প্রপর্ণ পর্ব ২২

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(২২)
#কুরআতুল_আয়েন

রাত এগারোটার পর বুরাগ হাসি,খুশির রুমের দিকে গেলো।পর্দা আড়াল করে প্রথমে মুখ ঢুকিয়ে দেখলো তাদের পজিশন।হাসি,খুশি দুজনেই বিছানায় বসে পড়ছে আর,তাদের মাঝখানে বেলী আরামসে ঘুমিয়ে আছে।পাশেই বই,পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।বুরাগ বেলীকে দেখছে আর বিরবির করে বলছে,এই বুঝি ম্যাডামের পড়াশোনা।পড়তে এসেই ঘুম।বুরাগ ধীর গতিতে রুমে ঢুকে পড়লো।হাসি,খুশি বুরাগকে দেখে চেঁচিয়ে উঠতে নিলেই বুরাগ ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারা করে চুপ বুঝালো।বুরাগের ইশারা পেয়ে দু’জনেই সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেলো।বুরাগ বিছানার কোণায় আলতো চেপে বসে পড়লো।বুরাগ বসতেই হাসি ফিসফিস করে বললো,

–“ভাইয়া!বেলীপু আজকে আমাদের সাথে থাকবে।”

হাসির কথা শুনে বুরাগের মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গিয়েছে।কিছুক্ষণ,থম মেরে বসে পুনরায় হাসি মুখে বলে উঠলো,

–“ঠিকাছে!আজকে বেলী তোমাদের সাথেই থাকবে।”

হাসি,খুশি অত্যধিক আনন্দ হয়ে বুরাগকে জড়িয়ে ধরলো।বুরাগের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’জনে সিদ্ধান্ত নিলো বেলী মাঝখানে শুবে আর তার দুইপাশে তারা দু’জন শুবে।কিন্তু বুরাগ খুব চিন্তা করছে বেলীকে নিয়ে।যদি কোনো ভাবে হাসি বা খুশি বেলীর পেটে ব্যথা দিয়ে দেয় তাহলে কি হবে এই নিয়েই সে চিন্তায় পাগলপারা।অনেকক্ষণ বসে থেকে বেলীর ঘুমন্ত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।এই ঘুমন্ত চেহারা দেখে বুরাগ মনে হয় হাজার হাজার বছর পার করে দিতে পারবে।বুরাগের খুব ইচ্ছা করছে বেলীর ঘুমন্ত চোখ দুটিতে চুমু খেতে।কিন্তু,হাসি আর খুশির সামনে ভুলেও এই কাজটা করা যাবে না।হাসি,খুশি পড়া শেষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।খাতা নিয়ে দু’জনেই রওনা দিলো মা’য়ের রুমের দিকে।বুরাগ তাদের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“কোথায় যাচ্ছো তোমরা খাতা নিয়ে?”

দু’জনেই একসাথে বলে উঠলো,

–“মা’য়ের রুমে।হোমওয়ার্ক দেখাতে যাচ্ছি।”

–“ঠিকাছে যাও।”

হাসি,খুশি চলে যেতেই বুরাগ আস্তে করে বিছানা থেকে উঠে পড়লো।পর্দাটা ভালোভাবে টেনে দিয়ে বেলীর পাশে এসে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়লো।হাতের উপর ভর দিয়ে বেলীর দিকে তাকিয়ে রইলো।বুরাগ ভেবে পায় না,মেয়েটা কে যতোই দেখে ততই কেন ভালো লাগে!বারবার শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছা করে!

