প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -০৩+৪

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৩য়_পর্ব

নতুন স্যার প্রসন্ন চিত্তে বললেন,
“গুড মর্নিং”

কিন্তু গুড মর্নিংটি ধারার চিন্তার জোয়ারে আঘাত হানলো। বাস্তবে ফিরতেই দারুণ বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরলো। যথারীতি তার মাথায় বজ্রপাত হলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো সামনের মানুষটির দিকে। অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে অজান্তেই বের হলো,
“অনল ভাই”

ধারার মস্তিষ্ক অকেজো লাগছে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত ফিটফাট ব্যাক্তিটি হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাদামাটা মুখশ্রীতে স্মিত হাসি। হাতে মার্কার। মোটা ক্যালকুলাসের বই টি খুলে অংক তুলতে লাগলো। এদিকে ধারার মস্তিষ্ক শূন্য, তার স্নায়ুকোষে রেষারেষি চলছে। অনল নামক ব্যাক্তিটি এখানে! শুধু এখানে নয় সে তার কোর্স টিচার। ব্যাপারখানা ভাবতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো। অজস্র চিন্তা মস্তিষ্ক হানা দিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। ধারার মনে হলো সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। অনল তার বহুদিনের প্রাইভেট চাকরিটি ছেড়ে একটা নতুন চাকরি নিয়েছে; ব্যাপারটা ধারার অবগত ছিলো। কারণ যেদিন অনলের চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছিলো সে পুরো পরিবারকে জম্পেশ বিরিয়ানি খাইয়েছিলো। মহা আনন্দিত অনলকে সেদিন স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় হাসতেও দেখেছিলো সে। অবশ্য হবে নাই বা কেনো! বড় মা বলেছিলো, এই চাকরিটি নাকি অনলের স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু এই চাকরি যে শিক্ষকতা এবং তাও তার ভার্সিটির; সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি ধারার। বাড়িতে একই ঘরে লোকটির সাথে থাকাটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। হাড় মাং’স জ্বা’লি’য়ে দিচ্ছে তথাকথিত প্রিন্স উইলিয়াম। গতরাতের কথাই ধরা যাক, হিংসুটে লোকটি ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিলো। এদিকে লাইটের তীব্র আলোটা পড়ছিলো সরাসরি ধারার চোখে। ধারা যখন বিনয়ী স্বরে বলেছিলো,
“অনল ভাই, লাইট অফ করো। আমি ঘুমাবো”

অনল তখন ল্যাপটপে কাজ করছিলো। চোখ স্থির রেখেই ঠোঁট বাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো সে। যার অর্থ “আসো, এবার খেলা হবে”। অনলের নির্বিকার মুখশ্রীর এই মিছকে হাসিটি ধারার অতিপরিচিত। ধারা বুঝলো সে অসহায়। এই মানুষটি হাতে না মে’রে তাকে ভাতে মা’র’বে। কাজ করতে করতেই অনল ঠেস মারা স্বরে বললো,
“আমি কাজ করছি। আর আমার ঘরের লাইট সারা রাত অন থাকে”

ধারা তীর্যক চাহনীতে তাকিয়ে রইলো নিষ্ঠুর মানুষটির দিকে। প্রচন্ড ক্রোধ তখন ভর করলো সমস্ত শরীরে। ক্রোধের অগ্নিতে যেনো লোমকুপ অবধি জ্বলছিলো। কিন্তু সে নিরুপায়, কারণ এই ঘরটি সত্যি ই অনলের। তার রাজত্ব এখানে। লোকটি এতোটা স্বার্থপর কেনো! প্রশ্নের উত্তরটি সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে খুঁজছে ধারা। গতরাতে ঘুম না হবার আরোও একটি মুখ্যম কারণ এই ক্রোধও। বাড়িতে অশান্তির পর ভেবেছিলো যাক ভার্সিটির কয়েক ঘন্টা জীবন শান্তিময় হবে৷ কিন্তু সেখানেও এই মানুষটির আগমণ৷ অনল মৃদু হেসে পড়াতে ব্যাস্ত, এদিকে ধারার মন পড়াতে নেই। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। অনল তাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। যেনো ধারার অস্তিত্ব নেই। এর মাঝেই মাহি ধাক্কা দিলো তাকে। চিন্তার প্রহরে বাধা পড়লো। পাশে ফিরতেই সে ফিসফিস করে বললো,
“অনল ভাই এখানে চাকরি নিয়েছে বলিস নি কেনো? আগে জানলে আমি সেজেগুজে আসতাম”
“হ্যা, প্রিন্স উইলিয়াম আমার অনুমতির জন্য যেনো বসে ছিলো। এতো বড় ধাক্কা খাবো জানলে আজ ক্লাসেই আসতাম না”
“আচ্ছা, তোর সমস্যা কি বলতো? অনল ভাই এর কথা আসলেই তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠিস কেনো?”
“কারণ তোর প্রাণপ্রিয় অনল ভাই এর জন্য আমার জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আর তোকেও বলিহারি, আটাশবার প্রেমপত্র দিয়ে ছ্যা’কা খেয়েছিস। তাও কিভাবে ভাই এখনো লেগেই আছিস? আমি হলে তো কচু গাছে গ’লা দ’ড়ি দিতাম অপমানে। ন্যা’ড়া একবার বেলতলায় যায়৷ আমার তো মনে হচ্ছে তুই বেলতলার বাসিন্দা, তাও পারমানেন্ট।”
“ও তুই বুঝবি না। শেক্সপিয়ার বলেছেন ফেইলিউর ইজ দ্যা কি অফ সাক্সসেস”
“তোকে পার্সোনালি বলেছে? আর এটা শেক্সপিয়ার না রবার্ট ব্রুস বলেছে”
“হলো, কেউ তো বলেছে। একবার না পারিলে দেখো শতবার। মাত্র তো উনত্রিশ বার দেখেছি। এখনো শ হতে বহুদেরি”
“উনত্রিশ বার মানে?”

