প্রাণহন্ত্রী পর্ব -০৬

প্রাণহন্ত্রী (৬)
” মাতব্বর সাহেব কালুর মৃত্যুর রহস্য খুঁজে পেয়েছেন?”

” আরে বাদ দে তো পলাশ।যে ম/রছে সে তো ম/রছেই। সামনেই আমার নির্বাচন। এহন নির্বাচনে মনোযোগ দে।এসব উটকো বিষয়ে কথা কবি না। ”

” কিন্তু কালুর মৃ/ত্যুর রহস্য ভেদ হবে না?ওর পরিবার কে, কি সান্ত্বনা দিবেন। ”

পানের পিক ফেলেন মাতব্বর। পলাশের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলেন ” তোর এতো দরদ উতলে কেন? ম/রার শখ হইছে? এহনি ভাগ হা/লারপুত। আইছে আমার সান্ত্বনার বাপ। ”

মাথা নিচু করে চলে যায় পলাশ। মনে মনে প্রচন্ড ক্ষোভ হয়েছে। কালু ছিলো মাতব্বরের ডান হাত। আর সেই ডান হাতের উপর এমন অবিচার অনাচারকেই যখন সাধারন ঘটনা ধরে নিয়েছেন তাহলে ওনার উপর কতো টা ভরসা করা যায়? ক্ষিপ্ত পলাশ মনে মনে ছক কষে নেয়। মাতব্বরের বারোটা বাজাবে এবার। নির্বাচনে কি করে বিজয়ী হয় সে ও দেখে নিবে।

কাঁথা নিয়ে জমিদার মহলে প্রবেশ করে রুমানা। সদর দরজায় এসে মাথায় ঘোমটা তুলে নেয়। দীপ্তির চোখ যেন ছানাবড়া। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে জমিদার মহলের বিশাল কারুকাজে। আদেশের সুরে রুমানা বলেন” মাথায় ঘোমটা তুলে নে। আগে কখনো জমিদার বাড়িতে আসি নি। জানি না কি আদব কায়দা। ”

” আচ্ছা আম্মা। জমিদার বাড়ির প্রতিটা আসবাবপত্র খুব মূল্যবান তাই না?”

” তা তো হবেই। ”

মায়ের সাথে মহলে প্রবেশ করে সে। চারপাশে চোখ বুলাতে থাকে বিস্মিত নয়নে। চোখ যেন নড়তেই চায় না। এমন সৌন্দর্য আগে কখনো দেখে নি ওহ। গ্রামের মাতব্বর বাড়িকে রাজ প্রাসাদ মনে হতো ওর। এখন তো মনে হচ্ছে জমিদার মহল কোনো স্বর্গ পুরী। অন্যমনস্ক থাকাতে দরজায় মাথা ঠুকে যায়। আহ বলে আর্তনাদ করে উঠে। একজন রক্ষী ছুটে এসে বলে” এই কে তুমি? মহলে কি করছো। ”

” আমি , আমি দীপ্তি। জমিদার মহলে কাঁথা দিতে এসেছি। ”

” এখান থেকে যাও। আর এদিকে আসবে না। ”

মাথা ঝাঁকায় দীপ্তি। রক্ষী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। নিজ অবস্থানে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে মিষ্টি এক কণ্ঠ কানে আসে ” কে এসেছিলো রক্ষী? ”

” শুপ্রভাত জনাব। ”

” শুপ্রভাত। কে এসেছিলো? ”

” কোনো এক কাঁথা বিক্রেতার মেয়ে। ”

” ওহহ আচ্ছা। জমিদার মহাশয়ের জন্য চিত্র তৈরি হয়ে গেছে। তাঁকে ডেকে পাঠাও। ”

” আচ্ছা জনাব। ”

রক্ষী চলে যায়। দরজা লাগিয়ে দেয় কুশল। বহু চেষ্টার পর আজ জমিদার পরম্পরা ভুক্ত চিত্রটি তৈরি করতে পেরেছে সে। বলতেই হয় কয়েক শত বছর পূর্বের চিত্র শিল্পীদের হাতের কাজ ছিলো খাসা। দীর্ঘ আটত্রিশ দিন পর একটি চিত্র তৈরি করতে সক্ষম হলো। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে কুশলের হাতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
.

