#পর্ব_২১(রহস্য উদঘাটন২)
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
রাত যতো গভীর হচ্ছে প্রহরের দৃষ্টিসীমা ততো ঘোলাটে হচ্ছে। কতোগুলো রাত যে সে নির্ঘুম কাটিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। চোখ জুড়ে নিদ্রাকন্যাদের আগমণ। অতি সন্তপর্ণে আলোকে নিজের সাথে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। আগামীকাল থেকে আবার শুরু নতুন সূত্র খোঁজা। এদিকে রেদোয়ানের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সে কিয়াকে কাছে টানতে পারছে না। কিয়া যাতে কিছু বুঝতে না পারে তাই কিয়াকে বাবার বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।
সকালে নতুন সূর্য নতুন আশার আলো নিয়ে হাজির। কার জীবনে কি মোড় নিবে নির্ধারণ খুব জলদি হবে। প্রহর নাস্তার টেবিলে এসে বসার পর রঞ্জনা খালা ওকে নাস্তা দেন। শিতল ও নিয়াজও বসে। প্রহরকে বলে,
“স্যারকে মেডিসিন, ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে?”
“হ্যাঁ। আমি দিয়েছি। উনি এখন বারান্দায় বসে আছেন।”
“আচ্ছা। শোন, আজ আমি আলোর জন্য ঢাকা থেকে ডাক্তারকে আসতে বলেছি। আমাদের ফ্রেন্ড ছিল মনে আছে? ত্রিশাল ঘোষ?”
শিতল উৎসাহী হয়ে বলে,
“হ্যাঁ ত্রিশাল। নিউরোলজিস্ট।”
“হ্যাঁ। ও আসবে। আলোর অবস্থা দ্রুত উন্নতি হোক চাই। তাছাড়া এখানকার ডাক্তাররা ভালো হলেও শত্রু তো এখানেই। কখন কি করে বসে! রিস্ক নিতে চাইনা। ত্রিশাল এখানেই এসে উঠবে। তার জন্য আমি সিলেটে জবের ব্যাবস্থা করেছি।”
প্রহরের সাথে শিতলও একমত। নিয়াজ বলে,
“ত্রিশালকে বলিস আরমান স্যারের ট্রিটমেন্টও করতে।”
প্রহর বলে,
“হুম। বাবা-মেয়ে দুইজনের জন্যই। খালাজান?”
প্রহর রঞ্জনা খালাকে একটু আওয়াজ করে ডাকলে তিনি রান্নাঘর থেকে এসে বলেন,
“বলো।”
“নিচের পশ্চিমের দুই নাম্বার ঘরটা ঠিক করতে হবে। স্যারের জন্য তো আপনি পশ্চিম দিকের একটা ঘর পরিষ্কার করেছেন। তাই অন্যটা পরিষ্কার করতে আমি লোক আনব। তাকে চোখে চোখে রাখবেন আপনারা।”
“আরে আমি আর শিতল মিলে করে দিবো। শুধু শুধু বাহির থেকে লোক কেনো আনবে?”
প্রহর হালকা হাসে। রঞ্জনা খালার কষ্টের কথা চিন্তা করেই সে বাহির থেকে লোক আনছে।
“না খালা। আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। আপনারা আছেন বলেই আমি নিশ্চিন্ত।”
রঞ্জনা খালা হালকা হাসেন। নাস্তা শেষে প্রহর নিজ ঘরে গিয়ে আলোর ললাটে উষ্ণ স্পর্শ এঁকে বেরিয়ে পরে।
__________
অন্ধকার ঘরে বসে টেবিলের উপর গোলাকার পেপারওয়েটটা ঘুরাচ্ছে। দৃষ্টি তার সম্মুখে রাখা ছবির ফ্রেম গুলোর দিকে। প্রথম ছবিটাতে ‘প্রহেলি শেহমাত’ যে কীনা রেদওয়ানের জন্মদাত্রী!
