প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব -১৬

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(১৬)

আঁখি কোনোরূপ গেটের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে,দূর্ভাগ্যবশত আজকে তার গাড়িটা ড্রাইবার গেটের বাইরেই পার্ক করেছে,আঁখির গার্ড দু’দিক থেকে তাকে আগলে রিপোর্টারদের ভিরের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে,এদিকে রিপোর্টারেরা তো সবাই নাছোড়বান্দা,তারা ঘেরাও করে রেখেছে তাকে,বেরুতেই দিচ্ছে না।এক এক জন এক এক কথা বলছে।

ডা.আঁখি আপনি কি আদ্রিশ রাহমানকে স্বইচ্ছায় ডিভোর্স দিয়েছেন?

ডা.আঁখি রিদিকা নামের মেয়ের সাথে কি আদ্রিশ রাহমানের বিয়ের আগ থেকেই অবৈধ সম্পর্ক ছিলো?

ডা.আঁখি, কিছু তো বলেন,আপনি এভাবে জবাব না দিয়ে গেলে কিন্তু সত্যতা চাপা পরে থাকবে না,আমাদের আসল সত্যটা বলুন।

আরে এ কী বলবে!হয়তোবা নিজেরই কোনো সমস্যা ছিল, আরে স্বামী কি আর স্বাদে বউ ছেড়ে অন্যত্র যায়,হয়তবা নিজের কোনো অক্ষমতা আছে নয়ত অন্য কোনো পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক, তাই তো মুখ ঢেকে পালাচ্ছে।

কথাটা কানে যেতেই পা থামিয়ে নিলো আঁখি,পাক ফিরিয়ে উল্টো হাতে একটা থাপ্পড় বসালো সে রিপোর্টারের গালে,টাল সামলাতে না পেতে সে লোকটা দাঁড়ানো থেকে পরে গেল।সবাই হতবাক হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।এবার আঁখির সবার উদ্দেশ্য গর্জে উঠে বলল।

আর কে কি জানতে চাও সামনে এসে বলো?সামনে এসো বলছি,ছিঃ এ দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে আমার লজ্জা করছে,আপনারা এতজন শিক্ষিত লোক আমার কাছে এসেছেন আমার স্বামীকে আমি কেন ছেড়েছি তা জানতে,যেখানে আদ্রিশের কাছে আপনাদের মধ্যে একজনও হয়ত এখনও যায় নি–আমি তাকে কেন ছেড়েছি বিষয়টা জানতে।কারণ আপনাদের একজন নারীকে হেনস্তা করতে ভালো লাগে,তারভুল ত্রুটি খোঁজে বার করাই তো আপনাদের অন্যতম শখের একটা অংশ,সংসার ভেঙেছে নিশ্চয়ই এতে নারীর কোনো ভুল ছিল,ধর্ষণ হয়েছে নিশ্চয়ই এখানেও তারই কোনো দোষ ছিল,এমনিই কেন একটা ছেলে তাকে ধর্ষণ করবে!আপনাদের তো শুধু মশলাদার খবর চাই,পীড়িত মেয়েদের পক্ষে কতো কথা লিখে পত্রিকায় ছাপাবেন,টিভিতে দেখাবেন,অতঃপর ৬-৭ দিন পর তার আর কোন খোঁজ নিবেন না,সেই অপরাধীকে আদোও কি ধরা হয়েছে বা তার শাস্তি হয়েছে তার খোঁজ আর নেওয়া হয়ে উঠে না আপনাদের,নারীদের নিয়ে খবর দিলে খবর বেশি ভাইরাল হবে,আপনাদের লাভ হবে,নাম হবে বেশি তাই তাদেরই হেডলাইনে রাখতে চান সবসময় কিন্তু তাদের সম্মান করতে চান না একচুলও,অশিক্ষিতদের তো ছাড় দেওয়াই যায় কিন্তু আপনাদের মতো শিক্ষিতদের এসব কর্মকাণ্ড বেশি খারাপ লাগে।ছিঃ…জানতে চান না আমার স্বামীকে আমি কেন ছেড়েছি,কারণ ও আপনাদের দলেরই একজন ছিলো,নারীদের প্রতি বৈষম্য রোধ করার চিন্তা মাথায় রাখলেও নিজের প্রথম স্ত্রীকে হাতের মুঠোয় দমিয়ে রাখতে চেয়েছে সে।এমন স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া তে খুব কম জিনিস প্রাণে মে*রে ফেললেও কষ্ট দূর হবে না আমার মনের।

