প্রিয়ংবদা পর্ব ৫

#প্রিয়ংবদা🧡
#পঞ্চম_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

আচ্ছা দিদা,দাদু যদি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসতো, তবে তুমি এখন বৃদ্ধাশ্রমে কেন দিদা? তুমি তো সিঁদুর পড়, হাতে শাখাও আছে,তারমানে তো দাদু জীবিত তাইনা? দাদু থাকার পরেও তোমার শেষ আশ্রয়টা হলো এই বৃদ্ধাশ্রম?বিষয়টা খুব দৃষ্টকটু লাগছে আমার দিদা। তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে উনি ওদিকে বিলক্ষণ নিজের বাড়িতে আরামসে আছে? কেমন ভালোবাসা এটা?”

হৃদিতা রুষ্ট স্বরে কথা গুলো বলতেই কাদম্বিনী দেবী ব্যাথিত নয়নযুগল মেলে ওর দিকে তাকালেন। তারপরে অত্যন্ত শান্তস্বরে বললেন,
“কারো সম্পর্কে, তার পরিস্থিতি সম্পর্কে না জেনে কখনোই এভাবে বলা উচিত না দিদিভাই! তুমি কতটুকু জানো ওনার বিষয়ে বলো তো?ওনার ভালোবাসা নিয়ে এভাবে প্রশ্ন তুলতে পারোনা তুমি, আমি তা মেনে নেবনা। কিছুতেই না।এই পৃথিবীতে সবার যদি ওনার ভালোবাসার গভীরতা নিয়ে সন্দেহ থাকে তবুও আমার নেই। একবিন্দুও না। ”

হৃদিতার দৃষ্টি এবারে নম্র হলো, রাগে জ্বলন্ত আঁখিপটে খনিকের ব্যবধানেই ফুটে উঠলো প্রকাশ্য অপরাধবোধ। তার অন্তরাত্মা তাকে জানান দিল, সে না জেনেই বড্ড বেশি বলে ফেলেছে। ভীষণ বেশি।
মুহুর্তেই তার মনে পড়লো, বাবা তাকে বলেছিলেন,
“কারো পরিস্থিতি সম্পর্কে সবটা সম্পূর্ণ রুপে অবগত হবার আগে, কখনো কাউকে দোষারোপ করতে নেই। কাউকে দোষী করে ফেলাটা হয়তো আমাদের কাছে খুব সোজা, তবে যে দোষী প্রতিপণ্য হয়ে সবার সামনে হেয় হয়, সে জানে সুনিপুণ বিচার না করেই দোষীর পদবী গায়ে ঠুকে দেয়াটা কতটা কষ্টের।
মনে রেখ মা, যার যার গল্প, তার তার নিজের মুখে না শোনা অবধি সেই গল্প নিছকই গল্প, প্রগাঢ় এক মিথ্যা! ”
হৃদিতার আত্মগ্লানিতে দৃপ্ত দৃষ্টিদ্বয় ক্ষণেই ভিজে উঠলো।অনুতাপের লেলিহান শিখা তার ভেতরটা পুড়িয়ে দিয়েই যেন শান্ত হলো, তবে সেই দহনযাতনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কাদম্বিনী দেবী তার অগাধ স্নেহে পরিপূর্ণ হস্তযুগলের স্নেহশীতল স্পর্শ হৃদিতার চুলের ফাঁক গলে ডুবিয়ে দিয়েই তার যন্ত্রণাটুকু শুষে নিলেন বলে মনে হলো। হৃদিতার বুকে জমাটবাঁধা অনুশোচনা টুকু সেই পরম স্নেহের পরশে যেন টলমলিয়ে ঝড়ে পড়লো, কৃষ্ণ কপোল সিক্ত হলো।কাদম্বিনী দেবী ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“আহা!কাঁদে কেন? কাঁদার মতো তো কিছু বলিনি দিদিভাই। কাঁদলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়?কাঁদেনা। আমি তো বয়স, অভিজ্ঞতা সবেতেই তোমার বড় সোনা!তাই কোন বিষয় সম্পর্কে উপলব্ধিও আমার তোমার চেয়ে ঢের বেশি। তাই বড় হিসেবে ছোটদের ভুল উপলব্ধি গুলোকে শুধরে দিতেই এসব বলা। তোমাকে আঘাত দিতে কিছু বলিনি দিদি!কাঁদেনা!”

