#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৬
গ্ৰীষ্মের মাঝামাঝি সময়। মধ্যাহ্ন ছাড়িয়েছে। সূর্যের তীব্র রশ্মিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। ঘামে শরীরের জামাকাপড় এক প্রকার লেপ্টে আছে শরীরে। একটার পর একটা গাড়ির রাস্তা অতিক্রম করে চলেছে। কখনো জ্যামের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কখনো শুনশান নীরবতায় গাড়ি ছুটে চলেছে। ইমারজেন্সি থাকার কারণে সকালে না খেয়েই বেরিয়েছে তাহসান। ভাইকে দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তৃষ্ণা। মিনিট দশেকের জায়গায় পাক্কা পঁচিশ মিনিট পর সিএনজি এসে থেমেছে হসপিটালের সামনে। সিএনজির ভেতর থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে ভাইয়ের হসপিটালে এসে পৌঁছেছে কি-না পরখ করে নিলো তৃষ্ণা। ঠোঁটের কোণে তখন এক তৃপ্তিকর হাসির রেখা দেখা গেল তার। ডোর খুলে বামপা বাড়িয়ে মাটি স্পর্শ করলো সে। মাথা এগিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে পার্স বের করে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিল। ড্রাইভার ক্যাশ বাক্সে টাকাটা রেখে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো। টাকাটা নিলো না তৃষ্ণা। মৃদু হেসে ভেতরে থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বের করে হসপিটালের ভেতরে ঢুকে গেল।
ভাইয়ের চেম্বারে বসে বাইরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তৃষ্ণা। এখনো তাহসানের আসার খবর নেই। এসিস্ট্যান্ট পাঠিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছে তাহসান। তাই শান্তমনে ভাইয়ের কেবিনে বসে আছে।
কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কারো প্রবেশের পদধ্বনি কানে এলো তৃষ্ণার। চমকে উঠলো না সে। ভালোভাবেই জানে ভাই এসেছে। তাহসান পড়নের এফ্রোন খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তৃষ্ণা ভাইয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে খাবার গুলো যত্ন সহকারে সাজিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ভাইয়ের জন্য।
তাহসান বের হয়ে তোয়ালের সাহায্যে শরীরের পানি গুলো মুছে খাবার খেতে বসলো। খাওয়ার ফাঁকে ভাইয়ের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলল…
— “ভাইয়া তুমি খাওয়াতে এতো অনিয়ম করছ কেন”?
আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পূর্ণরায় সম্পূর্ণ মনযোগ খাওয়া দিলো। কিন্তু খাবারটা শেষ করলো না। হাত ধুয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল ..
— “জানিস তৃষ্ণা,, তুই আর তিশা আমার কাছে অধিক প্রিয়। কতোটা প্রিয় বোঝাতে পারবো না।
ঠিক তেমনি বোনগুলো সবসময় ভাইয়ের কাছে প্রিয় হয়। আজ বোনের জন্য ভাইয়ের কান্না দেখে হতবাক হয়ে গেছি আমি। জানিস,
গত দুদিন আগে হসপিটালে দুইজন ভাই -বোন এডমিট হয়েছে। বোনকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে গিয়ে গাড়িটা হঠাৎ এক্সিডেন্ট হয়েছে। ভাইয়ের মাথায় সামান্য তম আঘাত লেগেছে আর বোনের পুরো শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ব্লাড লস হয়েছে। ভাই সব জায়গায় পাগলের মতো খুঁজেও রক্তের যোগার করতে পারে নি। মেয়েটা বাঁচবে কিনা এখনো সিউর জানা নেই”।
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন তাহসান। তৃষ্ণা মাথা নিচু করে এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাই বোনের জন্য কষ্ট হচ্ছে তার। আচম্বিতে তার ভেতরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এলো। যে করেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে, অন্তত তার ভাইয়ের জন্য। প্রয়োজনে পুরো ভার্সিটি খুঁজে রক্তের যোগার করবে সে। চক করে প্রশ্ন ছুঁড়ল।
— “ভাইয়া, মেয়েটার ব্লাড গ্ৰুপ কি”?
