#পদ্ম_পাতার_জল
#পর্ব_৯
#সাহেদা_আক্তার
#গল্প_কথার_ঝুঁড়ি
ইয়াশ মনে মনে বলল, এমন না করলে যে আজ আমি নিজেকে আটকাতে পারতাম না বোন। সবার সামনে উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলতাম। মেয়েটা না সেজেই আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিচ্ছিল। সাজলে তো মরেই যেতাম। জানি না কেন ওকে দেখলেই পাগল পাগল লাগে। কি আছে ওর মধ্যে!
.
.
.
.
দশ মিনিট পর পদ্ম চেঞ্জ করে নেমে এল। ইয়াশ দেখে আবার থ হয়ে গেল। একটা খয়রি রঙের থ্রিপিস পরেছে। চুলগুলো ভেজা থাকার কারনে ছেড়ে দিয়েছে। ইয়াশ মনে মনে বলল, আগেরটাই ভালো ছিল। এবার তো স্ট্রোক করব। না না, আমি এসব কি ভাবছি। একটা গেঁয়ো ভুতের জন্য আমি কেন এমন করছি? আমি ওর দিকে তাকাব না।
ইনু আর রিনি দৌঁড়ে গিয়ে বলল, পদ্ম আপু, তোমাকে সেই লাগছে। পদ্ম মুচকি হাসি দিল।
ইয়াশ- অনেক হয়েছে, মনিকা, মিস পদ্ম তোমার দায়িত্বে। কি কি কাজ করাবে সেটার তোমার উপর দিলাম।
মনিকা- ওকে জানু। এই মেয়ে এদিকে এসো।
পদ্ম এগিয়ে এল। মনিকা ওর ব্যানেটি ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে আসো। তারপর ইয়াশের হাত ধরে বলল, চলো জানু, আমরা গাড়ির কাছে যাই।
ইয়াশ- চলো।
পদ্ম ওদের পেছন পেছন গাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছাল। গাড়িতে উঠতে যাবে তার আগেই মনিকা বলল, খাবারগুলো কি আমি আনব? যাও নিয়ে এসো। আর গ্রিলের মেশিনটাও আনবে। আজকে আমরা গ্রিল খাবো সাগর পাড়ে বসে। কেমন জানু?
ইয়াশ- ওকে।
পদ্মের মেজাজ চরম পর্যায়ের খারাপ হচ্ছে। বাড়ির ভেতর যেতে যেতে বকবক করতে লাগল আপন মনে। ‘আমি কি কাজের লোক নাকি! এমন আচরণ করছে যেন আমি তাদের খাস দাসি। পেয়ে বসেছে একেবারে। আমি বুঝিয়ে দিব পদ্ম কি।’ খাবারগুলো গাড়ির ডেকে রেখে গ্রিল মেশিনটা কোনোমতে টেনে হেঁচড়ে আনল। এটা আনতেই ওটর ঘাম বেরিয়ে গেল। সবশেষে ও গাড়িতে ঢোকার অনুমতি পেল।
.
.
.
.
গাড়ি হাইস্পিডে চলছে। পদ্ম জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাতাসে ওর ছোট চুলগুলো উড়ছে। ইয়াশের চোখ বারবার আয়না দিয়ে ওকে দেখছে। এমন হতে থাকলে যেকোনো সময় এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। তাই ইয়াশ একটু ককর্ষ গলায় বলল, মিস পদ্ম জানালাটা বন্ধ করো।
পদ্ম- কেন?
ইয়াশ- এত প্রশ্ন করো কেন?
