প্রহরের শেষাংশে |৩|
লেখা : মান্নাত মিম
______________
“দুনিয়া বিষয়ে এলেম কতটুকু?”
হতভম্ব হয়ে যাই বড়ো ভাইয়ের কথা শুনে। সালাম দিলাম সেটার উত্তর না দিয়ে এমন প্রশ্নে যে কেউ বিস্মিত হওয়ার কথা। কোন কারণে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন বোধগম্য হলো না। সেক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তরে কী বলব, সেই চিন্তাতে আবার মাথায় হাত পড়েছে। চিন্তা করার কালক্ষেপ করতে না দিয়ে তিনি আবার বলে ওঠেন,
“দুনিয়া হলো টয়লেটের মতো। টয়লেটে আমরা যেমন বেশিক্ষণ থাকি না, তেমনি দুনিয়াটা-ও দুদিনের ঠিকানা। সেখানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, তুই করছস? দু-কদম হাঁটতে গেলেও ভেবেচিন্তে পা ফালানো লাগে। সেখানে তুই এতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললি কীভাবে? ভেবেও অবাক হতে পারি না। এই তোর বয়স কতটুকু, হ্যাঁ? ভাগ্যিস বাপ-মা’য় মইরা গেছেন, নইলে তোর মতো কুলাঙ্গারের জন্য সমাজে মুখ দেখাতে না পেরে শেষে আত্মহত্যার পথ ধরতেন।”
“বড়ো ভাই…..!”
কান্নার দমকে কথা আঁটকে আসছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে। এরমধ্যে হঠাৎ কান থেকে কে জানি ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। আকস্মিকভাবে এমন হওয়ায় পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি কুশাল রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে। রুদ্ধ হওয়া শ্বাস এবার বন্ধের উপক্রম।
খালামনি’দের দোতলা বাড়িটা নিবিড় পরিবেশে তৈরি। চারপাশে গাছপালাও বেশ। হালকা-পাতলা জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটা দেখতে অপূর্ব। এখানে খালামনি’রা তিনজনই থাকেন। শ্বশুর বাড়িতেই ছিলেন, কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ ঠাঁই পাননি। কারণ স্বরূপ ছিল বাচ্চা দিতে না পারা। তাও ছেলে বাচ্চা চায় পরিবার। খালু তাঁর বাবা-মা’য়ের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন। কে বলে? কেবল বিয়ের আগেই ভালোবাসা হয়। বিয়ের হলেও পরে প্রেম নামক অনুভূতির সন্ধান পাওয়া যায় না। বিয়ে স্রেফ কম্প্রোমাইজ! কিন্তু সেটার উর্ধ্বে গিয়ে খালু আমার খালামনিকে ভালোবেসে দেখিয়েছেন; পরিবার ছেড়ে আলাদা হয়ে। যেখানে অলক্ষ্মী, অপয়া নাম দিচ্ছিল সবাই সাথে খালুকে ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল, কারণ তাঁকে আবারও বিয়ে দিয়ে নাতিনাতনির মুখ দেখবে সবাই; সেখানে একমাত্র খালু সবার বিরুদ্ধে গিয়ে খালামনির হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, “সাবিনা কেন একা যাবে? গেলে সাথে আমি-ও যাব।” সেই হাত ধরে রাখা হাতটা আজও ধরে রেখেছেন সাথে দেয়া কথাটা-ও। সেখান থেকে চলে আসার পরই বহু পরিশ্রমে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে বাড়িটা গড়েছেন।
বারান্দা ফ্লোরে বসে মুখে হাত চেপে কান্না করছিলাম, তখন ফোন নিয়ে আসার সময় খালামনি কুশাল’কে আমার পিছু যেতে না বলেছিলেন; ভাই-বোনের কথাবার্তায় আপাতত দূরে থাকতে বলেন। কিন্তু পরে ঠিকই এসে কথাগুলো শুনে ফেলে কারণ ফোনের সাউন্ড বেড়ে গিয়েছিল হাতের চাপ লেগে। আপাতত কুশালের রক্তচক্ষু ভাইয়ের বলা কথার তীক্ষ্ণ ফলার চেয়েও বেশি চিন্তায় ফেলছে। কোনো উলটাপালটা কথা না তার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। কুশালের স্বভাব হুটহাট রেগে যাওয়ার মতো। এমনিতেও রাজনীতির কাজের সাথে এখনো জড়িত, সেসব কাজ করার লোকেরা দেখেছি সবসময় চওড়া মেজাজে থাকে। উত্তপ্ত মেজাজে কর্কশ গলায় ধমক দিলে; ভীত হয়ে জান যায় যায় অবস্থা।
“ভাইয়া ও-তো একা দোষী নয়।আমি-ও সমান দোষী।”
স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, যাক মন-মেজাজ ঠান্ডা রেখেই কথা বলছে। বেশ কিছুক্ষণ অপর পাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। অতঃপর থমথমে ভাব বিরাজ করা শেষে বড়ো ভাইয়ের গলা শোনা গেল,
“তুমি হলে পরের সন্তান। তোমাকে কী দোষ দেব? যেখানে তোমার বাপ-ভাই আমাদের বাড়িতে এসে নোংরা ভাষায় কথা বলে গেছেন। সাথে আমার স্ত্রীকে-ও বাদ রাখেননি।”
“ভাইয়া আমি তাঁদের হয়ে ক্ষ…..!”
