পদ্মপাতার জল পর্ব ১৮

#পদ্ম_পাতার_জল
#পর্ব_১৮
#সাহেদা_আক্তার
#গল্প_কথার_ঝুঁড়ি

পদ্ম রাগ করে সোফা থেকে নেমে সোজা দরজার দিকে হাঁটা দিল। ইয়াশের কথার উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল। ইয়াশ ওর কান্ড দেখে হেসে ফেলে বলল, আমার পাগলী।
.
.
.
.
একসপ্তাহ পরে আদনান আর নিলার বিয়ে। ইয়াশকে সপরিবারে দাওয়াত দিয়েছে। সেই হিসাবে কেনাকাটা শুরু করল সবাই।সবার শুধু একটাই আলোচনা, কোনদিন কি পরবে, কি করবে।এই নিয়েই সবার মাঝে একটা টান টান উত্তেজনা কাজ করছে। আয়েশা আমান, ইরিনা, ইনু, রিনি আর পদ্ম, পাঁচজন মিলে অনেক শপিং করল। সবাই ম্যাচিং করে হলুদের সেট কিনল। বিয়ের জন্য ভারি ড্রেস কিনল। এত সবকিছুর মধ্যে দেখতে দেখতে বিয়ের দিনও চলে এল।

গায়ে হলুদের দিন সকালবেলা ইয়াশের পরিবার আদনানদের বাড়িতে চলে গেল। সেখানে সবাই ব্যস্ত। গিয়েই কাজে লেগে গেলেন আয়েশা আমান। মাহফুজআমানও আদনানের বাবাকে সাহায্য করতে লাগলেন। ইরিনা আর পদ্ম সবসময় একসাথে থাকে। ইনু রিনির কোনো চিন্তা নেই। সারা বিয়ে বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সমস্যায় পড়ে গেল ইয়াশ। আদনান, নিলা দুইজনই ওর বেস্টফ্রেন্ড। ইয়াশ যেহেতু এখানে তাই মনিকাও এখানে। রাফিও চলে এসেছে আদনানের বাড়ি। ঐদিকে নিলা রাগ করে বসল। এখন কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চার বন্ধু এই নিয়ে আলোচনায় বসল। হঠাৎ কোথা থেকে এসে ইরিনা বলল, মেয়েরা নিলার বাড়ি চলে যাচ্ছি। ছেলেরা থাকুক এখানে।

ইয়াশ পদ্মের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, মেয়েরা বলতে?

ইরিনা- আমি, পদ্ম, ইনু, রিনি, মনিকা, রাহা। আমরা মেয়ে পক্ষ হয়ে চলে যাব ওখানে।

ইয়াশ ইরিনাকে একপাশে ডেকে বলল, কেন আপু?

ইরিনা- কেন মানে? মেয়েটা ওখানে একলা আর এখানে চার বন্ধু আনন্দ করবে?

ইয়াশ- বেশ তোমরা যাও। একজন বাদে।

ইরিনা- কে?

ইয়াশ- আমার বউ বাদে।

ইরিনা ভ্রূ কুঁচকে, তোর এল কোথা থেকে বউ!?

ইয়াশ- পদ্ম। ও থাকবে।

ইরিনা- ইস্…… এখনই বউ বউ করছে। চোখে হারাচ্ছে। ওকে ছাড়া কেউ একপাও নড়বে না। ও তো সবার আগে যাবে।

ইয়াশ- প্লিজ আপু, পদ্মকে না নিয়ে গেলে হয় না?

ইরিনা- উঁহু।

ইরিনা সবার সামনে এসে বলল, চলো মেয়েরা। আমাদের এখানে কোনোকাজ নেই।

ইয়াশ- আপু……

ইরিনা- ডিসিশন ফাইনাল।

ইয়াশ দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখ নিয়ে বোনের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল না ইরিনা। ওদের নিয়ে চলে গেল নিলাদের বাড়ি।
.
.
.
.
ইয়াশের দিনটা কাটতে চাইছে না। কাজের মধ্যে থেকেও মনটা অস্থির হয়ে আছে। সন্ধ্যা হতেই সবাইকে তাড়া দিতে লাগল। ওর অস্থিরতা দেখে আদনান বলল, ভাই বিয়েটা কার?

