প্রাণহন্ত্রী পর্ব -০৩

#প্রাণহন্ত্রী (৩)
” তোমার নামটি তো বললে না ”
” আমার নাম মাহু ”
” আচ্ছা মাহু শোনো, আমি তোমাকে বাসায় পৌছে দিবো। তবে আমি যে তোমাকে বাঁচিয়েছি কাউকে বলবে না। বুঝেছো? ”
” কেন আপা? ”
” তুমি ছোট মাহু। বড় হলে বুঝবে। আর কখনো একা বের হবে না। চারপাশটা নোংরা হয়ে আছে। সময়ের সাথে সাথে সব জানবে, বুঝবো। আগে বড় হও। ”
” আচ্ছা আপা। ”

পাশের গ্রামে পা রেখেই দীপ্তি বলল
” তুমি এখন যেতে পারবে তো? ”
” হ আপা। সামনেই আমার বাসা। ”
” তাহলে তুমি যাও। আমি দাঁড়িয়ে আছি।”
” আচ্ছা। ”

মাহু পথ আগায়। বিতৃষ্ণাতে ছেয়ে যায় দীপ্তির মন। একটু আগের ঘটনাটা মনে হতেই শরীর ঝাঁকুনি দেয়। একটা ছোট্ট মেয়ের উপর এমন বাজে দৃষ্টি দিতে ও বুক কাঁপে নি নিকৃষ্টতম জা/নোয়া/রদের। সে দৃশ্য মনে হতেই র/ক্ত চড়ে যায় ওর। ছুটে আসে মাহুর কাছে। মাহুকে বুকে টেনে নেয়। ছোট্ট মাহু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে যেন কিছুই বুঝতে পারে না। নরম হাতে দীপ্তির গালে হাত রাখে। ধারনার বাহিরে গিয়ে টুপ করে চুমু খায় গালে। অবাক হয় দীপ্তি। বলে ” এটা কি করলে? ”
” হামি। আমারে বাঁচানোর লাইগা হামি। ঐ দুষ্টু লোকটা বাজে। আমার লগে বাজে আচারণ করছে। ”

দীপ্তির নারী মন জেগে উঠে। তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয় হৃদয়ে। প্রতিটা মেয়েই যে মা। তাই বোধহয় মেয়েটার চোখে পানি চিক চিক করে। মাহুকে আবারো জড়িয়ে ধরে। দু চোখে পানির ঝর্ণা নেমে যায়। অদূরের বাড়ি থেকে একজন মহিলার ডাক শোনা যায়। সর্তক হয় দীপ্তি। মাহুর মাথায় হাত বুলিয়ে ছুট লাগায়।

নদীর পারে এসে লুকিয়ে পরে। মাহুর মা মাহুকে নিয়ে যায়। ছোট্ট মাহু বার বার পেছন ফিরছিলো। কেন যেন দীপ্তির ইচ্ছে হয় মাহুকে কাছে টানার। নিজের কিশোরী মনে হঠাৎ ই মাতৃত্বকে দেখতে পায়। অদ্ভুত অনুভব হয়। আজকের এই ঘটনা ওকে এতো পরিবর্তন করে দিলো! নাকি ওহ এমন ই ছিলো। শুধু মাত্র হিং/স্রতাকে নিজ চোখে উপলব্ধি না করতে পারায় নিজের ভেতর সুপ্ত সত্ত্বা লুকিয়েছিলো।
.