–” A-“।
শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিয়ে বড় সড় শ্বাস টানলো সে। নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল…
— “ভাইয়া আমি রক্ত দিতে চাই। আমি কাউকে ডোনেট করছি না। এটা তার ভালোবাসা প্রতি শ্রদ্ধা”।
তিনি জানতেন, তার বোনের রক্তের গ্রুপের সাথে মেয়েটির রক্তের গ্ৰুপের মিল রয়েছে। কিন্তু সরাসরি বোনকে প্রেসার দিতে চাই নি, তাই উল্টোভাবে বলে বোনকে ইমপ্রেস করেছে।
বোনের দিকে তাকালেন তাহসান। বোনের চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। চোখের অশ্রু গুলো টলটল করছে। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। তার বোনকে আজ মহীয়সী নারী থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। আজ গর্ব হচ্ছে তৃষ্ণার জন্য। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি দিয়ে বললেন..
— ব”ড় হ বোনু। অনেক বড় হ। দেশের এবং দশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত কর।
চল তাহলে”।
সাথে সাথে দুজনেই বেরিয়ে গেল।
বর্তমানে__
নিষুপ্তি উগ্ৰে বেডের পাশে হাত রাখতেই ফাঁকা অনুভব করলো আয়াত। দ্রুত চোখ খুলে পাশে তাকালে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা তার নজরে এলো না। মনের মাঝে চরম ভয় কাজ করলো তার। তাহলে কি তৃষ্ণা চলে গেছে। বেডের উপর ভর করে উঠে বসলো সে। বেলকেনির দরজা খোলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল। তৃষ্ণাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। শব্দহীন পায়ে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে পাশে বসে পড়লো। বাইরে তখন রোদের সোনালী আলোর খেলা চলছে। আজকে তৃষ্ণার ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু। কালকে রাতে তাহসান বই খাতা দিয়ে গেছে। দুগালে হাত রেখে স্লো কন্ঠে বলল…
— “তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা। দেখো সকাল হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে যাবে না”।
নিভু নিভু চোখ খুলে তাকালো তৃষ্ণা। পূর্বের ন্যায় চোখ বেষ্টিত করে ধরা গলায় বলল..
— “প্লীজ আয়াত ঘুমাতে দাও। প্রচুর ঘুম পেয়েছে। কালকে থেকে সত্যি কলেজে যাবো দেখো”।
ফোঁস করে দম ছাড়লো আয়াত। সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেছে এখনো বলছে কালকে ভার্সিটিতে যাবে। দোলনার হাতল থেকে মাথা তুলে কাঠ কাঠ গলায় বলল…
— “কবে যাবে সেটা আমার জানার দরকার নেই। আজকে যাবে কি-না সোজা উত্তর দিবে”।
বেশ সুবিধা হলো তৃষ্ণার। আয়াতের হাত ছাড়িয়ে ঘুম ঘুম চোখে সংক্ষেপে উওর দিলো… ” না”
প্রচন্ড পরিমানে রেগে গেল আয়াত। ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভেতরে যেতে যেতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে গেল..
— “আমি বুঝে গেছি, তুমি কি চাইছ। আজ বলছ, কাল যাবে আর কাল বলবে পরশু যাবে। এমন করলে তোমার আর যাওয়া হবে না। তারচেয়ে বরং আমি তোমার বই খাতাগুলো পুড়িয়ে ফেলি”।
মস্তিষ্ক সচল হতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো তৃষ্ণা। নিজের পাশে আয়াতকে না দেখে একছুটে দৌড়ে রুমে চলে গেল। আয়াতের কোনো বিশ্বাস নেই। সে-সব করতে পারে।
আয়াত বই ছোঁয়ার আগেই কেড়ে নিল তৃষ্ণা। বইগুলো বুকে আগলে কপাল কুঁচকে জবাব দিলো..
— “আপনি তো দেখি, মহা-ধুরন্ধর লোক। আমি একবারও বলেছি, আজকে যাবো না। আপনি ঘুমের ঘোরে কি শুনেছেন , তারজন্য বইগুলোকে”।
— “হয়তো। তুমি এখানে তৈরি হয় নাও। আমি নিচ থেকে আসছি”।(যেতে যেতে আয়াত)
আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সময় নিয়ে ভেংচি কাটলো তৃষ্ণা। অতি দ্রুত বইগুলো বেডের উপর রেখে ওয়াশরুমে ছুটল। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে আবার খুলে বেরিয়ে এলো। আয়াতের জ্বালায় জামা কাপড় নিয়ে যাওয়া হয়নি। কাবার্ড থেকে শুভ্র রঙের চুড়িদার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আয়াত যদি এসে আগের মতোই দেখে তাহলে এবার নির্ঘাত বইগুলো ছাই হতে সময় লাগবে না।
.
