#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৩তম_পর্ব
এশা যখন খুব নিপুন ভাবে শেষ তেলাপোকাটি ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢোকাচ্ছিলো। তখন ই কানে এলো,
“তোমরা এখানে কি করছো?”
রাশভারী কন্ঠটি কানে আসতেই কেঁপে উঠলো আশা এবং এশা। হাতের তেলাপোকাটা সেখানেই ছেড়ে দিলো তারা তারপর শুকনো ঢোক গিলে পেছনে ফিরলো। বেশ নিপুনদক্ষ চোর দক্ষতা দেখিয়েও যখন ধরা খায় তখন তাদের অবস্থা যেমন হয় আজ তাদের অবস্থাটি তেমন। পেছনে ফিরতেই আরোও ভয় পেলো তারা। কারণ পেছনে সেলিম সাহেব এবং দীপ্ত দাঁড়িয়ে আছে। সেলিম সাহেব তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যতই নির্ভীক বলে নিজেদের আখ্যা করুক না কেনো জমজেরাও ভয় পায়। এবং বড্ড বাজে ভাবে ভয় পায়। উপরন্তু সেলিম সাহেবের দৃষ্টি যে কেউ ভয় পাবে। তারা তো তার হাটুর থেকেও ছোট দুটো মেয়ে। তাদের প্রাণ ও খাঁচা ছাড়া হচ্ছে। বুক টিপটিপ করছে। কেনো করছে জানা নেই! সেলিম সাহেব তাদের ধমক দিবে সেই ভয় নাকি বাড়ির লোক জানাজানি হবে সেই ভয়! জানা নেই। তবে মা জানলে আবার মূর্তির জন্য কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবেন! অপমানিত হতে হবে মহল্লায়! ভেবেই নিকষকালো ভয়টা আরোও গাঢ় হলো। সেলিম সাহেব পুনরায় শুধালেন,
“হাটু গেড়ে কি করছিলে? হাতে কি তোমাদের?”
এশা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“কিছু না”
“তাহলে হাটু গেড়ে ছিলে কেনো?”
“খুঁ…খুঁজছিলাম”
“কি?”
এশা চুপ করে গেলো। এতো বুদ্ধিমান মস্তিষ্কটাও যেনো ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে। হবে নাই বা কেনো! কঠিন জেরার মুখোমুখি তারা। জেরা আগেও হয়েছে! কিন্তু সেটা রুবি বা অনল বা ধারার কাছে। এদের কাছে জেরা হওয়াটা ডালভাত। কিন্তু সেলিম সাহেবের মতো মানুষের কাছে জেরা হওয়াটা যেনো প্রচন্ড ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন। সেলিম সাহেব এশা এবং আশার কাছে সেই দৈত্যটি যিনি জোর করে তাদের ধারাপুকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে এসেছেন। তাই তো অস্ট্রেলিয়ান ফুফাকে তাড়াতে নিজেদের ছোট মস্তিষ্কে যা বুদ্ধি আসছে তাই প্রয়োগ করছে তারা। দৈত্যের কাছে ধরা খাওয়া কতোটা ভয়ংকর সেটা তাদের অকল্পনীয়। সেলিম সাহেব নিপুন দৃষ্টিতে দেখলেন মেয়েদুটোর দিকে। সাদা স্কুল ড্রেস পরহিতা জমজেরা ঈষৎ কাঁপছে। তারা ভীত সন্তস্ত্র চাহনীতে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো তিনি কোনো ছেলেধরা। তাদের কপালে ঘাম জমেছে। তারা একটা পর পর নিজেদের গলায় ঝুলোনো স্কার্ফটি টানছে। সেলিম সাহেব বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“কি খুঁজছিলে তোমরা মা? বলো, দীপ্ত খুঁজে দিবে! আর তোমরা কারা? এখানে কেনো! এবাড়ি তে তো থাকো না! দেখে মনে হচ্ছে স্কুল থেকে এসেছো। তাহলে বাড়ি যাও। এখানে কেনো?”
এশা আশা এখনো চুপ তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। ফুপা কি তাদের চিনতে পারে নি! তারা কি নিজেদের পরিচয় দিবে নাকি গোপন করবে! এর মধ্যেই দীপ্ত বলে উঠলো,
“আংকেল ওরা ইলিয়াস মামার মেয়ে। হয়তো ওদের বল এখানে চলে এসেছে। সেটা খুঁজছিলো। ওরা প্রায়ই বাহিরে খেলাধুলা করে। আপনাকে দেখে হয়তো ভয় পেয়েছে”
দীপ্ত এর কথাটা কর্ণপাত হতেই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো এশা আশা। দীপ্ত যা বলছে একেবারে দাহা মিথ্যে। তবে কি সে তাদের সাহায্য করছে! কিন্তু চেরাগআলী তাদের সাহায্য কেনো করছে! নাহ! এই প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়! গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কিভাবে অস্ট্রেলিয়ান ফুপার এই এলাকা থেকে প্রাণ নিয়ে পালানো যায়। ফুপার হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে পরে চেরাগআলীকে নিয়ে ভাবা যাবে। সেলিম সাহেব দীপ্তের কথা শুনেই হেসে দিলেন। মানুষটাকে যতটা ভয়ংকর লাগছিলো হাসিমুখে তাকে ততটা ভয়ংকর লাগছে না, বরং কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেছে, ক্রোধাগ্নি মুখশ্রী হয়ে উঠেছে নির্মল। তিনি হেসে বললো,
“ও তোমরা জামাল কাকার নাতীন। তাই বলো, আমি লাস্ট যেবার এসেছি ইলিয়াস কেবল বিয়ে করেছিলো। তোমরা ছিলেই না। তাই চিনতে পারি নি। চকলেট খাও! দাঁড়াও”
বলেই পকেট থেকে দুটো লজেন্স বের করে এশা আশার হাতে দিলো। এশা আশা এখনো বিস্মিত। এই দানব হুট করে আলাদিনের জিন কিভাবে হলো বুঝে উঠতে পারছে না তারা। তারপর তাদের মাথায় দু হাত রেখে বললো,
“বাড়ি যাও, ক্লান্ত শরীরে এতোটা হুটোপুটি ঠিক না। আর পড়াশোনা ভালো করে করো। যাও”
সেলিম সাহেবের মুখে “যাও” কথাটা শুনতেই যেনো প্রাণ ফিরলো এশা আশার। ভো দৌড় দিলো তারা। প্রাণ নিয়ে পালানো হয়তো এটাকেই বলে।
এশা আশা বিল্ডিং থেকে বের হতেই হাফ ছাড়লো। এশা আশাকে বললো,
“এখন কিছু দিন আন্ডারগ্রাউন্ড হতে হবে”
“হু, ঠিক। এই ফুপার মতিগতি ভালো না। ধরা খেলে আর আস্তো থাকবো না”
এর মধ্যেই পেছন থেকে একটি পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“টুইন্স, দাঁড়াও”
অতিপরিচিত কন্ঠটি চিনতে সময় লাগলো না এশা আশার। পেছনে তাকাতেই দেখলো দীপ্ত ছুটে এসেছে। মিষ্টি করে হেসে মুঠোবন্ধি বা হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমাদের একটা জিনিস রেখে যাচ্ছো তো! প্রিয় বন্ধুটিকে নিবে না?”
আশা অবাক কন্ঠে বললো,
“কি?”
