‘নয়নতারা ‘
লিখা- ফারিয়া নোভা
(পর্ব-১)
এই নয়ন উঠ, আর কত ঘুমাবি?
-বাবা, প্লিজ, রাতে ঘুম ই হয় নি।
তাই বলে আজকেও এতো বেলা?
আমি কিন্তু তোর চিঠি পড়ে ফেললাম…..
নয়নতারা তড়িঘড়ি করে উঠে বসে।
– একদম নাহ, এটার অধিকার শুধু আমার।( কপট রাগ)
মি. রোদিক মেয়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি হাসলেন।
তোর গিফট কি তোর আগে আমি খুলতে পারি বল? শুধু তোকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য বলেছি।
নয়নতারার মুখে হাসি, সে উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
– তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা।
আমিও অনেক ভালোবাসি তোকে। শুভ জন্মদিন মা
-থ্যাংক ইউ সো মাচ (উল্লাসিত)
কই দাও চিঠিটা?
উহু আগে ব্রেকফাস্ট, তারপর সবকিছু।
-বাবা, আজকেও তোমার কড়া রুটিন। মানি নাহ হুহ
আচ্ছা খাবার টা খেয়ে নাও, তারপর আর জোর করবো না কেমন…
– তুমি সত্যি একটা ভালো বাবা।
বাবা মেয়ে তে গল্প করতে করতে নাস্তা সেরে ফেলে।
আমরা কিন্তু আজ এতিমখানায় যাচ্ছি, মনে আছে তো মা?
– অবশ্যই বাবা। জন্মদিন বুঝি ওদের ছাড়া হয়?
এবার অনেক গিফট নিয়েছি ওদের জন্য।
মি. রোদিক মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখ তার জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে।
নিয়তি আজ বেঁচে থাকলে সংসারটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকতো।
-বাবা, ও বাবা!
হু বলো।
– মায়ের কথা ভাবছিলে?
মেয়েটার এই প্রতিভা মি. রোদিক কে বারবার ই চমকে দিয়েছে। ও যেনো চোখ দেখে মনের কথা বুঝে ফেলতে পারে।
মি. রোদিক কথা বাড়ালেন নাহ আর। তিনি উঠে চলে যেতে উদ্ধত হলেন।
দাঁড়া মা, আসছি।
মি. রোদিক একটা পুরোনো ফাইল নিয়ে ডাইনিং রুমে চলে এলেন। নয়নের মুখে হাসি, সে জানে এবার বহু প্রতীক্ষিত চিঠি হাতে পাবে।
এই নাও, মা।
নয়নতারা চিঠি টা নিয়ে দৌড়ে ওর রুমে ডুকে লক করে দিলো।
খাম টা খুলতেই চিঠি থেকে চিরচেনা এক ঘ্রাণ নয়নের নাকে এসে ধাক্কা দিলো।
মনকাড়া এ সুবাস।
প্রতিবারের মতো এবারো নয়নের মনে হচ্ছে চিঠি টা যেনো সদ্যই লিখা হয়েছে।
নয়নের বুক ফেটে কান্না আসে। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত হয়-
‘মা’
যতবার ও মায়ের চিঠি হাতে পায় ততবার ওর মনে হয়ে ওর মা যেনো ওর আশেপাশেই আছে, ওকে নয়নভরে দেখছে।
নাহ আর কাঁদলে চলবে না, মা কষ্ট পাবে যে।
চোখ মুছে নয়ন চিঠিটা পড়তে শুরু করে……
(পর্ব-২)
সেই গোটা গোটা হাতের লিখা, যা এতো বছরে নয়নের বেশ পরিচিত ও অনেক আপন হয়ে উঠেছে।
প্রিয় নয়ন,
কেমন আছিস মা? আজ তুই ১৭ বছরে পা দিলি, শুভ জন্মদিন মা।
তুই হয়তো জেনে মন খারাপ করবি যে এটাই তোকে লিখা আমার শেষ চিঠি।
দিনে দিনে আমার অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
শুধু একটাই চাওয়া তুই যেনো সুস্থভাবে ভূমিষ্ঠ হতে পারিস!