পুরো কথা শেষ না করতে দিয়ে বড়ো ভাইয়া আবারও বলে ওঠেন,
“তুমি অরুকে ভালোবাসো কি না জানি না। তবে আমার দুনিয়া দেখার অভিজ্ঞতা বলে, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে এসব বিয়ে তোমাদের কাছে ছলাখেলার মতো। পরে যদি অরুকে ছেড়ে যাও, তাহলে সে যেন আমাদের তার মুখ না দেখায়। এসব করার পরেও তাকে আমরা কখনাে মেনে নেব না, কথাটা বলে দিও তাকে।”
আদেশ শেষে ফোন কেটে ফেলেন, আমাদের কথা পর্যন্ত শোনতে চান না। বারান্দায় হাঁটুতে মুখ গোঁজে গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকি। চরম দুর্ভোগের মতো অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, মাথা ফাঁকা লাগছে। আপন ভাই-ও আজ মুখ ফিরিয়ে নিলো। আসলে মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো বড়ো ভাইয়া বিয়েটাকে সমর্থন করবেন। কিন্তু কুশালের পরিবার সেটা বীজ থেকে চারা গজাতে না দিয়ে, সেখানেই মেরে ফেললেন। সামনে দিয়ে অনেকক্ষণ সময় ধরে ঘাড় ঢলতে ঢলতে পায়চারি করল কুশাল। হঠাৎই এগিয়ে এসে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসিয়ে দিয়ে আমার গালে হাত রেখে নরম স্বরে বলল,
“কান্না করছ কেন? আমাকে বিয়ে করে আফসোস হচ্ছে? বিয়েটা ভুল পদক্ষেপ মনে করে দ্বিধায় ভুগছ?”
এ কোন জটিল প্রশ্ন করল সে, যদি-ও প্রশ্নের উত্তর সহজ। কিন্তু জঘন্যরকম লাগল প্রশ্নগুলো। কেন এটা কেমন প্রশ্ন? এমনই বা তার মনে হলো কেন? সে কি বোঝে না কেন কাঁদছি? ভালো না বাসলে পরিবারের সবাইকে দুঃখ দিয়ে তাঁদের ছেড়ে তার হাত ধরে এতদূরে আসতাম? তবুও শেষে তার মুখে এমন কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি।
“হলোটা কী আবার? এরকম বাঁধ ছাড়া কান্না করছ কেন?”