অতীত,,_______________
রেদোয়ান শাহ হচ্ছে আমির শাহ এর বেওয়ারিশ সন্তান। যে গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন আমির শাহ প্রহেলিকে এক প*তিতা*লয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। প্রহেলির অন্তঃসত্ত্বার খবর তখন প্রহেলিও জানতেন না। প*তিতা*লয়ে তাকে বি*ক্রির পর যখন প্রহেলি মুক্তির জন্য কাঁদতে কাঁদতে বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিলেন তখন সেখানকার সর্দারনী নাড়ি পরীক্ষা করে দাই ডাকার পর অন্তঃসত্ত্বার খবরটা জেনেছিল। জ্ঞান ফেরার পর প্রহেলিকে সংবাদটা দেওয়া হলে সে সর্দারনীকে অনুরোধ করেছিল আমিরকে খবরটা জানাতে কিন্তু আমির তো প্রহেলিকে বিক্রি করে দিয়ে নিজের সিমকার্ডটা ফেলে দিয়েছিল যাতে কোনো ঝামেলায় না পরে। আমিরের ব্যাপারে হতাশ হয়ে প্রহেলি উপায়ন্তর না পেয়ে পায়ে ধরে অনুরোধ করে, তাকে এসব কাজ না করায়। সে বুয়ার কাজ করতেও রাজি। সবার সব কাজ করে দিবে তাও এমন খারাপ কাজে যেন তাকে এই সময়ে না জড়ায়। সর্দারনী ভেবে দেখল। তাছাড়া প্রহেলি অনেক রোগা। তাকে কিনতেও বেশি খরচ হয়নি এমনকি যে বিক্রি করেছে তারও ডিমান্ড ছিল না। যেনো ঘার থেকে এক বোজা চিরজীবনের মতো নামাতে পারলে রক্ষে!
প্রহেলির জীবন সেখানেই কাটতে লাগল। একে একে আট মাস পেরোলো। এই আট মাসে অনেক সই বানিয়েছে প্রহেলি। প্রসববেদনা উঠলে দাইমা ডাকিয়ে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। চেহারায় কেমন রাজকীয় ভাব। হবে নাই বা কেনো? জমিদার কন্যার পুত্র তো! সন্তান জন্ম দিয়ে প্রহেলি শয্যাশায়ী হলেন। নিজের সন্তানের দেখভালও করতে পারতেন না। এমতাবস্থায় সর্দারনী প্রহেলিকে আর রাখতে চাইলেন না। তার ভাষ্যমতে, কোনো কাজ না করে শুধু শুধু অন্নধ্বংস করছে প্রহেলি। সর্দারনী প্রহেলিকে বের করে দিতে চাইলে প্রহেলির এক সই কাজল, প্রহেলিকে নিজের খরচে রাখলেন। নিজে দ্বিগুণ কাজ করে হলেও প্রহেলি ও তার সদ্যজাত সন্তানকে আগলে রাখতেন। সর্দারনী আর মানা করল না তাছাড়া প্রহেলির সন্তানটা একটু বড়ো হলে একে কাজে লাগিয়ে দিবেন নয়তো বিক্রি করে দিবেন।
এক বছরের মাথায় প্রহেলি মা*রা গেল! প্রহেলির অতীতের সবকিছু জানত কেবল কাজল। কাজল প্রহেলির সন্তান রেদওয়ানকে নিজের সন্তান মনে করে বড়ো করতে লাগলেন। কাজলের এই প-তিতা*লয়ে আসার কারণ তার কখনও বাচ্চা হবে না। তাই জন্য তাকেও তার স্বামী এখানে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিল। কাজলকে ডিভোর্স দিলে কাজলের শ্বশুর-শাশুড়ি কাজলের স্বামীকে ত্যাজ্য পুত্র করতো বলে কাজলের স্বামী কাজলকে সরাতে এই পন্থা অবলম্বন করেছিল।
রেদওয়ান বড়ো হতে লাগল কাজলের কাছে। কাজল ওকে ওর বাবা-মা, বংশ সব সম্পর্কে অবগত করেন যা যা প্রহেলি ডায়েরিতে লিখে গেছে। প্রহেলির ডায়েরি লেখার অভ্যেস ছিল। কোথাও গেলে ডায়েরিটা কাঁধছাড়া করতেন না। সেখানে সবার ছবিও ছিল। রেদওয়ান তার মায়ের দুঃখগুলোকে পড়ে নিজের মনে সবার জন্য রাগ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। বড়ো হতে লাগে প্রতিশো*ধের স্পৃহায়। কাজলও বুঝতে পারেনি সেই ছোটো ছেলের মনে কিসের জন্ম হয়েছিল। প*তিতা-ল*য়ের সর্দারনী রেদোয়ানকে বিক্রি করতে চেয়েছিল কিন্তু রেদোয়ান প্রত্যেকবার ফিরে এসেছে। কাজলকে সে মায়ের নজরে দেখে। সেই কাজলের কাছে জীবনের চৌদ্দ বছর থাকার পর কাজলের মৃত্যুর পর চিরতরে একা হয়ে নিজের লক্ষ্য পূরণে অগ্রসর হয়। আগে থেকে খোঁজখবর নিয়ে এক নিঃসন্তান দম্পতির গাড়ির সামনে ইচ্ছে করে চলে আসে। সেই দম্পতির মায়া হয় রেদোয়ানের সরল মুখ দেখে। দত্তক নিয়ে নিজেদের কাছে রাখে। রেদোয়ান ওদেরকে সিলেটে আসতে বাধ্য করে। তারপর থেকেই শুরু তার মায়ের সাথে অন্যায়কারীদের খোঁজা। নিজের বাবাকে সে শাস্তি তো পরে দিবে। আগে তাদেরকে শাস্তি দিবে যাদের জন্য তার মায়ের শেষ আশ্রয় ওই ন*র*কে হয়েছিল।