কিন্তু আমি জানি তুই যখন চিঠিটা পড়ছিস ততদিনে তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। এখনি খুব আফসোস হয় জানিস তুই বড় হয়ে কেমন হবি দেখার জন্য…..
জানি তোরও আমাকে দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছা। কারণ আজ অবধি তুই আমার একটা ছবি পর্যন্ত দেখিস নি।
এতোদিনের চিঠিগুলো ছিলো তোকে নিজের মা সম্পর্কে বুঝানোর জন্য। কাছ থেকে না পারি এই চিঠিগুলোই ছিলো তোর প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু আজকের পর থেকে তুই হয়তো আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবি, আমি যা করেছি তার জন্য ঘৃণাই প্রাপ্য।
তোর বাবা এসবের কিছুই জানে না। আমার এই ছোট্ট জীবনে ওর থেকে শুধু ভালোবাসা শুষে নিয়েছি।
সারাজীবন ভালোবাসার কাঙ্গাল ছিলাম।
অনাথ বলে কাছের মানুষের স্নেহ পাই নি। তাই এই স্বল্প সময়কার ভালোবাসা আমি হারাতে চাই নি।
কিন্তু তোকে বলতে আমার সংকোচ নেই, কারণ তুই আমি ভিন্ন কেউ নই।
তুই হয়তো এসব পড়ে আমাকে পাগল ভাবছিস, কি যা তা বলছি আমি!
কিন্তু তুই হয়তো জানিস ই নাহ তুই হুবহু আমারি মতো হয়েছিস। শুধু তোর সেই জোড়া ভুরু আমার নেই।
সেজন্য তোর নাম দিয়েছি নয়নতারা।
তোর নয়নে যে আমার বসবাস।
তুই কি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করিস?
হয়তো এখনকার যুগে এসব কথাবার্তা বড্ড বেমানান, তাও বলছি তোর মধ্যেই পুনর্জন্ম হয়েছে আমার শক্তি এবং রুপের।
তুই তা সময়ের সাথে সাথে টের পাবি…..
রোদিক কি আনমনে প্রায়ই তোর দিকে তাকিয়ে থাকে?
আসলে ওর নিজের মেয়ের মধ্যে ওর নিয়তিকে খুঁজে পায়।
নয়নের সারা শরীর হিম হয়ে আসছে, তার মা এসব কি লিখেছেন?
কেনোই বা লিখেছেন?
নয়নের জন্মের আগেই তিনি কিভাবে জানতেন যে ও হুবহু উনার মতোই হবে?
আর হ্যাঁ, বাবা তো প্রায়ই একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন বাবার চোখে অসম্ভব ঘোর কাজ করে। নয়নতারা তখন বাবা কে জিজ্ঞেস করেও কোনো সদ্যুত্তর পায় না, শুধু বাবা যে অশ্রুজল গোপন করছেন তা টের পেয়ে যায়।
নয়নের মাথা ঝিম ঝিম করছে এসব ভেবে।
ও আবারো পড়তে শুরু করেছে-
চিঠিটা হঠাৎ তোকে বেশ অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করবে আমি জানি। নিজেকে প্রস্তুত কর মা, তোর মায়ের রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজগুলো তোকেই সম্পন্ন করতে হবে।
তোর হাতে ৩টে জীবনের ভার,সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে তুই নিয়ে আসবি আলোর দিশা।
আজ থেকে তোর নতুন জীবনের শুরু, চোখ কান খোলা রাখবি সবসময়।
মিশন স্টার্ট করতে হবে এতিমখানা দিয়ে, যেখান থেকেই এ সবকিছুর শুরু।
আজ রাত ১২ টায় তুই আমার কবরের কাছে আসবি। সব তোকে একা করতে হবে, রোদিক যেনো না জানে।
সেখানে তোর জন্য অপেক্ষা করছে এক লুকায়িত সত্য……..