মাহি ধারার প্রত্যুত্তোরে কোনো কথা বললো না। বরং শুভ্র দাঁতগুলো বের করে হাসি মুখে ধারার দিকে তাকালো। যার অর্থ “আজ তুমি আবারো আমার প্রেমকবুতর হবে”। ধারার অস্থির কন্ঠে বললো,
” না, আলবত না”
“প্লিজ”
“পারবো না আমি”
“তপনের সামুচা খাওয়াবো, সাথে তরমুজের ঠান্ডা শরবত”
“না, নো, নেভার, কাভিনেহী”
“প্লিজ দোস্ত, বান্ধবীর জন্য এতোটুকু করতে পারবি না। ভাব, একবার তোর ভাবি হয়ে গেলে জীবন জিঙ্গালালা। প্লিজ, আমি তোর এসাইনমেন্ট ও করে দিবো”

অন্য সময় হলে এসাইনমেন্টের লোভটি হয়তো ধারার নৈতিকতাকে নাড়িয়ে দিতো। চট করে নিয়ে নিতো মাহির চিঠি। শত রিস্ক নিয়ে হয়েও বা’ঘে’র ডে’রায় ফেলে আসতো। এরপর প্রিন্স উইলিয়াম বুঝে বেড়াতো। কিন্তু আজ কেনো যেনো সাহস হচ্ছে না, ইচ্ছেটাও নেই। সাহস না হবার কারণ ধারা এখন অনলের ওই ডে’রাতেই থাকে আর ইচ্ছে না হবার কারণটা ধারার নিজেও জানা নেই। ফুল ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। অধৈর্য হয়ে বলে,
“দেখ মাহি, আমার সমস্যা চিঠি পৌছে দেওয়ায় না। সমস্যা খ’চ্চ’র মানুষটার ঠেস দেওয়া কথা শোনায়। ও ঠিক আমার সামনে আসবে, খচাৎ করে তোরে চিঠি ছিড়ে ফেলে দিবে। বান্ধবী হয়ে এটা কার দেখতে ভালো লাগে। এর চেয়ে বরং সুদর্শন পুরুষকেই যেহেতু মন দিবি, তাহলে দিগন্ত, অভীক, নীরব এদের দেখ৷ হ্যা হয়তো প্রিন্স উইলিয়াম না কিন্তু মনের দিক থেকে তারাও রাজা সিরাজ-উদ-দৌলা”

মাহির মনটা মিয়ে গেলো খানিকটা। সেই কিশোরী কাল থেকে একজন পুরুষের প্রতি ই সে আকর্ষিত হয়েছে। এটাকে কিশোরী মনের আবেগ বলে নাকি ভালোবাসা তার জানা নেই। তাই তো এতো প্রত্যাখ্যানের পর আবারো চিঠি পাঠাবার সাহস করছে সে। মাহি আবেগী কন্ঠে বললো,
“এভাবে হয় না ধারা, ওরা আমার বন্ধু। কিন্তু অনল ভাই ক্রাস। এই অনুভূতিটা অব্যক্ত। আমি বোঝাতে পারবো না। উনাকে দেখলে আমার সবকিছু কেমন যেনো রঙ্গিন লাগে। উনি আমার সাথে কালেভদ্রে যদি কথা বলে আমার লজ্জায় মিশে যেতে মন চায়। কথাও জড়িয়ে যায়। এই অনুভূতিটাকে বোঝাতে পারবো না। যেদিন তোর এমন টা অনুভূত হবে, সেদিন বুঝবি আমি কেনো বেলতলায় পারমানেন্ট বাসিন্দা”