অনেকদিন পরে আবার ভার্সিটিতে যাবে। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠবে।কখন ফিরবে জানে না, তাই সকাল সকাল শাওয়ার সেড়ে নিল তৃষ্ণা। কোনোরকম মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমের এক কোণ থেকে অন্য কোণে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে। কখনো এটা তো কখনো ওটা। বুঝে উঠার আগেই পা স্লীপ করে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। আপনাআপনি মুখ থেকে বের হয়ে গেল,, “আহহ”! সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিল। উঠতে গিয়ে ব্যাথায় আবার পড়ে গেল। পায়ে ব্যাথা লাগে নি। কোমরে প্রচুর ব্যাথা পেরেছে। হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে শুয়ে এক্সারসাইজ শুরু করে দিল। যাতে ব্যাথাটা কন্টালে আসে।
এক্সারসাইজ শেষ হওয়ার আগেই আয়াত রুমে প্রবেশ করলো। তৃষ্ণাকে এক্সারসাইজ করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এক হাঁটু গেড়ে নিচে উঁকি দিয়ে বলল..
— “একটু আগে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। বাই এনি চান্স, তুমি পড়ে যাওনি তো”।
তৃক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তৃষ্ণা। একেই তো কোমরে অসম্ভব ব্যাথা অন্যদিকে আয়াতের গাঁ জ্বালানো কথা বার্তা। কর্কট কন্ঠ বললো..
— “চোখে দেখেন না, কালা না-কি? দেখছেন এক্সারসাইজ করছি। আবার জিজ্ঞেস করছেন। জীবনে কখনো এক্সারসাইজ করেছেন ?
হাউ ফানি! এক্সারসাইজ আর আপনি। যদি এক্সারসাইজ নামটাও শুনতেন তাহলে আপনার শরীর গন্ডারের মতো থাকতো না”।
বলেই উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার হাসির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল..
— “আমি জানি, আমার শরীর গন্ডারের মতো। আসলে নিচ থেকে একটা হাতি পড়ার শব্দ পেয়েছিলাম। তাই দেখতে এলাম, আমার ঘরে কতোবড় হাতি (🐘) বাসা বেঁধেছে।”
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তৃষ্ণা। স্লীম হওয়াতে সবাই তাকে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা বলে আর আয়াত বলছে হাতি। হাতির বাচ্চা বললেও মানানসই ছিলো।
— হেই মিস্টার আমাকে আপনার হাতি মনে হচ্ছে।(রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তৃষ্ণা)
#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৭
ব্র্যাক সিটে বসে আছে আয়াত তৃষ্ণা। আয়াত বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিছু একটা মনে হতেই ধীরে ধীরে সেটে গেল তৃষ্ণার দিকে। দৃষ্টি পূর্বের মতোই বাইরে আছে। শুধু নিজের সিট থেকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে তৃষ্ণা কিংবা সামনে বসে থাকা আরোহী আর ড্রাইভার কিছু বুঝতে না পারে।
তৃষ্ণার শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো পাশে। আয়াতকে নিজের খুব কাছে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। নিশ্চুপ হয়ে আরেকটু জানালার দিকে সেটে গেল। আয়াতের দিকে আর না ঘুরে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পূর্বের ন্যায় তৃষ্ণার শরীর ঘেঁষে বসলো। সিটে রাখা তৃষ্ণার হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। শিউরে উঠলো তৃষ্ণা। বুকের ভেতরের ধুক পুকানী ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তিন ফুট দ্রুতে থাকা যে কেউ আওয়াজ শুনতে সক্ষম হবে। আয়াত সেই শব্দের তোয়াক্কা করলো না। বরংচ নিজের মাথাটা তৃষ্ণার কাঁধে রেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো।
স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। কোমরের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠছে। তখন পাত্তা না দেওয়াতে এখন প্রচুর ব্যাথা করছে। সবটা বোধগম্য হতেই নিঃশব্দে হাত ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকালো। আর জায়গা বাকি নেই। হাত ঝাড়া মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো..
— “আয় আমার কোলে এসে বস। সরি, আমার কোলে কেন বসবেন? একটা কাজ করুন হাতির কোলে গন্ডার বসুক। জীবনে কখনো তো দেখেন নি, এবার দেখে নিন”।
তৃষ্ণার বিরক্তিকর কন্ঠে সামনে বসে থাকা আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো পেছনে। সাথে সাথে তৃষ্ণার থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল আয়াত। হাই তোলার ভঙ্গি করে মাথা চুলকে বলল..