দীপ্ত মুঠো খুললো। মুঠো খুলতেই বেড়িয়ে এলো সেই তেলাপোকাটি। তেলাপোকাটি মৃত। মৃত তেলাপোকা দেখে খানিকটা নয় পুরোপুরি থ পেরে গেলো জমজরা। তাদের থমকে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো দীপ্ত। তারপর বললো,
“ইঁদুর তবে শেষ হলো, আমি তো ভেবেছিলাম ইঁদুরের বংশকে দত্তক নিয়েছো। তো এখন কি তেলাপোকা সাপ্লাই এর ধান্দা?”
এশা আশা উত্তর দিলো না। শুধু ভ্রু কুচকে দীপ্তকে দেখতে লাগলো। দীপ্ত হাসি প্রসারিত করে বললো,
“লাভ নেই, তোমাদের ধারাপুকে এবার আমরা নিয়েই যাবো। রাক্ষস বুড়ির মতো একটা খাঁচায় আটকে রাখবো। বেশ হবে না?”
“আমাদের ধারাপুকে নেওয়া এতো সোজা?”
“দেখি কিভাবে আটকাও”
বলেই মৃত তেলাপোকাটা ফেলে হাত ঝেড়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো৷ এশা আশা ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করলো কিন্তু কাজে দিলো না। ফলে ব্যার্থ আশা বলে উঠলো,
“এবার আর চুপ থাকা যায় না, চেরাগআলী কিভাবে চ্যালেঞ্জ করলো দেখলি!”
“হুম, এতোদিন মিডিয়াম পন্থায় যাচ্ছিলাম। এখন হার্ড পন্থা ব্যাবহার করতেই হবে। ও না ওর চোদ্দগুষ্টি দেশ ছেড়ে পালাবে”
দাঁত কিড়কিড় করে কথাটা বললো এশা। যা একটু আন্ডারগ্রাউন্ড যাবার কথা ভাবছিলো এবার সেটি হচ্ছে না_______
********
করিডোরে নোটিশবোর্ড ঝুলছে। অবশেষে ক্ষুদ্র মানবজীবনের ফলাফলের পালা। পরীক্ষাতে এতোটা ভয় করে না ওতটা তার ফলাফল দেখতে করে। পরীক্ষার সময় মনের মাধুরী মিশিয়ে কিছু একটা লিখে আসলেই হলো কিন্তু পুলসিরাতের সময় তো সেই ফলাফল। পাশ, ফেল, সিজি হাবিজাবি টাই মানুষকে নাজেহাল করে তোলে৷ যেমনটা বন্ধুমহলের ক্ষেত্রে হচ্ছে। ভীত পাঁচজোড়া নজর তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের রেজাল্ট দেখার জন্য। ভালোই তো সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস চলছিলো এই রেজাল্টের ফাড়া গেলে বাঁচা যায়। ভিড় ঠেলে দিগন্ত ভেতরে ঢুকলো। একে একে রেজাল্ট দেখলো। বরাবরের মতো ফার্স্ট হলো নীরব। শান্তির ব্যাপার একজন ও ফেল করে নি। অভীকের সিজি কোনো মতে ৩.৩০ এর কাছে, মাহির ৩.৪০ দিগন্তের টা কোনো মতে ৩.০৫। আর ধারা একেবারে কাটায় কাটায় ৩.২৫৷ মেয়েটি আরোও ভালো করতো। ধারা তো খুশিতে আত্মহারা। এজন্য নয় সে তার সিজি ভালো। নাহ, এজন্য যে সে এখন অনলকে যেতে বলবে “চল না ঘুরে আসি অজানাতে”। অনল স্যার কাউকেই নাকানিচুবানি দেয় নি। সবাই পাশ করে গেছে ভালোভাবে। মাহি উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
” কি রে ধারা, তুই তো ছক্কা হাকিয়েছিস। কই টেনেটুনে পাশ আর কই ৩.২৫”
“কার বউ দেখতে হবে না! একজন গণিতমাষ্টারের বউ যদি ফেল করে, সমাজে মুখ দেখাবে কিভাবে!”
ধারার কথা শুনে অভীক বলে উঠলো,
“বুঝলি না, ধারার রেজাল্টের রহস্য অনল স্যারের ভালোবাসা। তা স্যারকে বল, আমাদের ও একটু পড়াতে”
“তুই নীরবের কাছেই পড়। সে শুধু আমাকে পড়ায়। আমার পার্সোনাল টিউটর”
“হিংসুটে ধারারানী”
“ভালো হইছে। থাক আমি আসছি”
বলেই ধারা ছুটলো। বন্ধুমহলে উৎসাহ বেশ। ধারা চলে গেলে অভীক দিগন্তের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ক্যাফেতে পার্টি করবি নাকি অন্য কোথাও”
“যেখানে তোরা বলিস”
এর মাঝেই মাহি বলে উঠলো,
“আমার হচ্ছে না, বাড়ি যেতে হবে আজ। তোরা যা”
“একা যাবি? আমি দিয়ে আসি?”
দিগন্তের প্রস্তাব খানা শুনতেই সকলের নজর যায় দিগন্তের দিকে। মাহির মুখ হা হয়ে আছে। দিগন্ত তাকে নিয়ে যাবার কথা বলছে এ যেনো অষ্টম কোনো আশ্চর্য! সকলের হতবাক নজর দেখে দিগন্ত শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“তুই মাহি চু’ন্নীকে বাড়ি দিয়ে আসবি?”
“হ্যা, সমস্যা কোথায়? আর এমনিতেও ধারাও নেই। তাই আজ সেলিব্রেশন বাদ দেই। আর মাহি একা একা এই সময় যাবে। আমি দিয়ে আসলে তো ক্ষতি কি!”
“না ক্ষতি নেই, কিন্তু কখনো মাহির প্রতি তোর এতো দরদ তো দেখি নি, তাই”
“আজাইরা, এই চল তো মাহি। অভীকের কথার আগামাথা নেই। ওর কথার মাঝে পড়লে যাওয়া হবে না”
বলেই হাটা দিলো দিগন্ত। মাহিও তার পিছু নিলো। এই ভরদুপুরে বাড়ি যাওয়াটা একটা ঝামেলা বটে। এদিকে অভীক নীরবকে বললো,
“কেস কি নীরব বাবা?”
“নতুন প্রেমের ফুল ফুটবে ফুটবে ভাব! শুধু প্রেমের অভাব”
**********
অনলের রুমের কাছে আসতেই আশপাশটা দেখে নিলো ধারা। ছুটির সময় বিধায় স্যারদের আনাগোনা নেই। সেই ফাঁকে অনলের রুমে ঢুকতে হবে। কিন্তু যেই অনলের রুমে লক মোচড় দিলো অমনি তা খুলে গেলো। ভেতর থেকে কেউ দরজাটা খুললো। এই মানুষটি আর কেউ নয় বরং অনন্যা। অনন্যাকে দেখে রীতিমতো অবাক হলো ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনন্যা বলে উঠলো,
“ভালো আছো?”
“জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“আমিও ভালো! এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট নাকি?”
“হ্যা, আমি ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট সেকেন্ড ইয়ার। আপনি এখানে?”
“তোমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছি। পার্মানেন্ট না, পার্ট টাইম ক্লাস নিবো। অনলের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। আসি”
ধারার উত্তরের অপেক্ষা করলো না অনন্যা। হনহন করে হেটে চলে গেলো। অনন্যার হুট করে জয়েন করাটা খটকা লাগলো ধারার। সে ভেতরে পা বাড়ালো। রুমে ঢুকতেই দর্শন হলো অনলের কঠিন মুখশ্রীর। তার মুখখানা শক্ত হয়ে রয়েছে। চোখজোড়া রক্তিম। কপালের বা পাশে শিরা ফুলে উঠেছে। ধারা নরম গলায় বললো,
“আসবো?”
