#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১০
-”ভালোবাসার অভিনয়ে মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও পারদর্শী।
এর জলজ্যান্ত প্রমাণ, আমি।”
একথা বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভোরের মাথাটা বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। ক্লান্ত শরীর আর ক্ষুধার্থ পেটে ঘুমে অতিয়েও গেল। তিতাসের উপরোক্ত
কথাটা বলার উদ্দেশ্যে ভিন্ন। সত্যিই সে অভিনয়ে পারদর্শী।
স্বেচ্ছায় যাকে ভাবির আসনে বসানো হয়। তাকে এত সহজে ভালোবাসা যায়? না, যায় না। সেও পারে নি। অথচ নিখুঁত প্রেমিকের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে সে। যেন ভোরকে আগে থেকেই ভালোবাসত, খুব করে চায়ত। তিতাস চঞ্চল প্রানবন্ত ছেলে, তার চঞ্চলতার মাঝেই ঢাকা পড়ে যায় অভিমানী এক ছেলের রুপ। যে কখনো নিজের কথা নয়, ভেবেছে স্বপ্ন ভঙ্গ এক মেয়ের কথা আর নিজের মায়ের আদেশ। যেখানে তার সিদ্ধান্তের ছিঁটেফোঁটা মূল্য সে নিজেই দেয় নি। ভোর বয়সে বড়, সম্পর্কে ভাবি ছিল, এসব তার সমস্যা নয়। ভোরকে না ভালোবাসার হেতুও নয়। এমনও না যে সে কারো প্রতি দূর্বল ছিল। সে মূলত সময় নিতে চেয়েছিল। নিজেকে সবকিছুর জন্য গুছিয়ে নেওয়ার সময়। কিন্তু সে সেটা পায় নি। তাছাড়া ভালোবাসা কি জোরপূর্বক হয়? সে চেষ্টাও করে না। কারণ
ভোর এখন তার বউ। ওর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার। চায়লেও সে দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। তবে দায়িত্বের চাপে নয়, ভোরের সিগ্ধ মুখটা দেখে আজকাল ওর মনে মায়া কাজ করে। মনে হয়, তাকে সর্বদা সঙ্গ দিতে, আগলে রাখতে। তার অশ্রু না ঝরাতে। কারণে অকারণে ওকে রাগিয়ে দিয়ে রাগী মুখখানা দেখতে। এভাবেই যদি ভালো থাকা যায় তবে ভালোবাসার কী প্রয়োজন? এভাবে দিন কেটে যাক, বছর পেরিয়ে যাক।
বর্তমান সময়গুলো অতীত হয়ে যাক। সর্বনাশা মায়া থেকে যাক চিরন্তন।
হঠাৎ গাড়ির ঝাঁকুনিতে ভোরের ঘুমটা ভেঙে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করল পুরুষালি শক্ত বাহুডোরে। কেউ স্বযত্নে আগলে রেখেছে তাকে। ভোর নড়তে গেলে বাঁধা পেলো, বরং আরো শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো ওকে।খুব চেনা পারফিউমের সুগন্ধ এসে নাকে বিঁধছে।ভোর স্থির হয়ে গেল।তার মস্তিষ্ক জানিয়ে দিলো, সে কে। মানুষটার হৃদস্পন্দের ধুকপুক শব্দও শুনতে পেলো। কেন জানি সে অনুভব করল এই প্রশস্ত বুক শান্তির আবাস। আর এই শান্তিটুকু তার প্রয়োজন, বড্ড প্রয়োজন।
একখন্ড শান্তির দেখা পেয়ে তার মনটাও লোভী হয়ে উঠল, আঁচলভর্তি শান্তি কুড়াতে ইচ্ছেরা দলবদ্ধভাবে সায় দিলো। কিন্তু তাৎক্ষণিক সে নিজেকে সামলে নিলো। অবাধ্য মনকে কড়াভাবে শাসিয়ে নিলো। তারপর জোর খাঁটিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় নামল। তখন তিতাস বলল,
-” একাধিক বার চেষ্টা করুন।”
-”দিন দিন তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে, ছাড় আমাকে।”
-”পারব না।”
-”তিতাস!”
