#প্রিয়দর্শিনী
#সুমাইয়া_যোহা
পর্ব-৩৮
পান্থর কাধে মাথা রেখে তরুনিমা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। পান্থর গায়ে জড়িয়ে থাকা চাদরটা দিয়ে তরুনিমাকে সে জড়িয়ে ধরে আছে। পান্থ তরুনিমা মাথার সাথে নিজের মাথা রেখে বলে-
: আমাকে জিজ্ঞেস করলে না যে আমি এই দুদিন কেন তোমার সাথে কথা বলিনি?
তরুনিমা কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে পান্থর গালে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলে-
: প্রয়োজন মনে হয় নি তাই। হয়তো এগুলো জিজ্ঞেস করলে আপনি উত্তর দিতেন তবে আমার কাছে কারনগুলো জানার দরকার নেই। আর যদি সেখাঔএসামি কষ্ট পাই তখন আপনিও কষ্ট পাবেন। তাই যা চলে গেছে চলে যাক। তবে আমি শুধু এতোটুকুই জানি যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন আর আমি আপনাকে। এতোটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য।
কিছুক্ষণ আগে,,,
সৃষ্টি সেখান ছাদ থেকে চলে গেলে পান্থও সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে তরুনিমা পান্থর হাত ধরে আকাশের পানে উজ্জ্বল চাঁদের দিকে তাকিয়ে গুণগুনিয়ে গেয়ে উঠল-
“চাঁদের আলোয় রাত যায় যে ভরে
তাহার মত তুমি কর না কেন ওগো ধন্য মোরে।
চাঁদের আলোয় রাত যায় যে ভরে
তাহার মত তুমি কর না কেন ওগো ধন্য মোরে।”
পান্থর কোনো হেলদোল নেই। তরুনিমা পান্থর সামনে এসে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরেই বলল-
“যেমন করে নীড়ে একটি পাখি
সাথীরে কাছে তার নেয় গো ডাকি
যেমন করে নীড়ে একটি পাখি
সাথীরে কাছে তার নেয় গো ডাকি
যেমন করে সে ভালবাসে
কই তাহার মত তুমি আমায় কভুও ভালবাসো না
তো।।”
পান্থ তরুনিমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্যপাশে ফিরে দাড়ায়। তরুনিমা পান্থর পিছন থেকে পান্থর কাধে হাত রেখে বাকা ভাবে পান্থর দিকে তাকিয়ে বলল-
“অলির কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মত তুমি আমার কথা শুনে
হাসো না তো।।
ধরার ধুলিতে যে ফাগুন আসে
কই তাহার মত তুমি আমার কাছে কভু
আসো না তো।।”
পান্থ তরুনিমার হাত সরিয়ে চলে যেতে নিলেই তরুনিমা ম্লান কন্ঠে বলে উঠে-
: তাহলে কি সৃষ্টি আমাকে যা বলেছে তাই সত্যি? আমি কি আবার ঠকে যাবো?
পান্থর তরুনিমার কথায় থমকে যায়। ওর এবার নিজেকে আর দমিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি। সে পিছু ফিরে তরুনিমাকে দুই বাহু শক্ত করে ধরে জোরালো কন্ঠে বলে উঠে-
: জাস্ট শাট আপ! শাট আপ! এতো বেশি বুঝতে কে বলেছে তোমায়? আগে নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখো তারপর আমার উপর বিশ্বাস করো! ইউয়ট!