ধারার কন্ঠ শুনতেই চোখ তুললো অনল। নির্বিকার কন্ঠে বললো,
“তুই? ক্লাস শেষ?”
“হ্যা, তোমার সাথে দেখা করতে এলাম। বাড়ি যাবে না?”
“হু, যাবো। দশ মিনিটের একটা কাজ আছে। করে নেই?”
“আচ্ছা”
বলেই চেয়ারটা টেনে বসলো ধারা। একবার ইচ্ছে হলো অনন্যা আপুর কথাটা তুলবে কিন্তু অনলের কঠিন মুখশ্রী দেখে আর সাহস হলো না। তার বুঝতে বাকি নেই অনল তার রাগ সংবরণ করে রেখেছে। অনল ল্যাপটপে হাত চালাতে চালাতে কিছু একটা ভেবে বললো,
“রেজাল্ট দিয়েছে, দেখেছিস?”
“সেটা দেখেই তো ছুটে আসা। তা কোথায় নিয়ে যাবে আমায়৷ বলেছিলে তো আমাকে হানিমুনে নিয়ে যাবে”
“তোর মনে আছে?”
হাত থামিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো অনল। ধারা উৎসাহিত কন্ঠে বললো,
“বাহ রে! থাকবে না। তুমি জানো আমি এই ঘোরার লোভে কত কষ্ট করেছি। আমি কিছু বাহানা শুনছি না। নিয়ে যাবে মানে যাবে”
“আচ্ছা, যাবো। তবে ছুটি পেলে। এখন সেমিষ্টার শুরু। কিভাবে ছুটি নেই? এর চেয়ে একটু অপেক্ষা কর। ছুটি পাই। নিয়ে যাবো”
কথাটা শুনতেই ধারার উৎসাহে পানি পড়ে গেলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
“সব তোমার বাহানা। নেবে না বলে দিলেই হয়। কথা ঘোরাচ্ছো কেনো?”
“ঘোরালাম কোথায়! যাবো তো, এখন তুই যদি একদিনের ছুটিতে ঘুরে আসতে চাস সেটা আলাদা কথা। আর দশদিনের একটা জম্পেশ বান্দরবান ট্যুর দিতে চাস সেটা আলাদা কথা। কোনটা চাই বল”
ধারা গভীর চিন্তায় পড়লো, এদিকে ঘোরার মন ও হচ্ছে আবার একদিন ঘুরলে পোশাবেও না। তাই বাধ্য হয়ে বললো,
“বেশ, জম্পেশ ঘুরবো। কিন্তু আমি ঘুরতে যাবো, কোনো বাহানা চাই না। সামনের যে ছুটি পাবো তাতেই যাবো”
“যথাআজ্ঞা মহারাণী। চল কাজ শেষ”
বলেই ল্যাপটপ টা ব্যাগে পুরলো অনল। তখন ই রয়ে সয়ে ধারা বললো,
“আচ্ছা, অনন্যা আপু কি সত্যি জয়েন করেছে? না আসলে তোমার ঘরে ঢুকতেই ওকে দেখলাম তো”
অনন্যার কথাটা শুনতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো অনল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হ্যা, তাই তো বললো!”
“তা তোমার রুমে কি করছিলো?”
একটু কৌতুহলী কন্ঠেই কথাটা বললো ধারা। অনল ধারার মুখের দিকে তাকালো। মুখ ই বলে দিচ্ছে মনে কত কত প্রশ্নেরা উঁকি মারছে। উপরন্তু কিঞ্চিত ঈর্ষাও যেনো দেখতে পেলো সে। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর খানিকটা মজার ছলে বললো,
“প্রেম নিবেদন করতে এসেছিলো!”
“কি?”
অনলের আকস্মিক উত্তরে মাথাটা শুন্য হয়ে গেলো। হুট করে বুকটা ধক করে উঠলো। ফলে কৌতুহল মনের আবেগ মুখে উঠে এলো। খানিকটা ভীত হয়ে উঠলো মন। ফলে উচ্ছ্বাসিত মুখখানা হয়ে উঠলো রক্তশূন্য। ধারার মুখশ্রীর অনবদ্য মুখভঙ্গি দেখেই হেসে উঠলো অনল। মাথায় আলতো করে গাট্টা মেরে বললো,
“ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আর চাপ দিস না। ফেটে যাবে। ও এসেছিলো একটা অফার নিয়ে। যা আমি মানা করে দিয়েছি। চিন্তা করিস না। প্রেম নিবেদন দিলেও তা মানাই করতাম। আমার ধারারানীর জায়গা নেওয়া কি এতো সোজা। অবশ্য কি দিন ছিলো, স্বর্ণালী দিন। কত শত প্রেম নিবেদন। শুধু যারটার প্রতীক্ষা করতাম, তারটাই পেলাম না। আফসোস”
“কার প্রতীক্ষা করতে?”
অভিমান ধরা গলায় বললো ধারা। তখন তার কানে মুখ ঠেকিয়ে খাঁদে নামানো স্বরে বললো,
“তোর, একটা প্রেম নিবেদন তো আমারো পাপ্য ছিলো”
কথাটি শুনতেই নরম গালটি রক্তিম হয়ে উঠলো। অভিমানেরা বাস্পায়িত হয়ে গেলো। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণ রক্তের স্রোত। দুহাতে আঁড়াল করলো মুখখানা। ইশ কি লজ্জা!
*****
জ্বালাময়ী গরমে কুপকাত সকলে এর মাঝে অংকের বোঝা মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কোনো মতে ক্লাসের সমাপ্তি ঘটিয়েই যেনো হাঁফ ছাড়লো ধারা এবং মাহি। রেজাল্টের আনন্দটা বেশি স্থায়ী হলো না। তার আগেই স্যার ম্যাডামদের ক্লাস টেস্টে খ’ড়া ঝুললো। ব্রেকের মাঝে একটা ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিতেই যাবে অমনি একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“অনল স্যারকে নিয়ে মিটিং হচ্ছে। তাকে সাসপেন্ড করা হবে”……….
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৪তম_পর্ব
ব্রেকের মাঝে একটা ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিতেই যাবে অমনি একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“অনল স্যারকে নিয়ে মিটিং হচ্ছে। তাকে সাসপেন্ড করা হবে”
মেয়েটির কথাটা বুঝতে সময় নিলো ধারার মস্তিষ্ক। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো সে মেয়েটির দিকে। “সাস্পেন্ড” শব্দটি পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো যেনো হুট করেই অকেজো হয়ে পড়লো। সুউচ্চ বিল্ডিং এর উপর থেকে নিচে ফেলে দিলে যেমন অনুভূতি হয় ধারার অনুভূতিটা ঠিক তেমন। মেয়েটির কথায় ক্লাসে বেশ আলোড়ন তৈরি হলো। সকলে ঘিরে ধরলো তাকে। জানতে চাইলো কারণ কি! মেয়েটি একটু থেমে বললো,
“দাঁড়া, দাঁড়া বলছি। আমি উপরে স্যারের সিগনেচার নিতে গিয়েছিলাম। তখন ই দেখি মিটিং রুমে সবাই জড়ো হয়েছে। ভেতরের অফিস ক্লার্ক হাফিজ ভাইকে শুধালাম কারণ কি! তখন উনি বললো, আমাদের মধ্যে কেউ নাকি হেডের কাছে কমপ্লেইন করেছে। অনল স্যার প্রশ্ন আউট করেছেন। প্রশ্ন আউট করেছে নিজের কোর্সে। এবং শুধু নাই নয়, উনি খাতা দেখার সময় ও পার্শিয়ালিটি করেছেন।”
“কে করেছে কমপ্লেইন?”
