প্রিয় অপরিচিত পর্ব -০২

#প্রিয়_অপরিচিত [০২]

আমি অন্য একটা মানুষকে ভালোবাসি জেনেও পাত্রপক্ষ এতো জলদি এই বিয়েতে কোন যুক্তিতে রাজী হলো আমি বুঝতে পারছিনা।
এটাও সত্য এই মানুষটাকে মানে পাত্রকে প্রচন্ডরকম বিশ্বাস করেছিলাম, আর সে সেই বিশ্বাসে গুরুতরভাবে আঘাত করেছে। চরম খারাপ করেছে আমার সাথে,এবং সাথে আমার বিশ্বাস হরণ করেছে।
আমার জানা নেই আমি আমার পক্ষ থেকে বিয়েটাকে কীভাবে আটকাবো? তবে অন্যদের পরিবারের মতো আমার পরিবার ততটাও কঠোর না যে আমার ভালোবাসার মানুষকে মেনে নিবেনা, কিন্তু কাল্পনিক স্বল্প সম্ভাব্য একটা মানুষকে ভালোবাসা ওদের কাছে নিছক পাগলামি, যেটা তারা এক বছর ধরে শুনে আসছে। এখনো পর্যন্ত সেটার কোনো হদিস নেই, এভাবে বারংবার ভালো ভালো পাত্রদের ফিরিয়ে দেওয়া তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সবচেয়ে বড় কথা সেই দূর্ঘটনা যখন ঘটেছিলো তখনি আমার একটা ভালো পরিবারে বিয়ের কথা চলছিলো, কিন্তু সেদিনের ঘটনার পরে অনেক কিছু বলে বুঝিয়ে বিয়েটা আঁটকেছি আমি। এরপরও অনেক সমন্ধ ফিরেছে আমার এসব উদ্ভট কথাবার্তায়।
কিন্তু মাসখানেক হলো বাবা দেশে ফিরেছে, তিনি মনস্থির করেছেন এবারে আমার বিয়ে দিবেন বলে। তিনি দীর্ঘ চার বছর একনাগাড়ে প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে এসেছেন। আবার হয়তো ৫-৬ বছর পর আসবেন, সেটা একেবারে দেশে থেকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ।
সর্বোপরি বাবার প্রবাসজীবনের চাকরির ১০ বছর চলছে। আমার ১৪ বছর বয়সে বাবা আমার এবং আমার বাকি দুই ভাইবোনের কথা ভেবে গ্রামের একটা জমি বিক্রি করে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলেন। এই ১০ বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে আমাদের। শহরে একটা ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি মেইন সিটিতে একটা দোকান, আর আশেপাশে কিছু ব্যবসার সাথে সংযুক্তি, মানে সব মিলিয়ে প্রবাস জীবনে বাবার সাফল্য অন্যদের তুলনায় ভীষণ ভালোই বটে।

বাবা এখন ভালো পাত্র হাতে পেয়েছেন, তাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন বাচ্চামো রেখে উনি যা বলে তা করতে , নয়তো আমি যাকে ভালোবাসি ওই ছেলেকে বাবার সামনে হাজির করতে। বাবা আমার পছন্দের ছেলেকে দেখে মোটামুটি কোনো অবলম্বন থাকলেও মিলিয়ে দিবেন, তবুও এবারই নিজ চোখে বড় মেয়ের সংসারের সূচনা করবেন৷
বাবার এসব কথার পরে মা তো একদম আবেগের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে, বাবা এতো করে চাইছে আমার বিয়ের দায়িত্ব নিজে হাতে নিতে, সেখানে আমি মেয়ে অমত করি কীভাবে? তার উপর আমার বয়স ২০ এর কমও না, প্রায় ২৫ চলছে, এমন অবস্থায় একটা মেয়ে কীভাবে মা-বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারে আমার জানা নেই। আর বাবা ছাড়া মেয়ের বিয়ের কার্য সম্পাদন একটা মায়ের পক্ষে যে কতটা কঠিন সেটা শুধু স্বামী দূরে থাকা স্ত্রীরাই জানে৷ হ্যাঁ আমার কাছে কোনো অপশন নেই, সরাসরি মানা করার অধিকার সম্পূর্ণরূপে শেষ আমার।

বিয়েটা আটকানোর সব চেষ্টা বৃথা যাওয়ার পাশাপাশি আমি পাত্র’র সাথে যোগাযোগ করার মতোও কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা।
উনার ফেইসবুক আইডি আমার সংগ্রহে ছিলো, সেটাও এখন আর খুঁজে পাচ্ছিনা, কি জানি, ডিএক্টিভ করে রেখেছে হয়তো। সার্চলিস্ট কয়েকশোবার দেখেছি, নাহ পাইইনা একদম!
ফোন নাম্বারও নেওয়া হয়নি, কে জানতো ওই লোক সেদিনই বিয়ে ঠিক করবে, আর তার প্রয়োজন পরবর্তীতে আমার উপর এতো তীব্রভাবে পড়বে? অথচ সেদিন আমাকে এতো সুন্দর করে আশংকামুক্ত করে গেলো। এতো খারাপ মানুষ হয়?