বেলী গভীর ঘুমে বিভোর।ঘুমন্ত বেলীর শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।বুরাগ মাথাটাকে ঝুঁকিয়ে বেলীর ঠোঁটের দিকে এগিয়ে গেলো।বেলীর ঠোঁটের ভাঁজে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেলো।সাথে ছোট করে একটা কামড়ও বসিয়ে দিলো।এমন হওয়ায় বেলী একটু নড়েচড়ে উঠলো।বেলী নড়তেই বুরাগ সরে আসলো।বেলী একটু এপাশ ওপাশ করে পুনরায় ঘুমে মত্ত হয়ে পড়লো।বুরাগ মিটিমিটি হাসছে আর বলছে,
‘কামড়ের জন্য চলে এসেছিলো আমাকে রাক্ষস বলে!
আর এখন,ঠিকই তো আমি ঘুমন্ত অবস্থায় কামড় বসিয়ে দিয়েছি।ভাগ্যিস উঠে নি!তবে উঠলে না জানি আর কি উপাধি দিয়ে দিতো!রাক্ষস থেকে কি কোনো ভালো উপাধি পেতাম?’

বুরাগ হাসি থামিয়ে কতক্ষণ বেলীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো।নিজের ডান হাত টা দিয়ে বেলীর পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কোমল কন্ঠে বলছে,

‘আমার ছোট্ট সোনার আগমনে আমি অনেক খুশি।তবে,একটাই আফসোস রয়ে গেলো!তুমি আসার আগে আমি তোমার আম্মুকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারি নি।তবে এইটা কোনো ব্যাপার না!প্রথম যেদিন তোমাকে নিজের কোলে নিবো সেদিনেই তোমার আম্মুকে বলে দিবো আমার ভালোবাসার কথা।তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো তোমার বাবার কাছে।তোমার জন্য বাবা অনেক অপেক্ষা করে আছি ছোট্ট সোনা!’

বুরাগ কথাগুলো বলতে গিয়েই কেঁদে দিলো।চোখে তার পানি চিকচিক করছে।প্রথম যেদিন শুনেছিলো বেলী মা আর সে বাবা হবে সেদিন বুরাগ কতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।তার মনের ভিতর কোনো একটা অনুভূতি কাজ করেছিলো ঠিকই তবে সেটা কিসের অনুভূতি ছিলো তা বুঝতে পারে নি।তবে এখন,বুঝতে পারে বাবা হওয়ার অনুভূতি।এমনকি নিজের ফোনের গ্যালারি তে ছোট একটা মেয়ে বাচ্চার ছবিও রেখে দিয়েছে।বুরাগ চোখের পানিটুকু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো।বেলীর পেটে কয়েকটা চুমু দিয়ে শব্দহীন ভাবে উঠে দাঁড়ালো।বেলীকে ঠিকঠাক ভাবে শুইয়ে দিয়ে বিছানার পাশ থেকে একটা কুশন নিয়ে নিলো।কুশন টা বেলীর পেটের কাছে দিয়ে লাইট অফ করে ডিম জ্বালিয়ে চলে গেলো।
—-
সকালে বেলীর ঘুম ভাঙতেই দুইপাশে হাসি আর খুশিকে দেখে উঠে পড়লো।চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো সে কোথায় আছে।যখন দেখেছে এইটা হাসি আর খুশির রুম তখনি তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে নিজের রুমের দিকে।

আফিয়া নামাজ সেরে একটু ছাঁদে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েছিলেন।এক ঘন্টার মতো ছাঁদে ব্যয় করে রান্নাঘরের দিকে যাবেন বলে ছাঁদ থেকে নেমে আসলেন।সামনেই বেলীকে দ্রুত হাঁটতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,

–“বেলী এইভাবে এতো তাড়াতাড়ি হেঁটে কোথায় যাচ্ছিস?”