” বাহ তোমার হাতের কারুকাজ প্রশংসনীয় বটে। সব গুলো কাথাই আমার পছন্দ হয়েছে। ”

” ধন্যবাদ ম্যাডাম। ”

” কি যেন নাম তোমার? ”

” রুমানা সুন্দরী। ”

” খাসা নাম তো। আচ্ছা শোনো রুমানা সুন্দরী, তোমার সব গুলো কাথাই আমি নিয়ে নিচ্ছি। আর তোমার পারিশ্রমিক ও এখনি দিয়ে দেওয়া হবে। ”

” আচ্ছা ম্যাডাম। ”

জমিদার গিন্নির থেকে বিদায় নেয় রুমানা। দীপ্তিকে অনেক সময় ধরে দেখে নি সে। মাঝে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। চিন্তাগ্রস্ত রুমানা এগিয়ে যায়। রক্ষীর সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে ” আপনি কি একটা মেয়ে কে দেখেছেন? ”

” কোন মেয়ে? ”

” আম্মা। ”

পেছন থেকে দীপ্তির কণ্ঠ কানে আসতেই ঘুরে তাকায় রুমানা। দ্রুত দীপ্তির কাছে এসে বলেন ” কোথায় গিয়েছিলি। জানিস না এটা জমিদার মহল। ”

” এখানেই ছিলাম আম্মা। ”

” এখন দ্রুত আয়। ”

দীপ্তির হাত ধরে বেরিয়ে আসেন রুমানা। দরজা মেইন ফটকে এসে জমিদারের মুখোমুখি হতে হয়। জমিদার আনন্দ পাঠান বলেন ” এরা কারা? ”

” কাঁথা বিক্রেতা,জনাব। ”

” ওহ। ”

জমিদার চলে যান। রুমানা আর দীপ্তি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। দীপ্তি বলে ” জমিদার সাহেব এমন কেন আম্মা। কেমন যেন তাঁর দৃষ্টি। ”

” ওহ কিছু নয়। সন্ধ্যার পূর্বে বাসায় ফিরতে হবে। ”

গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যায় দুজনে। পা যেন ব্যথায় টনটন করছে। উপায় না পেয়ে বড় সড়কে আসেন রুমানা। লোকাল বাসে করে আসেন নিজেদের গ্রামে। এই প্রথম বাসে চরেছে দীপ্তি। নিজের গ্রামের বাইরে একটি গ্রাম ই ঘুরেছে সে। অভাবের সংসারের এর থেকে বেশি কিছু আশা করা ও ঠিক নয়। বিস্ময় নিয়ে বাস থেকে নামে মেয়েটি। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো। রুমানা বলেন” শহরের পরিবেশ আরো সুন্দর। বড় বড় গাড়ি, বাড়ি , স্কুল কলেজ দেখলেই মাথা ভনভন করে। ”

” তুমি কেমনে জানলা আম্মা? ”

” আমি গিয়েছিলাম তো। আব্বা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। শহরের পরিবেশ হলো কল্পনার মতো। তোর ম্যাডাম বলেছে তো উপজেলা ভিত্তিক প্রথম হতে পারলে তোরে শহরের পড়াশোনার সব খরচ দিবে। ”

” কিন্তু আম্মা আমি যদি না পারি? ”

” আরে বোকা মেয়ে পারবি। না পারলে আমি আছি তো। তোরে শহরে নিয়া পড়া লেখা করামু। তুই মস্ত বড় পুলিশ অফিসার হবি। কি যেন বলে কেমন অফিসার যেন, যাই হোক বড় অফিসার হবি তুই। ”

চোখে হাজার খানেক স্বপ্ন জমা হয়। অজপাড়া গ্রামের মেয়েটি পুলিশ অফিসার হতে চায়। এর থেকে ভালো কিছু আছে?

সন্ধ্যার অনেক আগেই বাসায় ফিরে দীপ্তি। জমিদার মহলের সৌন্দর্য্য ওর নজর কেড়েছে। তাঁর থেকে বেশি নজর কেড়েছে সুদর্শন পুরুষের ছবি। যেই ছবি দেখে হিম শীতল বাতাস বয়ে গেছে ওর পুরো শরীরে। স্নিগ্ধ মোহে জড়িয়ে গেছে ওর দু চোখ। মাথায় একটাই কথা আসে পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হয়?