ইয়াশ- কেন? তোর।

আদনান- কিন্তু আমার থেকে তো তুই বেশি অস্থির হয়ে আছিস। ব্যাপারটা কি বল তো।

ইয়াশ- কই কিছু না তো।

রাফি- বুঝছিস না? ভাবি তো ওখানে।

আদনান- ভাবি!

রাফি- হ,ভাবি। থাক ভাই, তোর এখন জেনে কাম নাই। আগে নিজের বৌয়ের কথা চিন্তা কর। দেরি হলে বিয়ের মাঝেই তোকে একটা আছাড় দিবে।

আদনান- তা ঠিক। নিলা একটা চিজ।

ইয়াশ- সত্যি তো? বলব নাকি?

আদনান- এই না না ভাই, এই কাম করিস না। তাহলে বিয়েটাই হবে না।

ইয়াশ- আচ্ছা, বাসর রাতের জন্য তোলা রইল।

আদনান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই যাওয়ার ডাক পড়ল। হলুদ নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুই মাইক্রো গেল হলুদ নিয়ে। প্রথম মাইক্রোয় ইয়াশ আর দ্বিতীয় মাইক্রোতে রাফি আর আকাশ।
.
.
.
.
সাড়ে সাতটার দিকে পৌঁছালো মাইক্রো দুটো। সবাই এক এক করে নামল মাইক্রো থেকে। গেটে ওদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বৌয়ের আত্মীয়রা দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই হাসিমুখে ওদের ভেতরে নিয়ে গেল। ইয়াশের চোখ দুটো খুঁজছে শুধু একজনকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। ইরিনাকেও বেশ কয়েকবার ফোন করল। রিং হলো কিন্তু কেউ ধরল না। ইয়াশ বেশ বিরক্ত হলো বোনের কান্ড দেখে। এদিক ওদিক ঘুরে যখন নিরাশ হয়ে স্টেজের কাছে এল তখন কোথা থেকে মনিকা এসে ওকে জাপটে ধরল সবার সামনে। ন্যাকা স্বরে বলল, তুমি এসেছ, জানু? কতক্ষণ তোমাকে দেখি না। আরেকটু হলে তো আমি পাগলই হয়ে যেতাম।

ইয়াশ- কি হচ্ছে সবার সামনে। ছাড়ো।

মনিকা- উহু।

ইয়াশ নিজেকে ছাড়িয়ে বলল, আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। আপু কোথায়?

মনিকা- বাড়িতে?

ইয়াশ- বাড়িতে কোথায়?

মনিকা- উপরে দোতলায়, সাজচ্ছে।

ইয়াশ- রিনি আর ইনু?

মনিকা- ওরাও ওখানে।

ইয়াশ বিড়বিড় করে বলল, তাহলে ও ওখানেই আছে।

মনিকা- কিছু বললে?

ইয়াশ- না। আমি উপরে যাচ্ছি।

মনিকা- আমিও যাব, চলো।

ইয়াশ- লাগবে না। আমি একলাই যেতে পারব।

ইয়াশ মনিকাকে কাটিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। ঢুকেই সোজা দোতলা। সব রুমগুলো খুঁজতে খুঁজতে শেষ রুমটা ফাঁকা দেখতে পেল। ইয়াশ হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, পদ্ম তখন ওয়াশরুম থেকে শাড়ি পরে বের হলো। আটপৌড়ে করে লাল পাড়ের হলুদ একটা শাড়ি পরেছে। মাথার চুলগুলো কোনোমতে পেঁচিয়ে কাকড়া দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মুখে এখনও মেকআপের ছোঁয়া লাগেনি। মুখটা পানি দিয়ে ধোঁয়ার বিন্দু বিন্দু পানি মুখের পাশটায় জমে আছে। চুল থেকে কিছু টপটপ করে পড়ছে।

