আমার মৃত স্ত্রীকে রাস্তা দিয়ে এক যুবকের সাথে হেঁটে যেতে দেখে স্বভাবতই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এটা কী আদৌ সম্ভব যে একজন মৃত ব্যক্তি এতোটা সাবলীল ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে? অথচ আমি নিজ হাতে নিশিকে কবর দিয়েছিলাম। আর তাছাড়া নিশির কোনো জমজ বোনও নেই যে সে আমার চোখের আড়ালে এভাবে হেঁটে বেড়াবে।
এসব ভাবতেই যখন পুনরায় আবার সেই স্থানে তাকালাম তখন আমার স্ত্রীর রূপধারী সেই নারীকে দেখতে পেলাম না। আমার এই বোকামীর কারণে এখন মন চাচ্ছে নিজের মাথায় নিজেই কিল মারি। তবুও মনে কিছুটা আশার সঞ্চার ঘটিয়ে যেখানে
সেই মেয়েটি একটি যুবকের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে উপস্থিত হলাম। যাত্রাবাড়ীর এই মোড়ে এতোটাই লোকালয়ে ভরপুর যে চোখের পাতা ফেললে মুহূর্তেই যেকোনো মানুষ লক্ষ্যবস্তু থেকে হারিয়ে যেতে সময় নেবেনা। উক্ত স্থানে উপস্থিত হতেই চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের পর যখন আশা অনেকটা ছেড়েই দিচ্ছিলাম ঠিক তখনি সেই মেয়েটিকে পুনরায় দেখতে পাই। কিন্তু যতক্ষণে রাস্তা পার হয়ে সেই স্থানে যাওয়া ধরলাম ততক্ষণে মেয়েটি একটি সিটিং সার্ভিস বাসে ওঠার সাথে সাথে বাসটিও তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলো। আমি অজানা এক কৌতুহলে মেয়েটির পিছু নিতে যেই উল্টো পথে এসে আমার বাইকে উঠতে যাবো ঠিক তখনি একটি ভারী যান আমাকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় দশফুট দূরে ছিটকে ফেলে দিলো। মাথায় বেশ আঘাত পাওয়ার দরুন মুহূর্তেই আমি অচেতন হয়ে গেলাম এরপর আর কিছুই মনে নেই।
যখন নিজের চোখ দুটো খুলি তখন নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের বেডে। পাশ ফিরেই দেখতে পাই আমার বর্তমান স্ত্রী মিমি আমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে আছে। কিছুক্ষণ অন্তর আমার শ্যালক মিহাদ একজন নার্সকে নিয়ে আমাদের কেবিনে প্রবেশ করলো। নার্স আমার কপালে হাত দিয়ে এবং পালস চেক করে আমার শরীরের অবস্থান জানার চেষ্টা করলেন। পরমুহূর্তেই আমার স্ত্রী মিমি আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-কী হয়েছিলো তোমার? কীভাবে এ্যাক্সিডেন্ট করলে বলোতো?
মিমির সাথে সাথে আমার শ্যালক মিহাদও বলে উঠলো,
-মারুফ ভাই! আপনার এ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে আপুতো পাগল হয়ে গেছিলো। কেমনে কী হইলো বলেনতো?
মিমি আর মিহাদের এসব ন্যাকামো দেখে আমি আর কিছু বললাম না। কারণ এদের ন্যাকামো দেখতে দেখতেই এই কদিন পার করেছি।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাড়িতে আসার পর আমি নিশির মতো হুবুহু চেহারার সেই মেয়েটিকে নিয়ে একমনে ভেবেই চলছি। আমাকে ভাবনার জগতে হাবুডুবু খেতে দেখে রাতে মিমি আমার জন্য স্যুপ বানিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো,
-আচ্ছা তুমি আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলো না ঠিক আছে তাই বলে আজ এ্যাক্সিডেন্টের খবরটাও আমার সাথে শেয়ার করা যায়না?
-এসব তোমার না শুনলেও চলবে তবুও বলি আজ আমি নিশির মতো চেহারার একটি মেয়েকে রাস্তায় দেখেছিলাম। তখন মেয়েটির কাছে যাওয়ার সময় কী থেকে কী হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি।
মিমি আমার কথায় বেশ খানিকটা চমকে উঠলো।
-কী বলো? নিশিতো সেই কবেই মারা গেছে সে আবার রাস্তায় আসবে কীভাবে? ওসব হয়তো তোমার মনের ভুল ছিলো। আচ্ছা এখন ওসব চিন্তা বাদ দাও, আসলে তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।
-হুম টাকা লাগবে তাইতো?
