#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ০৭
আর্শের গলায় মুখ গুঁজে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মিয়ামি।তার এক হাত আর্শের পেটের উপর অবস্থান করছে।আর্শের এক হাত তার মাথার নিচে এবং অপর হাত দ্বারা মিয়ামিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে সেও।সারা রাত পাটিতে শরীর এলিয়ে জোৎস্না বিলাসের সাথে সাথে অল্প স্বল্প কথোপকথন করার মাঝেই উভয়ের চোখে ঘুম ভর করে।অতঃপর কখন দুজনেই নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পরে তার খেয়াল উভয়ের মাঝে কারোরই নেই।
সূর্যাদয়ের পর ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে পৃথিবীর অর্ধাংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে।পাখিরা তাদের কিচিরমিচির শব্দে জানান দিচ্ছে নতুন ভরের।ঠিক এমন সময়ই ঘুম হালকা হয়ে আসে আর্শের।নিজের গলায় কারো নিঃশ্বাস অনুভব হওয়ায় সে ধীরে ধীরে নিজের চোখ মেলে তাকায়।মিয়ামিকে নিজের বুকের উপর দেখে চমকে উঠে সে।রাতে তো তারা এতোটা কাছে ছিলো না।তার ও মিয়ামির মাঝে প্রায় ১ হাত সমান দূরত্ব ছিলো তাহলে এতোটা কাছে কখন এলো তারা!
এসব ভাবতে ভাবতেই মিয়ামির দিকে তাকায় আর্শ।মেয়েটি একদম বাচ্চাদের মতোই ঘুমিয়ে আছে তার বুকে।ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটে ওঠে আর্শের।এই বাচ্চা মেয়েটিকেই তো সে আকাশ সমান ভালোবাসে।যে ভালোবাসা প্রকাশের সাধ্য তার নেই।থাকবেই বা কি করে?ভালোবাসলে তো ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখতে হয়।কিন্তু সে তো এতে অক্ষম।
মানুষের ভালোবাসা কতোটা তীব্র হলে সে এতো উপেক্ষা,অবহেলার পরেও ভালোবেসে যেতে পারে!ঠিক কতোটা তীব্র অনুভূতির জোরে মানুষ ভালোবাসায় বেহায়া হতেও দ্বিধা করে না! মিয়ামির এ তীব্র ভালোবাসা প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করে আর্শ।ইচ্ছে করে মেয়েটিকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা দিয়ে এভাবেই নিজের বুকে সারাটি জীবনের জন্যে আগলে রাখতে।কিন্তু মানুষের কর্ম ভালো না হলে জীবনটা সুখের প্রতিক্ষাতেই কেটে যায়,প্রকৃত সুখ আর মেলে না।ঠিক সেভাবেই আজ আর্শের কর্মই তার জীবনের সব থেকে বড় অভিশাপে রুপ নিয়েছে।এ অভিশাপের জন্যে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে সে।আদৌও কি হারিয়ে ফেলছে সে?মিয়ামি কি তাকে ছেড়ে যাবে কখনো?
আর্শের ভাবনার মাঝেই নড়েচড়ে উঠে মিয়ামি।পিট পিট করে নিজের চোখজোড়া মেলে তাকায় সে।আসেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিজের অবস্থান বোধগম্য হতেই আর্শের চেহারার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিয়ামি।আর্শ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।ফলে উভয়েরই চোখে চোখ পরে গেলো।সাথে সাথেই ঠোঁটে একটি মিষ্টি হাসি টেনে নেয় মিয়ামি।আর্শ অপলক তাকিয়ে আছে এই নিষ্পাপ মুখশ্রীর মেয়েটির দিকে।যার ঠোঁটের হাসিটি আর্শের ভেতর তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।
“গুড মর্নিং!”(মিয়ামি)
মিয়ামির কথায় ঘোর কাটে আর্শের।মুহূর্তেই মুখমণ্ডলে বিরক্তির ছাপ ফেলে আর্শ বলে ওঠে,
-কিসের গুড মর্নিং? ওঠো আমার উপর থেকে।দিন দিন নিজের সকল সীমাবদ্ধতা ভুলে যাচ্ছো তুমি।আমাদের কিন্তু এখনো বিয়ে হয়নি,মিয়ু!তোমার এ কাজ গুলো মোটেও ঠিক না।
আর্শের কথায় মিয়ামি ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-ঠিক,বেঠিক ভেবে ভালোবাসতে হয় না তো।ইমরানের একটি গান আছে না,
“ঠিক বেঠিক না ভেবে
ভালোবাসি বেহিসেবে
দুজনে..