ওয়াশরুম থেকে সোজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে কাঁধের কুচি ঠিক করতে লেগে গেল ও। সেফটি পিনটা কিছুতেই আটকাতে পারছে না। অনেকক্ষণ গুতাগুতি করে শেষে আঙুলে ফুটে গেল সেফটি পিনটা। সাথে সাথে আঙুলটা মুখে পুরে দিল। বিরক্ত হয়ে বলল, ধুর, আমার দ্বারা কিছু হবে না। সামান্য সেফটি পিন আটকাতে পারছি না। কয়দিন এখানে থেকে শাড়ি পরা ভুলতে বসেছি। পদ্ম মুখে আঙুল নিয়ে খোলা আঁচলটা কাঁধের উপর তুলে নিল। এতে করে শাড়ির বেশ অনেকটা অংশই সরে গেল ওর পেটের কাছ থেকে। ইয়াশ এতক্ষণ ওর কান্ড দেখছিল। এখন বলল, পেটটা ঠিক করে ঢেকে শাড়ি পরো। নাভির পাশের তিলটা দেখানো লাগবে না। না সামলাতে পারলে শাড়ি পড়ার দরকার নেই।

পদ্ম চমকে উঠে পেছনে তাকাল। ইয়াশ দরজা বন্ধ করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে ওকে। সোনালী পাঞ্জাবী পরেছে ও। বুক পকেটে একটা কলি গোলাপ। হাতে ম্যাচিং ঘড়ি। সবকিছু ওকে বেশ মানিয়েছে। এখন তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

পদ্ম- আপনি এখানে!

ইয়াশ- হুম। শাড়ি পরাতে এসেছি।

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বলল, কাকে?

ইয়াশ- পাগলীটাকে।

পদ্ম- মানে!?

ইয়াশ এগিয়ে এসে বলল, এতো প্রশ্ন করো কেন? দেখি কুচিটা দাও।

ইয়াশ জোর করে কাঁধের কুচিগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে নিল। যত্নসহকারে পরিয়ে দিল শাড়ি। চুলের কাকড়াটা খুলে নিতেই পদ্ম দুই পা পিছিয়ে বলল, চুল খুললেন কেন?

ইয়াশ- বেঁধে দেওয়ার জন্য।

পদ্ম- লাগবে না। আমি পারব।

ইয়াশ হঠাৎ ওকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, আমি তো জানি তুমি পারবে। তবুও দাও না, একবার সাজিয়ে দেই তোমাকে নিজের মতো।

পদ্ম- আপনার কি শরীর খারাপ? এমন করছেন কেন আমার সাথে? নাকি কিছু খেয়েছেন?

ইয়াশ ওকে ছেড়ে অন্যদিকে মুখ সরিয়ে বলল, না, কিছু খাইনি তবে মন খারাপ। খুব খারাপ।

পদ্ম- কেন?

ইয়াশ- অন্য একদিন বলব। আচ্ছা, পদ্ম, আমি যে ছোটবেলায় দুষ্টু ছিলাম সেটা তোমার মনে আছে। আর কিছু কি মনে নেই?

পদ্ম- কি মনে থাকার কথা বলছেন?

ইয়াশ বিড়বিড় করে বলল, একটা মুহূর্ত। যেটা তোমার আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হওয়ার কথা ছিল।

পদ্ম- কি হল, কিছু বলছেন না যে।

ইয়াশ- কিছু না।

না বলেই ইয়াশ বেরিয়ে গেল। একবারও ফিরে তাকাল না। পদ্ম এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইয়াশের অবস্থা কিছুতেই বুঝতে পারছে না ও। কেন এমন করছে তার কোনো কারন ওর জানা নেই।
.
.
.
.
পদ্ম তৈরী হয়ে নিচে নেমে এল। মাথায় বড় একটা খোঁপা। তাতে কাঠবেলী আর গোলাপ গেঁথে দিয়েছে। মুখে হলুদের হালকা সাজ। ওদের সবার সাজ একই হলেও ওকে যেন সবাই আলাদা করেই চিনতে পারছে। কিন্তু ও কাউকে চেনে না। এত মানুষের মাঝে ইয়াশ বা ইরিনা, কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না ও। তাই এক কোনে দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাৎ মনে হল কেউ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় থাকা কাঠবেলীর ঘ্রাণ নিচ্ছে। পদ্মে পেছনে ফিরে চমকে উঠে বলল, আপনি? আরে, কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে। না হলে কিন্তু চিৎকার করব।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here