাত ধরেছি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখব। যদি না, ইউশরা ছাড়ার চেষ্টা করে।”
বলেই আমার দিকে সমুদ্র তাকালো। বলল,
” আমি কিন্তু বড্ড প্রকৃতি প্রেমি। আর তুই সেটা খুব ভালো করেই জানিস। ট্যুর দিতে দিতেই আমার মাস যায়, বছর যায়। তাই সহজেই আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। সময় লাগবে। পারবি তো অপেক্ষা করতে। ”
আমি চুপ করেছিলাম। সমুদ্র ফের বলল,
” আমি কিন্তু তোর কাছে হ্যাঁ কিংবা না এসব কোনো টাইপের মতামত জানতে চাই নি ইউশরা। কারণ আমি জানি আজ না, অনেক আগে থেকেই তুই আমাকে পছন্দ করিস। শুধু পছন্দ বললে ভুল হবে কেননা তুই আমাকে মারত্মক ভালোবাসিস। যেটা আর কেউ অনুভব করতে না পারলেও আমি পেরেছি। কারণ আমার কাজই বিভিন্ন অনুভূতির উৎস নিয়েই খেলা করা। বিশ্লেষণ করা। তাই তোর এই অনুভূতির উৎস বের করতে আমার তেমন সময় লাগেনি।”
সমুদ্রের কথা শেষ হবার আগেই আমার কান্নার বেগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। নীরব কান্নারা যেন সহস্র শব্দ ভান্ডার খুঁজে পেল। সমুদ্রের থেকে হাত ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
” এত যখন বুঝিস বলিস না কেন আগে? কেন একের পর এক পাত্রের চক্ষু ভোগ হতে বাধ্য করেছিস। অপ্রয়োজনীয়, অবান্তর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দিয়েছিস? তুই জানিস কতটা কষ্ট হতো আমার? কতটা বিব্রত বোধ করতাম?”
একদমে কথাগুলো বলেই থেমে গিয়েছিলাম। আর কিছু বলতে পারলাম না। গলা ব্যাথা করছিল আমার। তবে সমুদ্র হাসছিল। আলতো করে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল,
” অনুভব করতে চেয়েছিলাম। তোর প্রতি আমার অনুভূতি গুলো কী শুধুই বয়সের মোহো না-কি মনের গহীনে বিরাজ করা টান।”
আমি নীরবতাকে সঙ্গী করে নিঃশব্দে সমুদ্রের বুকে পড়ে কাঁদতে লাগলাম। টুশব্দটি করলাম না। কেননা সমুদ্রের বুক সমুদ্রে ক্ষনিকের জন্য ভাসতে আমি চাইনি। চেয়েছি অফুরন্ত সময়ের জন্য ভাসতে। তাই অযথা কথা বলে সমুদ্রের সাথে এই মিশে থাকা অনুভূতি আমি হারাতে পারব না।তাউ চুপচাপ সমুদ্রের বুকে লেপ্টে নিজেকে অজানা ভুবনে বিসর্জন করেছিলাম।
______________
” মা! ”
রুবাইয়ার ডাকে ইউশরার ধ্যান ভাঙল। বলল,
” কিছু বলবি? ”
রুবাইয়া মিটি মিটি হেসে বলল,
” সেদিন থেকেই বুঝি হাতে হাত রেখে তোমাদের পথ চলা শুরু? ”
ইউশরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
” হুম। ”
” আচ্ছা মা, সমুদ্র কি সত্যিই এভাবে নিজের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করেছিল?তাঁর প্রপোজ স্টাইল এরকম সাদামাটাই ছিল? ”
” কেন? মায়ের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? সন্দেহ হচ্ছে?”
” না না, সন্দেহ কেন হবে? আমি তো অবাক হয়েছিলাম। কারণ এরকম প্রপোজও যে কেউ করতে পারে অবিশ্বাস্য ছিল। ভালোবাসি বলল না অথচ প্রপোজ করল। কেমন যেন!”
” ভালোবাসা কী মৌখিক যে মুখ ফুটে না বললে হবে না? ভালোবাসার বাস তো অন্তরের অন্তস্থঃতলে। যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। অনুভূতিই যথেষ্ট। ”
” কিন্তু আমাদের বেলা তো এরকম না মা। এই যে কতদিন আগের ঘটনা, আমার এক ফ্রেন্ড তার গার্লফ্রেন্ডকে আই লাভ ইউ বলেনি তাই ব্রেকাপ। আই লাভ ইউ না বলল না-কি ভালোবাসার প্রুভ হয় না। তাহলে তোমাদের কী করে হতো? আমার তো মাথাতেই ধরে না।”
ইউশরা মিনিট দুয়েক হাসল রুবাইয়ার কথা শুনে। রুবাইয়া ড্রাই কেক মুখে দিতে দিতে বলল,
” কী ব্যাপার মা..হাসছ যে? আমি কি হাসির কিছু বলেছি?”
” না, তুই হাসির কী বলবি। আমি তো হাসছি তোদের যুগের কথা ভেবে। আই লাভ ইউ না বললেই ব্রেকাপ। হায়রে কপাল! দিনে দিনে যে আরও কতকিছু দেখব সেটাই ভাবছি আর হাসি পাচ্ছে। ”
হঠাৎই নাকে যেন একটা পোড়া গন্ধ এসে ঠেকল ইউশরার। কিন্তু কী পোড়ার গন্ধ তাই বুঝতে পারছে না। পরক্ষনেই মনে পড়লো চুলোয় বসানো ভাতের কথা। মাথায় হাত দিয়ে বলল,
” এই রে ভাত……… গজব হয়ে গিয়েছে। ভাত আমার শেষ। ”
বলামাত্রই এক দৌড় দিল ইউশরা। আর পেছন পেছন দৌড় দিল রুবাইয়াও।
.
.
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here