সন্ধ্যার আজান কানে আসতেই হুরমুরিয়ে উঠে দীপ্তি। মাথায় ঘোমটা টেনে যায় পুকুর পাড়ে। কেন পুকুর পাড়ে আসলো তাঁর জানা নেই। হঠাৎ করেই সে দেখতে পায় ছোপ ছোপ র/ক্ত। গা গুলিয়ে আসে। পাশে পরে আছে বড় রকমের তলোয়ার। আম্মা বলে চিৎকার করে দীপ্তি। নামাজে বসবেন রুমানা। তৎক্ষনাৎ দীপ্তির চিৎকারের ছুটে যান। পুকুর পাড়ে পরে থাকতে দেখে চিত্ত কেঁপে উঠে। দীপ্তির চোখ মুখ উল্টে যাবার উপক্রম। পাশেই পরে আছে র/ক্তে মাখা তলোয়ার। কাউ কে ডাকার পরিস্থিতি ও নেই। কোনো মতে দীপ্তি কে টেনে তুলেন রুমানা। পানির ছিটে পরতেই চোখ মেলে তাকায় ওহ। বলে ” আম্মা র/ক্ত , দেখো র/ক্ত। ”

” কোনো র/ক্ত নেই দীপ্তি। কোনো র/ক্ত নেই। ”

পাশে তাকায় ওহ। সত্যি ই তো কোনো র/ক্ত নেই। আর না আছে তলোয়ার। তবে কি ভ্রম ছিলো এটা?

রুমানার হাত ধরে উঠে আসে দীপ্তি। চিন্তার রেখা স্পষ্ট। গা কাঁপুনি দিয়ে উঠে। তৎক্ষনাৎ টোটকা এনে দীপ্তি কে খাইয়ে দেন রুমানা। কপালে চুমু এঁকে বলেন ” আজ আর বড় সড়কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”

” আচ্ছা আম্মা। ”

কুপি বাতির আলো তেই ঝুঁকে পড়শোনা করে দীপ্তি। রান্না ঘরে এসে রুমানা থম মেরে বসে পরেন। তলোয়ার নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেছেন ওনি। কে করলো এ কাজ?
.

” আপনাকে ধন্যবাদ জমিদার আনন্দ পাঠান। ”

” আরে কি যে বলো না কুশল। ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্য। কতো শত শিল্পী চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেউ পারে নি। তোমার কাজে আমি বিস্মিত। তো আর কটা দিন থাকলে ও তো হতো। ”

” কিছু কাজ রয়েছে গ্রামে। বহু দিন হলো যাওয়া হয় না। ”

” আচ্ছা যাও তাহলে। প্রয়োজন হলে ডাকবো। তোমার পদধুলি দিও কিন্তু। ”

” অবশ্যই, আপনাকে দর্শন তো দিতেই হবে।”

জমিদার মহল থেকে বিদায় নেয় কুশল। সঙ্গে নেয় প্রিয় গিটার। দেশে গিটারের দাম চওড়া। সচরাচর পাওয়া ও যায় না। মহলের বাগান থেকে এক গুচ্ছ বেলি ফুল নেয় মামুনির জন্য। বেলি ফুলের পাপড়ি গুচ্ছ বড্ড প্রিয় মামুনির।

অশান্ত হয়ে গেছে আনন্দ পাঠান। ভারী তার কণ্ঠ
” জয়নুল এই জয়নুল ”

” জী জনাব। ”

” কাঁথা বিক্রেতার খোঁজ লাগা। সাত দিনের মধ্যে ওকে আমার চাই। যদি না পাই তোর ক’ল্লা যাবে। ”

” জী জনাব। আমি এখনি খোঁজ লাগাচ্ছি।”

আনন্দের চোখে ভাসে রুমানার নরম হাত। এমন সুন্দর হাত একজনের ই ছিলো। কিছুটা আঁচ করতে পারে সে। ফলের রস নিয়ে নেয় গ্লাসে। আজ বহু দিন পর শান্তি মিলেছে মনে। এতো খোঁজার পর ও মালিনী কে পায় নি আনন্দ। দেখতে দেখতে বারো বছর পার হয়ে গেছে।গ্লাস হাতে নিয়ে শয়তানি হাসে সে। বলে ” আমার মহলে তোমাকে আসতেই হবে মালিনী। আমার রঙ মহল এখন অবধি তোমার অপেক্ষায়। ”