মিমি আমার কথায় কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
-না মানে হ্যাঁ ঐ আর কি বাবা এবার তরমুজের চাষ করবে জমিতে তাই আমার কাছে বলেছিলো তুমি যেনো তাকে এক লাখ টাকা দাও। সমস্যা নেই তরমুজ বিক্রি করেই আবার তোমাকে টাকা দিয়ে দিবে।
মিমির কথায় আর কোনো জবাব না দিয়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে আসলাম। আমি জানি যে মিমির বাবা যেহেতু টাকা চেয়েছে তাই নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে টাকা দিতেই হবে আর সেটা কেবল আমার মায়ের কারণেই।
মিমির সাথে আমার বিয়েটা হয় গতমাসেই। মিমির আগে আমি নিশি নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের একবছরের মাথাতেই নিশি রহস্যজনকভাবে আত্মহত্যা করে।
ঘটনাটা একবছর আগের…
আমি তখন সবে সড়ক ও জনপদ বিভাগের ফিল্ড অফিসার থেকে মন্ত্রনালয়ে প্রোমোশন পাই। নিশিকে আমি খুব ভালোবাসতাম কেননা ও একজন স্ত্রী হিসেবে আমার নিকট যথেষ্ট পারফেক্ট ছিলো। আর তাছাড়া আমার সাথে ওর সম্পর্কটাও ছিলো বেশ বন্ধুসূলভ। একদিন অফিসের একটি কাজে জরুরী প্রয়োজনে আমার ঢাকা থেকে খুলনা যেতে হয়। সেদিন আমি নিশিকে বাসায় একাই রেখে গিয়েছিলাম আর এমনিতেও সচরাচর নিশি একাই থাকতো। মাঝেমধ্যে আমাদের কাজের বুয়া কিছু টুকটাক কাজ করে তাঁর বাড়িতে চলে যেত। খুলনা পৌঁছানোর একদিন পর হঠাৎই আমি বুয়ার ফোন পেয়ে তৎক্ষনাৎ আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। বাসায় উপস্থিত হতেই নিশির ঝুলন্ত দেহটিকে দেখে তখন আমার হৃদয়টা বায়ুমন্ডলহীন এক নিকষ কালো অন্ধকারে রূপ নিয়েছিলো। আমি তখনো ভেবে পাচ্ছিলামনা যে নিশি কেনইবা আত্মহত্যা করলো? ঠিক তখনি পুলিশের দায়িত্বে থাকা একজন অফিসার আমাকে একান্তে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় জানান যে আমাদের গেইটের দাড়োয়ান নাকি নিশির সাথে খারাপ কিছু করেছে তাই সে নিজের সম্মানহানীকে মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। আর এই সবকিছুই নাকি নিশির টেবিলে রাখা চিঠিতে উল্লেখ ছিলো। এমনকি তাঁরা জানায় যে দাড়োয়ান নাকি তখনো বাসার নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিলো তাই তাকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হয়নি বাকিটা পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা যাবে। সে যদিও এসবের কিছুই স্বীকার করেনি তবে শিকের ভিতরে নিয়ে দুই এক ঘা দিলেই ফরফর করে সবকিছু বলে দিবে।
তখন পুলিশের কথায় আমার মন কোনোভাবেই মানছিলো না কারণ আমার স্ত্রীর সাথে দাড়োয়ান কোনোদিনও এমন সাহসিকতার সহিত খারাপ কাজ করতে পারবেনা আর তাছাড়া দাড়োয়ানের এসব শুনে তৎক্ষনাৎ পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সে নাকি তখনো বাসার নিচেই ছিলো। যদিও নিশি আমাকে একদিন বলেছিলো যে দাড়োয়ান নাকি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর দিকে প্রায়শই কুদৃষ্টিতে তাকাতো। তাই বলে এতো কিছু?
সেদিন আমার মনে এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনার উদয় হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আর দাড়োয়ানের স্বীকারোক্তি আমার পূর্বের সব ভাবনা চিন্তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছিলো।
নিশির এই বেদনাদায়ক মৃত্যু তখন সত্যিই আমার জীবনকে হ য ব র ল করে দিয়েছিলো। কিন্তু অনেকটা রহস্যজনকভাবে নিশির মৃত্যুর প্রায় এক মাস পর আমার নামে একটি পার্সেল আসে। যখন পার্সেলটি খুলি তখন তাঁর ভিতরের কাগজটা দেখে সীমিত সময়ের জন্য আমি স্থির হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ সেটার ভিতরেই ছিলো একটি ডিভোর্স পেপার আর সেটাতে নিশির সাইনও ছিলো। মৃত্যুর একমাস পর এভাবে নিজ স্ত্রীর ডিভোর্স পেপার পাওয়া সত্যিই কোনো স্বাভাবিক বিষয় হতে পারেনা। এরপর যদিও আমি অজস্রবার এই সবকিছুর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আদতে আমি সেই রহস্যের কোনো ফল পাইনি।
.