____________
নিজের ও নিজের মায়ের অতীত রোমন্থন করে পেপারওয়েটটা প্রহরের ছবির উপর ছুঁড়ে মা*রে। চিৎকার করে উঠে অতঃপর ভয়ংকর কণ্ঠে বলতে থাকে,
“তোর মায়ের জন্য সবকিছুর সূত্রপাত প্রহর। তোর মাকে ওই আমির শাহ ভালোবাসত কিন্তু তোর মা আমার মামাকে বিয়ে করল। আমার মা ওই আমির শাহের দুঃখ সইতে না পেরে তার সাথে পালিয়ে গেলো তারপর তাকে ত্যাজ্যকন্যা করা হলো। তোর মা-বাবা কিন্তু আমার মায়ের খোঁজ নেয়নি। ভেবেছে সুখে আছে তাইনা? খুব সুখে ছিল তো! তোর বাবা কেনো খবর নেয়নি এখন বুঝি। এই বিশাল সম্পত্তির জন্য তাইনা? সব একা ভোগ করতে চেয়েছিল তাইনা? কিন্তু আমি তো তা হতে দিব না। তোর সবকিছু আমি কেড়ে নিব। আমার হবে সব। আমির শাহ তো তোর মায়ের চাচাতো ভাই হয়! সবমিলিয়ে তোদের সবার জন্য আজ আমি এই স্থানে। আমির শাহকে তো আমি নিজ হাতে মা*র*ব। দেখতে থাক কি হয়।”
রেদোয়ান এরপর পা*গ*লের মতো হাসতে হাসতে কাঁদতে শুরু করে।
____________
“প্রহরকে হিনটস দেও। রেদোয়ানের ব্যাপারে সতর্ক করো। রেদোয়ান প্রহরকে নিজের জালে ফাঁসিয়ে ফেলবে।”
শিতল চিন্তিত হয়ে বলে,
“কিন্তু প্রজাপতি, প্রহর যদি কারণ বা সোর্স জানতে চায় তখন? তখন কি বলব?”
ডার্ক বাটারফ্লাই ভাবতে ভাবতে বলে,
“বলবে, সেদিন রেদোয়ানের হাবভাবে অস্থীরতা ছিল। পিকুও অন্যরকম ভাইব দিচ্ছিল।”
শিতল বলে,
“না। এভাবে বললে কিছু প্রমান হবে না। তারচেয়ে চয়নিকার কোনো স্টেটমেন্ট পেলে ভালো হতো বা কোনো ক্লু। চয়নিকা এখনও কোমাতে। প্রেগনেন্সি মিসক্যারেজের কোমা তো বেশি সময় থাকে না।”
“তুমি রেদোয়ানের চুল বা নখের স্যাম্পল কালেক্ট করতে পারবে? তাহলে মিসক্যারেজ হওয়া ভ্রুণের সাথে ডিএনএ ম্যাচ করে প্রুভ করা যাবে।”
“ওটাই তো সমস্যা। কিয়া এখন তার বাবার বাড়ি। আমি কিভাবে যাব স্যাম্পল কালেক্ট করতে? এর আগেই যদি কিছু করে বসে?”
শিতলকে শান্ত করতে ডার্ক বাটারফ্লাই বলে,
“আমি প্রহরকে মেসেজ সেন্ড করব। তোমাকে কিছু বলতে হবে না তবে কোনোভাবে রেদোয়ানের ডিএনএ স্যাম্পল লাগবে।”
“হুম। একটা কথা, তুমি আর কতকাল এভাবে আড়ালে থাকবে? এবার প্রকাশ্যে আসো।”
ডার্ক বাটারফ্লাই মুচকি হেসে বলে,
“আসব তো। খুব জলদি আসব। সামনাসামনি এসে সব ঠিক করব কিন্তু আগে রেদোয়ানের সামনে আসব।”
শিতল স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“রেদোয়ান ভাইয়ের উদ্দেশ্য জানতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ডার্ক বাটারফ্লাই পরবর্তীতে কি করবে ভাবতে থাকে। নিকষ কালো চাঁদহীন এই অমাবস্যাতিথিতে সে নিজের পুরোনো অধ্যায় আউরাতে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
আসসালামু আলাইকুম। পর্বটা খাঁপছাড়া লাগতে পারে কিন্তু সব রহস্য প্রায় শেষের দিকে। পাঠকমহলকে এতোদিন অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। গতকাল রাতে পাণ্ডুলিপি লিখে শেষ করেছি। রিচেক করা বাকি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ। বেশি বেশি রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। পেজের রিচ নেমে গেছে।