মনগড়া প্রেমকাব্য
তোকে নিয়ে যে লিখব
আনমনে”
ঠোঁটে হাসি নিয়েই গানটা গাইছিলো মিয়ামি কিন্তু আর্শ বাঁধা দিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-হইছে।ওঠো এখন আমার উপর দিয়ে।
মিয়ামি কিছু না বলে চুপচাপ উঠে বসে পরে।আর্শও উঠে নিজের ফোনটি হাতে নিয়ে সময় দেখে নেয়।মাত্র সকাল ৫ঃ৪৫ অর্থাৎ আর্শি এখনো ঘুম আর আর্শের মা-বাবা নামাজের জন্যে উঠলেও নিজের কক্ষ দিয়ে এখন বের হবেন না।
আর্শ গম্ভীর কণ্ঠেই মিয়ামিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-রুমে যেয়ে চুপচাপ আর্শির পাশে ঘুমিয়ে পর।
বলেই উঠে যাবে ঠিক এমন সময়ই মিয়ামি নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-আমার না অনেক ক্ষুদা লেগেছে।পেটে ইঁদুর,বিড়াল, হাতি,ঘোড়া সব দৌড়াচ্ছে।এমন ক্ষুদা নিয়ে আমার ঘুম আসবে না।
এবার আর্শ রুক্ষ কন্ঠে বলে ওঠে,
-কি পাইছো টা কি আমাকে?সারারাত ঠিক মতো ঘুমুতে দেওনি, এখন আবার তোমার জন্যে সাতসকালে রাঁধতে যাবো?
উত্তরে মাথা নিচু করে নেয় মিয়ামি।আর্শ এবার উচ্চ স্বরে বলে ওঠে,
-এক্ষনি রুমে যাও।ঘুম আসলে আসবে না হয় দরকার নেই ঘুমোনোর।
মিয়ামি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুতে পদে সে স্থান ত্যাগ করে আর্শির কক্ষে চলে আসে।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে তার।মনে একটু একটু অভিমানরা বাসা বাঁধতে চাইছে।প্রতিটি মানুষের ভালোবাসার ধরণই আলাদা।ঠিক তেমনই অনন্য মিয়ামির ভালোবাসার ধরণ ও।তার ভালোবাসার ধরণ এমন যে,”তুমি না বাসলেও আমি বাসি”।আর তার এই এক তরফা অনুভূতিতেই সে বারংবার কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে,অভিমানও কম হয় না তার।কিন্তু সে তার অভিমানগুলোকে প্রশ্রয় দিতে অনিচ্ছুক।সদা সর্বদার মতোই এবারও মিয়ামি নিজের অভিমান গুলোকে প্রশ্রয় না দিয়ে সে নিজেকে নিজেই বলে ওঠে,
“ভাইটুর দোষ নেই।সারারাত আমার জন্য ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি দেখে একটু রেগে ছিলো।তাই একটু চিল্লিয়েছে।আমারই উচিৎ ছিলো না উনাকে ক্ষুদার কথা টা বলা।”
এ কথার বিপরীতে অভিমানেরা বলে ওঠে,
“আমার কথা সে একটি বারও ভাবে না কখনো।আজও ভাবলো না।আমি ক্ষুদার্ত শুনেও আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিলো।অকারণে চিল্লালো! আর শেষে বললো,ঘুম আসলে আসবে না হয় দরকার নেই ঘুমোনোর।এর মানে তো এই ই যে,তার কোনো চিন্তেই নেই আমাকে নিয়ে।”
এসব মনে হতেই আবারও চোখ ঝাপসা হয়ে আসে মিয়ামির।কেনোই যেনো আজ তার অভিমানেরা বিদায় নেওয়ার নামই নিচ্ছে না।জমা হতে হতে অভিমানদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলছে।তাই তো মিয়ামির আজকাল এদের নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
আজ এ অভিমানেরা বিদায় নেবেই না বরং তারা তো অশ্রু হয়ে ঝরতে চাইছে।
প্রায় ১৫ মিনিট অতিবাহিত হতেই দরজায় মৃদু শব্দ শুনতে পায় মিয়ামি।ভ্রু জোড়া কুঁচকে সে শোয়া থেকে উঠে দরজা অব্দি যেতেই দেখতে পায় আর্শ খাবারের থালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।থালাতে নুডলস ও ডিম রাখা।আর্শ স্বাভাবিক স্বরে বলে ওঠে,
-এতে চলবে?