সবাই হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঁখির এমন কার্যকলাপ আর জবাবে,কেউ যেন আর কোনো কিছু বলার সাহস জোটাতে পারল না,আঁখি গাড়িতে উঠে চলে গেল।

আদৃত ডা.আশরাফ খানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে,আগামীকাল থেকেই সে উনার হাসপাতালে জয়েন হবে।বিছানায় বসে ল্যাপ্টপে কিছু কাজ করছিল তখন ফোন বেজে ওঠল তার হঠাৎ, রিংকি নাম টা দেখে বেশ বিরক্ত হলো আদৃত,একবার ফোন কাটলে আবারও কল আসলো,এভাবে ১০ তম বার ফোন উঠাল আদৃত, রিংকি আহ্লাদী করে বলল।

″কি আদৃত ডিয়ার ফোন কেন ওঠাচ্ছিলে না?কোথায় আছো তুমি?বাংলাদেশে গিয়ে তো ভুলেই গেছো আমায়।″

″আমেরিকায় থাকতেই কখন মনে করতাম তোমায়। ″
বিড়বিড় করে কথাটা বলল আদৃত।

″কি বললে তুমি?″

″কেনো ফোন করেছ আগে সেটা বলো?″

″তোমাকে খুব মিস করছিলাম তাই ফোন করলাম,কবে ফিরছ বলো?″

″আমি আর আসব না,দেশেই থাকব।ভালো থেকো।″

কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল আদৃত রিংকিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।

এদিকে আদৃতের মা তার কক্ষেই আসছিলেন তখন দরজার বাইরে থেকে কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পান উনি,যাতে খুশিতে আত্নহারা অবস্থা হয় উনার মুহুর্তেই।

আঁখি আজ অনেক বিরক্ত,ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে,যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখ, গ্লানি,কোনো দুঃশ্চিন্তা, কোনো পিছুটান।জীবনটা এমন কেন হলো আঁখির!কতো সুন্দর ছিল সেই শৈশব যেখানে ছিল না কোনো হতাশা,কোনো দুঃশ্চিন্তা,চোখ বন্ধ করলেই যে প্রশান্তির ঘুম ছেঁয়ে যেত চোখ জুরে,আর এখন রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কাটাতে হয় আঁখিকে।খুব করে ইচ্ছে করছে আঁখির আবারও সেই শৈশবে চলে যেতে,বাবা মায়ের কোলে আহ্লাদী করে শুয়ে থাকতে।যা চাইলেও এখন করতে পারবে না আঁখি।
মন বড় অস্থির, মা বাবার সন্নিকটে থাকতে চায় এবার আঁখির মন,আশরাফ খানের প্রস্তাবে সাথে সাথে সম্মতির খবর পাঠিয়ে দিয়েছে উনার কাছে।তাকে আশরাফ খান দু’দিন পর জয়েন হবার জন্য বলেছেন,কিন্তু আঁখি বাবার পাশে যাওয়ার ব্যাকুলতা আর সয়ে উঠতে পারছিল না,তাই আগামীকাল থেকেই জয়েন করার আর্জি রাখল,যাতে মানা করলেন না আশরাফ খান,মেয়েকে দেখার অধীর এক আগ্রহ যে উনার মনেও সুপ্ত আছে।

আদ্রিশ ক্ষিপ্ত মেজাজে বাড়ি ফিরল,উভয় গালেই আঁখির দেওয়া থাপ্পড়ের দাগ,বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখল রিদিকা তার মায়ের পা ধরে কান্না করছে আর তার মা রিদিকাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না।রিদিকা কেঁদে কেঁদে বলছে।

আমাকে আর মারবেন না মা দয়া করে,আমি কখনও আর এমনটা করব না,আপনার পায়ের ধুলা হয়ে পরে থাকব,আমাকে প্লিজ ঘর থেকে বের করবেন না।

আদৃত ছোটে গিয়ে রিদিকাকে উঠাল,তার বাম হাতের উপরের বেশ জায়গা পো*ড়ে গেছে,গালেও আঙুলের ছাঁপ,আদ্রিশ বেশ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল।