— “দেখতে পারছিস পার্সোনাল সময় কাটাচ্ছি আর তুই তার বেঘড়া না দেওয়া পর্যন্ত থামবি না”।
সিটের উপর শরীরের সমস্ত ভড় দিয়ে আয়াতের দিকে একটু এগিয়ে বলল..
— “এটা তোর বেডরুম নয় ব্রো। তাই পার্সোনাল সময়টা কন্সিনটেশন করিস না”।
লজ্জা পেল তৃষ্ণা। দুহাতে মুখ গুঁজে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার আগ পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে তেমন আর কোনো কথা হলো না।
.
আনমনে ক্যাম্পাসের ভেতরে দিয়ে হেঁটে চলেছে তৃষ্ণা। উদ্দেশ্য সোজা ক্লাসরুমে যাওয়া আর ক্লাস শেষে বাড়ি পৌছানো। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার ফলস্রুতি স্বরুপ অপরিচিত লোকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। কিছুদিন থেকে হুটহাট পড়ে যাওয়া একটা অভ্যসে দাঁড়িয়েছে তৃষ্ণার। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো।” কে রে” সম্পূর্ণ করতে পারলো না। চোখের অগোছালো পলকগুলো থেমে গেল। হারিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো তাজা হতে লাগল। তার সামনে রিজভী আর তিশা দাঁড়িয়ে আছে। গভীর ভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল তৃষ্ণা।দুজনকে পাশাপাশি কতোটা সুন্দর লাগছে। আচ্ছা যদি তিশার জায়গায় তৃষ্ণা থাকলো। তাহলে কি এতোটা সুন্দর লাগত। কথাগুলো ভেবেই জিভ কিটলো তৃষ্ণা। কিসব ভাবছে সে। এখন তৃষ্ণার উপর একমাত্র আয়াতের অধিকার। তার ভাবনা জুড়ে শুধু আয়াত থাকবে, রিজভী নামের কেউ না। ধরা গলায় মলিন হেসে বলল..
— “কেমন আছিস আপু। আমাদের ছোট পুচকু কেমন আছে রে। আর রিজভী.. মাই মিন ভাইয়া। আমার বোন এতো শুকিয়ে গেছে কেন? একটু কেয়ার টেয়ার তো করতে হবে।
আর তুই এই অবস্থায় বাইরে বেরিয়েছিস কেন? যা বাড়িতে যা আর হ্যা পুচকুর যত্ন নে,
মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল তৃষ্ণা। নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না। তবুও দূর্বল প্রমান করতে চায় না। অন্তত নিজের জন্য। ক্যাম্পাসের মাঝে বসে পড়লো সে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ভেবে আয়াতকে ফোন করলো।প্রথমবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হলো।
আয়াতকে কিছু বলতে না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তৃষ্ণা। ভড়কে গেল আয়াত। একটু আগেও মেয়েটাকে স্বাভাবিক দেখেছিল। সামান্য সময়ের ব্যবধানে কি এমন হলো। বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে সংযত করে আশ্বাসের কন্ঠে বলল..
— “পিয়াসু, এই পিয়াসু। কি হয়েছে তোমার পিয়াসু পাখি। আমাকে বলো”।
কান্না থামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..
— “আয়াত ..! তুমি কোথায়? প্লীজ আমার কাছে এসো”।
— “চিন্তা করো না। আমি এখুনি আসছি। তুমি লাইন কেটে না”।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল আয়াত। আজকে ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। মিটিং ক্যান্সেল করে দিলো।
অবশেষে এসে পৌঁছালো ভার্সিটির সামনে। ড্রাইভার আসে পাশে না থাকায় নিজেই ফুল স্পিডে ড্রাইভ করে চলে এসেছে। যেন ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। প্রতিটা সময় ফোনে হ্যালো হ্যালো করে শান্তনা দিয়েছে। গাড়ি থামতেই ভার্সিটির ভেতরে ছুটল। তৃষ্ণার ক্লাস জিজ্ঞাসা করার আগেই চোখ গেল ক্যাম্পাসের ভিড় করা মানুষের মাঝে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখল, তৃষ্ণা হাঁটু ভাঁজ করে নাক টেনে কাঁদছে। লাইন কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। চোখ বন্ধ করে শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তৃষ্ণার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হচ্ছিল তৃষ্ণাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
মুখ তুলে গালে হাত রেখে বলল..
