পার্সেল ২য় পর্ব
Misk Al Maruf
.
আমি তখনো জানিনা যে এই পার্সেলের ভিতরে কী আছে তাই নিজের কৌতুহলকে দমাতে না পেরে সেখানেই চিঠিটা ছিড়ে ভিতরে থাকা কাগজটি বের করলাম। কিন্তু কাগজের ভিতরে বড় বড় অক্ষরে লেখা একটি বাক্য দেখে মুহূর্তেই আমার শরীরে অজানা এক শিহরণ বয়ে গেল। তাঁর মানে এই একবছরে আমি যা ভেবে এসেছিলাম সেটাই ঠিক ছিলো? কিন্তু তখনো আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না যে এই পার্সেলটি আমাকে কেইবা পাঠালো আর এই বাক্যটি পাঠানোর উদ্দেশ্যটাই বা কী তাঁর?
আজ এই পার্সেল রহস্যের কারণে অফিসেও ঠিকভাবে মন বসাতে পারছিলাম না। কেননা পরপর দুদিন আমি যে দুই দুইটি রহস্যের মুখোমুখি হবো এটা যেন আমার ভাবনাতেই ছিলোনা। তবে একটি বিষয় আমি কোনোভাবেই মিলাতে পারছি না আর তা হলো ঐদিন রাস্তায় যে আমি নিশির হুবুহু চেহারার মেয়েটিকে দেখলাম সে কী আসলেই নিশির কোনো জমজ বোন ছিলো নাকি অন্যকেউ? কোথাও যেনো শুনেছিলাম পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন ব্যক্তি হতে পারে তাই বলে এতোটা সাদৃশ্য থাকাটা কখনোই আমার নিকট বিশ্বাসযোগ্য নয়।
রাতে বাড়িতে ফিরে পার্সেলে থাকা সেই কাগজটি বেশ ভালো করে উলটে পালটে দেখলাম কিন্তু মোটা অক্ষরে প্রিন্ট করা বাক্যটি ব্যতীত সেই কাগজে আর কিছুই লেখা ছিলোনা। হঠাৎই আমার মনে হলো কুরিয়ার থেকে কোনো পার্সেল আসলেতো তাঁরা আমাকে সাথে করে একটি স্লিপও দিবে যেখানে প্রেরকের নাম এবং মোবাইল নাম্বার উল্লেখ থাকবে। কিন্তু আমি কতইনা বোকা, পার্সেলের প্রতি থাকা অতি আগ্রহের ফলে স্লিপটাও নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তবুও কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, যাক আগামীকাল কুরিয়ার অফিস থেকে স্লিপ নিয়ে আসলেই বোঝা যাবে কে আমাকে নিয়ে এরকম পার্সেল প্রদানের মাধ্যমে খেলা করছে?
এসব ভাবতেই চিঠিতে থাকা কাগজটি আমার ব্যক্তিগত অফিসের ব্যাগের ভিতরে খুব যত্ন করে রেখে দিলাম। তৎক্ষনাৎ মিমি রুমে প্রবেশ করেই আমাকে বলে উঠলো,
-আচ্ছা বাবার টাকাটার ব্যপারে কিছু ভেবেছিলে? বাবা বলেছেন কালকের মধ্যে টাকাটা দিলে একটু ভালো হয় আরকি! কাল নাকি তরমুজের বীজ কিনবে।
মিমির কথায় এতোদিন আমি নিশ্চুপ শ্রোতার ভূমিকা পালন করলেও আজ কোনো এক অজানা কারণে আমার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে গেলো। অনেকটা আক্রোশ কন্ঠেই বললাম,
-শোনো! তোমার বাপে আমার নিকট কোনো টাকা পায়না যে তাঁর যখন টাকার প্রয়োজন হবে তখনি টাকা দিবো। তোমাদের মতো মেয়েরা জামাই বাড়ি আসেই জামাইকে ফুতুর করার জন্য আর বাপকে বড়লোক করার জন্য। এই জন্যই আমি তোমাকে প্রথম থেকেই বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। আচ্ছা তোমার কী একটুও লজ্জা হয়না যে বাপের জন্য আমার কাছে টাকা চাও? মেয়েরা আরো বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে আর তুমি উলটো দিয়ে আসো। আর আমিতো এটা খুব ভালো করেই জানি যে তোমার বাপকে আমি যত টাকাই দেই না কেন তাঁর একটা টাকাও আমার ফেরত পাওয়ার সৌভাগ্য নেই। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি তোমার বাপের মতো এতো লোভী নও কিন্তু বিয়ের পর এই কদিনে আমার সেই ভুলটাকে তুমি সত্যি হিসেবে প্রমাণ করে দিলে। কেন বলোতো?