ধারা চুপ করে গেলো। তর্কে হেরে গেছে সে। কারণ এই অনুভূতিটার পরিচয় সে পেয়েছে। তার মনের আঙ্গিনাতেও সুপ্ত ভালোলাগার বীজ যে সেও বুনে রেখেছে। এই ভয়টা তার ভেতরটাকে বারবার উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে। মানুষটার সামনে লেগে কি শক্ত থাকতে পারবে নাকি তীব্র বেদনায় আচ্ছাদিত হবে তার সমস্ত হৃদয়। ভাবতেই পুনরায় মস্তিষ্ক যেনো দূর্বল হয়ে উঠলো। বিষন্নতা গ’লা চে’পে ধরলো। অবুঝ মন বুঝলো মাহির মনোস্থিতি। তাই হাত বাড়ালো চিঠি নেবার জন্য। কিন্তু বিধিবাম, তখন কঠিন কন্ঠ কর্ণপাত হলো,
“যদি ক্লাসে কথা বলতেই আসা হয়, তবে আমার ক্লাসে আসার প্রয়োজন নেই। আমি দুজন নিয়েও ক্লাস করতে রাজি। যদি তারা এটেনটিভ হয়”

কথাটা সে সরাসরি ধারার দিকে তাকিয়েই বললো। ফলে সারাক্লাসের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো ধারা। পেছন বেঞ্চে বসে থাকা অভীক কলম দিয়ে খোঁচালো তাকে। ফলে ধারার স্বম্বিত ফিরলো। সামনে থাকাতেই মুখোমুখি হলো অনলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির, নির্বিকার শক্ত মুখশ্রীর। তাড়াতাড়ি মাথা নামিয়ে ফেললো। ভেবেছিলো হয়তো এখানেই ক্ষান্ত হবে অনল। কিন্তু না, সে রীতিমতো বললো,
“তুমি, সেকেন্ড কলাম, ফোর্থ রো, সেকেন্ড ওয়ান। দাঁড়াও। এতোক্ষণ যা বুঝিয়েছি বুঝেছো?”

ধারা বুঝলো এটা প্রিন্স উইলিয়ামের অপমান করার ফন্দি। সারা ক্লাসের নজর তার দিকে। ছোটবেলায় ষাট সত্তর জনের ক্লাসে ভু’তের মতো দাঁড়িয়ে থাকাটা ততোটা গুরুতর ছিলো না যতটা না ভার্সিটি মাত্র পয়তাল্লিশ জন মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা। সকলের তীক্ষ্ণ, বিস্মিত দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতি যেনো দ্বিতীয়টি নেই। ধারা কোনো মতে মাথা দুলিয়ে বললো,
“জ্বী”
“তাহলে পরের ইকোয়েশনটি কি হবে?”

অনলের নির্লিপ্ত প্রশ্নের উত্তর নেই ধারার কাছে। কারণ সে তার একটা কথাও শুনে নি, বোঝা তো দূরের কথা। ধারাকে মাথানিচু করে থাকতে দেখে অনল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপাল ঘষলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“দেখো, তোমাদের পানিশমেন্ট দেবার বয়স নেই। যথেষ্ট বড় তোমরা, ভার্সিটিতে পড়ো। অনেকে এখানে এন.আইডি. ধারী। সুতরাং তোমাদের বোকাঝকা করা অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার। অন্য স্যাররা কেমন আমি জানি না, তবে আমার ক্লাস মাছের বাজার হবে এটা আমার পছন্দ নয়। এখানে কথা হবে ক্যালকুলাস বিষয়ক। আজ প্রথম দিন তাই কিছু বলবো না। তবে এর পর থেকে কথা বলার ইচ্ছে হলে সোজা বাহিরে চলে যাবে। আমি তোমাদের উপস্থিতির মার্ক কাটবো না। তবে যদি আমি দেখি আমাকে ডিসটার্ব করছো। তবে পরীক্ষায় বসা মুশকিল হয়ে যাবে”

নীরব ক্লাস। সকলের মুখে আতঙ্ক। সুন্দর মানুষের বাক্য এতোটা কঠোর হতে পারে সেটা যেনো অবিশ্বাস্য। এদিকে ধারা এখনো নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে। রাগ, ক্ষোভ, অপমান সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে যেনো একাকার হয়ে গেছে। নোনাজল রুপে চোখে বিদ্রোহ করছে। এখন ই যেনো তারা মুক্তি পাবে। অনল ভাই এমন টা না করলেও পারতেন! সে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে, যেনো শোধ তুলতে পারে৷ অনল তাকে বসতে বললে সে বসে যায়। কিন্তু সারাটা ক্লাস নীরব ই থাকে। মাহিও গুটিয়ে যায়। বান্ধবীকে চিঠি দেবার জিদ ছেড়ে দেয়।

