#পূর্ণা
পর্বঃ৩
মবিন সাহেব মা*রা গেলেন ভোর চারটা পঁয়ত্রিশে। শেষ মুহুর্তে তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট উঠেছিলো। কোনোভাবেই তিনি কথা বলতে পারছিলেন না ঠিকমতো। পূর্ণা এই পুরোটা সময় মবিন সাহেবকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করেনি। তার হাত ধরেই বসে ছিলো আর মাঝে মাঝে এই করিডর থেকে ওই করিডর ছুটেছে ডাক্তার ডাকার জন্য। কখনো না স্যালাইন বা জরুরি ওষুধ কিনতে ছুটেছে ফার্মাসিতে। মবিন সাহেব একটু সময়ের জন্যও তাকে যেতে দিবেন না, পূর্ণা তখন চার ছেলেকে অনুরোধ করেছে,”দয়া করে এই ওষুধটা এক্ষুনি এনে দিন, নাহলে যে দেরি হয়ে যাবে অনেক।”
মেয়ে জয়িতা মুখ বাঁকিয়ে বললো,”কেনো? তুমি যাও না। সবই তো একাই করলে, এখন আমার ভাইদের কেনো বলছো?”
“আমাকে যে আপনাদের বাবা ছাড়তে চাচ্ছেন না।”
“ইশ ঢং দেখে বাঁচি না। বাবা আমাদের, দরদ উনার বেশি। যাও যেয়ে ওষুধ আনো।”
পূর্ণা উপায়ন্তর না পেয়ে পূর্ণা ছুটে গেছে ওষুধ আনতে।
কিন্তু এতো করেও শেষ রক্ষাটা আর হলো না। পূর্ণা তখন পাগলের মতো ছটফট করছিলো আর সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মবিন সাহেব। তার চোখে ভালোবাসা,স্নেহ আর মমতা।
“পূর্ণা।”
“আপনি কথা বলবেন না দয়া করে। আরো কষ্ট হবে আপনার। ডাক্তার নিষেধ করেছে এখন আপনাকে কথা বলতে।”
পূর্ণা যদিও মুখে বললো কথাটা, কিন্তু তার মন চাচ্ছিলো মানুষটা অনেক কথা বলুক, অনেক গল্প করুক আগের মতো। তার প্রথম ভালোবাসার কথা, তার দাপটের সাথে করা চাকরির কথা, ছেলেমেয়েদের শৈশবের কথা সব বলুক। পূর্ণা মুগ্ধ হয়ে শুনতে চায় সেসব কথা।
“আমাকে একটু বলতে দাও পূর্ণা, নাহলে সারাজীবন আফসোস করবে।”
চমকে উঠে তাকায় পূর্ণা সেদিকে। কি বলছে উনি? সারাজীবন আফসোস করতে হবে মানে?
“কি বলছেন আপনি? আফসোস করতে হবে মানে কি?”
“আজকের পর থেকে তুমি চাইলেও আর আমার এই বকবক শুনতে পারবে না।”
আর্তনাদ করে ওঠে পূর্ণা।
“এসব কি বলছেন আপনি? শরীর খারাপ লাগছে আবার? একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসছি।”
উঠে ছুটে যাচ্ছিলো সে। হঠাৎ পিছনে টান অনুভব করায় ঘুরে তাকায় সে। পূর্ণার আঁচল ধরে বসেছেন মবিন সাহেব। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো পূর্ণার।
“বসো পূর্ণা, এতো ব্যস্ত হতে হবে না। আমার কথাটা শুনো। এরপর ডাক্তার ডাকতে যাও তুমি।”
বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকায় থাকে পূর্ণা। কোনোদিকেই কোনো মন নেই তার। মানুষটার কিছু হবে না তো?