— “এই পিয়াসু কাঁদছ কেন? চোখ তুলে দেখ, আমি এসেছি। তোমার কোনো ভয় নেই। কি হয়েছে বলো আমাকে”।
চোখের সামনে আয়াতকে দেখে সময় অবিলম্ব না করে ঝাপিয়ে পড়ল চিবুকে। চাঁপা কান্না থামিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পিঠে হাত রাখলো আয়াত। জিজ্ঞাসু সুরে বলল..
— “কি হয়েছে পিয়াসু বলো আমাকে”?
চোখ তুলে আয়াতের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। যে-চোখে তার জন্য লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। তাকে শান্ত করার অদম্য ইচ্ছা। সেই ছেলেটাকে কিভাবে বলবে অন্য একটা ছেলের দেওয়া ধোঁকার জন্য এভাবে কাঁদছে। আচ্ছা আদোও কি সে এমন স্বার্থহীন ভালোবাসার যোগ্য। মাথা নিচু করে করুন সুরে বলল..
— “আসলে আমার ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না। তাই এমন করেছি..
চোখ গরম করে তাকালো আয়াত। ইতিমধ্যে ভার্সিটি জুড়ে আয়াত তৃষ্ণার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। দুহাতে বাহু ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল…
— “তোমার ধারণা আছে, আমি কতোটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ক্যান্সেল করে এসেছি। তাও তোমার এইসব ন্যাকামীর জন্য।
আর আপনাদের কোনো ক্লাস নেই, এখানে দাড়িয়ে ফালতু ন্যাকামো দেখছেন। আ’ম আয়াত রিদুয়ান। তৃষ্ণার হাসবেন্ড। এখন যান এখান থেকে”।
ধীরে ধীরে ভিড় জমানো ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে শুরু করলো। সাথে সাথে ভেতরে ভয় জমতে শুরু করল তৃষ্ণার। কিন্তু আয়াত কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না। উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। খসে পড়া ব্যাগটা পূর্ণরায় কাঁধে ঝুলিয়ে আয়াতের পিছু পিছু ছুটল তৃষ্ণা। আয়াত যে তার উপর রাগ করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সত্যি কথাগুলো শুনলে হয়তো কষ্ট পেত, তারচেয়ে রেগে আছে এতেই ডের ভালো।
.
দু’জনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রিজভী -তিশা। বোনের কথা শুনে থামাতে এসেছিলো তিশা। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে বোনকে ধরার আগেই পাশ কাটিয়ে অন্য একটি ছেলে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গেল। প্রথমে ছেলেটির বিহেব বুঝতে ব্যর্থ হলেও পরে যখন হাসবেন্ড শুনেছে তখন চমকে উঠেছে। তার জানামতে তৃষ্ণা রিজভীকে ভালোবাসে। সামান্য কিছুদিনের তফাৎ এ কিভাবে এটা সম্ভব। মুঠোফোন থেকে তাহসানের নাম্বারে ফোন করল।
_____________________
— “এইযে শুনছেন? এভাবে মুখ ফুলিয়ে আছেন কেন? বলছি তো আ’ম সরি। প্লীজ এভাবে রাগ করে থাকবেন না। এই দেখুন আমি কান ধরছি”।(কানে ধরে তৃষ্ণা)
লুকিং গ্লাসে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আয়াত। এই নিয়ে ১৩ বার সরি বলছে কিন্তু আয়াত ফিরেও তাকায় নি। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই এক অদ্ভুত জাদু আছে। যতই চেষ্টা করছে কথা না বলতে ততই দূর্বল হয়ে পড়ছে।
ফোনটা বের করে কানে ধরা অবস্থায় একটা পিক তুলে নিলো। আকস্মিক ঘটা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল না তৃষ্ণা। কান ছেড়ে আয়াতের ফোন নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
হঠাৎ ব্রেক করতে সামনে ঝুঁকে গেল তৃষ্ণা। সামনে তাকিয়ে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত গাড়ির চাবি নিয়ে, সিট বেল্ট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল..
— “আজ সারাদিন পার্কে ঘুড়বো আর বাদাম খাবো। যদি কেউ যেতে চায়। তাহলে যেতে পারে। আমার কোনোরুপ সমস্যা নেই”।
(চলবে)
(চলবে)