#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ০৮
প্রথম দেখায় ভালোবাসা টা কতোখানি যুক্তিযুক্ত? এটি আদৌও কি সম্ভব? প্রথম দেখায় কোনো একটি মানুষের রুপে মুগ্ধ হওয়া যায় নতুবা তার ব্যক্তিত্বে।কিন্তু ভালোবাসা তো শুধু মুগ্ধতা নয়।ভালোবাসা তো মানুষটার ভালো টাকেও ভালোবাসা আর খারাপ টাকেও ভালোবাসা।সেই সাথে মানুষটাকে নিজের অস্তিত্বে মিশিয়ে নেওয়া।অর্থাৎ সেই মানুষটির পছন্দ-অপছন্দকে নিজের বানিয়ে নেওয়া,তার ঠোঁটে হাসি দেখলে এক বুক কষ্ট নিয়েও নিজের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠা কিংবা তার কষ্টে নিজের মাঝে দিগুণ কষ্ট অনুভব করা। প্রথম দেখায় এসব অনুভূতি আসা সম্ভব?
“লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট” বাক্যটি বেশ ক’বারই শুনেছে আর্শি।অনেকের কাছে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার গল্পও শোনা হয়েছে তার। কিন্তু এ বাক্যটির সত্যতা নিয়ে বেশ সন্দিহান সে।
তার আর বিহানের যখন কথা শুরু হয় তখন তো আর্শি বিহানকে নিজের ফ্রেন্ডও ভাবতো না।কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আর্শির বিহানের প্রতি কৌতূহল জন্মে।বিহানকে তার কাছ থেকে জানার ইচ্ছে জন্মে এবং এখান থেকেই শুরু তার বিহানের প্রতি আর্কষণ অনুভব করার।তারপর তারা একে অপরের সাথে সারা দিন কথোপকথন করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে একে অপরকে নতুন করে জানতে থাকে এবং আর্শি ধীরে ধীরে বিহানের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হতে থাকে। এ মুগ্ধতা দিন দিন শুধু বেড়েই গেলো।সেই সাথে বিহান তার অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেলো। সময়ের সাথে সাথে আর্শি আরো আবিষ্কার করলো যে,তার বিহানের সব কিছুই ভালো লাগে।যেসব জিনিস আর্শি এক সময় ভীষণ অপছন্দ করতো এখন যখন বিহান সেসব করে তখন আর্শির সেসব খারাপ লাগে না বরং এসব কিছুও তার ভালো লাগতে শুরু করেছে।এমনই ভাবে নতুন অনুভূতিদের আগমন ঘটলো এবং সময়ের সাথে তার তীব্রতা বাড়তেই থাকলো।বিহানের জন্য ঈর্ষানুভব করা, দুঃচিন্তায় অস্থির হয়ে চোখের কোণে জল জমা, একটি দিন কথা না হলে এক যুগ কথা না হওয়ার সম কষ্ট অনুভব হওয়া,তার উপর অধিকারবোধ অনুভব হওয়া শুরু করা এবং এমন হাজারো অনুভূতি অনুভবের পর আর্শি এখন নিশ্চিত সে বিহানকে ভালোবাসে।একটু আধটু না বরং অনেকটা ভালোবাসে।
এইতো সেদিন বিহান নেটওয়ার্কের ভেতরে এসে তাকে যখন টেক্সট করে তখন যেনো প্রাণ ফিরে পায় আর্শি।এর আগ মুহূর্ত অব্দি সে এক বিন্দু পরিমাণ শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলো না।নিজের সকল অনুভূতিগুলো নিয়ে ভাব্বার পর আর্শি আর যাই হোক এই “লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট” এ বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস স্থাপনে ব্যর্থ।
!!