ক্লাস শেষে ধারাকে পাওয়া যায় না। নীরব, দিগন্ত, অভীক মাহিকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু মাহি উত্তর দিতে পারে না। ক্লাস শেষ হতেই ধারা হনহন করে বেড়য়ে যায়। তার পিছু নেবার চেষ্টা করলে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অতিপ্রিয় বান্ধবী হবার কারণে ধারার কড়া নজরের অর্থ সে বুঝে যায়। ফলে বন্ধুমহল বিনা ধারায় ক্যাফেটেরিয়ায় যায়।

ক্লাস করে এসে বইটা অবহেলায় টেবিলের উপর রাখে অনল। পঞ্চাশ মিনিট টানা কথা বলার অভ্যাস নেই। বলে টেবিলের উপর রাখা বোতল থেকে এক নিঃশ্বাসে পানি পান করে সে। এক ঘন্টা পর আরো একটা ক্লাস আছে। মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে তবুও যেনো অসহনীয় উত্তাপে ঝা ঝা করছে শরীর। শার্টের হাতাটা গুটিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। তখন পিয়ন হাসেম মামা আসেন। বিনয়ী স্বরে বলে,
“স্যার কি কিছু লাগবে?”
“ঠান্ডা কিছু হবে?”
“ট্যাং দেই?”
“দিন”

হাসেম মামা চলে যাবার পর ডান বাহু চোখের উপর দিয়ে বসে থাকে। একটু শান্তি লাগছে। পরমূহুর্তেই ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা স্মরণে আসে। ধারার মূর্ছা যাওয়া ভারাক্রান্ত মুখশ্রী ভাসছে। এতোটা কড়া না হলেও হতো। কিন্তু মেয়েটা এতো কথা বলে। প্রথমে দু-তিন বার উপেক্ষা করলেও শেষমেশ ক্রোধ ধরে রাখতে পারলো না। আজ বুঝেছে তার রেজাল্ট কেনো বাজে! ক্লাসে খেয়াল না থাকলে কি রেজাল্ট ভালো হবে! এর মাঝেই সজোরে দরজা খোলার শব্দ আসে। অনল ভাবে হাসেম মামা হয়তো এসেছেন। কিন্তু ভুল, এতো ধারা। রক্তিম চোখে, রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনল সোজা হয়ে বসলো। হালকা কেশে, স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কি চাই?”

উত্তরটা পাওয়া হলো না। বরং তড়িৎ বেগে তার নিকট ছুটে এলো ধারা। শার্টের কলার চেপে ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“প্রশ্নটা আমারো কি চাই? বাড়িতে জ্বা’লি’য়ে শান্তি হচ্ছে না? এখানেও আমাকে জ্বা’লা’তে হবে? শোধ তুলছিলে তাই না? ক্লাসে আমাকে অপমান করে খুব মজা পেয়েছো? শোনো অনলভাই, এক মাঘে শীত যায় না। এখানে আমি তোমার ছাত্রী, কিন্তু বাসায় আমি তোমার বউ। তোমাকে কিভাবে তুর্কীনাচন নাচাই সেটা দেখো। আমার নাম ও ধারা, মনে রেখো”

অনল বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। “বউ” শব্দটি তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় নিলো। তার মুখে কোনো কথা নেই। সব কথা যেনো বাস্পায়িত হয়ে গেছে। চোখগুলো বিস্ফোরিত। অপলক দৃষ্টিতে শুধু রুদ্ররুপী ধারাকে দেখছে সে। ধারা বুঝলো না, সে কি ভয় পেয়েছে নাকি অতি শকে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তবে প্রিন্স উইলিয়ামকে এভাবে থামিয়ে দিতে পেরে নিজেকে বাহবা দিতে ইচ্ছে হলো তার। এক প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো যেনো। এটাকেই হয়তো আত্মশান্তি বলে। কিন্তু এই খুশি টেকসই হলো না। যখন একটা মৃদু স্বর কানে এলো,
“উপস, ভুল সময়ে চলে এলাম নাকি?”

ধারার প্রশান্তির ঢেউ তিক্ত বিষাদে পরিণত হলো। যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেইটাই হলো……..
#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৪র্থ_পর্ব

কিন্তু এই খুশি টেকসই হলো না। যখন একটা মৃদু স্বর কানে এলো,
“উপস, ভুল সময়ে চলে এলাম নাকি?”

ধারার প্রশান্তির ঢেউ তিক্ত বিষাদে পরিণত হলো। যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেইটাই হলো, অবশেষে মানুষটির মুখোমুখি হতেই হলো। অনল দরজার দিকে তাকাতে দেখলো তার প্রিয় বন্ধু প্লাবণ দাঁড়িয়ে আছে। প্লাবণকে দেখামাত্র নিজের পরিস্থিতির জ্ঞান হলো তার। সাথে সাথে ধারার হাত থেকে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিলো। নিজের শার্ট ঠিক করতে করতে বললো বিব্রত কন্ঠে বললো,
“আরে আয় আয়, আসলে…”

অনলের কিছু বলার পূর্বেই প্লাবণ তার ভুবন ভোলানো হাসি হাসলো৷ তারপর ধারাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো, জলধারা?”

