#পরীজান
#পর্ব ৩৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
ছোট্ট টিনের ঘরের চারিদিক দিয়ে বেড়া দেওয়া। কলপাড় রান্নাঘরের চারিদিকও ঢাকা। শায়েরের ঘরটা খুব বেশি জায়গায়া জুড়ে নয়। বেড়ার ধার ঘেষে বড় একটা নারকেল গাছ। বেশ বড়বড় নারকেল ধরেছে তাতে। ভর দুপুরে পলাশের ইচ্ছা করছে পিঠা খাবে। হেরোনার কাছে বায়না ধরতেই তিনি বললেন নারকেল পাড়ার জন্য। হুট করেই সে গাছে চেপে বসে আর বিপত্তি ঘটায়। শায়ের বুঝতে পেরেছে এই ছেলেটা যতদিন বাড়িতে থাকবে কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবে না। খুসিনাও চলে এসেছে। তিনি হেরোনার ঘরের সামনে গিয়ে গলা ছেড়ে বলতে লাগলেন,’ও হেরো,,তোর বলদ দামড়া পোলা কি মানুষ হইবো না? এই ভর দুপুরে গাছে উইঠা কি করতাছে?’
হেরোনা ও তেড়ে এলেন ঘর থেকে,’তাতে তোমার কি? আমার পোলায় পিঠা খাইবো। তোমার এতো বাধে ক্যান?’
-‘ঘরের চালে নারকেল ফালাইছে। ঘরটা তো খাইবো। পোলা নামা।’
-‘নামবো না আমার পোলা। আমি দেখছি আমার পোলার ভালা তোমার সহ্য হয়না। তা দূরে যাও না। এইহানে আহো ক্যান??’
শায়ের ধমকে পলাশকে গাছ থেকে নামায়। চালের টিন দেবে গেছে কিছুটা। এটাকে ঠিক করতে হবে নয়তো বাদল দিনে বৃষ্টির পানি পড়বে। ঝামেলা ছাড়া এই ছেলে আর কিছুই করতে পারে না। বছর খানেক আগে যে ঘটনা ঘটিয়েছে তারপর এখন বাড়িতে এসেছে। বাইরের কেউ দেখলে আস্ত রাখবে না ওকে।
কয়েক দিন পরই চলে যাবে সে। তাই হেরোনা আদর যত্ন করছেন ছেলেকে।
এই মুহূর্তে হেরোনার সাথে ঝগড়ার কোন মানেই হয় না। খুসিনা যা বলার বলুক। তাই শায়ের আর সেদিকে এগোলো না। নিজ গন্তব্যে সে চলে গেল। কিন্ত নারকেল গাছটা আর সে রাখলো না। পরের দিন লোক দিয়ে কেটে ফেললো। হেরোনার রাগ হলেও কিছু বলতে পারলেন না। কেননা শায়েরের বাবার জমি শায়েরের চাচারা মিলে দখল করে রেখেছে। শায়েরের দাদা তার সমস্ত সম্পত্তি চার ছেলেকে ভাগ করে দিয়ে গিয়েছেন। একমাত্র ছেলে হওয়াতে বাবার সম্পত্তি শায়ের পেয়েছে। কম করে বিঘা দুয়েক কিংবা তার থেকে একটু কম হবে।
শায়ের কখনোই নিজের সম্পত্তি চায়নি।
এখন কিছু বললে শায়ের যদি তার সম্পত্তির অধিকার চেয়ে বসে? হেরোনা কিছুতেই তা হতে দেবে না। তাই তিনি আগ বাড়িয়ে কিছু বললেন না। বাকি দুই জা কেও চুপ থাকতে বললেন। তবে চিন্তা হেরোনার গেলো না। কেননা শায়ের এখন বিয়ে করেছে। বাচ্চা হলেই তো শায়ের নিজের ভাগ বুঝে নেবে। এজন্য বেশ চিন্তা হয় হেরোনার।
——-
জমিদার বাড়ির সামনে ভিড় জমিয়েছে গ্রামের শত শত মানুষ। মহিলারা আঁচলে মুখ ঢেকে অন্দরে যাচ্ছেন আবার বের হচ্ছেন। চোখের পানি ফেলছেন কেউ কেউ। বাইরের লোকজন বাঁশ কেটে এনে রাখছেন। কয়েক জন মিলে কবর খুড়ছেন জমিদার বাড়ির পাশে থাকা কবরস্থানে। গরুর গাড়িটি এসে থামতেই আগে নামলো শায়ের। তারপর পরী। ভিড় জমানো স্রোতারা রাস্তা দিলো পরীকে ভেতরে যাওয়ার। পরী ধীর পায়ে অন্দরে ঢুকল। অন্দরের উঠোনে আজ অনেক মহিলারা। সবাইকে এক নজর দেখে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল সে। সারিবদ্ধ ঘরগুলো পেরোতে লাগলো সে। শেষের আগের ঘরটাতে ঢুকতেই পরিচিত মুখগুলো দেখতে পেল পরী। মালা জেসমিন মেঝেতে বসে আছে। রুপালি পালঙ্কের উপর বসে আছে। আবেরজানের পুরো শরীর চাদরে ঢাকা।
কাল রাতে পরলোকগমন করেন আবেরজান। পরীকে রাতেই খবর পাঠানো হয়। খবর পাওয়ার পর শায়ের দেরি করেনি। তখনই নূরনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পরীকে নিয়ে। দীর্ঘ আটমাস পর পরী নিজ বাড়িতে পা রেখেছে। কাজের জন্য শায়ের সময় পাচ্ছিল না বিধায় আসতে পারে না। কিন্ত আবেরজানের মৃত্যুর খবর শুনে তো আর থাকা যায় না। ইলিয়াস কে না জানিয়েই আসতে হলো।
পরী রুপালির পাশে গিয়ে বসতেই রুপালি ওকে ধরে কেঁদে উঠল বলল,’দাদি আর নেই রে পরী। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।’
পরী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বোনকে। তবে ওর খারাপ লাগলেও চোখে পানি আসলো না। কারণ আবেরজানের জন্য মালার জীবনটা দূর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। তার কটু কথাতে মালা কষ্ট পেতো। সেজন্য পরী দাদিকে খুব একটা পছন্দ করতো না। তাই তার মৃত্যুতে এতো শোক পালন করার কোন মানেই হয় না বলে পরীর ধারণা। তবে মুখ ফুটে সে কিছুই বলে না।