শ্বাশুড়ি আফিয়ার কন্ঠ পেয়ে বেলী দম নিলো।সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো।মুখটাকে কাঁচুমাচু করে বললো,

–“রুমে যাচ্ছিলাম।কালকে হাসি,আর খুশির সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

–“তাই বলে,এইভাবে হেঁটে যাবি।তুই ভুলে গিয়েছিস,তোর ভিতরেও আরেকটা প্রাণ আছে।তার জন্য তোকে সাবধানে থাকতে হবে।এইজন্য,ছোট বয়সে মা হতে নেই।কাকে দোষ দিবো আমি!তোকে নাকি বুরাগকে।তোদের অন্তত প্রোটেকশন নেওয়ার দরকার ছিলো।”

বেলী লজ্জায় নিজেকে কুঁচকিয়ে ফেলেছে।মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আফিয়া নিজেই নিজের কথার ধরণ দেখে বেক্কল হয়ে গেলেন।কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললেন তাও বুঝতে পারছেন না।উনিও লজ্জায় এখন কিছু বলতেও পারছেন না।নিজেকে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঠিক করে নিলেন।বেলীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বেলীর মুখটা উপরে তুলে ধরলেন।মুখে মিষ্টি একটা হাসি টেনে বললেন,

–“আমার কথায় কিন্তু একদম মন খারাপ করবি না।আমি কিন্তু খুব খুশি আমার নাতি বা নাতনি আসবে বলে।তবে একটু সাবধানে চলবি।”

বেলী এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।শ্বাশুড়ি আফিয়ার কথায় মাথা নিচু করেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।আফিয়া বেলীর কপালে একটা চুমু খেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

আফিয়া চলে যেতেই বেলী হাফ ছাড়লো।গুটিগুটি পা’য়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।বিছানায় বুরাগকে দেখতে না পেয়ে চুপটি মেরে বিছানায় বসে পড়লো।মুখটা গোমড়া করে নিজের গা’য়ে লেপ্টে থাকা জামার প্রিন্ট টার দিকে তাকিয়ে রইলো।

বুরাগ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় বেলীকে বসতে দেখে কিছু বলতে নিবে তার আগেই বেলী ধড়াম ধড়াম করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।বেলীর যাওয়ার দিকে বুরাগ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।আর ভাবছে,কি হলো মেয়েটার।

বেলী কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম ফ্রেশ হয়ে আগের ন্যায় বিছানায় বসে পড়লো।বুরাগ,শার্টের উপরের বোতাম লাগাচ্ছে আর আয়নায় বেলীর মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে।শার্টের বোতাম লাগিয়ে বুরাগ বেলীর পাশে বসে পড়লো।বেলীর দিকে তাকিয়ে বললো,

–“কিছু হয়েছে তোমার?মন খারাপ কেন?”

বেলী খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বললো,

–“মন খারাপ না লজ্জা হচ্ছে বুঝেছেন।”

–“এই তুমি এতো দিনদিন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছো কেন?আগে তো এইরকম ছিলে না।”

বেলী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

–“আপনার তো এখন এইটাই মনে হবে।একটু আগে আমি কি সহ্য করে এসেছি তা তো আর আপনি শুনেন নি বা দেখেন নি।”

বুরাগ ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

–“কি হয়েছে?না বললে বুঝবো কিভাবে?”

–“একবারও কি জিজ্ঞেস করেছেন কি হয়েছে?”

–“এখন তো জিজ্ঞেস করছি।এখন বলো?”

বেলী কিছু বলে না চুপ করে বসে আছে।বুরাগ কতোক্ষণ বসে বেলীর দিকে তাকিয়ে রইলো।বেলীকে কিছু বলতে না দেখে অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো,নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।একটু পরেই অফিসে যেতে হবে।আজকে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে।

বেলী বুরাগের দিকে একবার চেয়ে নিলো।বুরাগ নিজের মতো ব্যস্ত।বেলী বুরাগকে উদ্দেশ্য করে মিনমিনে গলায় বললো,

–“আমাদের না প্রটেকশন নেওয়া উচিত ছিলো।”

বুরাগ চট করে পিছন ফিরে তাকালো।বেলীর দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

–“মানে?”

বেলী ভ্রুকুটি কুঁচকে বললো,

–“আপনি কি বুঝতে পারছেন না আমার কথা?আপনি কি বোকা মশাই?”

–“কিন্তু,হঠাৎ এইসব বলছো কেন?”