ধারা এক কোনায় শিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুভূতি গুলো বেসামাল হয়ে উঠেছে৷ হৃদমাঝারে কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে। ধারা এই আশঙ্কাটাই করছিলো। এই কিশোরী আবেগের মুখোমুখি হবার ভয়। প্রচন্ড বিষাদের অনুভূতি হচ্ছে। অনুভূতিগুলো অব্যক্ত। সব যেনো তিক্ত দুঃস্বপ্নের ন্যায় লাগছে। হয়তো ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে, সব আগের মতো নির্মল, প্রশান্ত। কিন্তু সে তো হবার ছিলো না। ধারার মুখে কথা নেই সে শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্লাবণের হাস্যজ্জ্বল মুখের পানে। প্রচন্ড আবেগ তার ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। সে জানতো মানুষটির মুখোমুখি হলে প্রচন্ড কষ্ট হবে। কিন্তু কষ্টের মাত্রাটা জানা ছিলো না। বর্তমানে এই মাত্রার খোঁজ মিললো তার। ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্লাবণ পুনরায় প্রশ্ন করলো, তখন কোনো মনে নিজেকে সামলে জড়ানো গলায় উত্তর দিলো,
“ভালো”

ধারার আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না। সে পালাতে পারলে যেনো বাঁচে। কোনো মতে বললো,
“তোমরা কথা বলো আমি আসছি”

কোনো মতে যেনো ছুটে পালালো সে। ধারার এরুপ জড়তা নজর এড়ালো না অনলের। আড়চোখে নিপুনভাবে লক্ষ্য করলো সে ধারাকে। ধারা চলে গেছে প্লাবণ অনলের মুখোমুখি বসলো। সেও এই ভার্সিটির ই শিক্ষক৷ তবে তার স্থায়ীকাল অনলের থেকে বেশি। অনল বললো,
“ট্যাং খাবি?”
“খাওয়াই যায়, যা গরম”
“আচ্ছা”

মিনিট দশেকের মাঝে হাসেম মামা দুগ্লাস বরফ দেওয়া ট্যাং দিয়ে এলেন। একটা অনল নিজে নিলো, অন্যটি প্লাবণ। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে প্লাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে ফোন করেছিলাম, দুদিন মোটে ফোন ধরলি না। আফিয়া আপুর বিয়েতে এতো ব্যস্ত হয়ে পরেছিলি নাকি?”
“আসলে, বিয়ের কাজে ব্যাস্ত ছিলাম”
“তাই বলে এতো, ভাবটা এমন যেনো নিজের বিয়ে ছিলো”
“হ্যা নিজের ই বিয়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম”

কথাটা শোনামাত্র বিষম খায় প্লাবণ। কাশতে কাশতে নাকে মুখে উঠে যায় তার ট্যাং। অনল একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়। নিজেকে সামলে হতবাক কন্ঠে অনলকে জিজ্ঞেস করে,
“সত্যি?”

অনল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক চুমুকে ট্যাংটুকু শেষ করে। তারপর বিবাহবিভ্রাটের সম্পূর্ণ কাহিনী খুলে বলে প্লাবণকে। প্লাবণের মুখ স্তম্ভিত। অবশেষে কি না অনল বিয়ে করলো!

ভার্সিটির পিচঢালা রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছে ধারা। বড্ড এলোমেলো পায়ে হাটছে। মৃদুমন্দা বাতাসে তার এলোকেশ অবাধ্য হয়ে উড়ছে। দক্ষিণ আকাশে মেঘের আনাগোনা। স্বর্ণালী তেজী সূর্যটাও মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। কৃষ্ণাচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়াতে থেমে গেলো ধারা। উদাস নয়নে তাকালো নীলাম্বরের পানে। তার মনমন্দিরেও আজ মেঘমেদুর জমেছে। এখনি হয়তো ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হবে। ভেসে যাবে সব তিক্ততা, ভেসে যাবে সব আবেগ। মাঝে জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকবে ধারা। অতীতের পৃষ্ঠা উল্টাতে ইচ্ছে করলো তার। সেই সুখমিশ্রিত অতীত। যেখানে তার প্রথম সাক্ষাত হয়েছিলো প্লাবণের সাথে। প্লাবণ যখন প্রথম তাদের বাড়ি অনলের সাথে এসেছিলো তখন ধারা মাত্র ক্লাস সেভেন এ পড়ে। লম্বা অনলের সমান, ফর্সা মুখশ্রী, খাড়া নাক, সুগভীর উদাসীন নয়ন আর মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। বেশ নায়ক নায়ক দেখতে পুরুষটি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেছিলো,
“নাম কি তোমার?”
“ধারা”
“জলধারা?”