রাগে ক্ষোভে বেশ কয়েকটা শক্ত ঘুষি মারি কুশালের বুকে। লাগলোও বেশ তার, যার দরুন আমার হাতগুলো কুশাল একহাতে পিছমোড়া করে ধরে, আরেক হাতে মাথার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে সেগুলো মুঠোবন্দি করে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“এতো যদি ভালোবাসো, তাহলে সকলের তিক্ত কথা হজম করে ফেলো। আর তাঁদের’কে দেখিয়ে দেও আমাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল নয়।”
চোখ তুলে অনিমেষ চেয়ে রইলাম তার মুখপানে। ইস! তার সম্মোহনী মায়াময় দৃষ্টির জালে প্রতিবারই আঁটকে পড়ে খেই হারিয়ে অতলে ডুবে যাই। কান্না ভুলে সেই ডুবে যাওয়া সমুদ্রে সাঁতরে চলি দু’জনা রাতভর। ভুল-ঠিক সময়ের তালে তালে পরিবর্তনের ধারায় নতুন করে প্রকাশ পায়। বেখেয়াল ছিলাম সেবিষয়ে; ভুলের মাশুল সময় ঘুরে দিতে হয় প্রকৃতির নিয়ম করে।
________
সকালের পাতাঝরা বাতাসে হালকা আমেজের রোদ্দুর খোলা বারান্দা দিয়ে ঘরে শায়িত আমাদের ওপর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমাদের নিরাবরণ অবস্থায় একই চাদরে দেখে শরম পাচ্ছে বোধহয় নিজের আলোর উত্তাপ; আমাদের ওপর ফালাতে। যদিওবা আমার ঘুম ছুটে গেছে বহু আগেই তবুও বিছানায় শুয়ে আছি মনমরা হয়ে। স্নিগ্ধ সকালটা-ও কেমন যেন বিষণ্ণ লাগছে। পাশ ফিরে কুশালের দিকে তাকাই। মেয়েদের রূপ কেন ছেলেদের হবে সেটাই ভাবি। এইযে গৌড় বর্ণের কুশাল’কে অত্যধিক ফর্সা রঙের হওয়ায় মেয়ে মেয়ে আভা ছড়ানো চেহারা লাগছে। উপরন্তু টকটকে লাল ঠোঁট যেন আগ বাড়িয়ে জানান দিচ্ছে; কুশাল মেয়েদের মতো লিপস্টিক দেয়। আসলে এসব কিছুই করে না সে, আমারই বেখেয়ালি ভাবনা এগুলো। এসব ভেবেই ফিক করে হেসে দেই। ফলাফল হিসেবে ঠুস করে কুশালের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ঘুম ফোলা চোখে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
“কী ব্যাপার হাসছ কেন?”
আমি মাথা নাড়িয়ে না বলায় তার যেন জানার আগ্রহ আরো চেপে বসল। চাদরের নিচ দিয়ে হাত গলিয়ে আমার কোমর টেনে তার বুকের ওপর উঠিয়ে বলল,
“উহুম মাথা নাড়লে তো হচ্ছে না। উগরে দেও কথাটা।”
তার জোর করা দেখে মুখে হাত দিয়ে হাসি আরো চেপে রাখছি। এসব কথা ভুলেও কুশাল’কে বলা যাবে না। শুনলে নির্ঘাত আমায় জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলবে। কিন্তু তার আর হলো কই? তারচেয়েও বেশি মরণবাণ বিদ্ধ করছে শরীর জুড়ে। শিরশির করে ওঠে কাঁপন ধরে গায়ে। অবশ অবশ লাগে। বাতাসে ভর করে শূন্যে বিচরণ করা পাখির পালকের ন্যায় হালকা লাগে। আমার কাঁধ থেকে কুশাল তার স্পর্শের স্পৃষ্ট বন্ধ করে কানে লতিকা কামড়ে ধরে। সুখানুভব ব্যথাতুর শব্দ আমার মুখ নিসৃত হয়ে উঠলে কুশাল বাক্য ছুঁড়ে,
“বলে দাও, বলে দাও। নইলে সুখের ব্যথায় কাঁদিয়ে ছাড়ব।”
আমি-ও অসাড় হওয়া গলায় কোনোরকম জবাব দেই,
“এমন সুখে প্রতিনিয়ত মরতেও রাজি।”
আমার আবদ্ধ হওয়া চোখের তারায় দীর্ঘায়ত চুমুর স্পর্শ বসাল কুশাল। ফের তার সুখের ফলা জারি করা শুরু করে দিলো। আমি-ও মুঠো ভরে সেই সুখ কুড়াতে লাগলাম। কারণ জানা নেই। কীসের এতো তাড়া দু’জন দু’জনকে আপন করে নেওয়ার? একজনের শরীরে আরেকজনের ছাপ ফেলার? জানা নেই আসলেই কি জানা নেই। না কি ভীত সামনে আগতপ্রায় বিপদের কথা চিন্তা করে।
______
চলবে….