–“তার আগে আমার কথার উত্তর দিন।”

–“ঠিকাছে!উত্তর দিচ্ছি!তার আগে তুমি বলো,পিল গুলো খেলে না কেন?”

বেলী কিছু বলতে পারছে না বুরাগের কথায়।থম মেরে বসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।বুরাগ বিছানায় বসে বেলীকে নিজের হাঁটুতে বসিয়ে দিলো।বেলীর কোমড় টা নিজের সাথে চেপে ধরে কোমল কন্ঠে বললো,

–“কি হয়েছে বলো তো।হুট করেই এইসব কথা কেন বলছো?”

বেলী বুরাগের গলার আশেপাশে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তার কাছে এখন বুরাগের গলাটা খেলার যন্ত্র হয়ে গিয়েছে।এমনকি বুরাগের দাড়ি গুলোয় আলতো হাতে বুলিয়ে দিচ্ছে।মুখটাকে চুপসে বললো,

–“মা আজকে বলেছে,আমাদের প্রটেকশন নেওয়া উচিত ছিলো।এতো ছোট বয়সে মা হতে নেই।”

বুরাগ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বললো,

–“মা বলেছে।কিন্তু কেন?নিশ্চিয় তুমি কিছু করেছো।”

বেলী আমতাআমতা করে বললো,

–“আসলে আমি তাড়াহুড়ো করে রুমে আসছিলাম তাই দেখে মা এইটা বলেছে।”

বুরাগ রেগে গিয়েছে।চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো,

–“মা একদম ঠিক বলেছে।তুমি সাহস করো কীভাবে তাড়াতাড়ি হাঁটার।”

বেলী কিছু বলার সাহস পায় নি বুরাগের কথার পিঠে।বুরাগ কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে বেলীকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বেলীকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

–“ভুলেও আর এইভাবে হাঁটবে না।তোমাদের কোনো ক্ষতি হলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারবো না।তবে,পিল না খেয়ে ভালো করেছো,এতো তাড়াতাড়ি বাবা হওয়ার আনন্দ পাচ্ছি।আর,মা’র কথায় মন খারাপ করো না।”

বেলী বুরাগের কথা শুনে মনে মনে ভাবছে,মাত্র তো তিনমাস চলছে,এখনোই যদি এইরকম করেন তাহলে বাকি দিনগুলোয় কি করবেন উনি!!
—-
জাবেদা শিউলির কবরের সামনে বসে আছেন।নতুন জন্ম নেওয়া কচি ঘাসগুলোর উপর বসে একপ্রকার মনমরা হয়ে তাকিয়ে আছেন শিউলির কবর টার দিকে।শেষ বিকালের সূর্যের আলোটা জাবেদার চোখে পড়তেই চোখের কার্ণিশে লেপ্টে থাকা পানি গুলো মণিমুক্তার মতো চিকচিক করে উঠছে।শিউলির কবরটার আশেপাশে আগাছা জন্ম নিচ্ছে।জাবেদার আগাছা গুলোর দিকে চোখে পড়তেই তিনি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালেন।দু’হাত দিয়ে আগলে আগাছা গুলো পরিষ্কার করতে লাগলেন।চোখের পানি গড়িয়ে উনার বুকের আঁচলের সামনে এসে থামছে।পাশের সরু রাস্তায় কয়েকজন কৃষক হেঁটে যাচ্ছেন।হাতে তাঁদের ধান কাটার যন্ত্র।জাবেদাকে দেখছেন আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন,

‘বাবা,মা’য়ের সামনে সন্তানদের কবর দেখা মানে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করা।আহারে!অলি সাহেবের বউয়ের দুঃখ টা আমরা বুঝতে পারছি।মেয়ে যতোই খারাপ হোক না কেন সন্তান ছিলো তো।’

আরেকজন কৃষক বলে উঠলেন,

‘খারাপ না হইলে কি এইভাবে মাইরা ফেলতো।নিশ্চিয় কারোর সাথে কিছু ছিলো।’