মাহি অস্থির কন্ঠে প্রশ্নটি করে উঠে। মেয়েটি অসহায় কন্ঠে বলে,
“সেটা আমি কি করে বলবো। হাফিজ ভাই ও চুপ করে আছেন। সেটার মিটিং হচ্ছে। অনল ভাই কে প্রশ্ন করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি করা হবে। তবে হাফিজ ভাই বললো, অনল স্যারকে হয়তো সাসপেন্ড করা হবে। আগেও এমন হয়েছিলো।”
সকলের মাঝে একটা গুঞ্জন তৈরি হলো। এর মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“কিন্তু উনি তো প্রশ্ন আউট করেন নি। তাহলে এই ক্লেমটা কে করেছে! আর খাতায় পার্শিয়ালিটির তো প্রশ্ন ই আসছে না। আমাদের সবাই ভালো ভাবেই তো পাশ করেছি উনার সাবজেক্ট এ। তাহলে এই ক্লেইমের তো ভিত্তি নেই”
“ঠিক, এই ক্লেইম টা করেছে কে?”
সকলের মাঝে গুঞ্জন উঠলো। সবাই নিজেরাই বলছে, “আমি তো করি নি, আমি তো করি নি। কে করেছে জানি না!” এর মাঝে ধারা নিস্তব্ধ। সে চুপ করে বসে রয়েছে। অনলের উপর দিয়ে কি ঝড় চলছে কল্পনাও করতে পারছে না। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এতো বড় অপবাদটা দিলো কে? মাহি তার ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
“চিন্তা করিস না, এমন অপবাদে অনল ভাই এর কিছু হবে না”
মিটিং রুমে মোট সাত জন শিক্ষকের সামনে বসে রয়েছে অনল। হেড অফ ডিপার্টমেন্ট আব্দুল আনসারী সাহেব চোখের চশমাটা নামিয়ে বললো,
“দেখো অনল, আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আছে তুমি এই কাজটা করেছো। প্রথমত তুমি কাউকে জানাও নি তোমার ওয়াইফ ওই ক্লাসের স্টুডেন্ট। এটা তুই অথোরটির কাছে গোপন করে গেছো। উপরন্তু তুমি নিজেই বলো যে মেয়েটির গত সেমিষ্টারে এতো বাজে রেজাল্ট করলো। সে এই সেমিষ্টারে কি করে ৩.২৫ পায়। শুধু তাই নয়। তোমার কোর্স ছাড়া কোনো কোর্সে কি সে ভালো করেছে? বি, বি মাইনাস এমন গ্রেড উঠেছে। শুধু তোমার কোর্সেই এ। তাও ক্লাস এসেসমেন্টে সে পেয়েছে ত্রিশে তিন। এই কাজটা তোমার থেকে এক্সপেক্টেড ছিলো না অনল। তোমার কি কিছু বলার আছে?”
আনসারী সাহেবের কথা শেষ হতেই অনল ধীর গলায় বললো,
“স্যার, আমি জানি না আপনার এমন কেনো মনে হচ্ছে! আপনি আমার কোর্সের এভারেজ রেজাল্ট দেখুন। ৪৫ জনে একজনও ফেল করে নি। এদের সবার এসেসমেন্টে নম্বর কম। আপনার কি মনে হয়েছে কেউ খারাপ করেছে? আর ক্যালকুলাস আমি একা নেই নি। শিহাব স্যার ও নিয়েছেন। আমাদের কোর্সের প্রশ্ন ও মডারেট হয়েছে। এরপর ও আপনি আমাকে সন্দেহ করলে আমার কিছুই বলার নেই। আমার ওয়াইফকে ভালো রেজাল্ট করাবো, খাতায় পার্শিয়ালিটি করবো আমি এমন মানুষ নই। আমার নৈতিকতা আছে। যখন এই ভার্সিটির টিচার হয়েছিলাম সেই নৈতিকতা নিয়েই আমি এসেছিলাম। হ্যা, এটা সঠিক যে আমি এডমিনিস্ট্রেশনকে ধারার কথাটা জানাই নি। সেটারও কারণ আছে। আমাদের বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে। আমার জয়েনিং এর পর। তাই ব্যাপারটি আমি লুকিয়ে গেছি। যদি এজন্য আমাকে শাস্তি দেওয়া হয় আমার আপত্তি নেই। তবে আমি আমার দায়িত্বে কোনো গাফেলতি করি নি। আমি কোনো প্রশ্ন আউট করি নি। খাতাগুলো অফিসে রয়েছে। তদন্ত করে দেখতে পারেন। মডারেটর স্যার যিনি ছিলেন তাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। শুধু শুধু একটি মেয়ের কথা শুনে আমার উপর এলিগেশন দেওয়াটা কতটা ঠিক আমার জানা নেই”
উপস্থিত সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শিহাব ও বললো, সে কোনো পশ্ন আউট করে নি। ডিপার্টমেন্টাল হেড আনসারী সাহেব বললেন,
“তুমি এখন যেতে পারো অনল। আজ তোমার ক্লাস নেবার প্রয়োজন নেই।”
“জ্বী”
বলেই উঠে দাঁড়ালো অনল। তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আছে। মুখ কঠিন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। মাঝে মাঝে সততার প্রমাণ দেওয়া এতোটা কঠিন কেনো! সে আন্দাজ করেছিলো এমন কিছু একটা হতে পারে। সে ভেবেছিলো কমপ্লেইন টা দিগন্ত করবে। কারণ এই প্রশ্নের সন্দেহটা তার মনেই জেগেছিলো। কিন্তু সে কমপ্লেইন করে নি। করেছে মালতী নামের একটি মেয়ে। ব্যাপারটা জানতেই বেশ অবাক হয়েছিলো অনল। তবে অনল ও কাঁচা মানুষ নয়। সেও যথেষ্ট প্রমাণ নিজ পক্ষে রেখেছে, কিন্তু স্যারেরা সেটা বিশ্বাস না করলে তার করার কিছুই নেই। মিটিং রুম থেকে বের হতেই ধারার দর্শন পেলো অনল। মেয়েটি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ টলমল করছে। অনলকে দেখেই সে এগিয়ে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“তোমাকে ওরা সাসপেন্ড করে দিয়েছে?”
“এতো সোজা? মাত্র তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে। তারপর আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ পেতে হবে। তারপর আমাকে সাসপেন্ড করবে।”
স্মিত হেসে কথাটা বললো অনল। ধারা অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“কিন্তু করবে টা কেনো? তুমি তো অন্যায় করো নি”
“তাদের ধারণা আমি তোকে প্রশ্ন দিয়েছি। তুই সেই প্রশ্ন সবাইকে দিয়েছিস। আবার তোর বেলায় খাতা দেখাতেও আমি পার্শিয়ালিটি করেছি। মালতী নামের একটি মেয়ে নাকি কমপ্লেইন করেছে। আমিও বলেছি প্রমাণ করুক। তারপর না হয় বাকিটা দেখা যাবে। চিন্তা করিস না, আমার কিছু হবে না। বড় জোড় চাকরি যাবে। করলাম না শিক্ষকতা। বেকার বরে আপত্তি নেই তো তোর?”
