প্রমত্ত অঙ্গনা
(৩)
কালো শাড়িটা পরে বেশ সেজেগুজে বসে আছে রিদিকা নতুন স্বামীর সাথে বাইরে বেড়াতে যাবে বলে কথা,আয়নায় নিজেকে দেখে যে নিজেরই প্রেমে মত্ত হচ্ছে, বার বার নিজেকে খুঁটিয়ে দেখছে আয়নাতে, সেই ক্ষণেই আদ্রিশ প্রবেশ করল কক্ষে,গিফ্ট বক্সটা এনে টেবিলের উপর রেখে বিছানাতে চিৎ হয়ে শুয়ে পরল,চেহারাতে মলিন একটা ভাব একবারও তাকাল না রিদিকার দিকে যে তার আশায় সেজেগুজে বসে আছে, রিদিকা কত সুন্দর করে শাড়ি পরেছে, বেশ সাজগুজ করেছে আদ্রিশ এসে ওর রূপে মোহিত হবে বলে,ওর তারিফে পঞ্চমুখ হবে বলে,আ**দ**রে ভরিয়ে দিবে বলে তাকে কিন্তু হল না তার ভাবনার মত কোনো কিছুই,আদ্রিশ মুহুর্তে সবকিছুতে জল ঢেলে দিল,বেশ অভিমান হল তাতে রিদিকার,মুখ ঘুমরো করে বসে রইল আদ্রিশ উঠে ওকে এভাবে দেখলে ওর অভিমান ভাঙাতে ছুটে আসবে বলে তবে হল না তার কিছুও,আদ্রিশ চিৎ হয়ে শুয়েই রইল ছাঁদের দিকে দৃষ্টি স্থীর রেখে,গভীর কিছু ভাবনান মোহিত সে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রিদিকার অভিমানটা আরও প্রখড় হল তাই উঠে এগিয়ে গেলো আদ্রিশের কাছে, আদ্রিশের একগালে হাত রেখে ওর মুখখানা নিজের দিকে করে নিয়ে বলল।
কী?এতো সুন্দর করে সাজলাম আর তুমি দেখছও না,ভাল লাগছে না বুঝি দেখতে আমায়?
আদ্রিশ রিদিকার কথার উত্তর না দিয়ে বলল।
আমরা হয়ত বিয়ে করে ঠিক করি নি রিদিকা।
কথাটা রিদিকার ভিতর অল্পক্ষণে ছা**ড়**খা**ড় করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখলো তাও নিজেকে সামলে নিল রিদিকা,বেশ স্বাভাবিক হয়ে বলল।
″এমনটা কেনো বলছ তুমি?″
″দেখো রিদিকা আমি জানিনা কখন কিভাবে আমি তোমায় ভালোবেসে গেছি,আঁখি পরে তুমি প্রথম মেয়ে যার প্রতি আমি আলাদা এক টান অনুভব করেছি,কিন্তু কথাটা যেভাবেই হোক আসল কথা হল আঁখির পরে।আঁখি আমার জীবনের প্রথম নারী,ওকে পাওয়ার জন্য আমি কী কী করেছি তা শুধু আমি জানি,ওর জায়গা কখনো কেউ নিতে পারবে না,তুমিও না।তোমার প্রেমে পরেছি যখন থেকে বোঝতে পারলাম তোমাকে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করতে থাকি,তোমাকে অবৈধ ভাবেও পেতে চাই নি তাই বিয়ে করে পেতে চেয়েছি তোমায়,এজন্য একটা না একটা কারণ খোঁজতাম,অবশেষে বাচ্চার কারণ পেলাম,কিন্তু যাই হোক যার জন্যই হোক এটাই সত্য আঁখির অবস্থান আমার জীবনে সব থেকে আলাদা,তোমাকে বিয়ে করার কারণ খোঁজেছি তবে আঁখিকে হারানোর কোনো কারণ আমি মেনে নিব না।আমি ওকে হারাতে পারব না।″
″এতই যখন ওকে ভালোবাসো তবে আমাকে কেন বিয়ে করলে?আমি তো জোর করি নি তোমায়।″
″এটাই তো ভুল করেছি।″
কিছু না বলে চোখের জ*ল ফেলতে শুরু করলো রিদিকা এবার।নতুন বউয়ের আঁখির জলে বেশ হয়**রা**ন হয়ে উঠল শোয়া থেকে আদ্রিশ।
