#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৭
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
” কীরে এখনো রেডি হোসনি? পাত্র পক্ষ চলে এলো বলে। কী যে করিস না….. তোর বাবা জানতে পারলে তুলকালাম বাঁধিয়ে ছাড়বে।”
বলেই আলমারি থেকে একটি নীল রঙা শাড়ি নামিয়ে দিল মা। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম মায়ের দিকে! কী বলছে মা এগুলো? পাত্র পক্ষ আসছে মানে কী? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। তাই সংশয়পূর্ণ গলায় বললাম,
” পাত্র পক্ষ আসছে মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না মা।”
” কেন? তোর ছোট চাচী তোকে কিছু বলেনি? ঘন্টা খানেক আগেই হুট করে খবর এলো পাত্র পক্ষ তোকে দেখতে আসবে। এদিকে বিস্কুট ছাড়া ঘরে তেমন কিছুই নেই। তাই আমি পায়েস আর পিঠা বানানোর কাজে চলে যেতেই ছোটকে বলেছি তোকে বলে দিতে। যেন সময় মতো রেডি হয়ে থাকতে পারিস। ছোট টা যে কী না, সব ভুলে যায়। ”
” ও…..”
” শুনেছি ছেলে বিদেশ ফেরত। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বিষয়সম্পত্তি অনেক। পরিবারও ভালো। উচ্চ বংশের। ছেলে আবার বি এ পাশ। তবে…. বয়স টাই বেশি। চৌত্রিশের উর্ধ্বে হবে। ”
” ও…..”
” হুম।”
কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে ‘মা!’ বলে ডাক দিতেই মা আঁৎকে উঠল। চোখ দুটো চেপে তাকালো। হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমার ‘মা’ ডাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সহস্র আর্তনাদের গভীরতা। আমি মায়ের সেই চাপা দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে বললাম,
” আমার পড়ালেখা, ভবিষ্যৎ, জীবনের চাওয়া-পাওয়া এগুলোর কী হবে মা? ”
মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
” তোর বিয়ে আটকাতে গিয়ে কম তো পিঠে চোট খাইনি রে মা। তোর বাবা হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দিয়েই আঘাত করেছে। বয়স হয়েছে। শক্তিও কমে আসছে। আর যে পারছি না। তারউপর মানুষও তো নানান কথা বলছে। তোর সাথের মেয়েদেরই দেখ, দু-তিনটা ছেলেমেয়ের মা-ও হয়ে গিয়েছে। সেখানে তুই এখনো অবিবাহিত। আর কত? যা পড়েছিস তা নিয়েই না’হয় সন্তুষ্ট থাক। ”
মায়ের অপারগতায় জড়িত প্রতিটি শব্দ শুনে আর ইচ্ছে করেনি নিজের ইচ্ছেগুলো মেলে ধরতে।মায়ের যন্ত্রণা দ্বিগুণ থেকে চৌগুণ করে দিতে। বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে শাড়ি পড়তে শুরু করলাম। হোক সে ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে।
মিনিট বিশেকের মধ্যে পাত্র পক্ষ এসে হাজির হলো আমাদের বাড়িতে। বাবা, চাচা, ভাইসহ সবাই তাদের যত্ন আদ্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ততক্ষণে আমিও পুরোপুরি রেডি। ফুলহাতা ব্লাউজের সাথে কুচি দেয়া নীল রঙা শাড়ি। চুলগুলো ঢিল বেনী করে পিঠে রাখা। কপালে ছোট্ট নীল টিপ। আর ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক। গায়ের রঙ তো শ্যামা ছিল তারপরও নীল রঙটা যেন গায়ে ফুটে ছিল।