জেসমিন আর মালা গুনগুন করে কেঁদে যাচ্ছেন। শ্বাশুড়ি যেমনই হোক না কেন মা বলে ডেকেছেন এতোদিন। সম্মান দিয়েছেন,সেই মানুষটা আজকে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। কষ্ট তো হবেই।
মহিলারা ধরাধরি করে আবেরজান কে নিচে নামালো। গোসল করালো গরম পানি দিয়ে। তারপর সাদা কাফনে মুড়ে দিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দিলো। আগরবাতি আর গোলাপজলের গন্ধে চারিদিক ভরে উঠেছে। আবেরজানকে নিয়ে যাওয়ার আগে শেষ দেখা দেখতে এলো সবাই। পরী খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্থির দৃষ্টি আবেরজানের বন্ধ চোখে। একসময় কতোই না এই মহিলার মৃত্যু কামনা করেছে সে। তখন অতো কিছু বোঝেনি। কিন্ত এখন একটু হলেও কষ্ট হচ্ছে। নিজের রক্ত বলে কথা।
রুপালি হুট করেই আবেরজানের পা জড়িয়ে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,’মাফ করে দিও দাদি। না জেনে অনেক কথা বলেছি তোমাকে। ভুল বুঝেছি, বেঁচে থাকতে বুঝতে পারিনি। মাফ করো তুমি।’
মালা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদেন। শেষ বিদায় সবাই চোখের পানিতেই দেয়। সে যত খারাপ মানুষ হোক না কেন? কেননা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষেরও আপনজন আছে। কারো না কারো ভালোবাসা সেও পায়। বিদায় নিয়ে চলে গেল আবেরজান।
পুরো অন্দর শান্ত এখন। ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডব শেষ হওয়ার পর যেমন শান্ত হয় পরিবেশ। ঠিক তেমনি।
মানুষ জন একে একে চলে গেছে নিজ গৃহে। অন্দরের বারান্দায় বসে আছে সবাই। কুসুম আর শেফালি ভাত ডাল ঘরে নিচ্ছে। কেউ মারা গেলে সে বাড়িতে তিনদিনের মধ্যে চুলায় আগুন জ্বালানো নিষেধ। তাই প্রতিবেশীরা রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে। যারা কবর খুড়ছেন এবং বাকি কাজ করেছেন তাদের খাইয়ে বিদায় করা হয়েছে।
ঘরের মহিলারা শুধু বাঁকি আছে। কুসুম কাউকে খেতে ডাকার সাহস পাচ্ছে না। কারো মন তো ভালো নেই। কেউ তো খাবে না বলে মনে হয়। কুসুম পরীর অভিব্যক্ত বুঝতে পেরে সেদিকে এগোয়। গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে কুসুম?’
কুসুম অত্যন্ত নিচু গলায় বলে,’কাইল রাইত থাইকা সবাই না খাওয়া আপা।’
-‘আচ্ছা চল রান্নাঘরে। সব গুছিয়ে আমি সবাইকে খেতে ডাকছি।’
কুসুম আর পরী রান্নাঘরে গেলো। সব কিছু এলোমেলো হয়ে আছে। পরী কুসুমের হাতে হাত লাগিয়ে সব গোছাতে লাগলো।
-‘গেরামে যে কি হইলো খালি মানুষ মরতেই থাহে। আল্লাহ কোন গজব ফালাইলো তা তিনিই ভালো জানে।’
-‘আল্লাহ যাদের পছন্দ করেন তাদের সবসময়ই পরীক্ষা করেন। কি জানি আমাদের উপর এতো পরীক্ষা কেন করছেন?’
পরী একটু চুপ থেকে কুসুম কে জিজ্ঞেস করে,’বিন্দুর খুনিদের কি খবর কুসুম? আমি দূরে থাকি বিধায় কোন খবর পাই না। তুই জানিস?’
হঠাৎ করেই মনমরা হয়ে গেল কুসুম। মনে হচ্ছে রাজ্যের কষ্ট তার ভেতরে চাপা পড়েছে। সে বলে,’কি কমু আপা? বিন্দু তো গেলো লগে তার সম্পানরেও নিয়া গেলো।’
পরীর হাত থেমে গেলো। ডালের বাটিটা রেখে বলল,’সম্পান মাঝি!! কি বলছিস কুসুম? ভাল করে বল।’
-‘আপনে জানবেন কেমনে আপা?আপনে তো অনেক দূরে থাহেন। আপনে এই বাড়ি থাইকা যাওয়ার সাতদিন পর সম্পান গলায় দড়ি দিছে আপা। বিন্দুরে যেই গাছে ঝুলাইছিলো হেই ডালেই ফাঁসি দিছে। সম্পানের মা পাগল হইয়া গেছে আপা।’
পরী নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। সম্পান যে এভাবে আত্মহুতি করবে তা ভাবেনি পরী। সম্পানের জন্য খারাপ লাগছে। বিন্দুকে ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন বলেই ছেলেটা নিজেকে শেষ করে দিলো!! ওদের ভালোবাসার পরিণতি এতোটা কঠিন না হলেও পারতো। কেন জানি আজ পরীর কষ্ট হলো না। কষ্ট পেতে পেতে সে হাঁপিয়ে গেছে।
পরী আর ভাবতে পারলো না সম্পান কে নিয়ে। সে বাটিতে ডাল তুলতে তুলতে বলল,’আর কিছু নেই কুসুম? শুধু ডাল?’
