পর্ব -০২ || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_২
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

(কপি করা নিষেধ।কোনো পেজ,গ্রুপ,ওয়েবসাইট কিংবা ইউটিউবে দেয়া যাবে না।)

বন্যার জন্মের আগেই বন্যার আব্বা মা,রা যায়।বন্যার আম্মা রেনু বেগমের গর্ভে তার অবস্থান কেবল চার মাসের,হঠাৎ করে স্বামী মা,রা যাওয়ায় অনেকেই বলেছিলো রেনুর বয়স অল্প আবার বিয়ে দেয়া যাবে এখন যদি এই বাচ্চা হয় তাহলে বাচ্চাসহ বিয়ে দিতে কষ্ট হয়ে যাবে তারচেয়ে ভালো হবে যদি এখনি ন,ষ্ট করে ফেলা হয়।কিন্তু রেনু বেগম নাকোচ করে দেয়,যে দুনিয়াতে আসতে চায় তাকে আসতে দেয়া উচিত ন,ষ্ট করার তার কোনো হক নেই।তার এই সিদ্ধান্তে সবাই নারাজ হয় কারণ রেনুকে আবার বিয়ে দিলে বাচ্চাটা তাদেরই পালন করতে হবে।বন্যার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন রেনুর আবার বিয়ে হয়।
বন্যার নানা আকতার ভালো মানুষ,রেনুকে বিয়ে দিলেন বেশ ভালো ঘরে,ছেলে আগে একটা বিয়ে করেছিলো বউ মা/রা গেছে একটা মেয়ে আছে।আকতার হক রেনুর স্বামী শফিককে কিছু টাকা দিলেন কিন্তু শর্ত রাখলেন বন্যা মায়ের সাথে থাকবে।রেনুর স্বামী শফিক ইসলাম সানন্দে রাজি হয়ে যায়,যেহেতু তারও একটা মেয়ে আছে রেনু যদি তাকে আদর দিয়ে বড়ো করতে পারে তাহলে সে কেনো রেনুর মেয়েকে আপন করে নিতে পারবেনা?শফিক রাজি হয়।সব স্বাভাবিক’ই হচ্ছিলো কিন্তু একটা ঝ’ড়ে বন্যার জীবনের ছন্দ বদলে দিলো।কোমল,মিষ্টিভাষী,সুন্দরী মেয়েটা কি রুক্ষ,কর্কশ আর স্বভাব চরিত্র ছেলেদের মতো হয়ে গেছে।রেনু অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে।বন্যার জন্য হাহাকার করে উঠে ভেতরটা।তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়ের অপেক্ষাই করছিলো।আজকাল উনার কথাও শুনে না।বিয়ের কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেয়,অথচ বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে।উনার বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।তখনি দেখে বন্যা গেইট ঠেলে ভেতরে আসছে।এই বাড়িটা চারতলা।রেনুরা নিচতলায় থাকে।আগে পুরোবাড়িই ভাড়া থাকতো বছর চারেক আগে বাড়িওয়ালারা এসেছে।বাড়িওয়ালা মোবারক ভাই চট্রগ্রাম সরকারি পুলিশ অফিসার ছিলেন,চার বছর আগে উনার রিটায়ার্ড হয়েছে,আগে সপরিবারে উনারা চট্রগ্রাম থাকতো,যেহেতু রিটায়ার্ড হয়েই গেছে তাই আর শিকড় ছেড়ে দূরে পরে থাকেননি,ঢাকায় ফিরে এসেছেন।এখন তিনতলায় থাকেন।রেনুর মনে হয় মোবারক ভাই যথেষ্ট ভালো মানুষ কিন্তু উনার স্ত্রী আফিয়া যেনো কেমন!খুঁচা মা/রা স্বভাব।কথায় কথায় অহংকারী গলায় কথা বলতে ভুলে না,তবে উনার সাথে কথাবার্তা বলে,মাঝে মাঝে বাসায়ও আসে।এই বাসার সবচেয়ে পুরোনো ভাড়াটিয়া হচ্ছে তারা প্রায় বারো বছর ধরেই এই বাড়িতে আছে।সেই হিসেবে মোবারক সাহেবের সাথে সফিক আর রেনুর আলাদা একটা সম্পর্ক।
বন্যা বাসায় এসেই সোফায় গা এলিয়ে দেয় দুই পা ছড়িয়ে পুরুষের মতো বসে মাথাটা পিছনে হেলান দিয়ে রাখে।রেনু রুমে এসে মেয়েকে দেখে মনটা শান্ত হয় কিন্তু বন্যার এমন বসার ভঙ্গিমা দেখে জোড়ে জোড়ে বললো,
“এভাবে বসেছিস কেনো?পা ঠিক কর।বেয়াদব!”