অস্থির মন নিয়ে বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসেছিলাম। আর তখনি ডাক পড়ল ছোট চাচীর। পাত্র পক্ষ’রা তাড়া দিচ্ছে। পাত্রীর দর্শন তাঁদের দ্রুত চাই। ব্যস্ত মানুষ তাঁরা। অকারণে বসে থাকার মত পর্যাপ্ত সময় তাঁদের হাতে নেই। আমিও তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলাম। হাতে জুসের ট্রে। বসার ঘরে সবাইকে সালাম দিয়ে ঢুকতেই লক্ষ্য করলাম, পাত্র পক্ষদের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে গিয়েছে। অবশ্য এটা আমার জন্য নতুন কিছু ছিলও না। বেশিরভাগ সময়ই পাত্র পক্ষদের ভ্রু আমি কুচকে যেতে দেখেছি। ওই যে, গায়ের রঙ শ্যামা। আর যারা হাসি মুখে আমার পানে তাকিয়েছে কোনো না কোনো কারণে তাঁদেরকে বাবার পছন্দ হয়নি। এভাবেই চলছি দেখাদেখির পালা। তবে এতে কিন্তু আমি বড্ড খুশি ছিলাম। যেভাবেই হোক বিয়ে তো ভাঙছে। আর আমিও সময় পাচ্ছি। তো….জুস পাত্র পক্ষদের সম্মুখে এগিয়ে ধরতেই পাত্রের মা বলেন,
” আমরা কেউ জুস খাবো না, টেবিলে রেখে দাও। ”
আমিও মাথা নাড়িয়ে ট্রে টেবিলের উপর রেখে সবার মাঝের চেয়ারে বসলাম। পাত্রের মা বলে উঠলেন,
” মেয়ের রঙ যে ময়লা আপনাদের কী বলা উচিৎ ছিল না? আমাদের একমাত্র ছেলেকে অবশ্য আমরা ময়লা মেয়ে বিয়ে করাবো না। তারউপর মেয়ের বয়সও তো কম না। কম করে হলেও ২০/২১ হবে। এতবড় মেয়েকে বিয়ে করিয়ে কী ছেলের গলায় দড়ি পড়াব না-কি? ”
আমি এক পলক বাবার দিকে তাকিয়েছিলাম। মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিল বাবা। খুব কষ্ট হচ্ছিল বাবার জন্য। কম তো আর হলো না এই গায়ের রঙের জন্য অপদস্থ। আর কত? চাচা পাশ থেকে নরম গলায় বলল,
” গায়ের রঙ টাই তো সব না ভাবি। সবকিছু মিলিয়ে যে পরিপূর্ণ সেই সুন্দর। আমাদের ইউশরার কিন্তু অনেক গুণ মাশা আল্লাহ। হাতের কাজের থেকে শুরু করে রান্নাবান্নাসহ সবকিছুতেই পারদর্শী। পড়ালেখা তেও খুব ভালো। কলেজের খুব উপরের ক্লাসে পড়ে। খুব ভালো ছাত্রী। ”
পাত্রের বাবা আমার উদ্দেশ্যে বলেন,
” কীসে পড়ো তুমি?”
” জি, অনার্স তৃতীয় বর্ষে। ”
” ওরে বাব্বাঃ…. এত উপরে!”
আমার বড় ভাই একরাম বলল,
” জি কাকা। অনেক উপরে পড়ে। আমরা বাকি ভাই বোনেরা তো ক্লাস ফাইভ পাশও করিনি। কিন্তু ইউশরা অনেক দূর অবধি পড়ালেখা করছে।”
পাত্রের মা বলেন,
” ভেবেছিলাম মেয়ের বয়স ২০/২১ হবে। এখন তো দেখছি না হলেও ২৩ এর উপর হবে। বিয়ে করালে সবাই বলবে ছেলের খালাম্মা বিয়ে করিয়ে নিয়ে এসেছি।না না, এ বিয়ে হবে না। এই তোমরা উঠতো এখানে বসে থেকে আর কোনো লাভ হবে না। উঠো উঠো।”
বলেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লেন সকলে। চলে যাবার জন্য পা বাড়াতে নিলেই বাবা তাদের কাছে হাতে জোর করলেন। বহু অনুতি মিনতি করে বললেন যেন এভাবে না চলে যায়। কিন্তু তাঁরা সেদিকে পাত্তা দিলেন না। হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মায়ের কাছে গিয়ে চড়া গলায় বলল,
” ঘরে বসিয়ে বসিয়ে মেয়েকে কুমরো পাকা বানিয়েছিলি না? বোঝ এবার পাকা কুমরোর জ্বালা কত।”
বাবার কথার ভাজে স্পষ্ট ফুটে উঠছিল সত্যি সত্যি আমি কতটা বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর চোখে। সকলের সামনেই আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। তবে….. নিঃশব্দে।
পরেরদিন সকাল ৯ টা। কলেজ ক্যান্টিনে বসে আছি সবাই। সমুদ্র আমার থেকে দু চেয়ার পরে বসে। গতকালের পুরো ঘটনা শুনে সবার মুখই ভার কেবল সমুদ্র ছাড়া। কেননা সমুদ্রের ধ্যানজ্ঞান ছিল ক্যান্টিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটির উপর। ওসমান বলল,
” কী রে সমুদ্র? তুই ওদিক কী দেখছিস? ইউশরা কী বলছে শুনছিস না?”