জাবেদার কানে তাঁদের কথা কর্ণপাত হতেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে শিউলির কবরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—-
করিম এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে ছিলো।বাটন ফোন টা নিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখছে।নিজের মনে আজকে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।বারবার,প্রহর গুনছে রাত হওয়ার।কখন রাত হবে।আর রোকসানার কাছ থেকে ওইদিকের কোনো খবর না জানা পর্যন্ত তার শান্তি মিলছে না।এমনকি তার আব্বাকেও ফোন করতে পারছে না করিম।সব কিছু শোনার পর যদি বেঁকে বসেন তাহলে তো আর নিজেকে পালিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার কাছে।তাই সুযোগ বুঝে আব্বাকে হাতে রাখার বুদ্ধি ভেবে নিচ্ছে করিম।

দিনটি শুক্রবার হওয়ায় সবার কর্মস্থলেই বন্ধ।কর্মকর্তাদের জন্য এই দিনটি যেনো অনেকটা ঈদের মতো।শুক্রবার হওয়ায় রায়ান আজকে বুরাগদের বাসায় এসেছে।সকালে এসেছিলো,এখন বিকাল হয়ে এসেছে।চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সবার জোরাজুরিতে রাতে খেয়ে যাবে।বুরাগ এতোক্ষণ রায়ানের সাথে ছাঁদে ছিলো।কিন্তু বেলী বমি করায় তড়িঘড়ি করে রায়ানকে থাকতে বলে ছাঁদ থেকে নেমে রুমে চলে গেলো।রায়ান ছাদের কার্ণিশে হেলান দিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছে।একটা পা উঁচু করে দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছে।বাম হাত টা পকেটে গুজে রেখে ডান হাতে ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে।কালকেই কিনেছে ফোনটা।দূরের পুকুরের পানিটার দিকে আছে রায়ান।আচমকাই একটা শব্দ শুনতে পেয়ে রায়ান চট করে ছাঁদের দরজার দিকে তাকালো।সাদা ফ্রোক পড়া একটা মেয়ে বসে আছে ছাঁদের ফ্লোরে।হয়তোবা কোনোভাবে পড়ে গিয়েছে।ছোট ছোট চুল গুলো মুখের সামনে পড়ে আছে।রায়ান দ্রুত পা’য়ে এগিয়ে গেলো সামনে।হাঁটুগেঁড়ে বসে বললো,

–“পিচ্চি তুমি ঠিক আছো?”

খুশি মাথা তুলে সামনে তাকালো।রায়ানকে দেখে মুখটাকে ছোট করে নিয়েছে।রায়ান কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো খুশির দিকে।রায়ানের মুখ দিয়ে হুট করে বেরিয়ে আসলো,পুরাই পুতুল।রায়ান বুঝতে পেরেছে এটাই তাহলে খুশি।কারণ,ও এতোক্ষণ হাসিকে দেখেছে কিন্তু খুশিকে দেখেনি।দু’জনের চেহারা এক হলেও রায়ানের কাছে খুশি অনেক সুন্দর লাগছে।তার উপর খুশির বাম গালের উপরের কালো তিলটায় রায়ানের চোখ আটকে গিয়েছে।খুশি পড়ে গিয়ে লজ্জায় মাথায় নিচু করে ফেলেছে।ছোট তো কি হয়েছে অচেনা একজনের সামনে পড়ে গিয়ে তার ভিষণ লজ্জা করছে।মূলত,সে হাসিকেই খুঁজতে এসেছিলো।এতোক্ষণ পড়া শেষ করে ঘুম দিয়েছিলো।একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে সারা বাসায় হাসিকে খুঁজে না পেয়ে ছাঁদে চলে আসলো।তাড়াহুড়োয় ছাঁদের দরজার পাশে রাখা মাঝারি সাইজের ইটটায় পা বেজে ধপাস করে নিচে পড়ে যায়।

রায়ান আবারও বললো,

–“ঠিক আছো তুমি?”