ইতি,
তোর মা নিয়তি।
নয়ন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, নিজের মুখে নিজে হাত বুলাচ্ছে।
চোখ কোনো বাঁধা মানছে নাহ, অশ্রুজল গড়িয়েই পড়ছে। সবকিছুর মধ্যে নয়নতারার চোখে জোড়া ভুরুটাই বেশি আকর্ষিত হচ্ছে……..
‘
(পর্ব-৩)
নয়ন মা? কোথায় তুই?
নয়ন চোখ মুছে দরজা খুলে দেয়।
– জ্বী, বাবা।
মি. রোদিক মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন নয়নতারা কাঁদছিলো।
পাগলী মেয়েটা একা রুমে বসে কি করছিস? আমাদের না এতিমখানা যাওয়ার কথা?
ইয়েস ‘এতিমখানা’ ।
মায়ের চিঠি অনুযায়ী খুঁজতে হবে ক্লু। কিন্তু তার সামনে কোনো সঠিক দিশা নেই যে সেই পথ ধরে এগুবে। তবে খুঁজতে হবে স্বাভাবিকের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু।
ভেদ করতে হবে চোখের সামনে থাকা অদৃশ্য পর্দা। আদৌ কি পারবে সে?
নয়নের মায়ের চিঠি মতে ওর মধ্যে কিছু শক্তি বিরাজমান। তবে সে শক্তির এখনো বিকাশ ঘটেনি। নয়ন জানেও নাহ এসবের কিছু। আপাতত মাথা খাটানো যাক।
বাবা তুমি একটু দাঁড়াও, আমি রেডি হয়ে আসছি।
মি. রোদিক মেয়ের জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন।
নয়ন বড়সড় এক ব্যাগ নিয়ে হাজির। সে সকলের জন্য গিফট নিয়েছে।
কিরে মা, এতোসব কবে কিনলি?
– অল্প অল্প করে বছরভর কিনেছি ওদের জন্য।
তুই আসলে দিন দিন অনেক লক্ষ্মী হয়ে উঠছিস।
কথায় কথায় এতিমখানার গেইটের সামনে কখন যে গাড়ি এসে থামে তাদের খেয়াল নেই।
চিঠিটা পড়ার পর এতিমখানাটা আজ বড্ড অচেনা লাগছে।
ও চারদিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে নজর রাখছে।
তখনি একঝাক বাচ্চাকাচ্চা ওকে ঘিরে ধরে, চারদিকে কোলাহল।
‘নয়ন আপা আসছে, নয়ন আপা আসছে….. ‘
নয়নের মুখেও প্রাণোচ্ছল হাসি।
মি. রোদিকের মুখেও পরিতৃপ্তির ছায়া।
নয়ন বাচ্চাদের সাথে বড় হলরুমটায় এসে বসে। সবাইকে গিফট ভাগ করে দিতে থাকে আর বেলুন তো আছেই।
পিচ্ছিগুলোর সে কি আনন্দ। যেনো আজ ঈদ…..
হঠাৎ একটা পিচ্ছি আত্মচিৎকার দিয়ে উঠে।
মি. রোদিকের সাথে একটা সাদা দাড়িওয়ালা লোক ভেতরে ডুকে। তিনিই এ পিচ্ছিদের দেখাশুনা করে আসছেন।
সবাই তাকে ‘ফাদার’ বলে ডাকে।
ফাদার এসেই সে পিচ্ছির কাছে যায়। পিচ্ছিটা কাঁপছে।
ওর হাতে নয়নের দেয়া পুতুল।
পুতুলের গায়ে লেগে আছে জোড়া ভুরু।
বৃদ্ধের চোখ-মুখ লাল হয়ে আসে, নয়ন তার হাবভাব দেখে মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে।
– ইয়েস, প্রথম টার্গেট পেয়ে গেছি…….
(চলবে)