মিমি আমার এতোগুলো কথা হজম করতে না পেরে স্বভাবতই নিজের চোখের অশ্রুধারা ছেড়ে দিলো। কিন্তু ওর এসব ভাব ভঙ্গি কেন যেন আমার নিকট বেশ ন্যাকামোর মতো লাগছিলো। পরক্ষণেই মিমি হনহন করে বেডরুম ত্যাগ করলো। আমি আর ওর বিষয়ে নাক না গলিয়ে খাঁটের উপরে আস্তে করে শরীরটা এলিয়ে দিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখতে পাই আমার শ্যালক মিহাদ লাগেজপত্র গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বেশ কৌতুহলের স্বরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কীরে কই যাস?
মিহাদ কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
-আপু বলছে আমি এখানে থাকলে নাকি তাঁর অনেক সমস্যা হয় তাই আমাকে আলাদা মেছে উঠতে বলছে।
মিহাদের কথা শুনে আমি বেশ হতভম্ব হয়ে গেলাম পরক্ষণেই মনে বেশ কিছুটা রাগের সঞ্চার করে বেলকনিতে যেতেই দেখি মিমি কারো সাথে ফোনে বেশ রাগান্বিত স্বরেই কথা বলছে। কথা বলার মুহূর্তে আমি ওকে বিরক্ত না করে বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলাম। যতটুকু বুঝলাম মিমি ওর বাবার সাথে কথা বলছে এবং বারবার ওর মাধ্যমে আমার নিকট টাকা চাওয়ার ফলস্বরূপ ও ওর বাবাকে বলছে,
-তুমি যদি আমাকে সুখি দেখতে না চাও তবে আমার সাথে আর কথা বলার দরকার নেই। তুমি জানো? আমি টাকা চাওয়ার সময় কতটা অপমানের স্বীকার হই? তোমরাতো এখানে আমাকে বিয়েই দিয়েছো নিজেদের স্বার্থে, মেয়ের সুখের কথাতো জীবনেও ভাবলে না। আমি আজ একটি কথা খুব ভালোভাবে বলে দিচ্ছি আর যদি আমার স্বামীর কাছে কখনো টাকা চেয়েছ তবে তোমার মেয়েকে আর কখনোই পাবেনা।
এই বলে মিমি কলটি কেঁটে দিয়েই নিজের চোখের অশ্রু মোছার বৃথা চেষ্টা করলো। ও তখনো খেয়াল করেনি আমি ওর পিছেই দাঁড়িয়ে ওদের সকল কথোপকথন শুনেছি। সত্যি বলতে এতোদিন মিমির প্রতি আমার বিরক্তিভাব কাজ করলেও আজ নিজের কাছেই অনুশোচনাবোধ হচ্ছে যে মিমির সাথে গতকাল খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। কারণ এখানেতো ওর কোনো দোষই নেই বরং তিলের তেল বানিয়ে ওকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর তাছাড়া শ্বশুরতো আমার বাবার মতোই তাই তাঁর যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় তবে মেয়ে জামাই হিসেবে সেক্ষেত্রে আমার তাকে সাহায্য করা একান্ত কর্তব্য। এসব ভেবেই মিমির কাধে হাত দিতেই ও কিছুটা চমকে উঠলো। আমার এরকম আকস্মাৎ উপস্থিতি দেখে মিমি অবাক হলেও ও বুঝতে পারছিলো না যে আমি ওর কথাগুলো শুনেছি কীনা? একটু আগে রাগমাখা মন নিয়ে আসলেও এখন বেশ শান্ত স্বরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
-মিহাদকে তুমি কোথায় যেতে বলেছো?