সেখান থেকে ধারার নাম হলো জলধারা। কি চমৎকার আচারণ। ধারা মুগ্ধ হয়ে দেখলো মানুষটিকে। প্রতিদিন একটা দুটাকা দামের ইকলিয়ারস নিতে আসতো। ধারাকে দেখলেই চুলগুলো এলোমেলো করে হাতে ধরিয়ে দিতো। এই স্নিগ্ধ স্মৃতিগুলো কিশোরী আবেগ হয়ে কখন যে মনের জমিনে বীজ রুপে রোপিত হবে, কে জানতো! এই ভার্সিটির লেকচারার প্লাবণ কথাটি জানার সাথে সাথেই ধারার জিদ হলো এই ভার্সিটির ছাত্রী হবে। তারপর সিনেমার মতো একটা সময় প্রেমপত্র পাঠাবে প্লাবণকে। কিন্তু সবই এখন স্বপ্ন। নানাভাই এর জিদের কাছে কিশোরী আবেগ ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো৷ আবেগের সেই রঙ্গিন ফুলটাও আজ ঝড়তে বসেছে। ধারা ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো সন্তপর্ণে। এই কিশোরী আবেগখানা তুলে রাখবে সে সংগোপনে। ধারা খেয়াল করলো বৃষ্টি নামছে, দুয়েক ফোটা করে করে অঝর ধারায় নামলো বৃষ্টি। ভালোই হলো, চোখের জোয়ারটা বৃষ্টির দাপটে ঢাকা পড়ে গেলো অবশেষে_________

অনলের বর্ণনা শোনার পর নিজের হাসি আর থামাতে পারলো না প্লাবণ। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। অনল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। প্লাবণের হাসি তাকে বিরক্ত করছে। বন্ধুর দূর্দিনে কেউ এভাবে হাসে? এজন্য ই হয়তো বলে “কারোর পৌষমাস, কারোর স’র্ব’না’শ”। বিরক্তির স্বরে বললো,
“হাসি থামা, হলুদ দাঁত দেখতে ভালো লাগছে না”

প্লাবণ কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললো,
“চটিস না, তবে বলতেই হবে দাদাকে হ্যাটস অফ। নয়তো আমাদের নারী বি’দ্বে’ষী অনল কি না বিয়ে করে। তাও জলধারাকে? ভাবা যায়”
“আমি মোটেই নারী বি’দ্বে’ষী নই। এগুলো তোদের বিকৃত মস্তিষ্কের রটনা”
“ও তাই না! তাহলে অনল সাহেব বলুন তো, এতো সুন্দর সুন্দর নারীদের কোমল প্রেমপত্রগুলো আপনার ডাইরিতে স্থান না পেয়ে কেনো ডাস্টবিনে স্থান পায়?”
“এই ঘটনাকে নারী বি’দ্বে’ষী রুপে ব্যাখা না করে অন্য ভাবেও তো ব্যাখ্যা করা যায়। এই ধর, যে নারীদের প্রেমপত্র আমি পাই তাদের আমার মনে ধরে না; আর যাকে মনে ধরেছে তার প্রেমপত্র এখনো পাই নি”

প্লাবণ কিছুসময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অনলের মুখপানে। অনলের বিরক্ত বাড়ে। কাছের বন্ধুটি অতি বিরক্তিকর। প্লাবণ আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে,
“আর কত শক দিবি ভাই। এক দিনে দুইটা ব্রেকিং নিউজ। অনলের বিয়ে আবার অনলের কোনো নারীকে মনে ধরেছে। তা বলি রোমিও তোর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন মনে ধরেও লাভ নেই”
“ধ্যাত, অফ যা তো। তোদের মতো মানুষের জন্যই রোম পুড়েছিলো বুঝলি!”
“নাহ! আমাদের জন্য না, তোমার মতো এক রোমিও এর জন্য পুড়েছিলো। আমরা তো শুধু দর্শক। আচ্ছা মজা বাদ দে! এই বিয়েটাকে নিয়ে কিছু ভেবেছিস? কিভাবে কি করবি?”