-‘হ আপা। আর কিছু নাই। সক্কাল সক্কাল সবাই তাড়াতাড়ি কইরা ডাল রান্না করছে।’
পরী চুপ থাকলো,ভাবলো শায়ের তো ডাল পছন্দ করে না। ও বাড়িতে শুধু পরী আর ফুপুই ডাল খেতো। কিন্ত আজকে শায়ের খেয়েছে তো? পরী চোখ তুলে কুসুমের দিকে তাকালো বলল,’উনি কি খেয়েছে কুসুম?’
-‘শায়ের ভাই? খাইছে তো।’
-‘তুই দেখেছিস?’
-‘আমি নিজে খাওয়াইছি তারে।’
-‘ওহ।’
আর কোন বাক্য ব্যায় করলো না কেউ। পরী সবকিছুই গুছিয়ে বাইরে এলো। প্রথমে কেউ খেতে না চাইলেও পরী জোর করেই সবাইকে নিয়ে গেল। তবে পেট ভরে কারো খাওয়া হলো না। সবাই কোনরকম খেয়ে নিজ ঘরে চলে গেল। পরী ও ঘরে গেল। শায়ের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পরী একবার ওকে দেখে নিয়ে আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করলো। আলমারি খোলার শব্দে শায়ের ফিরে তাকালো। পরীর চোখে চোখ পড়তেই পরী সেদিকে এগিয়ে গেলো। বলল,’গোসল করেছেন?’
-‘হুম।’
-‘খেয়েছেন?’
-‘আপনি খেয়েছেন??’
-‘হ্যা খেয়েছি।’
শায়ের নিঃশব্দে হাসলো। পরীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,’আমি না খেলে কখনো খেয়েছেন আপনি? জেনেও প্রশ্ন করছেন?’
পরী প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,’আপনি কি জানেন সম্পান মাঝির কথা??’
-‘সম্পান!!না তো,কোথায় সম্পান?’
-‘সম্পান মাঝি আত্মহত্যা করেছে।’
চমকালো শায়ের। পরীর দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। পরী বলল,’আমিও আজকে শুনলাম। কুসুম বলেছে। আমার বিন্দুর জন্য নিজের জীবনটা দিয়ে দিলো সে।’
-‘জীবন উৎসর্গ করে কি ভালোবাসা প্রমাণ করা যায় পরীজান?’
-‘আমার থেকে তা আপনি ভালো জানেন। আপনার থেকেই তো ভালোবাসা শিখছি আমি। প্রতিদিন আপনার ভালোবাসার নতুন রূপের সাথে পরিচিত হই আমি। আপনিই বলুন।’
-‘আমি যদি আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করি তাহলে আপনাকে ভালোবাসবে কে পরীজান?’
#পরীজান
#পর্ব ৩৫
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
জীবন দিয়ে ভালোবাসা প্রমাণ করা যায়??তাহলে শাজাহান কেন তাজমহল বানিয়ছিলো?? সেও তো পারতো তার প্রিয়তমার জন্য জীবন দিয়ে দিতে। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরন এক হয় না। ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য কেউ জীবন দেয় আর কেউ হাতে হাত রেখে সারাজীবন একসাথে চলার অঙ্গীকার করে। ভালোবাসা সম্পর্কে সবার চিন্তাধারা ভিন্ন হলেও ভালোবাসার কোন পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় সময় এবং পরিস্থিতি। সময়ের বেড়াজালে আটকে যায় সব। পাল্টে যায় ভাগ্য লিখন।
গামছা আর শাড়ি হাতে নিয়ে ধৈর্যহীন চোখে শায়ের কে দেখছে পরী। সবসময় অদ্ভুত লাগে শায়ের কে। যখন শায়ের কথা বলে তখন ওর চোখ থেকে চোখ ফেরানো দায়। পরী আটকে যায় সুরমা পরিহিত ওই চোখে। পরী বলে ওঠে,’আপনার পরীজান কে ভালোবাসতে হলে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে মালি সাহেব। আপনার ভালোবাসা ছাড়া পরীজান আর কিছু চায় না।’
-‘সম্রাট শাজাহান তার স্ত্রীর জন্য তাজমহল বানিয়েছে। জানেন কি??’
পরী মাথা নেড়ে বলে,’হুমম।’
-‘ভারতের সম্রাট শাজাহান। তার স্ত্রীর নাম মমতাজ। স্ত্রীকে তিনি এতোটাই ভালোবাসতেন যে তার জন্য বিশাল বড় তাজমহল বানিয়েছেন। ইতিহাস সেরা সে মহল। তিনি তার ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য তাজমহল বানিয়েছেন।’
-‘আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন?’
শায়ের মৃদু হেসে জবাব দিলো,’শাজাহানের মতো তাজমহল বানাতে পারবো না বলে কি আমার ভালোবাসা মিথ্যা পরীজান?’