রান্না ঘরে বসে রান্না করছেন রুমানা। মনটা ভালো নেই। ভেতর থেকে শান্তি মিলছে না। ভর দুপুর বেলা মেয়েটা স্কুলে গেছে। এই দুপুরে চারপাশে মানুষ জনের সমাগম ও কম থাকে। না জানি কোন বিপদ এসে ধরা দিবে। দীপ্তির মাঝে চঞ্চলতা নেই বললেই চলে। ভীতু প্রকৃতির হওয়াতেই যতো ভয়। এভাবে মেয়েটা হিং/স্র থাবার প্রতিবাদ করবে কি করে? কি করে স্বপ্ন পূরণ হবে ওনার। ভাবনার মাঝেই পাশের বাড়ির জমেলার চেঁচামেচি কানে আসে। থম মেরে যায় রুমানা। চুলার আগুন নিভিয়ে ছুটে যায় সে দিকে। কপাল চাপরিয়ে কাঁদছেন জমেলা। তাঁর ই পাশে বসে আছে গুটি কয়েক মহিলা। রুমানাকে দেখেই তাঁরা নাক কুচকোয়। এদের স্বভাব ই এমন। রুমানা আড়াল হয়ে যায়। কিছু দূরে কয়েক জন লোক কিছু আলোচনা করছে। সে দিকেই যায় রুমানা। কানে আসে কিছু কথা। ” হায় হায় রে। কে জানি মন্টুর মাথাটাই ফাঁ/টায় দিছে। র/ক্তে একদম মাখামাখি। গ্রামের চিকিৎসালয়ে নিয়া গেছিলো সবাই , কইছে সদরে নিয়া যাইতে। কে যে করলো এই কাম। ”

বিস্ময়ে হতবাক হয় রুমানা। কে এমন কাজ করবে? ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন জমেলার বাড়িতে। জমেলা মাটিতে কপাল খুটছেন। ভাইয়ের অসুস্থতায় যেন পাগল হয়ে গেছেন। রুমানার কিছুটা মন ক্ষুন্ন হয়। তবে এক দিকে শান্তি অনুভব হয়। এমন নরপ/শু দের বাঁচার ই কোনো অধিকার নেই। সেখানে তো সামান্য মাথা ফাঁ/টিয়েছে কেউ।

ঘরে ফিরেন রুমানা। উঠানে দীপ্তিকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে যান। সেকেন্ড কয়েক পর ছুটে যান মেয়ের কাছে। দীপ্তির বাহু ধরে বলেন ” আম্মা, আম্মা , তুই ঠিক আছিস তো। এই সময়ে বাসায় ফিরলি যে। কি হইছে তোর? ”
” আমি ঠিক আছি আম্মা। ভালো লাগছিল না তাই তো বাসায় ফিরা আইছি। অনেক ক্ষুধা লাগছে আম্মা। রান্না হইছে? ”
” হাত মুখ ধুয়ে বোস তুই।আমি এখনি শাক ভাজি করে , খাইতে দিতাছি।”
” আচ্ছা। ”

রুমানা এগিয়ে যান। নিঃসেন্দহে রুমানা অপরূপা। নির্লিপ্ত চেয়ে থাকে দীপ্তি। এমন গড়নের মেয়ে হয়ে কি করে সাধারন এক কৃষককে বিয়ে করেছেন রুমানা? অবাক হলো দীপ্তি। বুকের ভেতর নানান প্রশ্ন উঁকি দেয়।

নিজের প্রশ্নের উত্তর পায় না সে। হাত মুখ ধুয়ে উঠানে মাঁদুর পেতে বসে। কাঁধের ব্যাগটা পাশেই রেখে দেয়। আজ পড়াশোনা কিছুই হবে না। ভেতরে জ্বালা হয়। রুমানা ভাতের প্লেট রেখে চলে যান। পিছু ডাকে দীপ্তি।
” আম্মা। ”
” হুম বল। আর কিছু লাগবো।”
” না আম্মা। অসলে হইছে কি আমি একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ছি। তবে পাইতেছি না। ”

দীপ্তির পাশে এসে বসলেন রুমানা। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ” আমি তো নবম শ্রেনি অব্দি পড়াশোনা করেছি মা। তাঁর পর তো আর পড়াশোনা করি নি। তোর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো? ”
” উফফ আম্মা। অন্য রকম প্রশ্ন এটা। ”
” আচ্ছা বল। দেখি পারি কি না। ”
” আমগো গ্রামের সবাই শুদ্ধ অশুদ্ধ মিশ্র ভাষায় কথা কেন কয়? আমি তুমি ও তো মিশ্র ভাষা বলি। ”

