#প্রণয়
#পর্বঃ২৮
#তানিশা সুলতানা
“ঢং করে ডাকলেন কেনো? সবাই কেমন করে হাসলো।
তানহা রাগে গজগজ করতে করতে কোমরে হাত দিয়ে বলে।
সূচক তানহার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
” এখানে বস। তারপর বলছি।
খাট দেখিয়ে বলে সূচক।
“বসবো না বলেন
তানহা ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে।
” না বসলে বলতে পারবো না।
সূচক টেবিলের ওপর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ে। তানহাও গিয়ে ধপ করে সূচকের পাশে বসে।
“জলদি বলেন।
মুখ বাঁকিয়ে বলে তানহা।
” নাকে ব্যাথা আছে এখনো?
তানহার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদুরী গলায় বলে সূচক। তানহা চোখ নামিয়ে নেয়। মাথা দুলিয়ে না বলে।
“মুখে বল?
নাক ফুল পড়তে পারবি?
নাক হাত দিয়ে বলে সূচক।
” এনেছেন?
তানহা ছোট করে জিজ্ঞেস করে।
একটাতে
সূচক নাকটা দেখে ফোলা কমে গেছে।
হাতের প্যাকেট খুলে সেখান থেকে প্রথমে আংটিটা হাতে নেয়।
“আজ তো তোর বার্থডে ছিলো আর আমাদের বাসর রাত ছিলো কাল। তো দুইটা মিলিয়ে একটা গিফট।
তানহা মিষ্টি করে হাসে। সূচক আংটির ওপর ঠোঁট ছোঁয়ায়।
” এবার নাক ফুল পরিয়ে দেই?
সূচক প্রশ্ন করতেই মাথা নারিয়ে সম্মতি দেয় তানহা।
সূচক খুব যত্ন করে নাক ফুল পরিয়ে দেয়। একটুও ব্যাথা পায় না তানহা।
“বাহ একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে।
তানহার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলে সূচক। তানহা চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। লজ্জা লাগছে খুব।
সূচক গভীর মনোযোগ দিয়ে খানিকখন তাকিয়ে থাকে তানহার মুখের দিকে। কি আছে এই মুখটাতে? যা সূচককে এতো টানে? ওই তো সরু না টানা টানা দুটো চোখ, থুতনিতে ছোট একটা তিল দুই ভ্রুর মাঝে একটা লাল ব্রণ। সম্ভবত রাতে উঠেছে।
এসবই কি পাগল করেছে?
নিজেই ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে সূচক।
” চোখ খোল তানহা।
সূচক গম্ভীর সুরে বলে। মুখটা খুব কাছাকাছি হওয়াতে সূচকের নিশ্বাস একদম তানহার চোখে মুখ আঁচড়ে পড়ে। চোখ দুটো আরও শক্ত করে খিঁচে বন্ধ করে ফেলে তানহা।
“আমি তোকে খুব ভালোবাসি তানহা। বন্ধুরা বলে তুই ছোট এখনো ভালোবাসা বুঝিস না। যখন বড় হবি তখন আমাকে ভুলে যাবি। অন্য কাউকে ভালোবাসবি। ওদের কথা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছিলো। তাই বিয়ে করে ফেললাম।
আমি তোকে হারাতে চাই না।
তানহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে সূচক। তানহা সূচকের কথা গুলো মন দিয়ে শুনছে বুকে মাথা রেখে। এতোটা ভালোবাসে এই মানুষটা ওকে?
নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
” শোন তানহা
আমি যা বলবো তাই শুনবি। একদম কথার অবাধ্য হবি না। নাহলে একদম থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো।
ধমক দিয়ে বলে সূচক। তানহা গাল ফুলায়। এইতো নরম গলায় কতো আবেগ মিশিয়ে ভালোবাসার কথা বললো। এখনই আবার ধমক?
গিরগিটির থেকেও বেশি ভয়ংকর এই লোকটা।
সূচক ছেড়ে দেয় তানহাকে। তানহা সোজা হয়ে বসে।
“চেঞ্জ করে আয়।
জামাকাপড়ের প্যাকেট দেখিয়ে বলে সূচক। তারপর রুম থেকে বের হয়ে যায়। তানহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
” এতো অন রোমান্টিক মানুষ এখনো আছে দুনিয়াতে?