” হুম শুনেছি তো। ”
” তাহলে কিছু বলছিস না যে? ”
” কী বলব? এখানে আমার কী বা বলার থাকতে পারে। ”
” আশ্চর্য মানুষ তো তুই! একটি মেয়ে যে কি-না তোকে ভালোবেসে এতকিছু সহ্য করছে আর তুই…. সেগুলো মনেই গাঁথছিস না? মনের ভেতর জেদ সৃষ্টি করছিস না? ”
সমুদ্র কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
” বাদ দেয় ওসমান। ও কখনো কিছু বুঝেছে না-কি যে আজ তোর কথা বুঝবে? ও কেবল প্রকৃতির কথা বুঝতে পারে। প্রকৃতির ব্যাথা অনুভব করতে পারে। তোর, আমার, আমাদের কথাও বুঝবে না আর ব্যাথাও অনুভব করবে না। ”
আমার কথা শেষ হতেই সমুদ্র আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
” একটু ওদিকে চল।”
” কোনদিকে?”
” পেছনের দিকে।”
” পেছনে? পেছনে কেন?”
” কথা আছে কিছু।”
” কথা থাকলে এখানে বল। ওদিক যেতে হবে কেন?”
” প্রয়োজন আছে বলেই তো ডাকছি। চল….”
” না, আমি কোথাও যাবো না। যা বলার এখানেই বল। তোর সাথে আমার কখনোই এমন কোন কথা হয় না, যেটা কি-না সবার সামনে বলা অযোগ্য। তাই যা বলার এখানেই বল। আমক পেছনে যাব না।”
” দেখ, আমি ওসব নোংরামো চিন্তাধারার ছেলে না যে তুই আমার সাথে পেছনে যেতে পারবি না। ওরকম চিন্তা ভাবনা থাকলে এতদিনে অনেক কিছুই হয়ে যেত। কিন্তু আমি ওসব পছন্দ করি না। যার দরুণ আমাদের সম্পর্ক বছরের গন্ডি পেরোলেও তোর হাত আজ অবধি ধরি নি। অতএব আমি মনে করি না, অন্তত আমার সাথে তোর পেছনে যেতে কোনোপ্রকার সমস্যা কিংবা মনের ভেতর দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করতে পারে।”
ওসমান বলল,
” যা না ইউশরা। কথা বাড়াচ্ছিস কেন? দেখ ও কী বলতে চায়। হয়তো তোর সাথে ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু কথা আছে তাই যেতে বলছে। আর এমনিতেও সবকথা সবার সামনে বলা উচিৎ না। যতই কাছের কেউ হোক না কেন।”
” আমার তো ওর সাথে ব্যাক্তিগত কোনো কথা নেই। যে কি-না আমার কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝে না, তাঁর সাথে ব্যাক্তিগত কথা থাকতে পারে বলে অন্তত আমি মনে করি না।”
” তুই কিন্তু বেশি করছিস ইউশরা। সমুদ্র তোকে যেতে বলছে তুই যা। শুনে আয় কী বলে।”
সমুদ্র বলল,
” কী যাবি?”
আমি মুখে কিছু না বলে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে পা বাড়ালাম। পেছন পেছন এলো সমুদ্র। ক্যান্টিনের পেছনের বট গাছের শেকড়ের উপর বসল সমুদ্র। আর আমি কিছুটা দূরে সরে সামনের শেকড়ে বসলাম। সমুদ্র একটি ছোট ইটের চাড়া হাতে নিয়ে বলল,
” সমস্যা কী? ”
আমি চুপ করে রইলাম। সমুদ্র আবারও বলল,
” কী হলো কথা বলছিস না যে? এতক্ষণ তো খুব কথা বললি এখন চুপ কেন? ”
” তুই যেই প্রশ্ন করেছিস তাঁর উত্তর আমার জানা নেই। তাই চুপ করে আছি।”
” মানে?”