এবার চুপ করে গেলো অনল। থমথমে হয়ে গেলো মুখ। গাম্ভীর্য ছেয়ে এলো মুখে। রাশভারি কন্ঠে বললো,
“এটা তো আমারো চিন্তা। আসলে ধারাটা যে বড্ড ছেলেমানুষ, শুধু তাই নয় বড্ড জেদি, সেন্সিটিভ। ওর স্বভাবটা খুব ভাবাচ্ছে বুঝলি। আমাদের মধ্যে কোনো কালেই সখ্যতা ছিলো না। আমি বাম বললে তাকে ডান বলতেই হবে। আর ফুপি মারা যাবার পর থেকে মা-বাবা, দাদাজান তাকে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মতো রেখেছে। ও কি মানিয়ে নিতে পারবে আমার সাথে! আমি কি পারবো ওর মনের মতো হতে। প্রচন্ড ভাবাচ্ছে। আর গরম তেলে পানি ঢালার মানুষ আমার শ্বশুর তথা ফুপা তো আসেন নি। উনি দেশে আসলে তৃতীয় মহাযু’দ্ধ বাধবে। ভালো লাগে না।”

প্লাবণ ম্লান হাসলো। অনলের মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলো সে। নিপুনভাবে দেখে নিলো বন্ধুর মনটি। কিছুসময় চুপ করে থেকে বললো,
“এতো ভাবিস না, সম্পর্কগুলো গণিতের কোনো ইকুয়েশন নয়। এতো ভেবে চিন্তে কিছুই হয় না। সময়ের উপর ছেড়ে দে। সময় ঠিক বলে দেবে কি করা উচিত। আর অন্য নারীতে মনোনিবেশ না করে বউ এর উপর নজর দাও। আসলাম”

অনল হেসে দিলো। বউ, হ্যা বউ ই তো। রাগী, জিদি, এক ঘুয়ে রনচন্ডী বউ, তার ধারা________

ধারা বাসায় পৌছালো একেবারে কাকভেজা রুপে। ছাতার অভাবে ভিজতে হলো বিনা নোটিশের বর্ষায়। বাসায় ঢুকতেই বড় মার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো তাকে,
“ভিজলি কিভাবে? ছাতা নিস নি? আর সকালে খেয়ে যাস নি কেনো? হুড়মুড়িয়ে চলে গেলি? খেয়েছিস কিছু?”
“না”
“যা, কাপড় বদলে আয়। খাবার দিচ্ছি খেয়ে নে”

বিষন্ন মনটার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই মাথা দুলিয়ে রওনা দিলো নিজ ঘরের পানে। ঘরের দরজা খুলতেই মাথার উপর আরো এক দফা বাজ পড়লো। তার ঘর তো ঘর নয় আস্তো গোয়াল ঘর। সব জিনিস এদিক অদিক অবহেলায় পড়ে রয়েছে। আর খাটের উপর ছোটমামার জমজ দু কন্যে এশা এবং আশা একে অপরের চুল টানছে। ঠিক কি কারণে তাদের ঝগড়া চলছে জানা নেই। একেই মন খারাপের স্তুপ, উপরে এমন অসহনীয় অবস্থা ঘরের। ধারার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তেড়ে যেয়ে দুটোকে দুটো গাট্টা মেরে দিলো। কড়া কন্ঠে বললো,
“এটা কি মাছের বাজার? তোরা কি মানুষ হবি না?”
“ধারাপু আমার দোষ নেই। এই আশাটাই আমার ক্লিপ নিয়েছে”
“এটা তোর না, ধারাপুর ক্লিপ। আর খাটের এপাশ আমার”

ধারা মেজাজ আরোও তিরিক্ষি হলো৷ তীব্র স্বরে বললো,
“এই চুপ, বের হ আমার ঘর থেকে। এখন ই বের হবি”

জমজ বি’চ্ছু দুটো তাদের আঠাশটি দাঁত বের করে বললো,
“তা হচ্ছে না, দাদাজান এই ঘর আমাদের দিয়েছেন। বলেছেন এই ঘরে এখন আমরা থাকবো”

ধারার বুঝতে বাকি রইলো না এই বিনা নোটিশে ছোটমামার আগমণের কারণ। হয়তো সকালে নিজ ঘর থেকে বের হতে দেখে ফেলেছিলেন নানাভাই। তাই দাবার ঘোড়ার চাল চেলেছেন। ছোটমামা এবং পরিবারকে নিয়ে এসেছেন। আর ধারার ঘর সপে দিয়েছেন নিজের একান্ত সেনাপতি জমজদের হাতে। উফ! দাদা, নাতি দুটোই একই রকম। হাড় জ্বা’লি’য়ে দিলো একেবারে। নানাভাইকে ভালোবাসে বলে এই অত্যাচারগুলো মুখ বুজে মেনে নিতে হচ্ছে ধারা। আর নয়, এর বিহিত চাই ই চাই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছুটলো সে নানাভাই এর ঘরে