-‘এখন সারা বিশ্ব দেখলেও মমতাজ কিন্ত তাজমহল দেখেনি। আমি চাই না আমার অনুপস্থিতিতে আপনি আপনার ভালোবাসা প্রমাণ দিন। কারণ আপনার চোখে আমি প্রতিদিন প্রমাণ পাই। শুধু এটুকুই আমার পাওয়া। তাজমহলেই কি শুধু ভালোবাসা হয়? কুঁড়ে ঘরে হয়না বুঝি??
শায়ের উত্তর না দিয়ে হাসলো। পরী আর সময় ব্যায় করে না। শায়ের কে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে সে গোসলে চলে যায়।
রুপালি তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। পরী তখন রুপালির ঘরে গেলো। মনমরা হয়ে বসে আছে রুপালি। পরীকে দেখে সে হাল্কা হাসার চেষ্টা করে। পরী হাত বাড়িয়ে দিলো ছোট্ট পিকুলের দিকে। পিকুল এখন বসতে পারে। পরীকে দেখে সে এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার পরীর দিকে তাকায়। পরী অবিকল তার মায়ের মতো সুন্দর। মায়ের থেকে একটু বেশি বলা চলে। তবে পরীর হাসিটা যেন রুপালির মতোই। পিকুল ঝাঁপিয়ে পড়ে পরীর কোলে। পরীর বুকের সাথে মিশে থাকে সে। রুপালি বলে,’দেখ,জন্মের পর তো তোকে পায়নি বলতে গেলে। কি সুন্দর খালামনিকে চিনে নিয়েছে।’
-‘কেন চিনবে না? আমাদের রক্ত না? আমার কাছে আসবে না তো কার কাছে যাবে?’
-‘তাই তো দেখছি।’
-‘দাদিকে কি ভুল বুঝেছো আপা? কোন ভুলের মাফ চাইছিলে তুমি?’
হঠাত করেই রুপালি চুপ করে গেলো। এদিক ওদিক পলক ফেলে চোখ আড়ালে ব্যস্ত হলো সে। পরী আবারো জিজ্ঞেস করতেই সে বলে,’অনেক কটু কথা শুনিয়েছি তাকে। বুড়ো মানুষ, আমার ঠিক হয়নি দাদির সাথে খারাপ আচরণ করা। তাই মাফ চাইলাম।’
পরী পিকুলের গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’সেজন্য এভাবে বলার মানুষ তুমি নও আপা। আমি জানি তুমি দাদিকে কতটা অপছন্দ করতে। কিন্ত সে কি এমন মহান কাজ করলো যে তার কাছে এভাবের মাফ চাইবে? তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যা বলছো।’
রুপালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’সত্যিই আমি দাদিকে চিনতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। মানুষের বাইরের সত্ত্বা দেখা গেলেও ভেতরের সত্ত্বা বোঝা কঠিন। তুইও বুঝবি পরী। সময় এলেই বুঝবি।’
-‘সময়ের অপেক্ষা করতে পারবো না। তুমিই বলো।’
-‘কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর সময়ের থেকে নিতে হয়। তাহলে সেই উত্তর থেকে অনেক কিছু জানা যায়। এখন বল একটা প্রশ্নের উত্তর নিবি নাকি অনেক প্রশ্নের?’
জবাব না দিয়ে রুপালির দিকে তাকিয়ে রইল পরী। এই মুহূর্তে বোনের ভাবমূর্তি বুঝতে অক্ষম সে। সবকিছু ধোয়াশা মনে হচ্ছে। পরীর মনে হচ্ছে ওর সামনে যা কিছু আছে তা শুধুমাত্রই আবছা,মেঘে ঢাকা সবকিছু। মেঘ কেটে গেলে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনদিন পর মিলাদের আয়োজন করা হয়। হুজুর ডেকে এনে ঘরেই সবকিছু সম্পন্ন করা হয়। এই তিনদিন পরী আর শায়ের জমিদার বাড়িতে থাকলেও এখন তাদের চলে যেতে হবে। পরী কেন যেন থাকতে ইচ্ছা করলেও থাকা হয়ে ওঠে না। শায়ের তাকে ফেলে যেতে নারাজ। তাই স্বামীকে ফেলে তার থাকা হয়ে ওঠে না। যাওয়ার আগে আবেরজানের কবর দর্শনে গেলো সে। ইতিমধ্যে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়ে গেছে। একদিন মাটির নিচে সবাইকে যেতে হবে। আগে কিংবা পরে,যেতে হবেই। তবে ঈমানের সাথে যাওয়াই শ্রেয়। পরী জানে না কি এমন ভালো কাজ আবেরজান করেছে যার জন্য রুপালি আজ এতো আফসোস করছে তার জন্য। বোনের কথামতো সে সময়ের থেকে সব জবাব নেবে বলে মন স্থির করেছে।
শায়ের পরীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,’আমাদের যেতে হবে পরীজান চলুন।’
পরী শায়েরের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার কবরের দিকে তাকালো বলল,’কবরস্থানের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীর সব আয়োজন বৃথা। সব শত্রুতা,বিরোধীতা,হিংস্রতা এমনকি ভালোবাসাও এখানে স্থির। তাহলে কেন এতো দ্বন্দ্ব মানুষের মাঝে?কেন সবাই কবরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় না?’
-‘সবার মস্তিষ্ক একই রকম দেখতে হলেও চিন্তাধারা এক নয় পরীজান। সবাই যদি আপনার মতো ভাবতো তহলে সবাই ভালোবাসাতে পূর্ণ থাকতো। ঠিক আপনার মতো।’
অতঃপর পরীর হাত ধরে নিয়ে গেলো শায়ের। যাওয়ার আগে বাড়িটাকে ভালোভাবে দেখে নিলো পরী। এই কি সেই বাড়ি যে বাড়িতে পরী ছিলো? সবকিছুই স্বাভাবিক থাকলেও পরীর কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছে। পরীকে অন্যমনস্ক দেখে শায়ের জিজ্ঞেস করে,’আপনি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?’