” মানে আবার কী? তুই সবকিছু জানার পরেও আমার থেকে সমস্যা জানতে চাস। যেন তুই কিছুই জানিস না। তাহলে এর উত্তর আমি কী দিব তুই-ই বল।”
” আমি সেসব জানতে চাইনি। আমি জানতে চেয়েছি তোর সমস্যা কী? তুই কী চাস? ”
” আমি কী চাই? আচ্ছা, আমার চাওয়া গুলো কী তুই জানিস না? তোকে বলি নি? না-কি ভুলে গিয়েছিস? নতুন করে বলতে হবে?”
বেশ উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম। সমুদ্র আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
” আস্তে কথা বল। চারিদিকে মানুষ ভর্তি। ”
আমিও চুপ হয়ে গেলাম। তবে মুখ বন্ধ হলেও নতুন করে সংযোজন হলো চোখের জল। সমুদ্র বলল,
” কাঁদছিস কেন? আচ্ছা, সম্পর্কের শুরুতে কী আমি বলিনি আমার সময় লাগবে? আমি এখন বিয়ে করতে পারব না। আমি বেকার, কামাই নেই….. বলিনি? ”
আমি মাথা নাড়লাম। সমুদ্র বলল,
” তাহলে এখন কেন এমন করছিস? আমি তো এ-ও বলেছিলাম যে, আমি মারাত্মক ভাবে প্রকৃতি প্রেমি। প্রকৃতির ছোট ছোট বিষয় আমায় খুব করে টানে।এমনকি এটা সম্পর্কের আগেই তুই ভালো করে বুঝে গিয়েছিলি। তাহলে এখন কেন এই প্রকৃতি প্রেমে আঙুল উঠে? ”
” তোর প্রকৃতি কিংবা তোর অনুভূতি এসব নিয়ে তো কেউ কিছু বলে না। আর না আঙুল উঠায়। তোকে বলা হয় প্রকৃতি আর তোর মাঝকার সম্পর্কের প্রতি তুই যতটা চর্চা করিস ততটা চর্চা যেন আমাদের সম্পর্কের মাঝেও করিস। প্রকৃতির ব্যাথা অনুভব করার পাশাপাশি আমার ব্যাথাও অনুভব করিস। এটা কি ভুল সমুদ্র?”
” চর্চা বলতে কী বুঝাস? আর দশটা প্রেমিক প্রেমিকার মত গাছের পেছনে, পার্কের কোণে বসে রঙ তামাশা করা? সিনেমা হলে সিনেমা দেখার কথা বলে নিয়ে গিয়ে নষ্টামি করা? কিন্তু আমি যে ওসব চর্চায় ধ্যান দিতে পারব না। কেননা ওসব চর্চা আর কাউকে মানালেও সমুদ্রকে মানায় না। ”
” তুই কিন্তু উল্টো টা বুঝলি সমুদ্র।”
” উহু…..একদম ঠিক বুঝেছি। তোর কাছ ঘেঁষে বসি না, হাতে হাত রাখি না, বিয়ে করব করব বলে মন মাতিয়ে রাখি না এগুলোই তো সমস্যা। ”
সমুদ্র সবসময় এরকম উল্টো পালটা কথা বলত। আর আমি চুপ করে শুনে যেতাম। সহ্য করে যেতাম। কিন্তু সেদিন কী যেন হলো আমার। বসা থেকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
” আমারই ভুল। হ্যাঁ হ্যাঁ , আমারই ভুল হয়েছে যে, তোর মতো ছেলের জন্য এতগুলো দিন নষ্ট করেছি। ঘরে বসে বসে বাবার অন্ন ধ্বংস করেছি। তোর কথা না ভেবে বাবার কথায় যে কাউকে বিয়ে করে নিতাম সেটাই ছিল ভালো। ঘরের অপমানও সহ্য করা লাগত না, আর না তোর অপমান সহ্য করা লাগত।”
বলেই বড় বড় পা দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম।
.
.
চলবে…….