পদ্ম- গরমে আমার খারাপ লাগে।
ইয়াশ- আমি এতকিছু শুনতে চাই না। জানালা বন্ধ করো। আর বেশি গরম লাগলে চুল বেঁধে নাও।
পদ্ম- কিন্তু …
মনিকা- এত কথার কি আছে। জানু যা বলছে করো। এত ঢং করে চুল খোলা রাখার কি আছে।
পদ্ম মেজাজ খারাপ করে জানালার কাচ উঠিয়ে দিয়ে খোঁপা বেঁধে নিল। কিছুক্ষণ পর খারাপ লাগতে শুরু করল। কখন বমি করে দেয় সেই ভয়ে শুয়ে পড়ল সিটে। দশ মিনিটের মাথায় হঠাৎ হার্ডব্রেক কষল ইয়াশ। পদ্ম সিট থেকে পড়ে যেতে গিয়ে সামলে নিল।
মনিকা- কি হল জানু?
ইয়াশ- খাবো। চলো।
মনিকা- ওকে জানু।
ওরা দুইজন নামল। মনিকা ইয়াশকে বলল, তুমি যাও জানু। আমরা আসছি। ইয়াশ চলে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরে। পদ্ম গাড়ি থেকে নামতে লাগলে মনিকা বলে উঠল, তুমি কেন নামছ? তুমি গাড়িতে থাকো। আমরা আসছি। বলেই মনিকা হাঁটা দিল। পদ্ম গাড়ির দরজার ধরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এ কেমন ব্যবহার!
একঘন্টা হয়ে গেল। পদ্ম গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে থাকলে বমি বমি লাগে। হঠাৎ পাশে দিয়ে এক ফুসকাওয়ালা যেতে লাগলে ও দাঁড় করালো। প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে। তার উপর ব্যাগে অল্প কিছু টাকা ছিল। তা দিয়ে ফুসকা খাবে বলেই ঠিক করল। ফুসকা খেতে খেতে মনে মনে বলল, ভাগ্যিস, ব্যাগে ত্রিশ টাকা ছিল। না হলে না খেয়ে থাকতে হতো। পদ্ম মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ফুসকা খেতে লাগল।
রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে ইয়াশ ওর হাসি দেখে রেগে আগুন হয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে কাঁটা চামুচ দিয়ে মুরগীর পিসটাকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে।’ এত অহংকার! মনিকাকে বলেছে এসব বড় লোকের খাবার খায় না। পেটে সহ্য হয় না। ঠিকই আছে। ওর জন্য ঐ স্ট্রিট ফুডই ঠিক আছো। গেঁয়ো মানুষ গেঁয়োই থাকে। তাদের মাথায় তুলতে নেই।’
মনিকা- জানু, কি হল?
ইয়াশ- কই কিছু না তো।
মনিকা- তাহলে খাচ্ছো না যে।
ইয়াশ- আমি একটু ওয়াশরুম যাচ্ছি।
ইয়াশ উঠে চলে গেল। ইয়াশ যাওয়ার সাথে সাথে পদ্ম রেস্টুরেন্টে ঢুকল। চারদিকে তাকিয়ে মনিকাকে একটা টেবিলে দেখতে পেল। দ্রুত ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়াশ কোথায়?
মনিকা- ওয়াশরুমে গিয়েছে। কেন?
পদ্ম- ফোন এসেছে।
মনিকা- কই দেখি।
পদ্ম মনিকার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল। এমন সমন হঠাৎ হাতের সাথে লেগে পানির গ্লাসটা টেনিলে পড়ে গেল। ফলে ভিজে গেল মনিকার জামা। মনিকা চেয়ার থেকে উঠে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল। ওর চড়ের শব্দে পুরো রেস্টুরেন্টের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। মনিকা চিৎকার করে বলল, দেখে কাজ করতে পারিস না? আমার এত দামি ওয়েস্টার্ন ড্রেসটা নষ্ট করে দিয়েছিস। জানিস এটার দাম কত? স্পেশালি ওর্ডার দিয়ে আনিয়েছি বিদেশ থেকে। তোর বাপ পারবে এটার দাম দিতে? যত সব ছোট লোক। ম্যানেজার।
ম্যানেজার- ইয়েস ম্যাম।
মনিকা- এই ছোট লোককে এখুনি এখান থেকে বের করে দিন। আপনার সিকিউরিটি গার্ড কি করে? যাকে তাকে ঢুকতে দেয়।
পদ্ম কিছু বলার আগেই ম্যানেজার সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে ওকে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে দিল। ইয়াশ ওয়াশরুম থেকে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, কি হয়েছে? সবাই এরকম আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে কেন?