ধারা অবাক নয়নে মানুষটির দিকে চেয়ে আছে। এতো বড় বিপদেও সে এতো শান্ত কি করে! না চাইতেও অপরাধবোধ হলো ধারার। কোথাও না কোথাও তার ও দোষ ছিলো। তার বন্ধুর জন্যই আজ ব্যাপারটা এতোদূর গড়িয়েছে। সেদিন যদি দিগন্ত এবং তার মাঝে ঝামেলা না হতো তাহলে সেই সুযোগটা মালতী নিতে পারতো না। সেদিন করিডোরে মালতীও ছিলো। মালতী ধারার উপর শোধ তুলতেই এই কমপ্লেইন করেছে। কিন্তু এই ঝামেলাগুলোর ফলস্বরূপ অনলকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কথাটা ভাবতেই হৃদয়ের অন্তস্থলে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো। ধারার লম্বাটে মুখখানা দেখেই অনলের হাসি চওড়া হল। মেয়েটির মুখে নিজের জন্য দুঃচিন্তা এবং ভীতি দেখে এক অসামান্য শান্তি অনুভূত হলো অনলের। ধারার হাতটা নিজের মুঠোবন্দি করে বললো,
“আজ আমার ক্লাস নেই, ঘুরতে যাবি?”
“তোমার চিন্তা হচ্ছে না?”
“চিন্তা করলে যদি কিছু লাভ হতো, চিন্তা করতাম। কিন্তু আফসোস লাভ নেই। তুই ও চিন্তা করিস না। আমার কিচ্ছু হবে না। হ্যা, এখন ভেবে দেখতে পারিস বেকার স্বামীর সাথে থাকবি কি না! না থাকতে চাইলে”
“আর একবার যদি এই কথাটা তুলেছো তো দেখবে আমি করি। বাসায় যেয়ে লংকাকান্ড বাঁধাবো বলে দিচ্ছি। একেই চিন্তা হচ্ছে উপরে বারবার এক কথা!”
বেশ ক্ষিপ্ত কন্ঠে কথাটা বললো ধারা। অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
“ব্যাগ নিয়ে আয়। একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো তোকে”
“কোথায়?”
“যেয়েই দেখতে পাবি”
ধারা আর কথা বাড়ালো না। ব্যাগ নিয়ে আসলো ক্লাস থেকে। অনল বাইকে স্টার্ট দিলো। পিচঢালা পথ চিরে এগিয়ে গেলো গন্তব্যে।
শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। বিনা নোটিসে বৃষ্টির ঝোক যেনো আরোও বেড়ে গেছে। ইট পাথরের শহর পেরিয়ে নিরিবিলি এলাকা। চিকন রাস্তা, দু পাশে মাঠ তাতে হাটুজল পানি। অনলের বাইক চলছে। ধারা অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছে। রোদের তেজ কমে এসেছে। দক্ষিণ আকাশের কোনে কালো মেঘ জমেছে৷ মেঘের গর্জন কানে আসছে। এখনই শ্রাবণের বর্ষণ হবে, ভিজে যাবে উত্তপ্ত পৃথিবী। বাইক মোড় ঘুরলো। একটা বিশাল মাঠের মাঝে দেওয়াল ঘেরা একটা জায়গায় বাইক থামালো অনল। ধারা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো জায়গাটির দিকে। একটি লোহার কেঁচিগেট৷ অনল গেটটিতে আওয়াজ করতেই। একজন ছুটে গেট খুললো। অনল স্মিত স্বরে বললো,
“কেমন আছেন চাচা?”
“এই তো আল্লায় যেমন রাখছে। তুমি কেমন আছো?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ, কাজ কতদূর?”
“আজকে কামে আসে নাই কেউ। তুমি ভেতরে আসো, নিজেই দেইখে নিও”
অনল হেসে বললো,
“বউ মা নিয়ে আসছি। যার বাড়ি সেই দেখুক”
অনলের কথাটা শুনতেই অবাক হলো ধারা। তার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,
“চাচার সাথে ভেতরে যা। আমি বাইক রেখে আসছি”
ধারাও তার কথা শুনলো। সে ভেতরে গেলো। ভেতরে যেতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। একটি অর্ধ নির্মিত বাড়ি। মাত্র ছাদ ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। রড, বালি, সিমেন্টের স্তুপ নিচে জড়ো হয়ে আছে। বাড়িটি এক তালার কাঠামো আপাতত দেওয়া। ইটের সিড়ি উঠে গেছে। এখনো রুম করা হয় নি। বৃদ্ধ মানুষটি বললো,
“এই বছরে কাম শেষ হয়ে যাবে। আসলে স্যার তো আসার সময় পায় না। আমি ই ওদের দিয়ে করাই। মিস্ত্রীরা কাম চোর, কাছে না থাকলে কাম করে না”
ধারা উত্তর দিলো না। সে শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো ইটের কাঠামোর দিকে। এর মাঝেই অনল এলো। বলিষ্ট হাতের ফাঁকে ধারার হাতটি পুরে বললো,
“ভেতরে না গেলে বুঝবি কিছু?”
বলেই ধারাকে নিয়ে গেলো বাড়িটিতে। সাবধানে উঠালো সে। পিলার গুলো এখনো ঢালাই দেওয়া হয় নি। শুধু কাঠামো করা। অনল ধারাকে ঘুরয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালো। শেষমেশ একটা স্থানে এনে বললো,
“এটা আমাদের রুম হবে। তোর যেমন ইচ্ছে তেমন করে সাজিয়ে নিস”
“এসব কবে করলে?”
অনল বাকা হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ধারাকে। তার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
“বহুদিন আগে। তোর সাথে বিয়ের পর ই তোকে কিছু দেবার ইচ্ছে ছিলো৷ শহরের মাঝে আমার ভালো লাগে নি। প্লাবণ এই জায়গার খোঁজ দেয়। আমিও সস্তা পেয়ে জমিটা কিনলাম। তারপর এই আসতে আসতে বাড়ির নকশা করলাম। চেয়েছিলাম যখন বাড়িটা শেষ হবে তখন তোকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বহুবছর পার হবে বাড়ি শেষ হতে”
অনল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“আমরা যখন বুড়ো হয়ে যাবো, বাচ্চাকাচ্চারা বড় হয়ে যাবে, তাদের বিয়েশাদী হয়ে যাবে তখন আমরা বুড়াবুড়ি এখানে এসে থাকবো। নিরিবিলি, নির্মল পরিবেশ। যেখানে কোনো কোলাহল নেই, কোনো ঝঞ্জাট নেই। শুধু আমি আর তুই। আর আমাদের প্রণয়। আমি তো বাহির নাম ও ঠিক করেছি, “প্রণয় প্রহেলিকা”। আমাদের প্রণয় প্রহেলিকার সাক্ষী এই বাড়ি। তোর পছন্দ হয়েছে?”
ধারা নিশ্চুপ। শুধু একটু পর পর ডুকরে উঠার শব্দ আসছে। অনল অনুভব করলো তার বউ টি কাঁদছে। অনল তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখখানা আদলে করে বললো,
“পছন্দ হয় নি”
ধারা উত্তর দিলো না। শুধু অনলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সে কাঁদছে। তার নোনাজলের ঢেউ অনলের শার্ট ভিজিয়ে দিলো খানিকটা। কিন্তু ধারা এখনো কাঁদছে। অনল ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“কাঁদছিস কেনো?”