-”সুন্দর করেও তো ডাকা যায়, তাই না? বড় বলে সবসময় ধমকাতে হবে?”
-”এবার কিন্তু কামড়ে দিবো।”
-”আমিও।”
-”আজ আমার বাবা মারা গেছে, কষ্টের মুহূর্তে ফাজলামি করিস না, প্লিজ।”
-”এজন্য ই তো সুযোগ দিচ্ছি।”
-”কিসের?”
-”আমার বুকে লুটিয়ে পড়ে কান্না করার। নিন কাঁদুন, যতবার ইচ্ছে হবে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদবেন। এটা আপনার জন্য উন্মুক্ত।”
ততক্ষণে জ্যামের কারণে গাড়ি থেমে গেছে। ভোর ছটফট করাতে তিতাস এবার ছেড়ে দিলো। তখন গাড়ির গ্লাসে কেউ নক করল। পথশিশু হবে হয়তো। বেলি ফুলের মালা অথবা অন্যকিছু নেওয়ার জন্য। তিতাস গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, আয়মান। পাশের গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভোরের দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন বিশ্বজয় করে সবে ফিরেছে। তিতাস ওকে দেখে ফিচেল গলায় বলল,
–”পথশিশুর মতো নক দিচ্ছেন, খুচরো পয়সা টয়সা লাগবে নাকি?”
একথা শুনে আয়মানের মুখটা রাগে থমথমে হয়ে গেল। সে
তবুও নিজের স্বাভাবিক রাখল। কারণ এখানে ভোর আছে। তার সামনে আসল রুপ বের করা আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা সমান। তখন ভোর রেগে তাকালে তিতাস চুপ হয়ে গেল। তবে তার ছটফটানি বেড়ে গেল, সে শুভ্র শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বলল,
-”আপনি আমার শশুড় বাড়ির লোক আপনাকে খালি মুখে যেতেই দিবো না, চলুন ওই সামনের দোকানে গিয়ে কিছুমিছু খাইয়ে আনি।”
-” থাক, এত কষ্ট করতে হবে না।”
-”তা বললে হয় নাকি?”
একথা বলে তিতাসগাড়ি থেকে বের হয়ে আয়মানকেও টেনে বের করল। তারপর তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। যেন তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভোর প্রচন্ড বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। এই ছেলে কী দিয়ে তার বোধগম্য হয় না।ক্ষনিকেই শান্ত খানিকেই দূরন্ত। মাঝরাস্তায় আতিথিয়েতার মানে হয়! তাও এই মুহূর্তে। ভোর দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করল।বাবার সঙ্গে ম/রে গেলে মন্দ হয় না। এই পৃথিবীর আলো বাতাসও স্বার্থপর। এসব ভেবে
পুনরায় তার চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। তার জীবনের গতিপথ এমন পর্যায়ে এসে থমকে গেছে, না পারছে এগিয়ে যেতে আর না পারছে বাঁধন কেটে হারিয়ে যেতে। তিতাস কী সত্যিই তাকে মেনে নিয়েছে? নাকি করুণার বশে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে? তার সঙ্গে কী সত্যিই বাকি পথ পাড়ি দিবে? নাকি মাঝপথে হাত ছেড়ে চলে যাওয়ার তাগাদা দিবে?এসব
প্রশ্নগুলো সর্বদা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।সে ওর বাবাকে