দীপ্তির প্রশ্নে হেসে উঠেন রুমানা। নিজের এমন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করে দীপ্তি। মাথা নিচু করে বলে ” ভুল প্রশ্ন করলাম আম্মা? ”
” আরে না। ভুল কেন করবি। শোন তাহলে গ্রামের কিছু মানুষ শিক্ষিত আর কিছু মানুষ অশিক্ষিত। সবার সাথে চলতে গিয়া আমরা সব ভাষাই রপ্ত করেছি। তাই তো শুধু শুদ্ধ কিংবা শুধু অশুদ্ধ ভাষার ব্যবহার করতে পারি না। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি হয়ে যায়। ”
” ভুল বললা আম্মা। জগাখিচুড়ি না বরং গুরুচন্ডালী হয়ে গেছে। ”
” ঐ একি কথা। শুদ্ধ ভাষায় কয় গুরুচন্ডালী আর গ্রাম্য ভাষায় কয় জগাখিচুড়ি। এহন কথা বাদ দিয়া খাইয়া ল মা। আমার অনেক কাজ। ”
” আম্মা আরেকটা কথা বলি? ”
” তাড়াতাড়ি বল। ”
” আচ্ছা তাহলে রাতে বলুম নে। তুমি এখন কাম করো যাও। ”

বিগলিত হেসে চলে যায় রুমানা। দীপ্তি ঠায় বসে থাকে। প্রশ্ন করতে চেয়েছিলো এক আর করেছে আরেক। সব কেমন গুলিয়ে আসে।চোখ জ্বালা করছে এখন। কি যে করবে বুঝে উঠে না।মূলত দুপুরের ঘটনা এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। সাথে চাঁপা কিছু ভয় ও কাজ করছে। মন্টু কি দেখেছে ওকে?
যদি দেখে থাকে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। গলায় ভাত আটকে যায় ওর। দ্রুত পানি এগিয়ে দেয় রুমানা। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে ” অন্যমনস্ক হয়ে খাবার খেতে নেই। দ্রুত খাবার শেষ কর। একটু পর পড়তে বসবি। ”
” আচ্ছা। ”
.

বই খাতা ছড়িয়ে উঠানে পড়ছে দীপ্তি। গনিতের সমাধান করতে বেশ ভালো লাগে ওর। তাই তো অর্ধ বছরেই পুরো বই কমপ্লিট করে নিয়েছে। জীবনে অনেক বড় হতে হবে কি না। তবে কি হবে ওর জানা নেই। কখনো ইচ্ছে হয় নি আমি এটা হবো। লক্ষ্য একটাই জীবনে অনেক বড় হতে হবে। একের পর এক অঙ্ক করে চলেছে দীপ্তি। অঙ্ক হলো ম্যাজিকের মতো। একটা পারলেই আরো অনেক গুলো পারা যায়। রহস্য ভেদের মতোই। বেশ মজা লাগে দীপ্তির। পাশের বাসা থেকে চিৎকার কানে আসছে। অঙ্কে ব্যাঘাত ঘটাটা বেশ বিরক্তিকর। হঠাৎ করেই জমেলার চেঁচামেচি বুঝতে পারে না ওহ। পরমুহূর্তেই মনে পরে মন্টু হলো জমেলার ভাই। ফাঁকা ঢোক গিলে ওহ। হাত যেন থমকে যায়। একটা অক্ষর ও লিখতে পারে না। ভয়ে চোখ দুটো কাঁপছে। এদিকে রুমানা ঘরে নেই। এক বালতি কাপড় নিয়ে গেছেন পুকুর ঘাটে। বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ। কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ায়। টিনের বেড়া ফাঁক করে তাকায় জমেলার উঠানের পানে। পাড়ার মহিলা নিয়ে গভীর সমাবেশে বসেছেন। কিছুক্ষন পর পর ই হাঁক ছেড়ে কাঁদছেন। দীপ্তি বুঝতে পারে মন্টুর অবস্থা ভালো নয়। গা ঝমঝম করে ওর। মাথাটা ও কেমন করছে। মুখ দিয়ে একটাই শব্দ বের হয় ” আম্মা , আম্মা। ”