“তুমি আমাকে এতোটা ভালোবেসো না। আমার নিজেকে অসহায় লাগে। বারবার মনে হয় এতোটা সুখের আমি যোগ্য নই। এই সুখের বিনিময়ে তোমাকে দেবার কিছুই নেই আমার। আমি যে কাঙ্গাল। আমি কোথায় রাখবো বলো তোমার এই প্রণয়গুলো?”
অস্পষ্ট স্বরে কোনোমতে কথাটা বললো ধারা। সে বারবার ডুকরে উঠছে। অনলের হাসি প্রসারিত হলো। হাতের বেষ্টনী শক্ত করলো। নিবিড় ভাবে ধরে রাখলো ধারাকে। ধীর কন্ঠে শুধু বললো,
“পা’গ’লী”
*********
সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো ধারার। দু চোখ এক করতে পারলো না সে। অনল যদিও তাকে নিজের বুকে আগলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে বলেছে, কিন্তু সেটি হলো না। অনলের ঘুমন্ত মুখখানা নিষ্পলক চোখে দেখলো এবং একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে।
পরদিন যখন অনলের ঘুম ভাঙ্গলো তখন পাশে ধারাকে পেলো না সে। ভেবেছিলো মেয়েটি বাথরুমে আছে। কিন্তু সেখানেও তাকে পাওয়া গেলো না। মাকে শুধাতেই সে বললো,
“ধারা তো না খেয়েই ভার্সিটি চলে গেছে”
অনলের মনে খটকা লাগলো। সে যতটুকু জানে ধারার ক্লাস আজ সাড়ে দশটায়। সুতরাং এতো সকালে যাবার কোনো মানেই নেই। অনল দেরি করলো না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে গেলো ভার্সিটি। ক্লাসের সামনে যেতেই মাহির সাথে দেখা হলো তার। ধারার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে উত্তর দিলো,
“অনল ভাই, আমি তো ওকে আসার পর দেখি নি।”
“তোমাদের কি আজ আগে আগে আসার কথা?”
“না তো”
তখন ই সেখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো। অনলকে দেখতেই সে বললো,
“ধারা, হেড স্যারের রুমে”…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৫তম_পর্ব
তখন ই সেখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো। অনলকে দেখতেই সে বললো,
“ধারা, হেড স্যারের রুমে”
দিগন্তের কথাটা শুনতেই অনলের বুঝতে বাকি রইলো না কাহিনী। সে যা সন্দেহ করছিলো সেটাই হয়েছে। ধারা তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিয়ে ঠিক লড়াই করতে চলে গেছে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো! কেনো বুঝতে চায় না সবকিছুর একটা পদ্ধতি রয়েছে। র’ণ’চ’ন্ডী হওয়া সর্বদা মানায় না। এতো সময় তো সন্দেহের তোর অনলের উপর ছিলো এখন ধারার উপরও সেটা বর্তাবে। অনল আর দাঁড়ালো না। সে সোজা চলে গেলো ডিপার্টমেন্ট হেড আনসারী সাহেবের কেবিনের কাছে। অনলের ছুটে যাওয়া মাহির মনে সন্দেহ তৈরি করলো সে দিগন্তকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাহিনী কি?”
“সকালবেলা ধারা আমাকে ফোন করেছিলো। আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ফোন ধরতেই ধারা ঠান্ডা গলায় ভার্সিটিতে আসার কথার বললো। আমিও দেরি না করে চলে এলাম। ভার্সিটিতে আসার পর ও আমাকে বললো সে আনসারী স্যারের রুমে যাবে। সে তার সাথে অনল স্যারের ব্যাপারে কথা বলবে। এবং আমাকেও সাক্ষী দিতে হবে সেদিন করিডোরে যা হয়ে তা আমি রাগের বশে বলেছি। তার কোনো সত্যতা নেই। মাধবীর (গত পর্বে আমি মাধবীর নামের বদলে মালতী লিখেছিলাম) হয়তো বুঝতে ভুল হয়েছে। অনল স্যার কোনো পার্শিয়ালিটি করে নি”
“তুই কি স্যারকে স্বীকারোক্তি দিয়েছিস?”
মাহি অবাক কন্ঠে প্রশ্নটি করলো৷ দিগন্ত একটু থেমে বললো,
“হ্যা, আর উপায় কি! ভুল তো আমার হয়েছে। আমার জন্য একটা নির্দোষ মানুষ তো ভুগতে পারে না। কিন্তু স্যার বিশ্বাস কতোটুকু করেছে জানি না। আমাকে সে ক্লাসে যেতে বললো৷ ধারা এখনো স্যারের সাথেই কথা বলছে”
দিগন্তের কথাটি শুনে মাহি তার কাঁধে চা’প’ড় মেরে বললো,
“আমার তোর উপর গর্ব হচ্ছে। প্রাউড অফ ইউ দোস্ত। এটাই না আমাদের দিগন্ত”
মাহির কথাটা শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো দিগন্ত। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অগোছালো হৃদয়টা হুট করে প্রচন্ড জোরে স্পন্দিত হচ্ছে। এক অজানা ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে। তাড়াতাড়ি মাহির হাত সরিয়ে বললো,
“লজ্জা লাগে না, ছেলেদের গায়ে হাত দিস। অ’স’ভ্য মহিলা”
বলেই হনহন করে হাটা দিলো সে। মাহি বেকুবের মতো চেয়ে রইলো তার দিকে। ভুল টা কি হলো! দিগন্ত একটা চা’প’ড়ে এতো ক্ষেপে গেলো কেনো!
********
হেড অফ ডিপার্টমেন্ট “ম্যাথ” আব্দুল আনসারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। তার হাত পা এখনো ঈষৎ কাঁপছে। আনসারী সাহেব চোখের চশমাটা মুছে পড়লেন। তারপর অফিস ক্লার্ক হাফিজকে ডাকলেন। রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“এক কাপ চা দাও”
হাফিজ ও সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। চাও চলে এলো মিনিট দশেকের মাঝে। আনসারী সাহেব আয়েশ করে চুমুক দিলেন৷ তারপর তীর্যক নজরে তাকালো ধারার দিকে। ধারা এখনো ভীত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিললো সে। এতো সময় সে এবং দিগন্ত ই স্যারের সাথে কথা বলেছে। সে কি বুঝলেন সেটা তিনি প্রকাশ করেন নি। উপরন্তু শুধু তীর্যক নজরেই দেখে গেছে ধারার দিকে। তারপর সে শান্ত কন্ঠে বললেন,
“দিগন্ত তুমি ক্লাসে যাও। আর ধারা তুমি এখানে থাকো”
তারপর থেকেই তিনি ধারাকে দাঁড় করিয়েই রেখেছেন। যত সময় যাচ্ছে ধারার ভয় গাঢ় হচ্ছে। হিতে বিপরীত হবার ভয়। ভালো করতে যেয়ে যদি অনল আরোও বাজে ভাবে এই চোরাবালিতে আটকে যায় নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না ধারা। এর মাঝেই আনসারী সাহেবের গম্ভীর কন্ঠ কানে এলো,
“দেখো ধারা, তুমি যা বলছো আমি বুঝেছি। তোমার ধারণা তোমার ক্লাসমেটের একটা ভুল ধারণা হয়েছে। বুঝলাম। কিন্তু তোমার বা ওই ছেলেটা দিগন্ত, তার স্বীকারোক্তিতে খুব একটা যায় আসবে না। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিক। ডিসিশন আমরা তখন নিবো। তবে তোমাদের দুজনের স্বীকারোক্তিতে কিছুই প্রমাণ হয় না। চোর যদি এসে বলে সে চুরি করে নি তাহলে সত্য বদলায় না। আর আমি এখানে ছাত্রছাত্রীদের ইনভলভ করতে চাচ্ছি না, আমাদের বিষয় আমরা দেখে নিবো”
অবশেষে চা খাওয়া শেষ করে আনসারী সাহেব মুখ খুললেন। তার কথা শোনার পর পর ই ধারা প্রতিবাদ করে উঠলো,
“স্যার, মাধবীর কাছেও কিন্তু প্রমাণ ছিলো না। সেও দিগন্তের কথাটা শুনেই আপনাকে কমপ্লেইন করেছে”
“সেজন্য ই তো আমরা তদন্ত করছি। প্রমাণ হলে অনলের শাস্তি হবে না। এখানে আমার কিছুই করার নেই। সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে৷ তুমি বরং যাও”
বলেই আনসারী সাহেব তার যাবতীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আজকে ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস নিতে হবে। হাতে অনেক কাজ। মিটিং ও আছে দুপুরের পর। ধারার মুখে আষাঢ়ের মেঘ মেদুর জমলো। নিয়ম কাননের বাহানা দিয়ে স্যার তার কথা উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। কিন্তু হার মানবে না সে। শান্ত কন্ঠে বললো,
“স্যার, আপনাদের সন্দেহ তো আমার রেজাল্ট নিয়ে। আমার মতো খারাপ ছাত্রী কি করে ভালো করে। তাহলে আমি যদি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেই তবেও কি আপনাদের একই সন্দেহ থাকবে?”