কি করছ এসব রিদিকা? কেঁদো না প্লিজ।আমারই ভুল হুটহাট এমন কিছু করে যাওয়া ঠিক হয় নি আমার,কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে।তুমি ভয় পেয় না আমি তোমাকে ছাড়ব না,আর না তো আমি আঁখিকে ছাড়তে পারব,তোমরা দু’জনেরই আলাদা গুরুত্ব রয়েছে আমার জীবনে।তাই কান্না বন্ধ করো,আর হ্যাঁ আজ থেকে তুমি তোমার আগের রুমে থাকবে,এই রুমে একমাত্র আঁখির অধিকার,কাল রাতে তোমাকে এখানে আনাও আমার ঠিক হয় নি।না জানি কোথায় থেকেছে আঁখি সারারাত,অন্য কোনো রুমে থাকে নি এটা জানি আমি।তুমি তোমার রুমে থাকবে আজ থেকে, আমার রুমে আঁখি থাকবে আমার সাথে।
এগুলো যেন কথা নয় ই**ট**পা**ট**কে**ল ছিল যা ছুঁড়ে দিল আদ্রিশ রিদিকার বুকে।ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিদিকা আদ্রিশের দিকে,চোখে জল ভরে আছে তার।
প্লিজ লক্ষিটি কান্না করো না,আমি তোমাকে এভাবে আঘাত করতে চাই নি,কিন্তু অবস্থা বোঝতে পারছ তো,তুমি দেখো খুব জলদি আঁখি তোমাকে মেনে নিবে তখন আর কোনো কষ্ট থাকবে না।তোমার সব জিনিসপত্র তো তোমার রুমেই আছে,এখানে যা এনেছ আমি কাজের লোকদের দিয়ে তোমার রুমে পাঠিয়ে দিব।আর এখন আর বাহিরে যাওয়ার মুড নেই আমার,শাড়িটা পাল্টে নাও কেমন।
তারপর উঠে বেড়িয়ে গেল আদ্রিশ কোথাও।রিদিকা অতি স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পানে,তবে হাতের মুঠো শক্ত করে বিছানার চাদর খাঁমছে ধরল।
পাশে কেউ বসেছে এইমাত্র বোঝতে পারল আঁখি তাই আকাশের তরফ থেকে চোখ হটিয়ে পাশে তাকাল,দেখতে পেল শুভ্রতাকে,ভিতরে জ্বলন্ত আ**গু**ন ধামাচাপা রেখে নরম স্বরে বলল।
″আরে আপু তুমি?কিছু চাই?গল্প করতে আসছ বুঝি?″
″তুমি কি মানুষ না অন্য কিছু আঁখি?এত কিছুর পর এত স্বাভাবিক ব্যবহার করছ কিভাবে?তুমি তো এমন নও,ওই প**শু দের এক ইশারাতে উ**প**ড়ে ফেলার ক্ষমতা রাখো তুমি।তবে কেন এমন করছ বলো!″
″প্রথমত রিদিকা ওকে কি সাজা দিব,নিজের জন যদি ঠিক না থাকে তবে অপরের দো**ষ খোঁজা যৌক্তিক দেখায় না আপু,হ্যাঁ চাইলে আমি আমার পক্ষে ন্যায়টা নিয়ে আসতে পারি তবে তাতে যে তোমাদের সাথে অ**ন্যা**য় হবে সেটা ভেবে দেখেছ।আমি এতটা স্বার্থপর হতে পারি না আপু। ″
″মানুষ কতটা মহান হলে এমন অবস্থায়ও অন্যের কথা ভাবতে পারে,তোমার মত ভালোদের কপালে আল্লাহ তায়ালা ভালো রাখেন।যা হয় ভালোর জন্যই হয়,আদ্রিশ তোমাকে ডিজার্ভ করে না,তুমি দেখো আল্লাহ তোমার ভাগ্যে ভালো কিছু রাখবেন।″
উত্তরে কিছু বললো না আঁখি,মাথা রেখে শুয়ে পরল শুভ্যতার কোলে,নিজের আপন কোনো বোন নেই আঁখির,শুভ্রতাকে সবসময় নিজের বড় বোন মেনে এসেছে,শুভ্রতার কোলে যেন মাতৃ কোলের ভালোবাসার অনুভুতি পেলো আঁখি।আবেগ এইবার আর আটকাতে পারল না দু’হাতে মুঠো করে আঁকড়ে ধরল শুভ্রতার কাপড় আর শব্দ করে কেঁদে উঠল।হেচঁকি টেনে টেনে বলছে।
কেন রে আপু?কেন ও এমনটা করল?কী কমতি ছিল আমার ভালোবাসায়,ওর জন্য তো সব ছেড়েছি আমি,সব করেছি আমি,কখনো ওর অসুবিধে হোক এমন জিনিস করি নি তবে সে কিসের অভাবে অন্যত্র গমণ করল?কেন আপু বলো না?তুমি না বলতে আমি বড় ভাগ্যবতী,কপাল গুণে একটা স্বামী পেয়েছি, আমার জন্য পাগল,এমন স্বামী সবার হওয়া চাই,সবার কপালে এমন স্বামী জুটে না।তবে কি হল আমার এই কপালের?কোথায় গেল ওর সব ভালোবাসা?এটাই কি ছিল ওর ভালোবাসা?একেই কি বলে ভালোবাসা? বলো না আপু?বলো না?ও আপু বলো না?