গোসল টা সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে মিয়ামি।ভিজে চুলগুলো গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বাড়ির সামনের রাস্তায় চোখ পরে তার।ওমনি ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে মিয়ামির।রাস্তায় আর্শ ও একটি মেয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে।সেই সাথে দুজনেই ঠোঁটে হাসি নিয়ে গল্পে মত্ত।আর এই মেয়েটি অন্য কেউ না বরং গত কালকেই আর্শদের বাসায় আসা মেয়েটি।কোচিং এর জন্যে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো তখন তাই সে সময় মিয়ামি ও আর্শি এই মেয়ের সাথে পরিচিত হতে পারেনি।আর্শকে এভাবে মেয়েটির সাথে হাসতে দেখে চরম বিরক্ত লাগছে মিয়ামির।তেমনই রাগও লাগছে আবার কষ্ট কষ্ট ও লাগছে।তবুও তাদের পানে অপলক তাকিয়ে ছিলো মিয়ামি যতক্ষণ অব্দি তারা সম্পূর্ণ দৃষ্টির আড়াল না হলো।
তারা দৃষ্টি সীমা অতিক্রম করতেই মিয়ামি রুমে এসে নিজের ফোনটি হাতে তুলে নেয়।কিছু ভাবতে সময় অপচয় না করেই আর্শির নাম্বার ডায়াল করে সে।
“হ্যা দোস্ত বল?” (আর্শি)
-তোর ভাই কই?
-অবন্তী আপুর সাথে বাইরে গেছে।
-কেন?অফিস নেই ওর?
-আছে কিন্তু আগামী কিছু দিন অফিসে যাবে না। অবন্তী আপু কয়েক দিনেই চলে যাবে তো তাই ওকে নিয়ে একটু ঘুরাঘুরি করার কথা বলছে আম্মু।
-অফিস কি আমার শশুরের যে ও ছুটি চাইলো আর পেয়ে গেলো!
-আরেহ, ভাই কাজে দক্ষ আর দায়িত্বশীল হওয়ায় অফিসের বসের খুব পছন্দের। তাই ভাই এমন একটু আধটু সুযোগ পায়।কিন্তু তোর কি হইছে?
-চুল হইছে! আচ্ছা,এই অবন্তী নাকি অবনতি কে এইটা?
-ভাইয়ার ছোটকালের প্রেমিকা।
কথাটি বলেই একটু হাসে আর্শি।কিন্তু কথাটিতে মিয়ামির হৃয়দ কেমন জানি কেঁপে উঠলো।কন্ঠ স্বর নিস্তেজ হয়ে এলো তার।নিন্ম স্বরেই সে বলে ওঠে,
-মানে?
-নানুবাড়িতে আমাদের অনেক বছরের প্রতিবেশী ওরা। আম্মুর সাথে ওর আম্মুর খুব ভালো সম্পর্ক। তো ছোট বেলায় আমরা নানু বাড়িতে গেলে নাকি ওর সাথে খেলতাম।আমি তো তখন অনেক ছোট তাই আমার তেমন কিছু মনে নেই কিন্তু ভাইয়া আর ওর বন্ধুত্ব অনেক ভালো ছিলো।নানু মারা যাবার পর তো আমরা আর নানু বাড়ি যাইনি আর ওরাও ঢাকায় আসেনি দেখে এতো বছর ওদের কারো সাথে আর দেখা হয়নি।আম্মুর সাথে নাকি ওর আম্মুর ফোনে যোগাযোগ হয়।এখন অবন্তী আপু ঢাকায় এসেছিলো তার খালাতো ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে এটা আম্মু জানার পর আম্মুই ওকে আমাদের বাসায় দাওয়াত করেছে।
-ওহ।প্রেমিকা বললি যে?ভাইটুর সাথে ওর প্রেম ছিলো?
-আরেহ না মজা করে বলছি।ভাইয়ার তখন প্রেমের বয়স হইছিলো নাকি!
নিস্তেজ কন্ঠটি আর আগের ন্যায় স্বাভাবিক হলো না মিয়ামির।কেনোই যেনো হৃদয় পুড়ছে তার।সে নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-আচ্ছা, রাখি।
-এই দাঁড়া, তোর মন খারাপ হয়ে গেলো কেন?আর ইউ জেলাস বেবজ?
আর্শির কথাটি যেনো কাঁটা গায়ে নুনের ছিটার মতো লাগলো মিয়ামির।সে রাগী কন্ঠে বললো,
-তোর ভাই মেয়ে নিয়ে ঘুরবে আর আমার মজা লাগবে?