কথাও দিয়েছিল, তিতাস যদি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়, সে দুই হাত বাড়াবে, স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে। বিয়ে করে এক রুমে থাকলেই স্বামী-স্ত্রী হওয়া যায় না। এখানে বিশ্বাস এবং ভালোবাসার স্থান সবার ঊর্ধ্বে। কিন্তু তারা এখনো অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতেই পারি না। সেদিন তিতাসের বড় বোন নোংরা কথাগুলো বলা মাত্রই, তিতাসের মা’ও উপস্থিত হয়েছিলেন।
উনি সবকথা শুনেছিলেন। নিজের মেয়ের মুখের ভাষা শুনে
উনি কিছু বলার রুচিই হারিয়ে ফেলেছেন। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ভোরের মুখপানে। ভোর অবলীলায় এসব কথা হজম করে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো। তখন তিনি
ভোর হাত দু’টো ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,
-” আমার পিয়াস আমার কোলশূন্য করে চলে গেছে। আমার তিতাসটাও মরে যাবে। পিয়াসের অকাল মৃত্যু তিতাস মানতে পারে নি। সে কাঁদে নি, একটুও কাঁদে নি। আমি জানি পিয়াস তার কাছে কী ছিল। ঠিক কতটা ভালো সম্পর্ক দুই ভাইয়ের মধ্যে। কিন্তু এখন তোকে ও পিয়াসকে জড়িয়ে নোংরা কথা শুনতে হয়। অনেকেই তোর নাম করে তিতাসকেও খোঁচাতে কম করে না। যে ছেলেটা কখনো কারো কথা শুনতে পারত না, আমার সেই ছেলেটা নিশ্চুপ হয়ে সবটা সহ্য করে যায়।
কিন্তু ওর চোখ বলে, ‘মা, আমি ভালো নেই।’
-”আমাকে কিছুদিন সময় দিন আমি সুইডেন চলে যাবো।”
-”পালাতে চাচ্ছিস? এর চেয়ে সমাধানে আসা যায় না?”
-”মানে?”
-”বিয়েতে এবার তুই সম্মতি দে মা। আমার ছেলের দায়িত্বটা আমি তোর কাঁধে ফেলে আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে চাই।”
তারপর ভোর একপ্রকার রেগে গিয়ে তিতাসকে বিয়ের কথা বলেছিল। সে ভেবেছিল তিতাস নাকচ করবে। আর পাঁচটা ছেলের মতো বিধবাকে বিয়ে করতে নাক কুঁচকাবে। দ্বি-মত পোষণ করে চলে যাবে। সেই সঙ্গে লোক দেখানো তার করা
পাগলামিও বন্ধ হবে। কিন্তু না, তাকে অবাক করে দিয়ে সে বিয়ের ব্যবস্থা বিয়েও করে ফেলল। এখন সেই ছেলেটা তার স্বামী। এসব ভেবে ভোর দীর্ঘশ্বাস।
আর তিতাস আয়মানের কাঁধটা শক্ত করে ধরে কথা বলতে যাচ্ছে। কথা না ঠিক,রাগের মাত্রা দেখাচ্ছে। কারণ আয়মান
এতক্ষণ তাদের ফলো করছিল। যদিও সে সর্বদা তাই করে।
কিন্তু আজকে কেন জানি তার রাগ হচ্ছে। তীব্র রাগের চোটে
কথা বলতে পারছে না। যদিও সে রাগ সংবরণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে। তখন আয়মান কৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর ভোরের দিকে তাকিয়ে পুনরায় হাসল। ভোর ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তিতাসও মুখভর্তি হাসি নিয়ে পেছনে ফিরে ভোরকে দেখে নিলো। তারপর দু’টো আইসক্রিম নিয়ে
নিজেই খেতে শুরু করল। একবারও আয়মানকে সাধল না। খেতে সাধার জন্য আয়মানকে এখানে আনেও নি সে। মূলত এসেছে, কিছু কথা জানতে এবং জানাতে। তখন আয়মান তিতাসের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
– “ওই সংবাদটা এতক্ষণে পেয়ে গেছো তাই না?”
-”কোন সংবাদ?”
-”লোক লাগিয়ে এক্সিডেন্ট করানোর সংবাদ।”
-”কে করেছে, তুই?”
-”উহুম, ভোর নিজেই।”
To be continue…….!!