অতি আবেগে পা**গ**লের মতো কান্না করে এসব বলছে আঁখি,আঁখির মাথায় হাত রেখে ঠোঁট কা**ম**ড়ে কেঁদে চলেছে শুভ্রতা,কি উত্তর দিবে সে।আঁখিকে বলার মতো শান্তনা স্বরুপ কোনো ভাষাই নেই শুভ্রতার কাছে।
দখিনা হাওয়ায় দোলছে গাছগাছালি,আজকে হাওয়া বেশ প্র*ব*ল,বাড়ির পিছনের দিকের একটা অংশের ইজি চেয়ারে বসে আছে আঁখি,বিকেলের এই দিকটায় এখানে এসে বসে বাগানের হরেক রকম ফলের সৌন্দর্য উপলব্ধি, ফুলের সুবাসে মন ভরে নেওয়ার অভ্যেস যে আঁখির প্রায় দিনের।এখানে কতো স্মৃতি জমে আছে আঁখির আদ্রিশের সাথে।
মনে পরলো এমনই এক দিনের কথা।
একদিন বিকেলে এখানে এসে বসতেই চোখ লেগে যায় আঁখির,এদিকে কো**র্ট থেকে ফিরে আঁখিকে ঘরে না পেয়ে চে**চাঁ**মে**চি**তে ঘর মাথায় তু*লে ফেলেছিল আদ্রিশ,মুখে একটাই বুলি ওর ফুলপরি কোথায়।ফুলপরি ডাকটা আঁখিকে আদর করে দিয়েছিলো আদ্রিশ,কারণ আঁখির ফুল খুব প্রিয়,আঁখিকে চোখে হারাতো সে হরদম,সেদিন খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে ঘুমন্ত অবস্থায় পায় আঁখিকে আদ্রিশ।টান দিয়েই তাকে কোলে উঠিয়ে নেয় আর গালে দিয়ে দেয় ভালোবাসার পরম,আচমকা এমনকিছু হয়ে যাওয়ায় হক**চ*কি**য়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে আঁখি।অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে আদ্রিশকে।
″তুমি?″
″হ্যাঁ আমি,কখন থেকে পা**গ*লে**র মতো খুঁজছি আর তুমি আয়েশ করে এখানে ঘুমুচ্ছো।″
″আরে একটা সার্জারি শেষ করে এসে বেশ ক্লান্ত লাগছিল।এখানে এসে বসতেই কখন চোখ লেগে গেল বোঝতে পারি নি।″
″তাহলে এই কথা,এখনি দূর করছি ক্লান্তি।″
আহ্লাদী করে কথাটা বলে আঁখির ঠোঁ**টে**র পানে এগুতে লাগে আদ্রিশ,তখন ই সেখানে শুভ্রতা এসে যায়।ওকে দেখেই আদ্রিশ থেমে যায় আর আঁখি তো লজ্জায় নেই।
ইশ আমিও আসার টাইম পেলাম না।আমি কিছু দেখি নি তোমরা চালিয়ে যাও।
মুখ ঢেকে কথাগুলো বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো শুভ্রতা,আঁখি বেশ লজ্জা পেয়ে বলল।
″তুমিও না,শুভ্রতা কি ভাববে এবার আমাদের নিয়ে?কোল থেকে অন্তত নামাতে পারতে।″
কে কি ভাবলো তাতে আমার কি?আমি আমার বউকে আদর করব কাউকে তোয়াক্কা করব কেন?দশ টা না পাঁচ টা না আমার একটা মাত্র বউ।
অতঃপর আঁখির অ*ধ*রে অ*ধ*র মিলিয়েই দিয়েছিল আদ্রিশ,সেদিনের কথা মনে পরতেই চোখ দিয়ে আবার জ*ল নামল,মুছে নিল আঁখি তা সযতনে।তখনি ফোন বেজে উঠল আঁখির,রিসিভ করল সে ফোনটা।
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
জি বলুন,
ম্যাম আপনার ডি*ভো*র্সে*র কাগজ রেডি,কাল সকালে পৌঁছে যাবে আপনার কাছে।
ধন্যবাদ,কাল সকালে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দিবেন।
অবশ্যই ম্যাম।
আর হ্যাঁ কথাটা যেনো মিডিয়াতে না যায়।
আমি সেদিকে পুরো খেয়াল রাখব ম্যাম আপনি চিন্তা করবেন না।
ঠিক আছে,আল্লাহ হাফেজ।
আল্লাহ হাফেজ।
কলটা কেটে দিল আঁখি,কতোই না ভালোবাসা ছিল তাদের সম্পর্কে।এমন একটা সম্পর্ক কখনো ভাঙবে কেউ কল্পনাও করে নি।স্কুল কলেজের সেরা জুটি ছিলো আঁখি আদ্রিশ।,কলেজের সবাই একনামে তাদের জুটিকে জানত,দ্রিশঁখি জুটি।বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা কোনোকিছুতেই তাদের জুরি ছিল না কেউ।তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে জানলে হয়ত অনেকেরই বিশ্বাস হবে না,কেউ তো মজা বলে হেসে ফেলবে।
উঠে দাঁড়াল আঁখি এবার,এই বাড়িতে তার শেষ সময় এসে গেল অবশেষে, তিন বছরের গড়া সংসারের এক রাতে বিদায়ের ব্যবস্থা করা অনেক বড় ক*ঠি*ন এক জিনিস বলে মনে হচ্ছে আঁখির।
চলবে…….
আরোহী নুর……..