আর্শি এবার শব্দ করে হেসে বলে ওঠে,
-আরেহ জ্বলিস না!জ্বললে ক্ষতি নিজেরই।
রাগ এবার আরো বেড়ে গেলো মিয়ামির।সে রুক্ষ কন্ঠে বলে ওঠে,
-দুয়া করি,হুট করে বিহানেরও এমন প্রেমিকা পয়দা হোক তখন আমিও বলবো,”আরেহ জ্বলিস না!জ্বলার কিছু নেই ই।”
বলেই ফোনটি কেটে দেয় মিয়ামি।রাগে,দুঃখে ভাই-বোন দুইজনকেই মনে মনে একশত একটা গালি দিলো মিয়ামি কিন্তু তাও শান্তির সন্ধান মিললো না তার।
!!
সকালে গভীর ঘুমে মগ্ন মিয়ামি।হটাৎ ই তার মা অর্থাৎ মেহরিন বেগম কক্ষে প্রবেশ করে তাকে কর্কশ কন্ঠে ডেকে ওঠে,
-মিমি ওঠ জলদি।
-উম মা,ঘুমাতে দেও।আজ তো কলেজ নেই।
-আর্শ আসছে। ড্রয়িং রুমে বসে আছে ছেলেটা।তুই ফ্রেশ হয়ে নে।কি জানি,তোর সাথে দেখা করতে আসছে কি না! ওঠ ওঠ! আমি ওর কাছে যাইতেছি।
মেহরিন বেগমের কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে বসে মিয়ামি।আর্শ এসেছে শুনেই হৃদয়পর ধুকপুকনি বেড়ে গিয়েছে তার।মেহরিন বেগম কক্ষ ত্যাগ করতেই মিয়ামি দৌড়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
হাতের নাস্তার ট্রে টি আর্শের সামনের টেবিলে রেখে হাসি মুখে আর্শের সামনে বরাবর সোফায় বসে পরেন মেহরিন বেগম। কোমল স্বরে বলে ওঠেন,
-আর্শ,বলো কোনটা খাবা?সব আমার হাতের রান্না। তুমি তো পছন্দ করো।
-জ্বি আন্টি।আপনার তৈরি তাহলে কি আর তা না খেয়ে পারা যায়!
উত্তরে হাসলেন মেহরিন বেগম।আর্শ একটি সমুচা এক কামড় খেয়ে বলে ওঠে,
-আন্টি একটি বিষয়ে আপনার একটু অনুমতি লাগবে।
-হ্যা বাবা,বলো।
-আসলে গ্রাম থেকে আমার একটা কাজিন এসেছে। আসলে তারা হচ্ছে নানু বাড়ির ওখানের আমাদের প্রতিবেশী।ঢাকায় ওদের আসা হয় না বললেই চলে।এতো বছরে কিছু দিন আগে ঢাকায় এসেছে ওর খালাতো ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে তারপর আম্মুর দাওয়াতে আমাদের বাসায়।ঢাকার কোত্থাও ঘুরে দেখা হয়নি ওর।তাই আমি,আর্শি আর আমার কাজিন মানে অবন্তী আমরা একসাথে ঘুরবো সামনের কিছু দিন।আম্মু চাইছে আমাদের সাথে মিয়ামিও থাকুক।ওর ও ঘুরে ভাল্লাগবে।
-কিন্তু আর্শ!মানে..আসলে…
-আপনি কোনো কিছুর চিন্তা করবেন না আন্টি।মিয়ামিকে ইন শাহ আল্লাহ সহিসালামত আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।
-তা জানি বাবা।কিন্তু তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।এমন অবস্থায় বিয়ের আগে তোমাদের এভাবে একসাথে ঘুরাঘুরি টা দৃষ্টিকটু নয় কি?
-জ্বি কিন্তু আন্টি আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। আর আর্শি ও অবন্তী ও তো সাথে থাকবে।তারপরও যদি আপত্তি থাকে তাহলে সমস্যা নেই আন্টি।আমি আম্মুকে বুঝিয়ে বলবো।
-থাক আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।তোমার হবু বউ তুমি নিয়ে যাও।শুধু সবার সম্মানের দিকটি মাথায় রাখবা,কেমন?
হেসেই কথা গুলো বলেন মেহরিন বেগম।আর্শও ঠোঁটে হাসি টেনে সম্মতি দেয়।কিন্তু “তোমার বউ” কথাটায় বুকের বা পাশ টায় ব্যথা অনুভব করছে সে।
চলবে।