পরী জবাব দিলো,’আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই জমিদার বাড়িতে কিছু একটা হচ্ছে। যা আমার অজানা। কিন্ত আম্মা,আপা,কুসুম,শেফালি,দাদি এবং জুম্মান জানে। কি এমন হয়েছে সবার??’
-‘হয়তো আপনার দাদির মৃত্যুতে সবাই কষ্ট পেয়েছে তাই এরকম লাগছে সবাইকে।’
-‘নাহ!!আমি কুসুম কে দেখেছি,রান্নাঘরে ওর সাথে খাবার বাড়ার সময় ওর হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছিল। এমনকি পুরো শরীর ও। সামান্য বিষয় নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিল। ওর ঘাড়ে একটা ক্ষত ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল পড়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত কেউ ওকে আঘাত করেছে। আর জুম্মান কে তো এই তিনদিনে দেখলামই না। যে ছেলেটা আমার এতো পাগল সেই ছেলেটার মুখ আমি তিনদিনে দেখলামই না। কিছু তো একটা হয়েছে। আম্মা,আপা,বাকি সবাই আড়াল করছে আমার থেকে।’
-‘আপনার যদি সেরকম কোন সন্দেহ হয়ে থাকে তাহলে আপনি থাকতে পারেন। আমি বাধা দেবো না।’
পরী নিশ্চুপ রইলো। শায়ের কে একা ছাড়তে ওর মন সায় দিচ্ছে না। কেননা মানুষ টা তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। পরী যে তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া পরী নিজেও থাকতে পারবে না।
যে মানুষটির ঘুমন্ত চেহারা দেখে ঘুম ভাঙে,যার স্পর্শ না পেলে সারা রাত্রি বিনা নিদ্রায় পার হয় তাকে ছাড়া থাকার কোন প্রশ্ন আসে না। তাই সব অজানা রহস্য নূরনগরে ফেলে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি।
পরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ওবাড়ি থেকে চলে আসার পর সবকিছু বদলে গেছে। আপাকে রেখে আসার পর থেকে ভয়ে আছি আমি। না জানি কোন হিংস্র পশু থাবা মারে। আপা যে বড়ই দূর্বল প্রকৃতির। আঘাত সে সহ্য করতে পারে না।’
শায়ের পরীর হাত চেপে ধরে বলল,’আপনি চিন্তা করবেন না পরীজান। অন্দরের সব নারীরা সুরক্ষিত। তাদের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।’
-‘যেখানে ঘরের মানুষ থাবা মারে সেখানে বাইরের লোক কিছু না।’
-‘আমাকে বলবেন কি হয়েছে? আমার মনে হচ্ছে আপনি সব কথা বলছেন না। আপনিও কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন।’
পরী আর কথা বলল না। গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রইল। কি বলবে সে শায়ের কে? আখির ওর নিজের কাকা। এই লোকটা যে ওদের তিন বোনের দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলো। শায়ের তা জানলে কি করবে? হয়তো কিছু করতে পারবে না। আখির কে দেখতে শান্তশিষ্ট মনে হলেও সে একজন ভয়ানক মানুষ। নাহলে ভাতিজিদের দিকে কে এমন কুৎসিত নজর দেয়!! অতীত টানতে চায় না পরী। আর না শায়ের কে বলতে চায়।
সূর্য যখন দিগন্ত থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই নবীনগর পৌঁছালো ওরা। ঘরে ফিরতেই চম্পা এসে হাজির হলো। পরী মুচকি হেসে চম্পাকে ঘরে আসতে বলে। পরীর সাথে চম্পার এখন ভাব হয়েছে। চম্পা নিজেই এসেছে। পরী তাতে বেশ খুশি,সে চায় না সম্পর্কে মনোমালিন্য থাকুক। সবাই একসাথে হাসিখুশি থাকাটাই জীবনের বড় পাওয়া। তাই পরী সহজেই এবাড়ির সবার সাথে মিশছে। চম্পা আর চামেলি প্রতিদিন আসে পরীর সাথে গল্প করার জন্য। রাতে শায়ের এখন একটু দেরি করে ফেরে সেজন্য ওরাও থাকে। কখনো আম,জাম্বুরা,তেঁতুল মেখে তিনজনে কাড়াকাড়ি করে। কখনও ঘরে বসে নায়ক নায়িকার কাহিনী বলে। টেলিভিশন না দেখলেও চম্পা আর চামেলির মুখে অনেক সিনেমার কাহিনী শোনা হয়ে গেছে পরীর। ওদের সাথে সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগে পরীর।
আজকেও চম্পা এসেছে পরীর সাথে গল্পগুজব করতে। সে জলপাইয়ের আচার এনেছে পরীর জন্য। পরী হাসি মুখে তা গ্রহণ করে। আচার খেয়ে বেশ প্রশংসা করলো। এর আগেও হেরোনার দেওয়া অনেক কিছুই খেয়েছে সে। তার রান্নার হাত খুব ভালো।
চম্পা পরীর থেকে বিদায় নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে গেলো। ঘরে ঢুকতেই হেরোনার মুখোমুখি হলো সে। কঠিন দৃষ্টিতে মেয়েকে কিছুক্ষণ দেখে হেসে ফেলল হেরোনা। চম্পাও হাসলো বলল,’সব কিছু ঠিকঠাক হইবে তো মা?’
