প্রিয় অপরিচিত পর্ব -০১

বছরখানেক আগে এক ব্যস্ত রাস্তা পার হওয়ার সময় আমি উঁচু হিলের জুতোর জন্য পা মচকে রাস্তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলাম, চোখ বন্ধ করে ধরেই নিয়েছিলাম এটা আমার জীবনের শেষ মূহুর্ত, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কিছুটা দূরে একটা বাস রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে। কিন্তু আধ মচকানো পা নিয়ে আগানোর মতো কোনো প্রকার শক্তি আমার মধ্যে ছিলোনা। কিন্তু ঠিক তখনি ঠাহর করতে পারলাম আমি শূন্যে উঠে গেছি,চোখের পলকে আমি রাস্তার ওপারে চলে আসছি,আর ধিম ধিম আওয়াজ করে আমার আজরাইল ভাবা বাসটা একটু গতির সাথে থেমেছে,তাও কিছুটা দূরেই। রাস্তা থেকে না সরলে আমি এই যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও হয়তো আজীবন হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করেই রাখতে হতো। কারণ বাসটার পক্ষেও এত দ্রুত থেমে যাওয়া সম্ভব ছিলোনা, যেখানে তারা দেখছিলো আমি দ্রুতপায়ে পার হচ্ছিলাম, তারা কি করে ভাব্বে মধ্যখানে এসে আমার পা মচকে যাবে? তবে ভাবুক না ভাবুক গালির হাত থেকে রেহাই পেলাম না, ভেতর থেকে একজন ভয়ানক চেহেরা বের করে জোরে জোরে বলছে,
‘ এতো মরার ইচ্ছা থাকলে রেললাইন চোখে পড়ে না? আমাদের ভাত মারতে আসেন কেন? যদি কিছু হয়ে যেতো, ফাঁসাতো তো আমাদেরই, অসভ্য ছেলেমেয়ে। এই ভাই বাস ছাড়েন।

বলার পরেই বাসটা পূর্ণ গতিতে আবার চললো, ইতোমধ্যে এটার পেছনে অনেকগুলো গাড়ী এসে সারিবদ্ধতায় জমে গেছে। এবার সবগুলো আবার তাদের মতো করে চলছে, কিন্তু আমি স্থির। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা আমি বেঁচে আছি,আর সেই জুতা পায়েই আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি আশেপাশে তাকালাম। কয়েকজন আমাকে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি একটু অন্য মনস্কের কবল থেকে বের হয়েই কাউকে খুঁজছি, কালো হ্যাঁ ছেলেটা কালো শার্ট পরিধান করেছিলো, যে অচেনা অজানা একটা মৃত্যুযাত্রী মানুষকে কিছু না ভেবেই রাস্তার মধ্যে এলোপাতাড়ি হয়ে পেছন থেকেই আধকোলে তুলে নিয়েছিলো। রাস্তার এপারে এনে কিছু না বলেই পাশে দাঁড়িয়ে বাস থেকে বকাঝকা করা লোকটার কথা শুনছিলো, আমি তাকে ঝাপসা ঝাপসা একপাশ দেখেছি, কিন্তু তখন তাকাইনি। এখন দেখতে গিয়ে আর কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা! কি আশ্চর্য আমি কি ধন্যবাদটুকুও দেওয়ার সুযোগ পাবোনা নাকি?
সবাই সবার মতো করে আমাকে কথা শোনাতে শোনাতে সরে পড়ছে, আর আমার চোখ পাগলের মতো খুঁজছে আমাকে নতুন জীবনদানের উছিলা হয়ে আসা মানুষটাকে। আমি দূরের একটা বাচ্চাছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ তুমি দেখেছিলে কোন ছেলেটা আমাকে এপাশে নিয়ে আসলো?

ছেলেটা মাথা নেড়ে বললো,
‘ হ্যাঁ দেখেছিলাম।

আমি আগ্রহের সাথে বললাম,
‘ কোথায় সে?

ছেলেটা আঙুল তুলে উত্তরদিকে ইশারা করে বললো,
‘ উনি আরো দুজনের সাথে বাইকে উঠে এদিকেই চলে গেলেন দেখলাম।

আমি কপালে হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, তারপর নিচু হলাম জুতো খোলার তাগিদে। খালি পায়েই বাকি পথ যাবো, আর মনে মনে গভীর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে গেলাম,
কখনোই এমন মরণঘাতি জুতো পরবোনা। কিন্তু নিচে তাকাতেই আমি হলুদ রঙের একটা রুমাল দেখতে পেলাম৷ বুঝে গেলাম এটা নিশ্চয়ই তার ! এভাবে আমাকে কোলে নেওয়াতে হয়তো পকেট থেকে অথবা হাত থেকেই পড়ে গেছে। আমি রুমালটাকে তুলে ধূলো ঝেড়ে আমার পার্সে রেখে দিলাম। অন্যদিকে আশেপাশের এতো মানুষের বকাগুলো একটুও আমার গায়ে ঠেকেনি, আমি জানিনা কেন? আমি কখনোই বকা শুনে অভ্যস্ত না, আর না এসব পছন্দ করি, তবুও মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বেঁচে আছি এইতো অনেক,তাইনা? মানুষ বকবে এটাই স্বাভাবিক,কিছু একটা হয়ে গেলে আমার জন্য কতজনই তো ফাঁসতো!