এবার চোখ তুলে চাইলেন আনসারী সাহেব। তার চোখ চকচক করছে। তার মাথায় দ্বিতীয় বার পরীক্ষা নেবার চিন্তা ছিলো। তদন্ত যাই হোক সে আবারো পরীক্ষা নিতেন। এই রেজাল্ট বাতিল করে দিতেন। তবে ধারা নিজেই জালে পা দিয়েছে। সন্দেহ ধারাকে নিয়ে। তাহলে পুরো ক্লাসের পরীক্ষা নিয়ে কি হবে! ধারার পরীক্ষা নিলেই তো সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। আনসারী সাহেব হাসলেন, দুর্বোধ্য হাসি। তারপর বললেন,
“বুঝে বলছো?”
“জ্বী স্যার”
“যদি তুমি একই গ্রেড না পাও তবে কিন্তু তোমাকে রাস্টিকেট করার অধিকার প্রশাসন রাখে। সাথে অনলকে সাসপেন্ড। ভেবে দেখো”
ধারা শুকনো ঢোক গিললো। তার বুক কাঁপছে। কিন্তু অনলের জন্য এতোটুকু তার করতেই হবে। গাল ফুলিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
“জ্বী স্যার, আমি রাজি”
আনসারী সাহেবের হাসি প্রশস্ত হলো। তিনি বললেন,
“ক্লাসে যাও। তদন্ত শেষ হলেই তোমাদের জানানো হবে। আমার একার হাতে তো কিছু নেই”
আনসারী সাহেবের মুখ দেখে ধারার মনে হয়েছিলো তিনি ধারার প্রস্তাবে রাজী। কিন্তু তার শেষ উক্তি ধারাকে আবার হতাশ করলো। ক্ষণিকের জন্য উৎফুল্ল মুখশ্রী পুনরায় হতাশায় ডুবলো। ধারা নতমস্তক বেরিয়ে এলো আনসারী স্যারের কেবিন থেকে। কেবিন থেকে বের হতেই ধারার দেখা মিললো অনলের সাথে। সে কিছু বলার পূর্বেই অনল খপ করে তার হাত চেপে ধরলো। টেনে নিলে চললো ধারাকে। তার মুখশ্রী কঠিন হয়ে আছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। ধারা বারবার বলছে,
“আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছো?”
কিন্তু তার কথাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলো অনল। তার সারা শরীর ঈষৎ কাঁপছে। চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে আছে।
মিনিট দশেক বাদে ডিপার্মেন্টাল বিল্ডিং এর একটা ফাঁকা স্থানে এসে দাঁড়ালো অনল। হাতখানা ছেড়ে দিলো সে ধারার। ফর্সা হাত রক্তিম হয়ে গেছে রুক্ষ্ম হাতের পেষ্টনে। অসম্ভব রাগ হলো ধারার। সে তীব্র স্বরে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? উ’ম্মা’দের মতো টেনে আনলে কেনো?”
“স্যারের রুমে কেনো গিয়েছিলি?”
প্রচন্ড শীতল কন্ঠে কথাটা শুধালো অনল। তার চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে আছে তবে দৃষ্টি বরফ শীতল। ধারা তার চোখের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,
“কথা বলতে গিয়েছিলাম”
“সব জায়গায় তোর নাকটা ডুকাতেই হবে? পাকনামি না করলে হয় না? আচ্ছা! একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? একা একা কেনো গেলি?”
অনলের প্রশ্নের বর্ষণে খিল হারিয়ে ফেললো ধারার। অগোছালো ভাবে বললো,
“আমার দ্বারা চুপ করে থাকাটা সম্ভব হলো না। ঘটনাটা তো আমাকে কেন্দ্রিক। তাই আমি স্যারকে বোঝাতে গিয়েছিলাম”
“বুঝেছে সে?”
ধারা মাথা নামিয়ে নিলো। তারপর নাড়িয়ে নেতিবাচক উত্তর দিলো। অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমি তাকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার কথাটাও বলেছি। তবুও শুনে নি”
ধারার কথাটা শুনেই ক্রোধে ফেটে পড়লো অনল। তীব্র স্বরে বললো,
“তোর মাথা ঠিক আছে? দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিবি। তোর কি নিজেকে গণিতের বিদ্যাসাগর মনে হয়।সেই তো টেনেটুনে পাশ করিস। এ পেয়েছিস বলে মনে করছিস তুই বিদ্বান হয়ে গেছিস। এক লাইন লিখেই তো ইকুয়েশন ভুলে যাস। তোর মনে হয় তারা প্রশ্ন সোজা করবে। যদি সেম গ্রেড না উঠে তোকে রাস্টিকেট করবে! ওরা তো বসেই আছে প্রমাণ করার জন্য। কে বলেছিলো পাকনামি করতে তোকে?”
অনলের ক্রোধানলের মুখোমুখি এই প্রথম ধারা হয়েছে। ফ্যালফ্যালিয়ে সে তাকিয়ে রইলো অনলের দিকে। উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো, “আমি তো তোমার জন্য করেছি” কিন্তু উত্তরটা মুখ থেকে বের হলো না। শুধু চোখ থেকে বেয়ে পড়লো এক বিন্দু অশ্রু। না চাইতেও তার চোখে ভিড় হলো অশ্রুর। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“আমি পারবো, দেখো”
অনল সাথে সাথে দেয়ালে সজোরে আঘাত করলো। অনলের এমন আচারণে কেঁপে উঠলো ধারা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো অনল। তার শরীর কাঁপছে। আঘাত করায় হাতটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। বা হাত দিয়ে কপালের চামড়া টেনে ধরলো অনল। এরপর ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
“ধারা, সবখানে একটা নিয়ম থাকে। মনমতো করলেই হয় না। তোর কি মনে হয় আনসারী স্যার তোর কথা বিশ্বাস করেছে? না তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন। আর তুই সেই সুযোগ দিয়ে দিলি। আমাকে সাসপেন্ড করলেও তারা চাকরি থেকে তো বাদ দিতেন না। আমি তো বলেছিলাম আমি সামলে নিবো। একটু বিশ্বাস রাখতে পারলি না?”