“আমি জানি পূর্ণা, আমার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তোমাকে। আমার ছেলেমেয়েদের কাছে কটু কথা শুনতে হয়েছে। তবুও তুমি আমাকে ছেড়ে যাওনি। আমি কিছুই করতে পারিনি তোমার জন্য।”
ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে পূর্ণা, মানুষটার কথা কিছুই ভালো মনে করছে না সে।
“কেঁদো না পূর্ণা, শক্ত করো নিজেকে। আমি না থাকলে তোমার যেনো কোনো সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা আমি করে গিয়েছি। বেশ কিছুদিন যাবৎ আমার শরীরটা ভালো ছিলো না। আমি বুঝতে পারছিলাম সময়টা বুঝি এগিয়ে এসেছে। তাই যা করার করেছি আমি এরমধ্যে। আমার বন্ধুর ছেলে উকিল রেজাউলকে তো চিনো তুমি, দেখেছো অনেকবার বাড়িতে। ও তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবে। আমার ছেলেমেয়েদের অনেক আছে, আমি নিজেও রেখেছি তাদের জন্য অনেক। কিন্তু যে স্বীকৃতি আমি তোমাকে দিয়েছি তার জন্য এসব তোমার প্রাপ্য। নিজেকে কখনো ছোট মনে করবে না তুমি, দূর্বল মনে করবে না এদের সামনে। তুমি ভালো থাকবে পূর্ণা।”
বিস্ফারিত চোখে মবিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে পূর্ণা। হালকা চিৎকার করে উঠে বলে,”সম্পত্তি? কি করবো আমি ওই সম্পত্তি দিয়ে। যে বটগাছ আমার মাথার উপর এতোদিন ছিলো, যে মায়ায় সে আমার আঁকড়ে ধরে রেখেছে, যে স্বীকৃতি আমাকে সে দিয়েছে সেই মানুষটা আমার মাথার উপর না থাকলে এই সম্পত্তির কি মূল্য? সব তুচ্ছ আমার কাছে,সব।”
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পূর্ণা। মবিন সাহেব কিছু বলেন না। মুচকি একটু হেসে আস্তে আস্তে নিথর হয়ে যায়। পূর্ণা সেদিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। ছুটে যায় বাইরের করিডরে ডাক্তার ডাকতে।
সেই ভোর চারটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে ডাক্তার মবিন সাহেবকে মৃ*ত ঘোষণা করে।
মবিন সাহেবের বাড়িতে বিশাল মিটিং বসেছে। সেই মিটিং এ সবাই বসেছে। মবিন সাহেবের চার ছেলে, তাদের স্ত্রীরা, তিন মেয়ে, তাদের স্বামীরা এবং উকিল রেজাউল। এই মিটিংএ অনুপস্থিত শুধু পূর্ণা। তার অবশ্য এদিকে কোনো মন নেই। অসম বয়সের সঙ্গীকে হারিয়ে তার মানসিক অবস্থা শোচনীয়। সারাদিন নিজের ঘর আটকে এক কোণায় পড়ে থাকে।
আলোচনার বিষয়বস্তু মবিন সাহেবের সম্পত্তি। কোন ছেলে বা মেয়ে কোনটুকু পাবে।
রেজাউলকে কেউ কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না। তার আগেই সবাই নিজেরাই ভাগবাটোয়ারা করতে ব্যস্ত।
“দ্যাখ, আমি তোদের সবার বড় বোন। বাবার পরে আমিই তোদের অভিভাবক। তাই আমার কথাটা সবাই মন দিয়ে শোন।”
সবাই চিত্রার দিকে তাকায়।
“সবাই তো যা নেওয়ার নিচ্ছিস। এই বাড়িটা আমি নিই। পুরোনো আমলের বাড়ি। কতই বা হবে মূল্য। তোদেরই বেশি ছেড়ে দিচ্ছি।”
চিত্রার কথায় সব কয়টা ভাইবোন হৈহৈ করে উঠলো।