আমার কথায় ও বেশ ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
-না মানে ও এখানে থেকে কী করবে? ও পড়তে যেহেতু এসেছে তাই মেছে থেকে একটু কষ্ট করেই পড়ালেখা করুক। কষ্ট না করলে কী ভালোভাবে পড়ালেখা হবে?
-মিথ্যাতো ভালোই বলতে পারো। আমার এখানে কী জায়গার অভাব আছে যে ও মেছে থেকে পড়ালেখা করবে? আর শ্বশুরের জন্য টাকা রেডি করেছি এসে নিয়ে যাইতে বইলো। আমি এখন অফিসে যাবো তাড়াতাড়ি খাবার দাও সময় নেই বেশি।
মিমি আমার কথা শুনে আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। ওর মুখোভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও আমার থেকে এরকম বার্তা কখনোই আশা করেনি।
-কী হইলো এইভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
-না মানে কিছুনা। কিন্তু বাবাকে টাকা না দিলেও হবে কারণ তুমি ঠিকই বলেছিলে বাবাকে টাকা দিলে আর সেটা ফেরত পাওয়া যাবেনা।
-ওসব নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবেনা। টাকা ফেরত না পেলেও আমার সমস্যা নেই, শ্বশুরতো বাবার মতোই আর তাকে টাকা দিয়ে যদি ফেরত নাও পাই তবুও আমার কোনো সমস্যা নেই।
এই বলেই আমি পিছন দিকে ফিরে খানিকটা হাসি দিয়ে ডাইনিংএ চলে আসলাম। আমি খুব ভালো করেই জানি যে মিমি আমার হাসিটা অবলোকন করতে না পারলেও আমার চলার পথে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। ডাইনিং রুমে এসেই মিহাদকে বেশ তেজদীপ্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,
-তোর বোকা বোনের কথাই কী সবসময় শুনতে হবে? বোকারা তো কত কিছুই বলে। সবকিছু নিয়ে তোর রুমে যা।
আমার কথায় মিহাদের কালো করা মুখখানি মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
বিয়ের পর থেকে এই কদিনে মিমি আমার বেশ ভালোভাবেই যত্ন খাতির করেছে কিন্তু আজ কেনো জানি সবকিছুতেই একটু বেশি বেশির আভাস পাচ্ছি। আমার মনে মনে এই নিয়ে বেশ হাসি পেলেও তবুও তা প্রকাশ করলাম না।
অফিসে আসতেই পুনরায় আবার গতকালের সেই পার্সেলের কথা আমার মনে পরলো। আমার অফিসের কলিগ নজরুল আর আমি প্রায় সমবয়সী। তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটা অন্যদের থেকে একটু আলাদা। সবার সাথে আমি কথা কম বললেও নজরুলের সাথে আমার মনে গেঁথে থাকা যত কথা আছে সবকিছুই শেয়ার করি। আর এর মূল কারণটা হলো তিনি বেশ উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন একজন ব্যক্তি এবং যেকোনো সমস্যার সমাধান খুব দ্রুতই দিয়ে ফেলেন। আজ অফিসে আসতেই তাঁর দেখা পেয়ে মনের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম কারণ গত তিনদিন যাবৎ তিনি ছুটিতে ছিলেন। তাঁর ডেস্কে যেতেই তিনি আমাকে অনেকদিন না দেখা বন্ধুর ন্যায় জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর এহেন অমায়িক আচরণের কারণে তাকে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে। অতঃপর কুশল বিনিময় করে তাকে বললাম,
-নজরুল ভাই, ইদানিং আমি অনেকটা রহস্যের মারপ্যাঁচে আটকে গেছি। আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে নিয়ে খেলছে।
তিনি বেশ কিছুটা কৌতুহলী স্বরে আমাকে বলে উঠলেন,
-কী হইছে খুলে বলেনতো।
পরমুহূর্তেই এক এক করে সেদিন দেখা নিশির অনুরূপ মেয়ে আর পার্সেলের বিষয়টি তাকে খুলে বললাম। তিনি কিছুটা চিন্তিত মুখে বললেন,
-হুম বিষয়টা আসলেই ভাববার বিষয়। তবে ঐ মেয়েটিকে দেখা হয়তো আপনার চোখের ভুল কিন্তু পার্সেলের বিষয়টা আসলেই অদ্ভুত। তাছাড়া আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর একবছর পর কেনইবা কেউ আপনাকে পুরোনো ঘটনা মাটি খুড়ে নতুন করে জানানোর চেষ্টা করবে? আচ্ছা পার্সেলের স্লিপেতো প্রেরকের নাম্বার থাকার কথা। ঐটা এনেছেন?