অন্য সময় হলে মিয়ামি হয়তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠতো,”চলবে না দৌড়াবে”। কিন্তু আজ তার মন অভিমানীনি তাকে এর অনুমতি দিলো না।সে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-লাগবে না,আমার ঘুম এসেছে।
বলেই কক্ষের ভেতর প্রবেশ করতে অগ্রসর হয় মিয়ামি কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।আর্শ এক হেঁচকা টানে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। উভয়ের মাঝের দূরত্ব শূন্যতে এনে চোখে চোখ রেখে আর্শ বলে ওঠে,
-অভিমান হওয়া ভালো।রাগ তো লক্ষী। এগুলোতে আমার সমস্যা নেই।কিন্তু খাবারের উপর রাগ ঝাড়া টা আমি পছন্দ করি না।
মিয়ামি নির্বাক তাকিয়ে আছে।আর্শের কথাটি শেষ হতেই মিয়ামির চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে তার অনিচ্ছাতেই।এই এক ফোঁটা জল আর্শের হৃদয়ে যেনো তীরের মতো গিয়ে বিঁধলো।সে তো চাইছিলো মিয়ামি যেনো কোনো ভাবেই তার অনুভূতি বুঝে উঠতে না পারে।সে জন্যেই তখন মিয়ামির সাথে ওমন ব্যবহার করলো।কিন্তু এতে মেয়েটা যে এতোটা কষ্ট পেয়ে যাবে তা আর্শ কল্পনাও করেনি।
মিয়ামির চোখে পানি দেখে সে যেনো নিজের সকল বাঁধা,অপারগতা নিমিষেই ভুলে গেলো।অতঃপর কোনো কিছু না ভেবেই আলতো করে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মিয়ামির চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-স্যরি।
আর্শের এই একটা শব্দ কানে আসতেই মিয়ামির সকল অনুভূতি,অভিযোগ,অভিমান যেনো হৃদয় চিরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।দেরি না করেই মিয়ামি আর্শের বুকে একটু খানি আশ্রয় নিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে ওঠে,
-তুমি অনেক পঁচা,ভাইটু।আমাকে অনেক কষ্ট দেও।তুমি কি চাও,আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাই?আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাকবা?
ভালোবাসাও বড্ড অদ্ভুত!প্রিয় মানুষের দেওয়া কষ্ট গুলো অশ্রু রূপে বিসর্জন দিবার জন্যেও আমরা তাদের বুকেই আশ্রয় খুঁজি।কারণ তার দেওয়া কষ্ট গুলো প্রশমিত করবার সার্মথ্য অন্য আর কারোরই নেই।
মিয়ামির অভিমানী কন্ঠের অভিযোগের উত্তরে পাথরের মূর্তির ন্যায় নিরব দাঁড়িয়ে আছে আর্শ।উত্তর দিবার মতো তো কিছুই নেই তার কাছে।ঠিক এই মুহূর্তে তার থেকে বড় অসহায় পুরো দুনিয়ায় আর একটিও হয়তো নেই।তার বুকেই তার ভালোবাসার মানুষটির অশ্রু কণাগুলো সমাধিত হচ্ছে।আর সে এতোটা ভালোবাসার পরও অন্তত একটি বারের জন্যেও নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে অপারগ।মানুষের কর্মের ফলে ভাগ্য কতোটা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে!!
আর্শের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মিয়ামি আর্শের থেকে সরে এসে খাবারের থালা টা নিজের হাতে নিয়ে চুপচাপ আর্শির কক্ষে প্রবেশ করে। মিয়ামি যাওয়ার পরও আর্শ ঠায় কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রয়।
!!
বিকেল ৪ টা বাজার আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। আর্শি ও মিয়ামি উভয়ই কোচিং এ যাবার জন্যে প্রস্তুত।ঠিক এমন সময়ই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো।আর্শি ও মিয়ামি নিজেদের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে দরজা অব্দি আসতেই দেখে সানিয়া বেগম একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছেন।উভয়ের ঠোঁটেই হাসি লেগে আছে। মেয়েটি আর্শি ও মিয়ামিকে দেখে সানিয়া বেগমের থেকে সরে এসে আর্শির দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
-আন্টি,ও ই পুচকি না?মানে আমাদের আর্শি?
উত্তরে সানিয়া বেগম বলে ওঠেন,
-হ্যা,ঠিক চিনেছিস।
মেয়েটি এবার আর্শির সামনে বরাবর এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আমায় চিনেছো?
উত্তরে আর্শি মাথা ডানে,বামে ঘুরিয়ে “নাহ” বুঝায়।
চলবে।
[জানি জানি, অনেকেই কোনো একটি ছেলের এন্ট্রি চেয়েছিলেন গল্পে,আর্শকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে।তারা মন খারাপ একটুও করবেন না।আর্শ শাস্তি পাবেই।
আরেকটি কথা,গল্প টা মাত্র ৭ম পর্বে এসেছে।তাই বলবো সব রহস্য উদ্ঘাটন ও গল্পটাকে সম্পূর্ণ সাজানো অব্দি অপেক্ষা করুন।ইন শাহ আল্লাহ, গল্পটা পড়ে কেউ নিরাশ হবেন না।]