ছাদে দাঁড়িয়ে অতীতের সেই বিষাদময় মুহূর্তের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হাতের ঘরিটা চোখের সামনে নিয়ে আসি। কখন যে দুঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আজকের এ্যাক্সিডেন্টে তেমন আঘাত না পেলেও হাতে আর মাথায় অনেকটাই কেঁটে গিয়েছিলো। বেশ রাত হওয়াতে ছাদ থেকে নিচে নেমে ঘরের দরজায় নক দিলাম। নক দেওয়ার সাথে সাথেই মিমি দরজা খুলে দিলো। সত্যি বলতে এই মেয়েটাকে আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা। মিমি সম্পর্কে আমার খালাতো বোন, আমার মা প্রথমেই মিমির সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার এবং আমার বাবার এই বিষয়ে মত ছিলোনা দেখে তিনি তখন আর আগবাড়াতে পারেননি। মিমি রূপে গুণে কোনোদিক দিয়েই কম ছিলোনা কিন্তু ওর পরিবারের সবাই বেশ লোভী প্রকৃতির। মিমির বাবা সেই প্রথমেই আমার সাথে মিমিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বহু চাল খেলেছিলেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যদিও নিশির মৃত্যুর পর তাঁদের ইচ্ছাটা একটু দেরীতে হলেও পূর্ণ হয়েছিলো। মিমি মেয়েটি ওর পরিবারের মতো এতোটা খারাপ না হলেও ওর পরিবারের নিচু মনমানসিকতার কারণে ওকেও আমার একদমই সহ্য হয়না। বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই মিমির বাবা মিমির মাধ্যমে ইতঃমধ্যে আমার কাছ থেকে ধারের কথা বলে দুই লাখ টাকা নিয়ে ফেলেছে। যদিও এর পিছনে আমার মায়ের হাত আছে। কারণ তিনি এতোটাই বোকা যে তাকে কেউ পটিয়ে ফেললেই সে তাঁর মায়া কাঁটিয়ে উঠতে পারেনা। আমি যখন টাকা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করি তখন আমার মা বলেন,
-আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ গরীব থাকলে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হয়। আর মিমির বাবাতো আমাদের দুই দিক থেকে আত্মীয়। সে তো বললোই তোর টাকা নিয়ে আবার দিয়ে দিবে তাহলে এমন করিস কেন?
মায়ের এহেন বক্তব্যে তখন টাকা দিতে অনেকটা বাধ্যই হয়ে যাই। আমি খুব ভালো করেই জানি যে এসব টাকা বেঁচে থাকতে আর ফেরত পাবোনা। তাছাড়া আমার শ্যালক মিহাদও আমাদের এখানেই থেকে পড়ালেখা করে আর তাঁর সম্পূর্ণ খরচ আমারই বহন করা লাগে। মোটকথা এই সবকিছু বিবেচনা করে মিমির প্রতি আমি বেশ বিরক্ত কারণ ওকে বিয়ে না করলে মিমির বাবা কোনোদিনও এতোটা সহজভাবে আমার নিকট টাকা চাওয়ার সুযোগই পেতো না আর চাইলেও একবারের বেশি দিতাম না।
যাইহোক পরদিন যখন আমি অফিসের কাজে পরিপূর্ণ ব্যস্ত তখন হঠাৎই আমার ফোনে এক অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। অফিসে থাকাকালীন আমি চেনা পরিচিতজনদের নাম্বারই রিসিভ করিনা আর সেখানে অচেনা নাম্বার রিসিভ করার প্রশ্নই ওঠেনা। তাই পুনরায় আরেকবার কল দেওয়ার পরও রিসিভ না করে উল্টো মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখলাম।
রাতে যখন খাবার খাচ্ছিলাম ঠিক তখনি সেই অচেনা নাম্বারের কথা আমার মনে হলো, অনেকটা কৌতুহল নিয়ে খাবার শেষ করেই সেই নাম্বারে কল দিলাম। ওপাশ থেকে একজন যুবক রিসিভ করতেই বলে উঠলো,
-স্যার, কুরিয়ারে আপনার একটি পার্সেল এসেছে।
আমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কেউ আমাকে পার্সেল দিবে এমনতো কোনো কথা হয়নি।
-আপনার হয়তো মনে নেই। কাল যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে পার্সেলটি নিয়ে যাবেন।
আমি আর কিছু না বলে কলটি কেঁটে দিয়েই ভাবলাম,
-কেউ কিছু না বলেই কেনো আমাকে পার্সেল দিতে যাবে?
তবুও নিজের ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে পরদিন কুরিয়ার অফিসে উপস্থিত হতেই সেখানের দায়িত্বে থাকা একটি ছেলে আমার নাম্বারটা মিলিয়ে চিঠি সদৃশ একটি পার্সেল আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি তখনো জানিনা যে এটার ভিতরে কী আছে তাই নিজের কৌতুহলকে দমাতে না পেরে সেখানেই চিঠিটা ছিড়ে ভিতরে থাকা কাগজটা বের করলাম। কিন্তু কাগজের ভিতরে বড় বড় অক্ষরে লেখা একটি বাক্য দেখে মুহূর্তেই আমার শরীরে অজানা এক শিহরণ বয়ে গেল। তাঁর মানে এই এক বছরে আমি যা ভেবে এসেছিলাম সেটাই ঠিক ছিলো?…
.
[To Be Continue]
.
পার্সেল প্রথম পর্ব
Misk Al Maruf
.
(পরবর্তী পর্ব কমেন্টে দেওয়া হবে।)