বন্যা চোখ খুলে;মাথা উঠিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে।মেয়ের মুখে এমন মিষ্টি হাসি দেখে রেনুর বুকে আরো হাহাকারের রেশ লাগে।কি মিষ্টি তার মেয়েটা কিন্তু কারো এই মিষ্টতা দেখার সুযোগ বন্যা দেয় না,কপট রা,গে,অস্থিরতায়,রুক্ষতায় নিজেকে আড়াল করে রাখে।রেনু বন্যার কাছে এসে বললো,
“পা ঠিক কর।”

বন্যা বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
“আমার পা তোমাকে কি করেছে আম্মা?এভাবে রাখতেই তো মজা।”

“এমন পুরুষদের মতো বসার মানে কি?মেয়েরা থাকবে মেয়েদের মতো।গুছিয়ে চলা মেয়েদের বৈশিষ্ট্য।”

“আমি আমার মতোই আছি।মেয়েদের মতো চলার কোনো ইচ্ছা নেই।”

রেনু বেগম কিছুক্ষণ বন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বললো,
“তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।”

বন্যা তাচ্ছিল্য করে বললো,
“এসেছে নাকি তুমি ধরে বেধে নিয়ে এসেছো?”

রেনু দমে যায়।আসলে বন্যার যা চালচলন তাতে আশে পাশের এলাকা সহ সবাই বন্যার স্বভাব সম্পর্কে জানে।এই মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আনা খুবই কষ্টস্বাধ্য ব্যাপার।কিন্তু সফিক আর রেনু মিলে একটা সমন্ধ যোগার করে ফেলেছে।মেয়ে বড়ো হয়েছে এবার লাগাম টানা দরকার।বন্যার কথায় রেনু রেগে যায়,
“আমি আনি আর এমনি আসুক;এসেছে তো!এতো কথা বলবিনা।ছেলে ভালো চাকরি করে সুখেই থাকবি।”

বন্যা উঠে দাঁড়ায় নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“এসব বিয়ে আমাকে দিয়ে হবে না আম্মা,দেখা যাবে ব্যাটাকে সালা টালা বলে অজ্ঞান করে চলে আসবো।বাদ দাও তো।”

রেনু হতভম্ব চোখে বন্যার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।টয়া রুম থেকে বেরিয়ে আসে।রেনু যে তার সৎ মা তা সে কখনোই উপলব্ধি করে না,আসলে রেনু উপলব্ধি করার কোনো রাস্তা রাখেনি।টয়া পেছন থেকে রেনুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আপাকে না জ্বালিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও না আম্মা।এসব পড়া টরা আমার ভালো লাগে না।আপা ভালো ছাত্রী পড়ুক।”

রেনু টয়ার কান ধরে বললো,
“বিয়ের খুব শখ আপনার!আমার ঘরে একটার থেকে আরেকটা বেশী ধান্ধাবাজ।সামনে পরিক্ষা যা পড়তে যা!”