হৃদিতা তখনো ফোঁপাচ্ছে।তার কান্না থামার কোন লক্ষণ না দেখে কাদম্বিনী দেবী এবার মজা করে বললেন,
“তোর কপালেও বড় দুঃখ আছে বুঝলি!”

হৃদিতা ভ্রু কুচকে নাক টেনে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?কি করেছি?”

কাদম্বিনী দেবী হেসে বললেন,
“তোর বিয়ের পরে সময় অসময়ে যে এক আকাশ সম লজ্জার চাদরে তোকে তোর বর মুড়িয়ে দেবে তা নিশ্চিত।
তোর দাদু বলতো, যাদের বউ বেশি কাঁদে, তাদের সবারই উচিত কান্নার মাঝরাস্তাতেই সেসব ছিচকাঁদুনে বউয়েদের গালে টপাটপ চুমু দিয়ে দেয়া। হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া এই চুমুর বর্ষণে যখন তাদের স্বভারসুলভ লাজুকতা প্রস্ফুটিত হবে, লজ্জায় রাঙা দুগাল যখন আরো রক্তিম হবে, তখন তারা ঠিকই ভুলে যাবে আসলে কি কারণে কাঁদছিল। লজ্জায় এটাও ভুলে যেতে পারে যে কিছুক্ষণ আগেই কান্নাকাটি করে হাত পা ছোড়াছুড়ি অবস্থা হয়েছিল।
আর আমার ওপরেও এই কৌশলই প্রয়োগ করতেন উনি। যখনই হুটহাট মন খারাপ করে কেঁদে ফেলতাম তখনই টুপটাপ, পরপর চুমু দিয়ে যেতেন। আর তখন লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলতাম, সত্যি ভুলে যেতাম কান্নার কারণ।”

কাদম্বিনী দেবী হেসে কুটিকুটি হলেন। ওনার হাসি দেখে হৃদিতাও ভেজা চোখে হেসে ফেললো। তারপর অপরাধী স্বরে বললো,
“সরি দিদা। আমি না জেনে বেশি বলে ফেলেছি গো। এভাবে বলার আগে সবটা জানা উচিত ছিল। সরি দিদা।আর কখনো হবেনা। তুমি আমার ওপর রেগে থেকোনা কেমন?”
কাদম্বিনী দেবী স্নেহসুলভ হাসলেন, হৃদিতার মাথায় হাত রেখে আস্বস্ত করে বললেন,
“আমি রেগে নেই দিদিভাই।দিদা তোমাকে বিশ্বাস করে, আমি জানি তুমি আর এমন করবেনা!”