খুশি হুট করে কেঁদে উঠলো।খুশির কান্নায় রায়ান কিছুটা অবাক হলো।রায়ান কিছুক্ষণ খুশির কান্নামাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে খুশিকে ধরে উঠে দাঁড় করালো।কিন্তু,খুশির হাঁটুতে আঁচড়ের দাগ দেখতে পেয়ে রায়ান আবার পুনরায় বসে পড়লো।জামাটা একটু তোলে,খুশির হাঁটুতে লেগে থাকা ছোট ছোট পাথর গুলো সরিয়ে দিলো।আর এইদিকে,খুশি কেঁদেই যাচ্ছে।রায়ান,আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ছোট একটা বালতিতে পানি দেখতে পেলো।খুশিকে কোলে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো।পানি নিয়ে হাঁটু ধুয়ে দিতে শুরু করলো।হাঁটু জ্বলতে শুরু করতেই খুশি রায়ানের চুল খামচে ধরে নিলো।রায়ান খুশির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।নিজের কাজ শেষ করে রায়ান উঠে দাঁড়ালো।ছাদে রাখা দোলনা টায় বসে পড়লো।নিজের সামনে খুশিকে দাঁড় করিয়ে খুশির কান্না ভেজা চোখ দুটো মুছে দিলো।কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,

–“আর কান্না করে না পিচ্চি!একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।”

খুশি মাথা নাড়িয়ে আর কিছু বলে নি।
রায়ান খুশির দিকে তাকিয়ে আছে একমনে।খুশির ফর্সা গাল গুলো লাল হয়ে আছে।খুশি এখনো নাক টানছে।রায়ান খুশির গালের দিকে নিজের ঠোঁট দুটো আগাতেই কিছুটা চমকে উঠে নিজেকে থামিয়ে দিলো।নিজেই নিজেকে ধিক্কার করে বিরবির করে বলতে লাগলো,

‘ছি!রায়ান ছি!ও একটা ছোট মেয়ে।তোর সাথে ওর বয়সের পার্থক্য দ্বিগুণ।আর,তুই কিনা এইরকম একটা মেয়েকে পছন্দ করে বসলি।আর একটু আগে কিই বা করতে যাচ্ছিলি।’

পরমুহূর্তেই রায়ান মুখটাকে কঠোর করে খুশিকে বললো,

–“নিচে যাও।”

খুশি ফ্যালফ্যাল চোখে রায়ানের দিকে তাকালো।রায়ানের কথা মতো নিচে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরতেই পুনরায় রায়ান আবার থামিয়ে দিলো।খুশি থামতেই রায়ান খুশির ছোট ছোট হাত দুটো ধরে নিজের দিকে ফিরালো।খুশির দিকে তাকিয়েই রায়ান খুশির হাত দুটোর তালুতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।এমতাবস্থায় খুশি কিছুটা কেঁপে উঠলো।খুশি রায়ানের দিকে তাকিয়ে বার কয়েক চোখের পলক ফেললো।রায়ান খুশির মুখের হাবভাব দেখে হেসে উঠলো।রায়ানের ঠোঁটের হাসি দেখে খুশিও নিজের অজান্তেই হেসে দিলো।কিছুক্ষণ পর রায়ান মুখটাকে আগের ন্যায় কঠোর করে চোখ দিয়ে ইশারা করে খুশিকে নিচে যেতে বললো।
খুশি রায়ানের ইশারা বুঝতে না পেরে সেও মাথা দিয়ে ইশারা করে’কি’বুঝালো।রায়ান চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

–“নিচে যাও।”

খুশি চমকে উঠলো রায়ানের চেঁচানোর গলার আওয়াজ শুনে।পরক্ষণেই খুশি দৌড়ে নিচে চলে গেলো।রায়ান বুকে হাত গুজে খুশির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here