-‘আমার কথা হুনলে সব ভালা হইবো তোর। বাটিডা দে।’
মেয়ের হাত থেকে আচারের খালি বাটিটা নিয়ে হেরোনা চলে গেল। চম্পা নির্বাক চোখে শায়েরের ঘরের দিকে তাকালো। এই ঘরটাতে সে থাকতে চায়। শায়েরের বধূ হতে চায় তার আকুল মন। তাইতো মায়ের সাথে এক নোংরা খেলায় মেতেছে সে। এতে যে হেরোনার লোভ ও আছে তা জানে চম্পা। তবুও ভালোবাসার মানুষ কে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা এই কাজ করতে বাধ্য করছে চম্পাকে। ওর মতে প্রিয় মানুষ কে পাওয়ার জন্য যা কিছুই করুক না কেন তা পাপ না।
#পরীজান
#পর্ব ৩৬
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
‘লোভ’ মানুষ কে ধ্বংস করে দেয়। সাম্রাজ্য থেকে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ের লোভ তৈরি করে ধ্বংসলীলা।
লোভ কারী ব্যক্তিদের শাস্তিও ভয়ানক। আল্লাহ লোভীদের পছন্দ করেন না। তাইতো খোদা হওয়ার লোভ ফেরাউনকে বিশাল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিল। তবে অতি আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে ফেরাউন তার নিজের শাস্তি নিজেই লিখে দিয়েছিল জিব্রাঈল (আঃ) এর কাছে। নীলনদে পানি আনার জন্য ফেরাউন যখন দোয়া করেন তখন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নীলনদে পানি ফিরিয়ে দেন এবং জিব্রাঈল (আঃ) পাঠিয়ে দেন। তিনি ফেরাউন কে প্রশ্ন করেন,’যদি কোন মনিব তার ভৃত্য কে দুনিয়ার সমস্ত সুখ দেয়। তবুও সেই ভৃত্য তা উপেক্ষা করে নিজেই মনিব সাজতে চায় তাহলে তার কিরূপ শাস্তি হওয়া উচিত?’
উত্তরে ফেরাউন বলেছেন,’ওই অকৃতজ্ঞ কে এই নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মারা উচিত।’
ফেরাউনের উক্তিটি কাগজে লিখিয়ে নিয়ে চলে যান জিব্রাঈল (আঃ)। সেরকম মৃত্যু দেওয়া হয় ফেরাউন কে। সমুদ্রের গভীরে ডুবিয়ে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন।
লোভ কখনোই মানুষ কে শান্তিতে বাঁচতে দেয় না। হেরোনা যার কারণে সবসময়ই আতঙ্কে থাকে। শায়েরের ভাগে যেটুকু সম্পদ রয়েছে তা হাতিয়ে আনতে পারলে বেশ হবে। হেরোনার সাথে তার স্বামী আকবর ও আছেন। সাথে বাকি দুই ভাই আর তার বউয়েরাও। তাদের পরিকল্পনার প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছে হেরোনার মেয়ে চম্পাকে। শায়ের বলতে পাগল সে এখনও। এখনও সে শায়েরের চরণ তলে একটু ঠাঁই চায়। যার দরুন মায়ের অন্যায় আবদার সে মেনে নিয়েছে। পরীর সাথে ভাব জমিয়েছে। কথা বলার ছলে এটা ওটা খাওয়ায়। যার সাথে এক বিশেষ ধরনের ওষুধ মেশানো থাকে যা দূর গ্রামের একজন কবিরাজের কাছ থেকে আনিয়েছেন হেরোনা। পরী যাতে সন্তান জন্ম দিতে না পারে এবং সেই সুযোগে চম্পাকে শায়েরের সাথে বিয়ে দিবেন হেরোনা। এই সামান্য সম্পদের জন্য এখন মেয়েকেও উৎসর্গ করেছেন তিনি। চম্পাকে বুঝিয়েছে শায়ের তো পুরুষের জাত। বাচ্চা না হলে মেয়ে মানুষের দাম থাকে না। সে যতোই রূপবতী হোক না কেন!! তেমন করে পরীকেও সে ছুড়ে ফেলে দিবে। তার পর চম্পার সাথে শায়েরের বিয়ে দেবেন। চম্পাও খুশি মনে তা মেনে নিয়েছে। মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে সে।
কিন্ত শায়েরের পরীজান সম্পর্কে অবগত নন বলেই এসব কাজ করছে হেরোনা। যদি জানতো তাহলে এরকম জঘন্য চিন্তা মাথায় আনতো না।
শায়ের দুপুরের খাবার খেতে এসেছে। উঠোনে পরীর পরনের শাড়ি দেখে দেখে অবাক হলো সে। কেননা শায়ের ফেরা না পর্যন্ত পরী গোসল করে না। শায়ের যেদিন তাকে বলেছিল তার সবচেয়ে মোহনীয় রূপ হচ্ছে যখন সে গোসল করে কাপড় মেলতে যায়। সেই দৃশ্যটা শায়ের কে উপভোগ করানোর জন্য দুপুরে শায়ের ফেরার পর পরী গোসলে যায়। তাহলে আজকে হলো কি পরীর?? ঘরে আসতেই দেখলো পরী নামাজ পড়ছে। শুক্রবার বিধায় আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছে শায়ের। সে ভাবছে এখনও তো নামাজের সময় হয়নি। পরক্ষণে ভাবলো হয়তো নফল নামাজ পড়ছে। তাই শায়ের ও চলে গেল গোসলে। তারপর সেও চলে গেল মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে। শুক্রবারে দুপুরের পর বাড়িতেই থাকে শায়ের। নামাজ শেষে ফিরে এসে দেখে পরী অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। শায়ের পরীর পাশে বসে বলে,’আপনার কি মন খারাপ পরীজান?’