হৃদিতা কালবিলম্ব না করে কাদম্বিনী দেবীর বুকে মাথা রাখে। নাতনীস্থানীয়া মেয়েটিকে তিনিও বেশ সাদরেই গ্রহণ করেন নিজের স্নেহাশিসময় আলিঙ্গনে।
.
বেলা যখন ডুবন্ত প্রায় সূর্য যখন পাটে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই হৃদিতা গুটিগুটি পায়ে বড় রাস্তার মোড়ে এসে ওঠে।মোড়ের মাথায় একটা বড় খাবার হোটেল,ওপরে মস্ত সাইনবোর্ডে লেখা “হোটেল খাইখাই”! হৃদিতা হোটেলটার নামটা নিজের মনে বেশ কিছুক্ষণ আওড়ে নিয়ে হেসে ফেলে, তার মানসপটে ভেসে ওঠে সুকুমার রায়ের লেখা বিখ্যাত কবিতা” খাই খাই” তে উল্লেখিত সব আজব খাবারের নাম।হোটেলটা এই মাত্র কিছুদিন হলো খোলা হয়েছে, এর আগে কখনো তেমনভাবে খেয়াল করেনি বলেই হয়তো, এই আজব নামকরণ তার চোখ পড়েনি!
হোটেলের পাশেই একটা পানের দোকান, ঘামে জবজবে হওয়া সাদা স্যান্ডোগেঞ্জি আর সাদাকালোর ডোরাকাটা একটা লুঙ্গি পরিহিত ব্যাক্তি অতি দক্ষ কৌশলে একের পর এক পানের খিলি বানিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত এই লোকটাই দোকানী।হৃদিতা কিছুক্ষণ বেশ মনোনিবেশের সাথে দেখে নিল সেই পান বানাবার কৌশল। জলের মধ্যে ডুবন্ত পানের থেকে একটা করে তুলে তার বোটাটা ছিড়ে ফেলে রাখছেন একটা বাটিতে।তারপরে পানের ভেতরে সুপুরি, গোটা ধনে, গোটা মৌরী, আর কি কি যেন, হৃদিতা ঠিক ধরতে পারলো না, সেসব কিছু পুড়ে কেমন একটা ভাবে পানটাকে মুড়িয়ে কোণ আকারের করে দিলেন।হৃদিতা নিজের হাতের আঙুলগুলো একবার ওভাবে নাড়ালো, তবে পান হাতে না থাকায় ঠিক বুঝলো না সে দোকানীর মতোই ঠিকঠাক করে বানাতে পারবে কিনা।দোকানী লোকটি হৃদিতাকে বেশ অনেকক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাও মামণি?পান খাইবা?বানায়া দিব নাকি একখান?খাইয়া দেখবার পারো আম্মা!একদমই খাসা খাইতে!”
হৃদিতা চটপট বলে দিল,
“আমি পান খাইনা আঙ্কেল, মা বলে পান খেলে জিভ ভারী হয়ে যায়, তখন আর ঠিক ভাবে পড়া পড়া যায় না!আমি তো শুধু আপনার পান বানানো দেখছিলাম। খুব ভালো বানান!”

দোকানী লোকটি লাজুক হেসে জবাব দিল,
“আজ্ঞে ধইন্যবাদ মামনি!তোমার বাইত্তে যদি কেউ পান খাইতে চায় তো তাগো কইয়ো যেন আমার থাইকাই লইয়া যায়! কেমন?”

হৃদিতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো,
“জ্বি আঙ্কেল, বলবো!আজ তবে আসি!ভালো থাকবেন!”

দোকানী সপ্রতিভ স্বরে বললেন,
“হ হ মা যাও, তুমিও ভালা থাইকো!”

হৃদিতা মাথা নেড়েই সামনে চলে এলো,দোকানটার থেকে ৪ ৫ হাত দুরে।
সামনের পিচঢালা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে তার মনে আবার উদয় হলো, সেই খালি পায়ে পথচলার ইচ্ছে। হৃদিতা ইচ্ছে পূরণ করার জন্যই পায়ের জুতোজোড়া খুলে হাতে নিল। রাস্তা পুরো ফাঁকা, তাই কারো দেখার চান্স নেই আর থাকলেও বা কি?হৃদিতার ইচ্ছে করলে সে কারো থাকা না থাকার তোয়াক্কা করেনা কখনো।।নিজের ইচ্ছেকে মনে মাঝে চেপে রাখতে সে কোনকালেই পারেনা, শেখেওনি অবশ্য।
খালি পায়ে হেটে হেটে পাকা রাস্তা পেরিয়ে কাচা রাস্তায় পা রাখতেই চোখ আটকালো রঙের বাহারে। কাচা রাস্তার দুদিকটায় কেউ যেন বহু যত্নে সাদা-গোলাপী-হলুদের মিশেলে বেশ অনেকদুর পর্যন্ত রেইনলিলি দিয়ে সাজিয়ে গেছে, ভরা বর্ষায় সেই সাজানো ফুলের রুপ দেখে হৃদিতার চোখজোড়া ছাপিয়ে উঠল মুগ্ধতা।
সকালেও দেখেছিল, তবে ফুলগুলো পুরো ফোটেনি তখনও,সবে মাত্র কুদি ফুটে নিজেদের মেলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখন এই বিকেলের লালাভ আগ্নেয়গিরিতে স্নান করে নিজেদের প্রকৃত শোভা মাথা উঁচিয়ে যেন সগর্বে প্রকাশ করে চলেছে হৃদিতার সামনে।হৃদিতাও তাদের গর্বিত প্রকাশকে আরো গর্বিত করে তৃলতেই যেন সেই দম্ভপূর্ণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো।
হৃদিতার নয়নজোড়া যখন সেই বৃষ্টি রাণীদের রুপরসে মুগ্ধ হতে ব্যস্ত তখনই পেছন থেকে শুনতে পেল খানিকটা পরিচিত কন্ঠ,
“কেমন আছেন?”
হৃদিতার কানে ডাকটা বাজতেই তার চেনা চেনা বোধ হল, তবে ঠিক মনে করে উঠতে না পারায় পিছু ফিরে দাঁড়ালো, আর সেই আবাহনকারীর মুখদর্শনমাত্র দুই অধরের মাঝস্থলে সৃষ্টি হলো কিঞ্চিৎ দূরত্ব।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি? আপনি ঐ অপহরনকারীর লাইট ভার্সন না?”

সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো,
“হোয়াট?অপহরণকারীর লাইট ভার্স মানে কি?হোয়াট দা হেল!”

হৃদিতা এবার স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল,
“জোড় করে তুলে টুলে নিয়ে গিয়ে বেধে টেধে রাখাটা একধরণের অপহরণই তো। তবে অপহরণ করে বেশি কিছু করেননি, শুধু একটু মানে অনেকটাই প্রশ্ন করেছিলেন! তাই আর কি লাইট ভার্সন বললাম!আপনিও না!এত কম বুঝলে হবে?বেশি বেশি বুঝতে হবে!”

ছেলেটা ততক্ষণে আরো বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে হৃদিতার দিকে।হৃদিতার কথা শুনে সে বুক ভরে একটা শ্বাস নিয়ে জবাব দিল,
“ঠিকই বলেছেন, একটু কম বুঝি!কি করবো বলুন?জন্মগতই এমন! কম বুঝদার!”

হৃদিতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ছেলেটির বলার ধরণে। ছেলেটি এই প্রথম আর প্রথম বারের মতো বিরক্তিতে কপালে ফেলা ভাজ ভুলে মেয়েটার দিকে তৃপ্তদৃষ্টিতে তাকালো।হৃদিতার ঠোঁটের কোণজুড়ে সৃষ্ট হাসির রেশে গোটা মুখমন্ডলে সৃষ্ট প্রতিটা ভাজ যেন হিসেব করে লক্ষ্য করলো।হৃদিতা সেসব বুঝলো না, তার সরল হৃদয় কৌতুহলে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি এখানে কি করছেন?আজও কি আমাকে ফলো করতেই এসেছেন নাকি?”

ছেলেটার ঘোরলাগা দৃষ্টি এবার সরে গেল চকিতেই। গলা পরিষ্কার করার অযথা প্রয়াসে দু একবার খুকখুক করে কাঁশলো। তারপর জবাব দিল,
“আমি কি শুধু আপনাকে ফলো করিই?এছাড়া আর কোন কাজ কি নেই আমার? আসলে এদিকে একটা জমি দেখতে এসেছি। আমাদের কোম্পানির একটা শাখা এদিকেও খুলতে চাইছেন দাদু, তাই ার কি আসা!আর আমি আপনাকে এখন ফলো করবোই বা কেন? তেমন কোন কারণ এখন নেই
যা যা মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং ছিল তা কালই মিটে গেছে ম্যাম!”

হৃদিতা হালকা হেসে বললো,
“জানি তো। মজা করলাম।রাগ করবেন না যেন!”

ছেলেটি রাগ করবেনা জানিয়ে মাথা নাগলো। হৃদিতা সৌজন্যের হাসি ঠোঁটের কোণে ধরে রেখেই বিদায় নিল। ছেলেটি আটকালো না। সেও নিজের উদ্দেশ্যের দিকে পা বাড়ালো, তবে যাবার আগ মুহুর্ত অবধি মোড়ের বাকে হারিয়ে যাওয়া সেই পুতুলের ন্যায় কৃষ্ণমূর্তিকে গাঢ় দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখতে ছাড়লো না। সে নিজেও হয়তো বুঝলো না, তার ঐ দৃষ্টিতে সুউচ্চ মুগ্ধতা ছাড়াও কিঞ্চিৎ প্রণয় আভাও খেলে গেল, নিজের অজান্তেই, অবচেতন মস্তিষ্কের ষড়যন্ত্রেই!

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here