স্বামীর মনোযোগ পাচ্ছে না জমিদার গিন্নি শামিনা। বড্ড অধৈর্য হয়ে পরেছে সে। জমিদার আনন্দ পাঠানের চতুর্থ গিন্নি সে। প্রথম তিন বউ কে অন্যত্র পাঠানো হয়েছে। তাঁদের সহিত খুব কম দেখা করেন জমিদার। শামিনার সৌন্দর্য বরাবর ই কাবু করে নেয় জমিদার কে। তবে আজ কেন পারছে না। জমিদারের জন্য শ্বেত পদ্ম নিয়ে আসে শামিনা। টেবিলে রেখে বলে ” জনাব আপনার জন্য শ্বেত পদ্ম নিয়ে এসেছি। ”

” কে? ”

” জনাব আমি। ”

ঘুরে তাকায় আনন্দ। শামিনার পা থেকে মাথা অব্দি দেখে। কোনো আকর্ষন নেই তাঁতে। তাচ্ছিল্য হাসে সে। চোখে মুখে এক নারীর রূপ ভেসে উঠে। যা দেখেছিলো এক যুগ আগে। এখনো চোখ দুটো সেই নারী তেই আবদ্ধ। রঙমহলে এনেছিলো, কাছে পাওয়ার বাসনা ছিল। তবে পালিয়ে যায় সেই নারী।

কাঁধে শামিনার স্পর্শ পেতেই গা শিউরে উঠে। চোখে লাগে নেশা। শামিনার দিকে এগিয়ে আসে আনন্দ। শামিনার চোখ দুটো চকচক করে। আজ জমিদারের থেকে দামি কিছু চেয়ে নিবে। তবে তাঁর সমস্ত ধারনা কে তুচ্ছ করে দিয়ে আনন্দ বলে ” নিজের ঘরে যাবে শামিনা। ”

” একি জনাব। আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন। ”

” হুম বলছি। ”

” জনাব দেখুন , আমি আপনার মনের মতো সেজেছি। ”

শামিনার কথায় ঘাড় ঘুরায় আনন্দ। মাথা থেকে পা অবধিদেখে নেয়। মিহি সুতোর নকশা করা শাড়ি। অত্যন্ত নিপুন হাতের কাজ। চোখ দুটো জ্বলে উঠে। শামিনার হাতে একটা কাঁথা ছিল। ঝাঁপিয়ে নেয় কাঁথা। শামিনা বলে উঠে ” নতুন রেখেছি জনাব। বড্ড, দারুণ কারুকার্য করা। আপনার পছন্দ হয়েছে?”

শামিনার কথার উত্তর করে না সে। কাঁথায় নাক ডুবিয়ে দেয়। এই কাঁথা তেই মালিনীর হাতের স্পর্শ রয়েছে। নেশাক্ত কন্ঠে বলে ” মালিনী ”

” কে মালিনী? ”

” এই নকশি কাঁথা করেছে যে। ”

” ভুল বললেন জনাব। এটা তো রুমানার সেলাই করা কাঁথা। ”

কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় আনন্দ। রুমানার সেলাই করা কাঁথা। তবে কি মালিনী ছিলো না সে?

আগুনের মতো জ্বলে উঠে জমিদার। শামিনার চুলের মুঠো ধরে বলে ” চলে যেতে বলেছিলাম না। ”

” জনাব লাগছে। ”

ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আনন্দ। সব কিছু এলোমেলো লাগছে তাঁর। এতো দিন ধরে তাঁর এলাকাতেই ছিলো মালিনী। অথচ অন্য শহরে খুঁজে চলেছে সে। চুলের মুঠো খিচে ধরে পৈশাচিক হাসি দেয়। বলে” রুমানা নাম নিয়ে লুকিয়ে থাকবে তুমি। এবার তোমাকে ধরা দিতেই হবে। আমার রঙমহলে আসার জন্য সকল প্রস্তুতি নাও মালিনী। ”

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

** গল্পটা পুরনো কাহিনীতে লেখা। **

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here