এদিকে দিন ঘনিয়ে আসছিলো আর আমার ভেতরকার ভয়ও বাড়ছিলো। সত্যি সত্যিই না বিয়েটা হয়ে যায়। তারপর! তারপর কি ওই লোকটার সাথে আমার সংসার করতে হবে? আমার ভালোবাসার কি হবে? আমার এতো যত্নেগড়া জমানো আবেগ! আমার স্বপ্ন,আমার সাধনা, আমার প্রিয় অপরিচিত’র তরে একহৃদ উজাড় করা ভালোবাসা?
না না আমি কিছুতেই আমার ভালোবাসা স্থানান্তরিত করতে পারবোনা, যা কিছু হয়ে যাক না কেন!
যে করেই হোক উনার সাথে কথা বলার কোনো উপায় বের করতে হবে।
আর জিজ্ঞাসা করতে হবে কি করে এমন বাজেরকম ছলনা করতে পারলো উনি!

চলে গেলো আরো ক’দিন।
৫ তারিখ বিকেল বেলা অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম মার থেকে পাত্রের নাম্বার চাবো। নিশ্চয়ই মায়ের কাছে উনার নাম্বার দিছে, কিংবা মা উনার পরিবারের নাম্বার রেখেছে। বলেকয়ে আনাতে পারলে বড্ড উপকার হবে।
কিন্তু সাহস সঞ্চয় করতে পারছিনা, যদি এখন নাম্বার আনার পরে বিয়ে ভেঙে যায়, মা কোনো প্রকার সন্দেহ করে আমাকে! বাবা অনেক কষ্ট পাবে। সাথে আমার সাথে কথা বলার বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু বিয়ে যেভাবেই ভাঙুক পারিবারিক সন্দেহ থেকে নিস্তার পাবোনা তা আমার আগেরই জানা।
কারণ উনারা তো জানেনই যে আমি এই বিয়েতে সম্পূর্ণ অমত।

অথচ যদি ওইদিন প্রথমেই উনি অমত পোষন কিংবা সময় চেয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন অজুহাতে বিয়ে ভেঙে দিতেন, তাইলে আমাকে আর এতো যন্ত্রণার শিকার হতে হতোনা। হলেও সেটা আবার অন্য পাত্র আসলে।
নাহ আমি পারলাম না মায়ের মুখোমুখি হতে৷ অনেকবার গিয়েও ফিরে এসেছি, এদিকে কাল আমার হ্লুদের অনুষ্ঠান। সকল আত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়া শেষ, এই মূহুর্তে কি করেই বা পারি!
দম আটকে মরে যাবো মনে হচ্ছিলো! শেষে পর্যন্ত একটা মিথ্যুক প্রতারককে আমার জীবনসঙ্গী করতে হবে? যে কিনা বিয়ের আগেই কথা দিয়ে কথা ভঙ্গ করেছে, সে বিয়ের পরে আমার পরমানুষী আবদার শুনবে? উনি সিনেমার নায়ক তো আর নয়!

এই সব গেলো আমার, আমার অপরিচিত আর পরিচিত হলোনা বুঝি! না তারে দেখলাম ভালো করে, আর শুনলাম আর একটুখানি কণ্ঠস্বর!আচ্ছা পৃথিবীটা কি খুব বড়? কেন আরেকটাবার দেখা হয়না? শুধু একটাবার, যদি এমনও জানতে পারতাম উনার পৃথিবীটা অন্য কাউকে ঘিরে, তাহলে আমি শুধু একবার আমার ভেতরকার কথাগুলো চোখ বন্ধ করে বলে দিয়ে, তারপর সরে আসতাম। তারপর মুক্তমনা হয়ে ভালোবাসার দ্বিতীয়সূচনা করতাম, কিন্তু এখন আমি অজান্তে কি করে পারি?

গায়ে হলুদের রাতে আমার ফোনে একটা এসএমএস আসলো, অচেনা নাম্বার কিন্তু এসএমএসটা পড়ে বুঝলাম যার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে সে। লিখেছে,
রেগে থাকবেন না, বিয়ে করাটা আমার জন্য অতীব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, আর আমি আপনার মতোই একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম!

এটা পড়ে আমি পুরো থ হয়ে গেলাম, আমার মতো কারো অপেক্ষা করছিলো মানে? আমি আরো কল্পনা করতে লাগলাম, নাহ আমি ওই ছেলের মুখের একপাশ দেখেছি, একটা গোলগাল দাঁড়িভর্তি চেহেরা। বয়সও আমার মতো কিংবা কিছুটা বেশি যা সর্বোচ্চ ২৬-২৭ হতে পারে। আবার কম বেশি হতে পারে, কিছু ছেলেদের তো বয়স নির্ধারণ করা কঠিন! তবুও উনারটা মনে হলো এমন, এখন এটা হোক বা না হোক।
কিন্তু যার সাথে বিয়ে হবে তার বয়স ৩০+ যেটা দেখলেই বুঝা যায়। উনার মুখ ছিমছাম, মুখে দাঁড়ির প্রভাবও কম। তাহলে আমার মতো একজনের অপেক্ষা উনি কেন করছে? আমার অপেক্ষা তো উনাকে ঘিরে না! আমি খুব দ্রুত সেই নাম্বারে ফোন দিলাম, কিন্তু বিরক্তিকর আওয়াজ, কাঙ্ক্ষিত নম্বর বন্ধ! এই লোক আমার কাছে একটা ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবার। কি হতে যাচ্ছে বা করতে যাচ্ছে, উনিই কেবল জানে।

চলবে….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here