একটু তো রোমান্টিক হতে পারতো। আরে ভাই আমি তো তোর আপন বউ। একদম নিজের বউ। একটা চুমু তো আমার প্রাপ্য ছিলো। না কি? এভাবে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক না। একদম ভালো হলো না?
তানহা বিরবির করতে করতে দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ো চেঞ্জ করে নেয়। তারপর বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
সাবিহা মেয়েটা একদম মিশুক আর খুব ভালো। কি সুন্দর করে কথা বলে। দেখতেও মাশাআল্লাহ। সূচক আর ইমন রান্না করছে। সাবিহা আর তানহা পেঁয়াজ মরিচ মশলা পাতি বেটে দিচ্ছে। তোহা বসে বসে চিপস খাচ্ছে।
“এই জঙ্গিটাকে এখান থেকে সরাও তানহা।
ইমন তেলের মধ্যে পেঁয়াজ দিয়ে তোহার দিকে কটমট চাহনিতে তাকিয়ে বলে।
তেঁতে ওঠে তোহা।
” ভাইয়া আমাকে দিয়ে আয়। এই খাটাশের বাড়িতে থাকবো না আমি।
হাতে থাকা চিপসের প্যাকেট ফেলে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে তোহা।
“ভাইয়া যাবো না। তুমি একাই চলে যাও। কুম্ভকর্ণদের এখানে থাকার কেনো অধিকার নেই।
ইমন বাঁকা হেসে বলে। তোহার রাগে দাঁত কটমট করে।
” ইমন আমার বোনকে এভাবে বললে কিন্তু আমিও চলে যাবো।
সূচক চোখ পাকিয়ে বলে।
“ইমন আমিও কিন্তু চলে যাবো।
সাবিহা বলে।
” হাই আল্লাহ,
তোরা একে লাই কেনো দিচ্ছিস? চেহারা দেখেছিস? খায় আর ঘুরে তাই একদম ছোটমট হাতির বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে।
এই কুম্ভকর্ণ হাতিটাকে নিয়ে আমি সংসার করবো কিভাবে?
সবাই বড়বড় চোখ করে তাকায় ইমনের দিকে। সূচক মাংস দিচ্ছিলো পাতিলে। ইমনের কথায় দাঁড়িয়ে যায়। তোহা গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
“কি বললি?
সূচক আবার জিজ্ঞেস করে।
ইমন থমথমে খেয়ে যায়।
” তাড়াতাড়ি মাংস ঢাল। পেঁয়াজ পুরে গেলো।
তাড়া দিয়ে বলে ইমন। সূচক সেদিকে খেয়াল দেয়। তোহা তানহাকে জোর করে উঠিয়ে দিয়ে পেঁয়াজ কাটতে বসে। তোহা কখনোই এসব কাজ করে নি। তানহা মাঝেমধ্যেই করে।
একটা পেঁয়াজ কাটতেই চোখের জলে নাকের জলে এক করে ফেলে তোহা। সাবিহা সমানে না করে যাচ্ছে কিন্তু কে শোনে কার কথা। কাটবে তো কাটবেই।
তানহা মিটমিট করে হাসছে আর তোহাকে দেখছে।
তোহা সাধারণত ভীষণ অলস একটা মানুষ। পানি পিপাসা পেলে পানি আনার ভয়ে খায় না। যতই খিধে পাক কেউ খাবার বেরে না দিলে খাবে না। জামাকাপড় একটাও কখনো গোছায় না তানহার গুছাতে হয়। জীবনেও মশারি টাঙায় না। বিছানা গুটানোর ভয়ে তানহার আগে ঘুম থেকে উঠে।
একবার গ্রামের পিচ্চি মেয়েদের সাথে জুতাচোর খেলেছিলো তানহা আর তোহা। তানহা বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলেছিলো আমি আর তোহা। আর বাদ বাকি সবাই এক সাথে খেলো।
তারপর খেলা শুরু হওয়ার পরে তানহার একা একাই কুতকুত দিয়ে জুতো আনতে হয়েছে। তোহা শুধু দাঁড়িয়েই ছিলো। আর তানহা দম দিতে বললে শুধু বলেছে “আর একটা দম দে তুই তারপর আমি দিচ্ছি ”