“আপা, এই কথাটা কীভাবে বলো তুমি? পুরোনো বাড়ি তো কি হয়েছে? এই এতো বড় বাড়ির বর্তমান মূল্য জানো তুমি? কীভাবে এটা তুমি নিতে চাও? সামনের মাসেই আমার একটা প্রজেক্ট আছে। এইরকম জায়গা হলে বেশ হয়। ভাবছি এই বাড়িটা ভেঙ্গেই আমার প্রজেক্টের কাজ শুরু করবো। তাই তোরা আর যা নিবি নে, এই বাড়িটা আমাকে দে।”
বড়ভাই সাব্বিরের কথাতেও বাকি ভাইবোনগুলো অমত জানায়। আর যা নিবে নিবে কিন্তু এই বাড়ির ভাগ কেউ ছাড়বে না। রেজাউল সব শুনছে চুপ করে, কারণ সে এদের থেমে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। এরা ভাবতেও পারছে না এরা যা চাচ্ছে তা কোনোদিন পাবে না এরা।
প্রায় ঘন্টা দুই বাকবিতন্ডার পরে ঠিক হলো সাত ভাইবোনই এই বাড়ির ভাগ নিবে। যে যার ভাগে নিজের কাজ করবে। কেউ ফ্লাট বানাবে, কেউবা প্রজেক্টের কাজ করবে আবার কেউ নিজের ভাগটুকু বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাবে।
“ব্যস সবাই খুশি? কিন্তু এখন বলো ওই হাভাতে ঘরের মেয়েটাকে কবে তাড়াবে এখান থেকে?”
“ওকে নিয়ে এতো ভাবার কি আছে? এক্ষুনি ঘাড় ধরে বের করে দিলেই হয়। আমাদের বাবা ওকে মাথায় তুলে রেখেছিলো বলে কি আমরাও রাখবো?”
“কিন্তু আপা, এতোদিন বাবাকে দেখেছে ও। আমরা কেউ তো পারিনি সেভাবে বাবার খোঁজ নিতে। ওকে কি কিছুই দিবো না আমরা?”
ছোট ভাইয়ের কথা শুনে সবাই সরু চোখে তার দিকে তাকায়। সাব্বির রাগী কণ্ঠে বলে,”হাসিব, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? হ্যা এতোদিন বাবাকে দেখেছে, ওকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া যাবে। কিন্তু তার জন্য তাকে আমাদের সম্পত্তির ভাগ কেনো দিতে হবে? এটা আবার কেমন কথা?”
বাকি সবাই সায় দেয় সাব্বিরের কথায়। ভাইবোনের চাপে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয় ছোট ভাই হাসিব।
“আচ্ছা ওকে তাহলে এখনি ডেকে আনা হোক। টাকাপয়সা সবাই মিলে কিছু দিয়ে আপদ আজই বিদায় করি।”
“ঠিক বলেছিস ভাই, হাভাতের ভাবটা দেখলে বাঁচিনা। বাবা চলে গেলো আমাদের, উনি নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিব্বি সুন্দর একটা ঘর দখল করে শোক পালন করছে। তোর এতো কি? তোর সাথে বাবার কি সম্পর্ক?”
‘আরে বুঝিস না? সব এই সম্পত্তি পাওয়ার জন্য এমন করছে। ভাবছে দুইদিন নাটক করলে বোধহয় সম্পত্তি পাওয়া যাবে সব।”
“ওকে ডেকে পাঠা। আজই তল্পিতল্পা নিয়ে চলে যাক, ঝামেলা বিদায় হোক।”
পূর্ণাকে মাঝে বসিয়ে পরের ধাপের আলোচনা শুরু হয়েছে। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে এখন কি করতে হবে। কিছু টাকাপয়সা নিয়ে এক্ষুনি এ বাড়ি ছাড়তে হবে। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ভাঙ্গা হবে এ বাড়িটা।
পূর্ণা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,”আমি কারো কোনো ক্ষতি করবো না। একটা কোণায় পড়ে থাকবো। মানুষটার স্মৃতিটুকু নিয়ে থাকবো। আমাকে তাড়িয়ে না দিলে হয়না?”
বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে তাকায় সবাই পূর্ণার দিকে।
(চলবে। পরের পর্বে সমাপ্ত)