মাঠে কাপড় শুকাতে দেয় রুমানা। কিছু দিন পর ই তো নির্বাচন। বিশাল বাহিনী বের হয়েছে। ঘোমটা টেনে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফিরলেন ওনি। সেদিন রাতের কথাটা বেমালুম ভুলে গেছেন রুমানা। উঠানে এসে বালতি রাখেন। আঁচল দিয়ে কপালের শেষ ঘাম টুকু মোছার সময় চোখ যায় দীপ্তির দিকে।দীপ্তি বলে চিৎকার করে উঠেন তিনি। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে মেয়েটা। বুকে টেনে নেন রুমানা। হঠাৎ এমন হওয়াতে বুক হু হু করে উঠে। দীপ্তির মুখে পানির ছিটে দিতে ও ভুলে যান।ভেজা শাড়ির আঁচল চোখে লাগতেই কিছুটা সজাগ হয় দীপ্তি। ধীর কন্ঠে বলে” আম্মা। ”
” দীপ্তি, কি হয়েছে তোর। ”
” আম্মা , পানি , পানি খাবো। ”

দীপ্তিকে মাটিতে রেখেই ছুটে যান রুমানা। ঘর থেকে পানি নিয়ে এসে পানি তুলে দেন দীপ্তিকে। ঢক ঢক করে নিমিষেই পানি শেষ করে ফেলে ওহ। চাঁপা স্বরে বলে
” ঘরে যাবো আমি। ”

কোনো মতে দীপ্তিকে ধরে নিয়ে আসেন রুমানা। মাথার কাছে বসে থমথমে মুখে বলেন ” মাথা ঘুরে গিয়েছিলো তোর? ”

উত্তর করে না দীপ্তি। টিনের বেড়ায় তাকিয়ে থাকে। ডান পাশের জানালার কাছে বাবা মায়ের বিয়ের ছবিটা টাঙানো। দেলোয়ারার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো ফুয়াদের। আবছা আবছা মনে পরে দীপ্তির। বাবা মায়ের ভালোবাসার ছোট্ট সংসার। হঠাৎ করেই মা বাবা কে মনে পড়ে মেয়েটা। কষ্ট হয় বেশ। জ্বালা হয় হৃদয়ে। খুব করে দেখতে ইচ্ছে হয় মা বাবার সুখের সংসারটা। রুমানার আঁচল টেনে ধরে দীপ্তি। বলে ” আম্মা একটা কথা কও তো। আব্বার সাথে তোমার ভালো সম্পর্ক ছিলো না তাই না? ”
” ছিই ছিই মা এমন কথা কইতে নাই। তোর আব্বার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। তবে কি জানিস কখনো ওনি আমারে মন থেকে গ্রহন করে নাই। তোর মা রে খুব ভালোবাসতেন কি না। কিন্তু এহন এই কথা কেন বললি? ”
” এমনি আম্মা। ”
” গান শুনবি মা ? ”
” হুমম। ”

দীপ্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গান ধরেন রুমানা। ভেসে উঠে পুরনো স্মৃতি। নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সংসার করার প্রত্যয়। চোখ দুটো ছলছল করে কেমন। দীপ্তির কপালে কপাল ঠেকিয়ে লম্বা করে শ্বাস নেয়।

কলমে ~ ফাতেমা তুজ
চলবে…..

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here