তাহসান গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে পার্কিং করে তিনতলায় যায়।কলিংবেল দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।আজকে ভার্সিটিতে তার ফাস্ট ক্লাস ছিলো,লেখাপড়া শেষ করে এতোদিন পাহাড়,সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছে কিন্তু তার এই ঘুরে বেড়ানো তার মায়ের পছন্দ না।একমাত্র ছেলের এমন ছুটে বেড়ানো থেকে রেহাই দিতেই ঢাকায় টেনে নিয়ে এসেছেন।ঠাস করে দরজা খুলে দশম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত তাহিয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
“ভাইয়া;কি খবর?”

তাহসান ভেতরে যেতে যেতে বললো,
“ভালো।”

“কোনো ছাত্রী পছন্দ হয়েছে?মানে লাভ এট ফাস্ট সাইট!”

তাহসান টেবিলে গিয়ে গ্লাসে পানি নিয়ে ঠকঠক করে পানি খায়।তাহিয়ার কথা শুনে মেয়েটার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।তাহসান আশ্চর্য হয়ে গেলো যে এমন ফালতু একটা মেয়েকে তার মনে থাকছে কেনো?ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এতো পাকনা কেনো তুই?আমি তোর বড়ো না!”

তাহিয়া কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“আরে আমাকেই তো বলবা কোনো সমস্যা হলে আমিই তো দেখবো।বুঝনা?”

তাহসান গলা উঁচিয়ে ডাকে।
“আম্মু তোমার মেয়েকে ডাকো,বেশী পেকে গেছে।”

আফিয়া বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।তাহিয়ার হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বললো,
“টেবিলে যা!একটু পরেই পড়াতে আসবে।”

তাহসান শুনে বললো,
“এই বাদরকে পড়ায় কে?কথা শুনে তোমার মেয়ে?”

আফিয়া হাসি হাসি মুখে বললো,
“যে পড়ায় সে আরো হাই ভোল্টেজের বাদর।আমাদের নিচতলায়ই থাকে।”

তাহসান মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা আচ্ছা।ভালো।”
চোখের পর্দায় ভেসে উঠে চঞ্চল মেয়েটার প্রতিচ্ছবি।সে এবার নিজের উপর বিরক্ত।এই মেয়েটাকে মনে রাখার মতো কি আছে?মন আঙুল উঁচিয়ে বললো,
‘কেমন প্রতিবাদ করলো,আজকাল কয়জন মেয়ে এভাবে প্রতিবাদ করতে পারে?’
মনের কথায় সে বুঝে যায় এতোক্ষণ মেয়েটাকে মনে রাখার কারণ তাহলে এটা!আসলেই প্রতিবাদ করাতে তার ভালো লেগেছিলো।আজকাল কয়জন মেয়ে প্রতিবাদ করে? সবাই’তো বাজে স্পর্শ নিয়ে চুপচাপ বাড়ি আসে,কাউকে কিছু বলে না।অনেকে বাথরুমে গিয়ে কাঁদে,মায়ের কাছে বললে মা বলে এসব কথা মানুষকে না বলতে মানুষ শুনলে খারাপ বলবে অথচ খারাপ ভাবার কথা যাকে আমরা আস্তে করে তাকে পেরিয়ে নির্দোষ মেয়েটাকেই খারাপ বলি।এই দিক দিয়ে ওই বাউন্ডুলে মেয়েটা ভালো।কিন্তু কথায় কথায় এভাবে গালি দেয়ার অভ্যাস কেনো?গালি দেয়া ছাড়া প্রতিবাদ করা যায় না?এসব ভাষা ব্যবহার করা কোনো ভদ্র ঘরের সন্তানদের কাজ না,মেয়েটা কোথাকার?বাজে মেয়ে নাকি?সে সারাটা সন্ধ্যা মেয়েটাকেই ভাবলো।ভাবতে ভাবতে বিরক্ত হয়ে গেলো।সে এখন একটা ভার্সিটির লেকচারার তাকে ওই রকম ভাবগাম্ভীর্য নিয়েই চলাফেরা করতে হবে কিন্তু একদেখা একটা ছাত্রীকে নিয়ে ভাবা তো লেকচারার এক কম্য না।সে নিজের মনকে শাষালো ‘এসব ভালো না। ‘

বন্যা আর তাহিয়া হলরুমে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।তাহিয়ার সামনে টেস্ট পরিক্ষা এই নিয়েই বন্যা কিছু বলছে।আফিয়া বেগম ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে বন্যাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে।বন্যার পোষাক আশাক তার মোটেই পছন্দ না,এই যে কেমন ডোলা ডোলা শার্ট আর ট্রাউজার পরে ঘুরে।তখনি বিপরীত পাশের রুম থেকে দরজা খুলে তাহসান বেরিয়ে আসে।তার চোখ প্রথমের শার্ট প্যান্ট পরা মেয়েটার মুখে গিয়ে আটকায় তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে কাছে এগিয়ে যায়,চেহারায় অবাকের মাত্রা ফুটে উঠেছে।
“এই!তুমি এখানে কি করছো?”

তাহিয়া ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
“বন্যা আপু!আমার গৃহশিক্ষক।”

তাহসান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তাই নাকি?এ পড়াতেও জানে?”

বন্যা চুপচাপ তাহসানের দিকে তাকিয়ে আছে।তাহিয়া অবাক হয়ে বললো,
“বলো কি!তুমি তো দেখি আপু সম্পর্কে কিছুই জানো না,ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।আমাদের বাসার নিচতলায় থাকে।”

তাহসান একবার বন্যার দিকে তাকায় তারপর হনহন করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।বন্যাও বাসা থেকে বেরিয়ে ক্ষিপ্ত গতীতে নিচে নামতে থাকে।তাহসান নিচতলায় দাঁড়িয়ে ছিলো,তার ইচ্ছা করছে বেয়াদব মেয়েটার সাথে একটু কথা বলতে।মানুষ স্বভাবতই এমন বাজে কিছুর প্রতি বেশী আকর্ষণ।বন্যা তাহসানকে দেখেও দাঁড়ায় না এমনকি তাকায়ও না।সে তো স্যার হয়,তাকে নিম্নতম সম্মানও কি করা যায় না?এই মেয়ে তো বেয়াদবের চূড়ান্ত।তাহসান দাম্ভিক গলায় ডাকে,”এই;দাড়াও।”

তাহসানের ডাকে চোখে কড়া আ,গুন এনে পিছনের দিকে তাকায়।তাহসান গম্ভীর গলায় বললো,
“তোমার নাম কি?”

বন্যা মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়।ভাব এমন যে তাহসানকে গুরুত্ব দিচ্ছে না,কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো এখনো কানে লাগাতার বেজে যাচ্ছে।শান্ত গলায় বললো,
“বন্যা;বন্যা মেহজাবীন।”

তাহসান শাষনের গলায় বললো,
“আমি তোমার স্যার হই না?দেখলে সালাম দিতে হয় সেই জ্ঞানটাও নেই নাকি?”

বন্যা দুই হাত বুকে মুড়ে তাহসানের চোখে চোখ রেখে বললো,
“ভার্সিটিতে আপনি আমার স্যার বাসায় না।বাসায় এসব স্যারগিরি দেখাতে আসবেন না।”

তাহসান চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“দেখালে কি করবে শুনি।”

বন্যা এক’পা সামনে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,
“সাইজ করে স্যারগিরি ছুটিয়ে দেবো।”

এটা বলে হনহন করে হেটে বাসার দিকে চলে যায়।তাহসান পেছন থেকে বলে,
“আস্ত ফাজিল।”

বন্যা পিছু ফিরে বললো,
“ফাজিল না বলেন ব্রাজিল আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার।”

বন্যার কথায় তাহসান কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না।হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে।এমনো মেয়ে হয়?আজব মেয়ে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here