-না ভাই পার্সেলের কৌতুহলে ঐটা নিতে একদমই মনে ছিলো না।
-এইতো একটা বোকার কাজ করে ফেললেন। আজকে বিকালে আবার কুরিয়ার অফিসে যেয়ে স্লিপটা নিয়ে আসবেন। ঐ নাম্বারে ফোন দিলেই বোঝা যাবে হারামজাদাটা কে?
এভাবে নজরুল ভাইয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে যেই আমার ডেস্কে ফিরে যেতে ধরবো তখনি এক অচেনা নাম্বার থেকে পুনরায় আবার কল আসলো। অফিস চলাকালীন সচরাচর আমি কল না ধরলেও আজ কেনো জানি কলটি রিসিভ করলাম। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক মেয়েলী কন্ঠস্বরে আমাকে বলে উঠলো,
-স্যার, আপনার জন্য একটি পার্সেল এসেছে। যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে অনুগ্রহপূর্বক নিয়ে যাবেন।
কথাটি শোনামাত্রই আমি দৌড়ে যেয়ে নজরুল ভাইয়ের ডেস্কে উপস্থিত হয়েই বললাম,
-ভাই আবার পার্সেল এসেছে।
-ফোনটা আমার কাছে দেনতো।
আমি ফোনটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি বলে উঠলেন,
-কই থেকে পার্সেল এসেছে?
কলটি লাউডস্পিকারে দেওয়ার কারণে ওপাশে থাকা মেয়েটির কথা খুব স্পষ্টতই শোনা যাচ্ছিলো। মেয়েটি তাঁর কথার জবাবে বললো,
-জ্বী স্যার, বাগেরহাট শাখা থেকে এসেছে।
কথাটি শুনেই আমি চমকে উঠলাম।
-নজরুল ভাই বাগেরহাটতো আমার আগের স্ত্রীর বাবার বাড়ি ছিলো।
তিনিও আমার কথায় বেশ অবাক হয়ে বললেন,
-ডাল মে কুচ কালা হে। চলেন আজকে আমিও যাবো আপনার সাথে পার্সেল নিয়ে আসতে।
.
অজস্র কৌতুহল নিয়ে বিকালে অফিস ছুটি শেষে নজরুল ভাইকে নিয়ে কুরিয়ার অফিসে উপস্থিত হলাম। নিজের নাম্বারটা পার্সেলে থাকা নাম্বারটির সাথে মিল দেখেই দায়িত্বে থাকা ছেলেটি পূর্বের ন্যায় আমাকে একটি চিঠি সদৃশ কাগজ ধরিয়ে দিলো। আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে বললাম,
-গতকালকেও একটি পার্সেল এসেছিলো কিন্তু সেটার স্লিপ নিতে মনে ছিলোনা। ঐ স্লিপটা কী এখন দেওয়া যাবে?
-জ্বী স্যার অবশ্যই।
এই বলেই ছেলেটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করানোর অন্তর আজকের এবং গতকালকের স্লিপটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।
উভয় স্লিপে থাকা প্রেরকের স্থানে আমার প্রথম স্ত্রী নিশির সেই পুরোনো নাম্বার দেখে অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলাম। এ কীভাবে সম্ভব? আমিতো নিশির মৃত্যুর পরই ওর সিম নষ্ট করে ফেলেছিলাম। তাহলে এখানে আবার ওর নাম্বার আসলো কীভাবে? প্রশ্নটি থেকেই যায়…
.
[To Be Continued]
.
(পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া হবে।)