অতঃপর সেখান থেকে আমি আমার গন্তব্যে হাঁটছিলাম আর আমার দেবদূত হয়ে আসা মানুষটাকে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। শুধু ভাবছিলাম আমি কি তাকে কখনো আর দেখতে পাবো? একবারের জন্যও?
আমার এই ভাবনার সিমান্ত অতিক্রম হতে লাগলো বেগতিক। তাকে পূণরায় দেখার বাসনার সাথে যুক্ত হতে থাকলো আরো নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষারা। সেদিন গেলো,পরদিন আসলো, সপ্তাহ কাটলো, মাসের পর মাস কাটলো আমি রুমে থাকা সবটা সময় একটা রুমাল হাতে নিয়ে কাটিয়ে দেই, জানেন আমি রুমালটাকে এখনো ধুইনি,আমি এর মধ্যে সেই আগন্তুকের গন্ধ পাই, আমি প্রতিবার এর গন্ধে মাতাল হই, আমি তাকে না দেখে, না জেনে, না বলেই ভালোবাসি।
তাই আমার পক্ষে এই বিয়ে করাটা সম্পূর্ণই….

আমি আর কিছু বলার আগেই আমাকে আজ দেখতে আসা আমার বাবা-মার যোগ্য পাত্র সাহেব বলে উঠলেন,
‘ অসম্ভব তাইতো?

মাথা নেড়ে বললাম,
‘ হ্যাঁ! একদম। আপনি আমাকে পাগল বলতে পারেন, কারণ আমি অস্তিত্বহীন একজনের জন্য একপাক্ষিক ভালোবাসা জমিয়েছি তাও আবার যাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভবনা যেখানে শূন্য। তবে আমার বিশ্বাস একদিন নিশ্চয়ই আমি তার দেখা পাবো৷ হোক সেটা আমার জীবনের শেষ সময়, কিংবা আমি বৃদ্ধা! তবুও সেদিন একবার তাকে বলবো, আমাকে বাঁচানো সেদিনের পরের প্রতিটা সেকেন্ডই আমার তাকে নিয়ে ভেবে এবং তাকে কল্পনা করে ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে কেটেছে। আমি তাকে ভালোবাসি, আজন্মকাল বাসবো।

লোকটা কফির শেষ চুমুকটা দিয়েই উঠে দাঁড়ালো, আর আস্তে আস্তে বললো,
‘ আপনাকে কোনোভাবেই আমার পাগল মনে হচ্ছে না, আর দুনিয়ায় এমন কিছু পাগলের দরকার আছে। কেননা পাগলরা যুগে যুগে ভালোবাসার একেকটা সংজ্ঞা নিরূপণ করে। শুনেন আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকেন এই বিয়ে হবেনা৷

আমি বেশ খুশির সাথে ধন্যবাদ বলে উঠে দাঁড়ালাম। লোকটা মৃদু হেসে বারান্দা ছাড়লো।
আমি দৌঁড়ে রুমে গিয়ে সেই রুমালটা বের করে চোখে মুখে বুলিয়ে, ফিসফিস করে বললাম, প্রিয় অপরিচিত! কবে আপনার দেখা মিলবে, কবে আপনি আমার হবেন?

রুমালের সাথে মিনিট দশেক আমার একা একা কথা বলার পরে আমার বড় আপু এসে হাসির সহিত বলে উঠলো,
‘ উপমা পাত্র তোকে ভীষণ পছন্দ করেছে, ওরা একদম বিয়ের তারিখ পাকা করে ফেললো, আগামীমাসের ৭ তারিখ মঙ্গলবার বিয়ে।

আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম,বড় বড় চোখ করে বললাম,
‘ মজা?

আপু ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ হ আমার খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই তো।

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। আমি রাগে বিরক্তিতে ধপ করে বসে পড়লাম। তারপর সাথে সাথেই আবার উঠে দাঁড়ালাম, দ্রুত পায়ে দরজার কাছ থেকে উঁকি দিলাম, দেখলাম তারা বিদায় নিচ্ছে। আমি মুখ ফিরিয়ে ফেললাম। উনাকে অনেক ভালো মনে করছিলাম, কি সুন্দর করে আমাকে নিশ্চিন্ত করে গেলো, পরে কিনা সেখানে গিয়ে! উফফ!
না না এই বিয়ে তো আমি করবোনা, আজকে ২৮ তারিখ ৭ তারিখ আসতে অনেক দেরি। এই বিশ্বাসঘাতককে আমি দেখে নিবো! সব জেনে এটা কিভাবে করতে পারলো?

চলবে….

#প্রিয়_অপরিচিত [০১]
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here