বিছানায় হেলান দিয়ে জামাল সাহেব আপন মনে শ্রীকান্ত বই টি পড়ছেন। বয়স হলেও বই তার খুব ই ভালো লাগে। শরৎচন্দ্রের এক একটা লেখা তার খুব ই পছন্দ। অসুস্থতা তো আছেই, কিন্তু মনকে সতেজ রাখাটা জরুরি। জীবন তো ক্ষণস্থায়ী। আজ নয়তো কাল, পরকালে তো যেতেই হবে। তাই নিজেকে আটকে রাখেন না তিনি। বই পড়েন, কবিতা লিখেন। ব্যস্ত যুবক বয়সে যা করেন নি, সেগুলোই করেন। এমন সময় আগমণ ঘটলো তার ছোট ছেলে ইলিয়াসের। তার কপালে চিন্তার সূক্ষ্ণ রেখা। মোটা ফ্রেমের চশমা নামিয়ে সেলিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু কইবা আব্বা?”
“আব্বা, বিপদ হয়ে গেছে”
“কি হইছে?”
“সেলিম ভাই ধারা আর অনলের বিয়ে সম্পর্কে জেনে গেছে। আমাকে ফোন করেছিলো। খুব চেতে আছেন উনি। বিশ্রী গা’লি’গা’লা’জ ও করেছেন”

শান্ত মুখটা চট করেই শক্ত হয়ে উঠলো জামাল সাহেবের। বুকের মধ্যখানে একটা তীব্র ব্যাথা অনুভূত হলো। কিন্তু ইলিয়াসকে বুঝতে দিলেন না। তীব্র স্বরে বললো,
“ওই খা***** পুতের সাহস কি করে হয় ফোন দেওয়ার। ওর লজ্জা করে না”
“আব্বা, উত্তেজিত হবেন না। সেলিম ভাই চাইলেই তো হবে না। আমরা তো আছি”
“ও আসুক, আমিও দেখাম ওই বে’য়া’দ’ব কি করে? আমার মাইয়াডারে মাই’রে শান্ত হয় নাই! এখন নাতীনডারে মা’র’তে চায়। ফাজিল পোলা”
“আব্বা, শান্ত হন। উনি এই মাসের শেষে আসবে। চিন্তা করবেন না, অনল ধারাকে সামলে নিবে। আপনি অসুস্থ। আপনি উত্তেজিত হবেন না”

জামাল সাহেব আরোও তীব্র হুংকার ছাড়লেন। ইচ্ছে মতো গালমন্দ করলেন সেলিম সাহবকে। কিন্তু কথাগুলো ধারার কানঅবধি পৌছালো না। বাবা আসবে কথাটাই তার জন্য যথেষ্ট ছিলো। এলোমেলো পায়ে রওনা দিলো অনলের রুমে। বা’ঘে’র ডে’রাতেই প্রবেশ করলো সে। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। অনুভূতিগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। প্রচন্ড কান্না। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো টের টিও পেলো না। এই ঘুমটি দীর্ঘকালের হলে হয়তো ভালো হয়তো, চিরকালের হলে হয়তো ধারা মুক্তি পেতো________

অনল বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে। কাজ শেষ করে, আড্ডা দিতে দিতে কখন বিকেল ফুরিয়ে গেছে টেরটি পায় নি। জ্যামও ছিলো হালকা, ব্যস্ত দিনের নিস্পত্তির পর সবাই বাড়ি ফিরতে ব্যাস্ত। তাই যানজট তো হবেই। অনল বাড়িতে ঢুকতেই ছোট মামার দেখা পেলো। নিস্প্রভ কন্ঠে সালাক দিয়েই রুমে গেলো সে। বড্ড ক্লান্ত শরীর। এতো দিন পর টানা কথা বলেছে সে। গলাও ব্যাথা করছে। নীরব, নিস্তব্ধ আঁধারে নিমজ্জিত ঘরে প্রবেশ করতেই প্রশান্তির স্নিগ্ধ ঢেউ বয়ে এলো অনলের হৃদয়ে। কি শান্ত, পরিবেশ! অনল লাইট না জ্বালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ঘড়ি, মানিব্যাগ সব রাখলো সেখানে। তারপর আয়নার দিকে তাকাতেই দেখলো একটা কালো অবয়বের প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্ব টি ঠিক তার পেছনে। অগোছালো চুল মুখের সামনে লেপ্টে আছে, উদ্ভ্রান্ত শান্ত দৃষ্টি। জামাকাপড় এলোমেলো। ক্লান্ত মস্তিষ্ক মূহুর্তেই জমে গেলো। বুকটা কেঁপে উঠলো অনলের। তার ঘরে কারোর উপস্থিতি হতে পারে কথাটা যেনো মাথায় ই ছিলো না। প্রচন্ড ভয় তাকে ঘিরে ধরলো। কপালে ঘাম জমতে লাগলো। ভয়মিশ্রিত চোখে পেছনে ফিরতেই মনে হলো অবয়বটি তার কাছে আসছে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়লো সে। জোড়ানো স্বরে চেঁচালো,
“ভু…..ত, ভু…ত”

সাথে সাথেই অবয়বটি লাইট জ্বালাতো। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরাতে সরাতে নিদারুণ অসহায় কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, ভুত না। আমি ধারা”…….

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here