“কিন্তু, আমি তো”
“আমি তোর সাহায্য চেয়েছি কি? চাই নি। তাহলে?”
এবার মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনল। তারপর বললো,
“অনেক সাহায্য করেছি। এবার ক্লাসে যা। আমার টা আমাকে বুঝতে দে।”
বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো অনল। ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। অনলের যাবার পানে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ধারা মাথা তুলে থাকালো নীলাম্বরের দিকে। আকাশেও যেনো বিষন্নতা ছেয়ে আছে। বিষাদমাখা স্বরে বললো,
“আমি সত্যি পারতাম। আমার জন্য নয়, তোমার জন্য আমি ঠিক পারতাম”
********
ক্লাস শেষ হয়েছে। বিকেলে ল্যাব থাকায় ক্যাফেটেরিয়াতে খেতে এসেছে বন্ধুমহল। ধারার মেঘ মেদুর মুখখানা দেখে বন্ধুরা বার বার জিজ্ঞেস করলো কিন্তু ধারা উত্তর দিলো না। রফিক মামা বন্ধুমহলকে দেখেই বললেন,
“কি গো সিনিয়র ভাই বোনেরা, কি হাল? দেখাই তো মিলে না। সিনিয়র হইয়ে কি হাওয়া হয়ে গেলে। এই রফিক মামারে ভুলে গেলা?”
“ভুলি নি বলেই তো আসা। দাও তো পাঁচটা গরম ভাত। আর তরকারি কি আছে?”
“আছে অনেক কিছুই আইসে দেখো”
রফিক মামার কথায় মাহি উঠলো। ধারাকে ঠেললো, কিন্তু সে উঠতে চাইলো না। সকালের ঘটনাটা এখনো চোখে ভাসছে। তখন হুট করে মাহি বলে উঠলো,
“এই ধারা, অনল ভাই এর সাথে ক্যাফের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই মেয়েটা কে?”
মাহির কথায় ধারার নজর গেলো ক্যাফেটেরিয়ার বাহিরে। তাদের ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেশ দূরে একটা গাছের পাশে অনলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। মেয়েটি আর কেউ নয় অনন্যা। ক্যাফেটেরিয়া থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের। না চাইতেই অনলের সাথে অনন্যার দাঁড়িয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু ঠেকলো। অকল্পনীয় কিছু চিন্তা মস্তিষ্ক ছেয়ে গেলো ধারার। বুকে অজানা ভয় হানা দিলো। ধারা উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে হেটে সেদিকে রওনা দিলো। মাহিও তার পিছু নিলো। অনল এবং অনন্যা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে কিছুটা দূরে একটা ঝোঁপের পিছনে আশ্রয় নিলো ধারা। সে লুকিয়ে তাদের কথা শুনবে। যদিও এই স্বভাব টি অতি কুৎসিত। কিন্তু তার মনে জন্মানো সন্দেহ এর চেয়েও কুৎসিত। সে যদি এখন সামনে যেয়ে দাঁড়ায় তারা কথা বলবে না। কিন্তু সেটা হওয়া যাবে না। আর সকালের ঘটনার পর অনলের সামনে যাওয়া মানে ক্ষুধার্ত বা’ঘে’র সামনে পড়া। তাই সে লুকিয়েই কথাটা শুনবে। মাহি এসে দেখলো ধারা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে আছে। মাহিও হাতু গেড়ে তার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এখানে কি করিস?”
“নিজের বরের উপর নজরদারি। টু শব্দ করবি না। শুনতে দে”
মাহি আর কথা বাড়ালো না। তখনই অনলের শীতল কন্ঠে শোনা গেলো,
“আমি তো একবার মানা করেছি অনন্যা তাহলে কেনো বারবার আমাকে অফার দিচ্ছো?”
“আমি তোর ভালো চাই অনল। রাইট নাউ তোর যা অবস্থা, তোর কি মনে হয় এ ছাড়া কোনো অপশন আছে? ওরা তোকে সাসপেন্ড করবে। ফলে তোর ক্যারিয়ার নষ্ট হবে। অস্ট্রেলিয়ায় অনেক সুযোগ তোর। তোর জিআরই স্কোর ভালো, আর এই প্রজেক্টে কাজ করলে তোর ভিসার কোনো প্রব হবে না। তুই হাইয়ার স্টাডি করতে পারবি। আমার সুপারভাইজার তোকে মাথায় করে রাখবে৷ আর সত্যি বলতে, এই প্রজেক্টটা তো তোর স্বপ্ন ছিলো”
অনন্যার কথা শুনেই তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় অনল। সাথে সাথেই ভেসে উঠলো ভার্সিটি জীবনের কথা। ভেসে উঠলো ইন্ট্রা ভার্সিটি প্রোগ্রামটির কথা। সেই কম্পিটিশনে একটি প্রজেক্ট নিয়ে অনল, অনন্যা এবং তাদের বাকি দুজন টিমমেট কাজ করছিলো। কম্পিটিশনে তাদের চারজনের কষ্টের ফল ছিলো এই প্রজেক্ট। সব চেয়ে বেশি আশা ছিলো অনলের প্রজেক্টটি নিয়ে। কিন্তু সব কিছু মূহুর্তেই তছনছ হয়ে গেলো। অনন্যা সবার অগোচরে সেই প্রজেক্টটি সাবমিট করলো অস্ট্রেলিয়ার একটি বড় ইউনিভার্সিটির টিচারের কাছে। ফলে খুব সহজেই তার স্কোলারশিপ হয়ে যায়। অনল যখন ব্যাপারটা জানতে পারে তখন সে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো অনন্যাকে। অনন্যা হেসে বলেছিলো,
“আমি তোকে ইউজ করি নি অনল, তোরা আমাকে সাহায্য করেছিস”
ঘটনাটি স্মরণ হতেই অসীম বিরক্তি এবং ঘৃণা মুখে ফুটে উঠে অনলের। সে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“আমার ফিউচার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না অনন্যা। তুমি বরং তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো। আমারটা আমি বুঝে নিবো। আসলে কি বলতো! তোমার মতো স্বার্থপর মানুষ অন্য কারোর কথা ভাবতেই পারে না। এর মাঝেও কোনো স্বার্থ আছে তোমার। আমার তো মনে হয় তুমি নিজের জন্যই আমাকে অফার দিচ্ছো। হয়তো সেই প্রজেক্টে কোথাও আটকেছো। ফলে আমাকে তোমার প্রয়োজন হচ্ছে। যাক গে! আমি আবারো বলবো, আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না। আমি এখানে আমার জীবনে সুখী আছি”
অনলের কথাটা শেষ হতেই হিনহিনে কন্ঠে অনন্যা বলে উঠলো,
“আমাকে সবসময় স্বার্থপর মনে হয় তোর! সবসময় আমাকেই দোষী করে এসেছিস। আচ্ছা তোর বউ স্বার্থপর নয়। তোকে বিপদে ঝুলিয়ে ঠিক ই তো গা ঢাকা দিয়ে আছে! কি করেছে তোর অপবাদকে মিটাতে?”…………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি