#পাওয়া_না_পাওয়া_সুখ
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৬
[৯]
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ রাশি ছুটে চলেছে অন্তরিক্ষে। হু হু দমকা হওয়ায় উড়িয়ে নিচ্ছে শক্ত মানবীর দিঘল কালো কেশ। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ভারী হচ্ছে আকাশ। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। রঙিন প্রজাপতির পসরা বসেছে বাহির জুড়ে। আকাশের বুক ছিঁড়ে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। বৃষ্টি নামবে বলে। কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে নীহা ছুটে ছাদে চলে গেলো শুকনো কাপড় নিয়ে আসতে। মাথায় কাপড় টেনে একহাতে কুঁচি ধরে দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পা রাখলো। দ্রুততার সাথেই কাপড় টে’নে টে’নে নিচ্ছে।
-“কেমন আছেন ভাবি?”
আচমকা পুরুষালি কন্ঠস্বর কর্ণধারে পৌঁছাতেই তড়াক করে উঠলো নীহা। ভ’য়ে ভ’য়ে পেছন ঘুরে দেখলো তাদেরই একা ভাড়াটিয়া ছেলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
নীহা জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,
-“জি ভাইয়া ভালো আছি।”
ছেলেটা ফোন হাতে নিয়েই ছাদে এসেছিলো। আকাশের করুণ অবস্থা দেখে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বাড়ির মালিকের পুত্রবধূকে চোখে পড়লো। তাই সৌজন্যতার খাতিরেই কথাটা জিজ্ঞেস করলো। আবার ও মিষ্টি হেসে ছেলেটি বলল,
-“আপনি তো ভারী মিষ্টি মেয়ে।”
ছেলেটি ভেবেছিলো প্রশংসা শুনে নীহা খানিকটা হাসবে। কিন্তু নাহ তাকে ভু’ল প্রমাণিত করে হাতের কাপড় নিয়েই তাড়া দেখিয়ে নিচে ছুটলো সে।
নীহার ভ’য় হয়। এমন তাগড়া যুবক আর তাকে একসাথে ছাদে দেখে যদি কেনো কে’চ্ছা রটে যায়? আজকাল এসব ঘটনা ঘটার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিকাল চারটায় অফিস শেষ করেই বাড়ি ফিরলো নাফিজ। স্বভাব সুলভ বাড়ি ফেরার পথে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলো নাফিজ। ছাদে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো তাদের ভাড়াটিয়া ছেলে তার বউকে হেসে হেসে কিছু বলছে। নীহা নেমে যাওয়ার পর নাফিজ ঘরে গেলোনা। সোজা ছাদে পা বাড়ালো। এই তিনতলা বাড়িটি তার বাবার হাতে গড়া। তারা দুইভাই চাকরী ছাড়া আর কিছুই জোড়াতে পারেনি। তিনতলায় তারা থাকে। আর নিচের দুইতলায় চারটা ফ্ল্যাট করে ভাড়া দেওয়া।
নীহা যাওয়ার পর ছেলেটি নামার জন্য সিঁড়ি ঘরে পা রাখলো। নাফিজ এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ছেলেটি স্বভাব সুলভ হেসে বলল,
-“ভাইয়া কিছু বলবেন?”
নাফিজ কোনোরূপ ভনিতা করলোনা। সাফ সাফ ছেলেটিকে জানিয়ে দিলো,
-“তুমি এখন থেকে আর ছাদে উঠবেনা। তুমি কেনো? যেকোনো ছেলেরই এখন থেকে ছাদে ওঠা নিষেধ।”
ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। খানিক সময় পর মুখ খুললো,
-“কিন্তু কেনো ভাইয়া? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
নাফিজ নিষ্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“ছাদে মেয়ে মানুষের আনাগোনা থাকে। তাই মেয়েদের ভীড়ে ছেলেমানুষের না আসাই ভালো।”
ছেলেটি যেনো বুঝেও বুঝলোনা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল,
-“ভাইয়া, মেয়ে মানুষতো আগেও আসতো।”
বিরক্ত হলো নাফিজ। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
-“আগে তোমার বোন, আমার বোন আরও কয়েকটা মেয়ে আসতো। এখন সেই লিস্টে বাড়ির বউ ও যোগ হয়েছে। আশা করি বুঝতে পেরেছো।”
নাফিজ আর দাঁড়ালোনা। সারাদিন অফিস করে সে ভীষণ ক্লান্ত। টানা বসে বসে কম্পিউটারের সামনে কাজ করা লাগে। মাথাটা ও ভার ভার লাগছে। বুকটা ক্রমাগত ব্যথায় লাফিয়ে উঠছে।
নাফিজের কথার মর্মার্থ বুঝে ছেলেটি মিটিমিটি হাসলো।
-“ভাইয়া দেখছি ভীষণ ভাবে প্রেমে পড়েছে।”
শুকনো কাপড়গুলো গুছিয়ে সবার জামাকাপড় সবার ঘরে দিয়ে আসলো নীহা। সুফিয়া কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত। অধরকোনে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। নিশ্চয়ই হবু বরের সাথে কথা বলছে। কিছুদিন আগেই বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। সুফিয়ার জামাকাপড় রেখে নিজের ঘরে যাওয়ার পথে নাফিজের দেখা পেলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা চালিয়ে ঘরে যাচ্ছে নাফিজ। নীহা আর ঘরে গেলোনা। রান্নাঘর থেকে ঠান্ডা পানি দিয়ে একগ্লাস লেবুর শরবত গুলে নিয়ে গেলো। নাফিজ অফিসের পোশাক পাল্টে নরমাল জামা পড়ে নিয়েছে। নীহা শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে নিজের কাজে ধ্যান দিলো।
নাফিজ শরবতে চুমুক দিয়ে চোখে হাসলো। ঠোঁট প্রসারিত হলোনা। কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই যেকেউ টের পেতো নাফিজের প্রশান্তির হাসি। ভালোলাগা, ভালোবাসাগুলোকে দমিয়ে রাখলোনা সে। বাড়তে দিলো বেসামাল ভাবে। একটু ছুঁয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। সুপ্ত অভিপ্রায়।
নীহা নিচু হয়ে ঝুঁকে কাপড় হাতে নিলো আলমারিতে রাখার উদ্দেশ্য। শাড়ি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হলো পিঠ, কোমরের অংশ। দৃষ্টি সরালোনা নাফিজ। আত্ম তৃষ্ণায় স্বার্থপর হলো। নেত্রপল্লবে শুষে নিলো রঙিন কিছু মুহূর্ত।
নীহা প্রয়োজন ব্যতীত নাফিজের সাথে খুব একটা কথা বলেনা। প্রথম দিকে জড়তা থাকলেও এখন কেবলই অভিমান দেয়াল টানিয়েছে। কিন্তু তার অভিমানের স্তর কতটা গাঢ় তা নাফিজকে আঁচ করতে দিচ্ছে না।
বুকে ব্যথা উপশমে বুকের নিচে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে শুলো নাফিজ। আবেশে চোখজোড়া বুঁজে নিলো।
পাশে দাঁড়ানো নীহার দেহের এক অকৃত্রিম সুবাস টের পেয় মনে মনে শুধালো,
-“আহা এ বুঝি এক কঠিন প্রেম। হাড় কাঁপানো জ্বরের আভাস পাচ্ছি। আমার হৃদয়ে তোমার উষ্ণতা পাওয়ার বড় স্বাদ জাগছে।”
[১০]
ঘন আষাঢ়িয়া নৃত্য শেষে স্থির হয়েছে প্রকৃতি। শান্ত, স্তব্ধ,নিরব প্রকৃতিতে সতেজতার ছোঁয়া। কচি কিশলয়ে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা জমে চিকচিক করে উঠছে। সোঁদা মাটির ঘ্রাণ প্রাণ ভরে শুষে নেওয়াতে এক আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। জানালার দ্বার ঘেঁষে প্রকৃতির এই মনোরম সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাঘাত ঘটলো মুঠোফোনের কম্পিত শব্দে। পাশ ফিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মুঠোফোনে। “অন্তিক ভাই” নামটি ফোনের স্ক্রিনে বারবার ভেসে উঠছে।
রিসিভ করে সালাম বিনিময় করলো দুজনে।
অন্তিক বলল,
-“তোর এপ্লাই কমপ্লিট। আমি এখান থেকেই আবেদন করেছি তোর জন্য। এখন শুধু অপেক্ষার পালা ফিরতি এসএমএস এর।”
প্রেমার মধ্যে প্রফুল্লতা আর চরম উৎকন্ঠা কাজ করলো। খুশির ঝিলিক দৃষ্টিগোচর হলো তার চোখেমুখে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে প্রেমা বলল,
-“তুমি এতো ভালো কেনো ভাইয়া? এই জন্যই তোমাকে আমার এত ভালোলাগে।”
স্মিত হাসলো অন্তিক। গলা ঝেড়ে কঠিন স্বরে বলল,
-“এত খুশি হলে চলবেনা। প্রাথমিক কাজ গুলো নিজে নিজেই বাড়িতে প্র্যাকটিস কর। তাহলে এখানে আসলে ট্রেনিং এ সহজ মনে হবে। আর হ্যাঁ আমি সেনাবাহিনী হবো বলে লাফালে চলবেনা। নিজের মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। দেশের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলাম। আমি একজন গর্বিত সৈনিক। প্রাণ থাকা অবদি দেশের জন্য লড়ে যাবো।
মনোবল শক্ত রাখতে হবে। নয়তো সেনাবাহিনীতে আসার আশা ছেড়ে দে। এখনো সময় আছে।”
অন্তিক অনুভব করলো প্রেমা কঠিন হচ্ছে। তার নরম আবরণ ঢাকা পড়ে শক্ত খোলস বেরিয়ে আসছে। প্রেমা চোয়াল শক্ত করে শুধালো,
-“আমিই পারবো। একবার যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছি তা সাফল্য হিসেবে বয়ে আনবোই।”
অন্তিক মনে মনে অনেকটাই খুশি হলো। প্রেমার মধ্যে দৃঢ়তা আছে। তবে তার বড্ড ভ’য় হয় এখানে এসে নাজানি মেয়েটার মত বদলে যায়। তাইতো সময় থাকতে তাকে শক্ত করছে। সিলেক্ট হওয়ার পর যদি এখানে আসার সুযোগ পায় প্রেমা তবে তার নরম, হাস্যরসাত্মক ভাই অন্তিকের বদলে অন্য এক অন্তিককে দেখবে। যার মধ্যে কোনো কোমল হৃদয় নেই। কেবল, কেবল এক কঠোর চরিত্রের অধ্যায় দেখবে প্রেমা।
দুজনের কথা শেষ হতেই প্রেমা মাকে গিয়ে খবরটা দিলো। আয়শা মুখ কালো করে বসে রইলেন। উনার মাঝে কোনো আগ্রহ দেখা গেলোনা।
সেদিন অন্তিক খালাকে নানাভাবে বুঝিয়ে প্রেমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে ঘুরিয়েছে। তবুও আয়শার মনে একটা কালো আঁধারের স্তর থেকেই গেলো। তার এমন তুলতুলে, নরম মেয়ে কিভাবে সইবে এমন কষ্ট?
জয়নুল আবেদীন খোশ মেজাজে বাড়ি ফিরলো। উনার নামের মি’থ্যে লোন নেয়ার অভিযোগ টা উঠে গেছে। উনাদের ছয় জনের নাম করে আবুল কোম্পানিরই এক লোক টাকা লোন নিয়েছেন।
বাড়ি ফিরে মেয়ের মুখে আরেকটা খুশির খবর শুনে আয়শাকে বললেন,
-“আজ বাড়িতে খিচুড়ি হবে নাকি? একে একে সব খুশির খবর। তারউপর বৃষ্টির পরবর্তী শীতল পরিবেশ। আহা! জিহ্বে জল এসে পড়লো।”
আয়শা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। প্রেমা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
-“মা সাথে একটু লেবুর আচার হলে ভালো হয়।”
[১১]
মইফুল ভাসুরের ঘরে গিয়েছে। চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আর থাকতে পারলোনা।
বাদশা আর তার বউ শিমু দুজন দুজনের উপর চরমভাবে ক্ষেপেছে। শিমু কেনো ঘর ছেড়ে ফকিরকে চাল দিলো? তার সুন্দরী বউকে এখন ফকির দেখে ফেলেছেনা? এ নিয়ে হা’উ’কা’উ করে বাড়ি মাথায় তোলে বাদশা। শিমু দিশা না পেয়ে তার হিল জুতা দিয়ে বাদশার মাথায় আ’ঘা’ত করে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-“আমার ডিস্কুর বাড়ি খা।”
বাদশা মাথায় হাত দিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে মই দিয়ে ঘরের চালে উঠে গেলো। আদরের বউকে ফিরতি আ’ঘা’ত করলোনা। তাদের ঝ’গ’ড়া থামানোর সাধ্য কারো নেই।
বাদশা চালের উপর গাঁট হয়ে বসে রইলো। অন্তিকের বাবা, তার বাবা সহ সবাই নেমে আসতে বলছে। সে কিছুতেই নামবেনা। জেদ ধরে বলল,
-“শিমু আমাকে ডিস্কু দিয়ে মা’র’লো কেনো? আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আরও একটা বিয়ে করবো। আব্বা আপনি আমাকে অনুমতি দেন বিয়ে করার। নয়তো আমি চাল থেকে নামবোনা বলে দিলাম।”
বাদশার বাবা ক্ষে’পে গেলেন।
-“হা’রা’ম’জা’দা আগে নেমে আয়।”
বাদশা বসেই রইলো। এদিকে বাদশা বিয়ে করবে শুনে শিমু জ্ঞান হারালো।
আর অপেক্ষা করলোনা বাদশা চাল থেকে নেমে গেলো। তার বউকে কাউকে ধরতে দিলোনা। নিজে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো। নিজ থেকেই সেবা করে শিমুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে।
পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে শিমুকে জড়িয়ে ধরলো বাদশা।
-“কসম করে কইলাম বউ। আমি বিয়ে করবোনা।”
শিমুর যে কয়টা দাঁত আছে সবগুলো বের করে হেসে দিলো। স্বামী স্ত্রীর মিল দেখে যে যার কাজে চলে গেলো। মইফুল বিড়বিড় করতে করতে হাঁটলেন,
-“পা’গ’লের গোষ্ঠীতে এসে পড়েছি আমি। আমি নিজে যে পা’গ’ল হয়ে যায়নি এতেই শুকরিয়া আদায় করি।”
অন্তিকের বাবা খরগোশের মতো কান খাড়া রাখলেন। খ্যাঁক করে উঠতে গিয়েও শান্ত রইলেন। পরিস্থিতি হয়তো বিগড়ে যেতে পারে।
#চলবে………
(