″কি হয়েছে রিদিকা?″

″কই কিছু না তো,তুমি কখন আসলে?তুমি রুমে যাও আমি আসছি।″

″কি হয়েছে রিদিকা বলবে তো?″

″বলছি তো কিছু হয় নি।″

″কি হয়েছে রিদিকা বলো আমায়?″

আদ্রিশ এবার বেশ রেগে গর্জে ওঠে জিজ্ঞেস করলে রিদিকা বেশ কেঁপে উঠে বলল।

″আমি আজকে রান্না করে তরকারির পাত্র সরিয়ে আনছিলাম কিন্তু হাত থেকে পিছলে পাত্রটা নিচে পরে যায়,তখন পাশে শুভ্রতা ভাবি দাঁড়িয়ে ছিলেন যার ফলস্বরূপ উনার পায়ের ওপর কিছু গরম তরকারি পরে আর উনার পা অনেকটা জ্বলে যায়, মা এর জন্য আমাকে দোষী ভেবে আমার গালে থাপ্পড় মেরে বসেন, হাতে গরম তরকারির বাকি অংশ ঢেলে দেন।প্লিজ তুমি এসব নিয়ে কোনো কথা বলো না,তুমি রুমে যাও,এসব আমরা শাশুড়ি বউয়ের বিষয় তুমি মাঝখানে এসো না।″

″বাবা আমি কিছুই করি নি,ও মিথ্যে বলছে।তুই জানিস আমি কেমন মানুষ।″

″এজন্যই তো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এসব তুমি করেছ,ছিঃ মা, আমি সবসময় তোমাকে মা রুপে আদর্শ মানতাম,কারণ তুমি কখনও আমার আর ভাইয়ার মধ্যে যেমন ভেদাভেদ করো নি তেমনটা আঁখি আর ভাবিকেও একই দৃষ্টিতে দেখেছ,নিজের মেয়েদের মতো আদর করেছ,তবে তুমি রিদিকার সাথে এমনটা কি করে করতে পারলে!″

″আদ্রিশ,কথা শুনো,রিদিকা মিথ্যে বলছে,মা এমন কিছু করেন নি,ও ইচ্ছে করে ওসব করেছে।″

″এনাফ ভাবি,ও কি পা*গ*ল যে নিজেকে এভাবে নিজে আঘাত করবে!গতকাল যখন রিদিকা বলেছিল তুমি ওর হাতে খামছি দিয়েছ আমি বিশ্বাস করতে পারি নি।ছিঃ তোমরা এতটা জগণ্য,আঁখি সক্ষম ও সবল ছিল বলে ওর সাথে কিছু করতে পারো নি তোমরা,আর রিদিকাকে অসহায় ভেবে এমনটা করছ তোমরা তাই না?কিন্তু এ ভুল দ্বিতীয় বার করো না বলে দিলাম,আঁখির মতো রিদিকা ও আমার স্ত্রী, ওর সাথে আবারও যদি কোনো খারাপ ব্যবহার করতে দেখি তোমাদের তবে আমি ভুলে যাব তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে।″

অতঃপর রিদিকাকে ধরে নিয়ে কক্ষের দিকে হাঁটা ধরল আদ্রিশ।

শুভ্রতা আর আদ্রিশের মা জাহানারা রাহমান তাকিয়ে রইলেন শুধু তাদের যাওয়ার পানে।

″আমার ছেলে আর আমেরিকা যাবে না।আল্লাহ রহম করলেন অবশেষে, ওর সাথে বিয়ের কথা বলি না যদি আবার আমেরিকা চলে যায়,যাক এবার নিশ্চিত হলাম,এখন একটা লক্ষি মেয়ের খোঁজ পেলেই হলো।″

″মা,তুমিও না,সারাদিন কি ভাইয়ার বিয়েই ঘুরে তোমার মাথায়?তোমার এই বিয়ের চাপের ভয়েই ভাইয়া হয়ত ছয় বছর দেশে আসেন নি।এখন আবার এসব শুরু করলে আবার চলে যাওয়ার জন্য না উঠেপরে লাগেন।″