কিন্তু পরে দৌড় দেওয়ার ভয়ে আর দমই দেয় নি। একা একাই খেলে জিতে ছিলো তানহা।
“তোহা রাখ তুই।
সূচক ধমক দিয়ে বলে। সূচকের ধমকে তানহার ভাবনা বন্ধ করে। তানহার মনে হচ্ছে এই ইমনই পারবে তোহাকে সোজা করতে।
” আরে বন্ধু করতে দে
কাজে লাগবে।
ইমন মুচকি হেসে বলে।
“হ্যাঁ পরে চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। ওঠে তুই।
সূচক তোহার হাত থেকে ছুড়ি নিয়ে নেয়। হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
তোহা ইমনের দিকে কটমট চাহনিতে তাকিয়ে একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
রান্না শেষ করতে করতে রাত দশটা বেজে যায়। সবাই মিলে এক সাথে খেয়ে নেয়। দারুণ হয়েছে রান্না।
সাবিহা আজকে বাসায় যাবে না। ওদের সাথেই থাকবে।
রাতে সূচক আর ইমন এক রুমে ঘুমায়। আর অন্য রুমকি সাবিহা তানহা আর তোহা। তিনজন প্রায় সারা রাতই গল্প করে।
সবাই বেলা ঘুম থেকে উঠেই সাবিহা চলে যায়। তানহা আর তোহা চোখে মুখে পানি দিয়েই বেরিয়ে পড়ে। আজকেই ঢাকায় ফিরে যাবে ওরা। সাদিয়া বেগম রেডি হোয়ল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ইমন গাড়ি নিয়ে এসেছে। পনেরো দিন হয়েছে ইমন গাড়ি কিনেছে। নিজের টাকায় কিনে নি। বাবা কিনে দিয়েছে। অবশ্য এর জন্য ইমনকে দুই দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে।
খেয়েছে সেটা সবার অগোচরে। অবশেষে ছেলের জেদের কাছে হার মেনে গাড়ি কিনে দেয়।
সূচক ইমনের পাশে বসে তানহার আর তোহা পেছনে বসে। সূচক নানা বাড়িতে আর ঢুকবে না। মাকে কল দিয়ে রেডি হতে বলেছিলো।
সাদিয়া বেগম রেডি হয়ে গেইটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। গাড়ি থামতেই তানহা নেমে পড়ে। এক দৌড়ে রুমে চলে যায়। সেখানে ফোন রেখে গেছিলো। তারাহুরো করে জামাকাপড় গুছিয়ে ফোন হাতে নিয়ে আবার চলে আসে।
সবাই দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে বিদায় দিচ্ছে তোহা সাদিয়া বেগম আর সূচককে। তানহার সাথে কেউ কথা বললো না।
তানহাও আগ বাড়িয়ে কথা না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে গাড়িতে বসে।
ফোন অন করতেই দেখে বাবার অনেক গুলো কল। সাথে দুটো মেসেজ। তাতে “শুভ জন্মদিন আম্মাজান লেখা”
তানহার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। কারে মুখে কোনো কথা নেই।
সাদিয়া বেগম যে রেগে আছে সেটা সবাই ভালোই বুঝতে পারছে।
সূচক চোয়াল শক্ত করে ফেলে। কালকে নানাভাইয়ের বলা সব কথায় শুনেছে ও।
তানহা তোহার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।
“মা আমি তানহাকে বিয়ে করে নিয়েছে। আর একটা সেকেন্ডও ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুমি বাবাকে বলে দিও।
আর আজকে থেকেই তানহা আমি রুমে থাকবে।
সূচক লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলে। সাদিয়া বেগম চমকে ওঠে। তানহা ধরফরিয়ে মাথা তুলে।
চলবে