হঠাৎ শায়েরের কথায় চমকে ওঠে পরী। কোন এক ধ্যানে মগ্ন ছিলো সে। শায়েরের কথাতে ধ্যান ভঙ্গ হলো তার।
-‘আপনি কি বাড়ির জন্য চিন্তিত?’
-‘নাহ তেমন কিছু না।’
-‘আপনার চোখ দেখে মনের ভাবনা কিছুটা বুঝতে পারছি। আপনি কি বাড়িতে যেতে চান? তাহলে নিয়ে যাবো।’
-‘নাহ!!বাড়িতে আমি যাবো না। ক’দিন হলো তো এসেছি। আমার কিছু হয়নি।’
-‘তাহলে আপনার মুখে হাসি নেই কেন পরীজান? আমি যেই হাসিটা দেখার জন্য ছুটে আসি সেই হাসিটা আজ কেন দেখতে পেলাম না? আপনি কি আমার কাছে সুখি নন পরীজান?’
পরী তৎক্ষণাৎ শায়েরের হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, ‘আপনি ছাড়া আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির কাছেও সুখি থাকতে পারবো না। তাই এই প্রশ্ন আপনি কখনোই করবেন না।’
পরম যত্নে স্ত্রীর গালে হাত রাখলো শায়ের। তারপর বলল,’তাহলে আমার থেকে কিছু লুকাবেন না। সব বলুন ভালো লাগবে।’
পরী শায়েরের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। বলে,’আপার বাচ্চাকে দেখেছেন??কি সুন্দর তাই না?’
পরীর মনোভাব সব বুঝে গেল শায়ের। সেও হাত ধরে পরীর তারপর বলল,’আপনার চাই তাই তো?’
-‘ফুপু বলেছিলেন একটা বাচ্চার কথা,কিন্ত??’
একটু চুপ থেকে পরী বলে,’আচ্ছা আমি কি মা হতে পারবো না?’
-‘আল্লাহ চাইলে সব পারেন পরীজান। আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ আপনার সাথে আছেন। কখনো আর এই চিন্তা করবেন না।’
-‘অনেক দিন তো পার হয়ে গেল। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আর ফুপু,,’
-‘বুঝেছি ফুপু আপনাকে চাপ দিচ্ছে তাই তো।’
-‘নাহ,ফুপুর ও তো মন চায় তাই না?তাছাড়া আমিও চাই।’
-‘এতো চিন্তা করবেন না। আপনাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ভালো লাগেনা আমার। আমার পরীজান কে সবসময়ই হাসিখুসি দেখতে চাই।’
পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শায়ের। নাজানি এখন একটা বাচ্চার জন্য পরীকে কথা শুনতে হয়। ভাবনাটা সেটা নিয়ে নয়। ভাবনা হলো পরী তখন কীভাবে নেবে বিষয়টা? নিশ্চয়ই কঠিন ভাবে প্রতিবাদ করবে। তখন না অশান্তির সৃষ্টি হয়।
মন ভাল করার জন্য পরীকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো শায়ের। গ্রামের পথে প্রায়শই যায় ওরা। তবে আজকে রাতে বের হয়েছে ওরা। সুধাকরের আলোতে তখন ঝলমল করছে ধরণী। রাস্তাঘাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে হাতে হাত রেখে হেঁটে চলছে শায়ের পরী। আলতো করে পরীর বাহু ধরে জড়িয়ে ধরেছে পরীকে। রাতে তো কেউ রাস্তাঘাটে খুব একটা আসেনা। ফাঁকা রাস্তাটা দুজনে বেশ উপভোগ করছে। সাথে পরীর মনটাও ভালো হয়ে গেছে। শায়ের বলে,’কিছু ভালোবাসা আর কিছু অনুভূতি গোপনে সুন্দর জানেন কি?’
-‘না তো!!আপনার কাছে প্রথম শুনলাম।’
-‘আপনার প্রতি আমার সকল অনুভূতি ভালোবাসা সবই ছিলো গোপন। কখনোই ভাবিনি আপনি আমার ভাগ্যে আছেন। আমি চাঁদের আশা করিনি,চাঁদের আলোতেই খুশি ছিলাম। কিন্ত বিধাতা যে আকাশসহ চাঁদটাকেই আমাকে দিয়ে দিলেন।’
চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে পরীর দিকে তাকিয়ে শায়ের বলে,’যে রাতে আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম খুব দীর্ঘ একটা রাত ছিলো। আপনাকে দেখার পর কাকভেজা চোখ নিয়ে শুধু অস্থিরতায় ছটফট করেছিলাম বাকি রাতটুকু। আপনাকে আরেকটিবার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলাম কিন্ত সেই দেখা দিলেন বিয়ের রাতে। কত অপেক্ষা করিয়েছেন আমাকে ভাবতে পারছেন?’
-‘কিন্ত আপনার চোখে কখনোই সেই অনুভূতি দেখিনি মালি সাহেব। কীভাবে এতোসব গোপন রাখেন আপনি?’
-‘আমার সবচেয়ে গোপন জিনিস টা কি জানেন?’