″তবে কি করব বল?ওর বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। ″

″মা তুমি চিন্তা করো না তো,ভাইয়া এডাল্ট,জোর করে তো তুমি উনাকে বিয়ে করাতে পারবে না,নিজের জীবন ভাইয়াকে সামলে নিতে দাও দেখবে ভাইয়া ঠিকই একদিন এগিয়ে যাবে।″

″আর কতো রে মা?আঁখি চলে যাওয়ার পর থেকে আমার ছেলেটাকেই হারিয়ে গেলাম আমি।আর কবে ফিরে পাব ওকে আমি।″

″মা নিরাশ হয়ো না, তুমি দেখে নিও আল্লাহ ভাইয়ার দিকে ঠিকই মুখ তুলে তাকাবেন।উনার জীবনে খুব জলদি সুখ চলে আসবে।″

আজ আদৃতের খুশি হাজারগুণ বেড়ে গেছে।আশরাফ খানের কাছে নিজের সাথে নতুন কোনো ডাক্তার উনার মেডিকেল কলেজে নিয়োগ হবেন কি না তা জানতে চাইলে উনি আদৃতকে তার লিস্ট দেখালেন।যেখানে আঁখির নাম দেখে যেন পাহাড় সমান প্রাপ্তি নিমিষেই পাওয়া হয়ে গেল আদৃতের,আঁখি আজ থেকেই জয়েন হবে বিষয়টা তার খুশিতে অতিরিক্ত আমেজ জুরে দিলো।খুশিতে মন আজ যে নাচতে ইচ্ছে করছে আদৃতের, সাত সকালে ঘুম ভেঙেছে,সময় যেন কাটছেই না তার,কবে হাসপাতালে যাওয়ার সময় হবে আর কবে সে তার আঁখিকে দেখতে পাবে।মনের উথালপাতাল ভাব আজ হয়ত আঁখিকে দেখার আগ অব্দি কমবেই না।মেরুন রঙের একটা শার্ট পরেছে।শার্টটা আঁখির দেওয়া,সেদিন হঠাৎ এই শার্ট টা নিয়ে হাজির হয়েছিল আঁখি আদৃতের সামনে।

″আজকে আপনি এই শার্টটা পরবেন।″

″কেন?আমি তোমার দেওয়া শার্ট পরব কেন?তাছাড়া আমার রঙিন জিনিস পছন্দ না।″

″কোন শোকে জীবন সাদা কালো করে রেখেছেন আপনি শুনি?হ্যাঁ এটা জানি আপনাকে কালো রঙেই বেশি মানায়,কিন্তু অন্যান্য রঙেও মাশাআল্লাহ খারাপ লাগবে না।এই মেরুন রঙ আপনার উপর যা লাগবে।″

″আমি পরব না এটা।″

″আপনাকে পরতেই হবে।আর না পরলে আপনি ভালো করে চেনেন আমায়,ভরা সমাজে আমার হাতে গায়ের শার্ট না ছেড়াতে চাইলে এটা ভালো ভালোয় পরে বাইরে আসেন,এখন আমি রুম থেকে যাই আপনি শার্ট পরুন কেমন।″

কথাটা মনে পরতেই আদৃতের মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটল।হাসিটাতেও লুকিয়ে আছে আঁখির স্মৃতি, আঁখি বলত।

ডা.আদৃত সবসময় হাসেন না কেনো আপনি?আপনাকে হাসলে যা লাগে।

অবশেষে আঁখির পাশে থাকার, তাকে ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ আদৃত পেয়ে গেল।হাতছাড়া করবে না এ সুযোগ প্রাণ থাকতে আর সে প্রেমিক পুরুষ মনে পুষে নিয়েছে তীব্র এক আকাঙ্খা।

আঁখির পছন্দ অনুযায়ী আজকে তৈরি হলো আদৃত, তাকে চোখ ভরে দেখার অধিকার যে শুধুই তার সুখপাখির।

আঁখির মন আজকে বেশ ভালো।অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ফুরালো তার।লম্বা একটা কুর্তি পরে চোখে কাজল টানল আঁখি,চুলগুলো আজ ছেড়ে দিলো,হাতে ঘড়ি পরল,কানে হালকা দুল ও পায়ে পায়েল দিলো,তারপর এপ্রোণ পরে বেড়িয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

চলবে……..

আজকে ভালো মতে রিচেক দেইনি ভুলত্রুটি ক্ষমাপ্রার্থী। আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here