মনিকা- ও কিছু না জানু। চলো খেয়ে নিই।
ইয়াশ- হুম।
ইয়াশ গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পদ্ম গাড়িতে বসে আছে। যদি কাছে থাকত তবে ওর প্রত্যেকটা অশ্রু বিন্দু দেখতে পেতো।
.
.
.
.
ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসল। ইয়াশ সিটবেল্ট লাগিয়ে মোবাইল নিয়ে দেখল পাঁচটা মিসড কল। ইয়াশ পেছন ফিরে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল, কানে কি শুনতে পাও না। আব্বু এত বার ফোন করেছে। নিজে না ধরলে গিয়ে তো আমাকে দিয়ে আসতে পারতে। পদ্ম কিছু না বলে চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। খোঁপাটা খুলে দিয়েছে। মুখের উপর একগাদা চুল। ইয়াশ আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল।
সন্ধ্যায় ওরা সাগর পাড়ে পৌঁছালো। ইয়াশ আগে থেকে ফোন করে একটা টেবিল আর তিনটে চেয়ারের ব্যবস্থা করিয়েছে। সেগুলো সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। দেখে মনিকা ইয়াশকে জড়িয়ে ধরল। ইয়াশ তাকিয়ে আছে পদ্মের দিকে। মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। একফোঁটাও কথা বলেনি আজ সারাদিন। ইয়াশ বলল, আমার একটা জরুরি কল করতে হবে। আমি আসছি তোমরা যাও।
ইয়াশ যাওয়ার সাথে সাথে মনিকা বলল, একটা কথাও যেন ইয়াশের কানে না যায়। যদি যায় তবে তোমার পরিবারের কি হাল করি দেখবে। যাও গ্রিল মেশিন নিয়ে আসো।
পদ্মের সারা শরীর ক্লান্তিতে নেই। প্রতিউত্তরে কিছু বলারও শক্তি নেই। তবু কেন যেন টেনে টেনে গ্রিল মেশিনটা এনে কয়লা ভরে আগুন ধরিয়ে নিল। মুরগীর কয়েক পিস জালির উপর রেখে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মনিকা আয়না বের করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছিল। হঠাৎ পোড়া গন্ধে পেছন ফিরে দেখল মুরগী পুড়ছে আর পদ্ম হা করে দেখচ্ছে। মনিকা রাগে গরম হয়ে কাবাব স্টিক গরম করে পদ্মের হাতে চেপে ধরল। জ্বালায় ওর হুঁশ ফিরল। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মুহুর্তে ফোসকা পড়ে গেছে পোড়া জায়গায়। পদ্ম কিছু না বলে দৌঁড়ে সাগরের কাছে চলে গেল। ইয়াশ পিছন থেকে মনিকাকে ডাকল। মনিকা ভয় পেয়ে কাবাব শিকটা ফেলে দিয়ে বলল, কি জানু?
ইয়াশ- পদ্ম কোথায়? একসাথে খাব।
মনিকা- ও খাবে না বলেছে।
ইয়াশ- এখনও খাবে না। সমস্যা কি ওর?
মনিকা মানা করার আগেই ইয়াশ পদ্মের কাছে চলে গেল। পদ্ম সাগরের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। চুল বাতাসে উড়ছে। পায়ে সাগরের ডেউ আছড়ে পড়ছে। ইয়াশ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই পদ্ম ওর দিকে ফিরল। আবছা আলোয় এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ‘ ঘুম থেকে ভাঙানোর শাস্তি যে এত বড় হয় আগে জানতাম না’ বলেই ইয়াশের বুকে ঢলে পড়ল।
চলবে…