মাথা নেড়ে না বুঝায় পরী। শায়ের তখন পকেট থেকে কিছু একটা বের করে। চাঁদের রুপালি আলোতে চিকচিক করে উঠলো নূপুর টা। পরী এবার ভিশন অবাক হলো!!এই সেই হারিয়ে যাওয়া নূপুর। যেটা পাগলের মতো খুজেছে পরী। আর সেটা কি না শায়েরের কাছে ছিলো!!সে বুঝতেই পারেনি। পরী জিজ্ঞেস করে,’এটা আপনার কাছে ছিলো? তবে আপনি তখন বলেননি কেন?’
-‘তখন তো জানতাম না যে এই নূপুরের মালিক আমার হবে। তাই যত্নে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এখন বুঝতে পারছেন তো আমার ভালোবাসা কতটা গোপন ছিলো!!’
বিনিময়ে হাসলো পরী। শায়ের হাটুমুড়ে বসে নূপুরটা পরিয়ে দিলো পরীকে। শায়ের উঠে দাঁড়ানোর আগেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে পরীর। ধাক্কাটা খুব জোরে লাগতে সরে আসে সে। পেছন ফিরে কাউকে দ্রুত পদে চলে যেতে দেখলো পরী। শায়ের উঠে দাঁড়াল পরীকে ধরে বলল,’আপনার লাগেনি তো?’
পরী আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনো। শায়ের বলল,’এই যে দাঁড়ান? চোখে দেখেন না? এভাবে ধাক্কা দিলেন!!’
-‘মেজো কাকি।’
শায়ের অবাক হলো বলল,’মেজো কাকি!! আপনি চিনলেন কীভাবে?’
পরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিনার দিকে তাকিয়ে বলে,’তার চাল চলন আমি খুব ভাল করে চিনি। সে যেই সুগন্ধি তেল মাখে তার গন্ধটাও পেয়েছি। কিন্ত মেজো কাকি এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলেন?’
শায়ের নিজেও তা খেয়াল করে। সত্যিই তো কোথায় যেতে পারে সে? এসব চিন্তা করতে করতে বাড়িতে চলে আসে ওরা। শায়ের কিছু না ভাবলেও পরী ভাবছে। কেননা ইদানীং পরী শায়েরের মেজ কাকি রিনা আর হেরোনাকে কথা বলতে দেখে। কিন্ত বিষয়টা এখন বেশ বুঝেছে সে। সাথে খুসিনাকে ঘরে ডেকে নিয়ে কিছু বলে। পরী এতদিন এসবে পাত্তা দিতো না। ওরা যা বলে বলুক ওর কি তাতে। কিন্ত যখন বিষয়টা খুসিনা পর্যন্ত গিয়েছে তখন পরী ভেবেছে কিছু তো ঘাপলা আছে। পরীর ধারণা সঠিক হলো যখন খুসিনা পরেরদিন এসে শায়ের কে ডাকলো।
কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে শায়ের। খুসিনা তখন শায়ের কে ডাকতে ডাকতে ঘরে ডুকলো,’কামে যাস তুই?’
-‘হুমম কিছু বলবে তুমি??’
-‘হ কইতাম। কি কমু? তুই আমার পোলা, তোর ভালার লাইগা কইতে হইবো। তোর বউয়ের তো পোলাপান হইবো না। বংশধর তো আনোন লাগবো। নাইলে তোর হইবো কি? তাই কইছিলাম তোর বউও থাক। তুই চম্পারে বিয়া কর।’
পরী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ফুপু যে এতো সহজে কথাটা বলে ফেলবেন তা জানা ছিলো না পরীর। এতোদিন কতই না ভালোভাবে দিন কাটছিল এই ফুপুর সাথে। আর আজকে এই মানুষ টা এতো সহজ ভাবে কথাগুলো বলে দিলো? পরী কিছু বলল না। শুধু শায়েরের জবাবের আশাতে চেয়ে রইল। শায়ের শান্ত স্বরেই বলে,’আজ বলেছো,তবে দ্বিতীয়বার যেন তোমার মুখে একথা না শুনি ফুপু।’
-‘ক্যান কমু না সেহরান। তোর কি বাপ হবার ইচ্ছা করে না? দেখ সব ভাইবা দেখছি আমি। তাই তোর বউর সামনেই কইলাম। তুই বিয়া কর। দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।’
শায়ের এবার খুব রেগে গেলো। রাগন্বিত কন্ঠে বলল, ‘পরীজান থাকলেই চলবে আমার। চাই না আমার বাচ্চা। আর তোমাকে কে বলল আমার বউয়ের বাচ্চা হবে না?’
খুসিনা জবাব দিলেন না। জবাব দিলো পরী,’বড় কাকি বলেছে তাই না ফুপু?’
এবার ও জবাব দিলেন না তিনি। কথাটা তো হেরোনা বলেছে খুসিনাকে। খুসিনা আগেও চেয়েছিল চম্পা শায়েরের বউ হোক। এখন যখন পরী মা হতে পারবে না জেনেছে তখন চম্পার সাথে শায়েরের বিয়ে হলেই ভাল হবে। এই ভেবে খুসিনা রাজি হয়েছেন।
-‘বড় কাকি কিভাবে জানলো আমি মা হতে অক্ষম? এতোটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?’
খুসিনা এবার মুখ খুললেন,’চম্পা তোমাগো কইতে হুনছে।’
শায়ের পরী একে অপরের দিকে তাকালো। ওরা কবে এসব নিয়ে আলোচনা করলো?আর চম্পা শুনলোই বা কীভাবে? পরীর মাথাটা ঘুরে গেল। ভালো ব্যবহার করাটা কি তাহলে চম্পার নাটক ছিলো? রাগে পরীর চেহারাটা লাল বর্ণ ধারণ করলো। ওর জীবনে বিশ্বাসঘাতকের জায়গা এক চুল ও নেই।
#চলবে,,,,