পান্থ এমনভাবে ধরাতে তরুনিমার কিঞ্চিত ব্যাথা অনুভব হলেও সে পান্থর চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির কন্ঠে বলে-
: নিজের ভালোবাসার উপর তো বিশ্বাস করার চেয়েও অধিকতর বেশি বিশ্বাস এই মানুষটার উপর আছে। যে মানুষটা আমার সাথে এক মিনিট কথা না বলে থাকে না। সেই গত দুদিন ধরে আমার সাথে কথা বলছে না। আমাকে এড়িয়ে চলছে। এইগুলো কতোটা কষ্ট আমাকে দিচ্ছে তা যদি বুঝতেন।
তরুনিমা গাল বেয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পরে। পান্থ ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তরুনিমার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দেয়। তরুনিমা পান্থর এমন আচরনে খানিকটা চমকে উঠে। পান্থ তর্জনী আঙুল দিয়ে তরুনিমার জল মুছে দিয়ে বলে-
: আমি তোমার চোখে আমার প্রতি যেই ভালোবাসাটার খোঁজ করছিলাম যেখানে শুধু আমার আমিই থাকবো। আর তা আমি পেয়ে গেছি। আমি বুঝতে চেয়েছিলাম আসলেই কি আমার প্রিয়দর্শিনী আমারই নাকি? আমি আজ পুরোপুরি নিশ্চিন্ত।
পান্থ সৃষ্টি আর নুহাশের ব্যাপারটা পুরোপুরি জানত। সৃষ্টির বিরুদ্ধে তরুনিমার কোনো পদক্ষেপ ছিল না এবং সৃষ্টিকে কিছু না বলার জন্য তরুনিমার উপর পান্থ কিছু রেগে ছিল। আর এর চেয়েও একটা বড় কারন ছিল নুহাশের সাথে তরুনিমাকে দেখা। পান্থর ভয় ঢুকে ছিল যদি তরুনিমা নুহাশের লাইফে আবার চলে যায় কিন্তু তরুনিমার বলা প্রতিটি কথা পান্থকে মুগ্ধ করেছিল। তবুও সে চেয়েছিল তরুনিমাকে কিছুটা বুঝতে এবং নিজেও তরুনিমাকে বুঝার চেষ্টা চালিয়েছে। তরুনিমার কপালে খানিকটা ভাজ পরলে পান্থ মুচকি হেসে বলে-
: মৃত মানুষের ছায়া হয় না। কিন্তু আমি মৃত নই কারন আমার ছায়া তুমি তরুনিমা। নিজের ছায়াকে নিজের থেকে কিভাবে দূরে থাকতে দেই। আমার ছায়াকে আমি সবসময় আমি আমার চোখের সীমানায় রাখি। অন্যকারো সীমানায় তার যাওয়া বারন। তাই সে ছায়াকে ছেড়ে নিজেকে মৃত মানুষ রূপে আবিষ্কৃত করতে আমি চাই না এবং সে কখনো আমি হতেও দিব না।
তরুনিমা আর কোনো কিছু বলল না। সে পান্থর কথাগুলোকে নিজের মাঝে ধারন করে নেয়। সে বুঝতে পারে পান্থ ওকে কি বুঝাতে চাইছে।
পান্থ তরুনিমাকে বসতে বলে সে উঠে চলে যায়। তরুনিমা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে রেখে নিজেকে চাদরে মুড়িয়ে রাখে। হুট করেই নিজের গালে ঠান্ডা কোনো কিছু স্পর্শ কেপে উঠে সে। বসা থেকে আচমকা দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাতেই লক্ষ্য করে পান্থ ওর ডান হাতে হলুদ এবং বাম হাতে হলুদের বাটি নিয়ে একটা দুষ্টুমিষ্টি হাসি দিয়ে চোখ টিপ দিল। তরুনিমা নিজের কোমরে হাত গুজে দিয়ে বলে উঠে-
: এটা কি হলো?
পান্থ হাতে থাকা হলুদের বাটিটা চেয়ারে রেখে তরুনিমা কোমর জড়িয়ে টেনে নিয়ে বলে তরুনিমা আরেক গালে আলতো করে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে তরুনিমা কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-
: ভালোবাসি #প্রিয়দর্শিনী! তোমার এই হলুদ রাঙা মুখটাকে আমি ভালোবাসি! আমার প্রতি তোমার জমে থাকা সব অভিমানগুলোকে আমি ভালোবাসি। আমাকে হারানোর ভয়ে তোমার সেই ভীত তুমিটাকে আমি ভালোবাসি!
পান্থ শেষের লাইনটুকু বলা মাত্রই তরুনিমা হলদে মাখা গালের সাথে নিজের গাল মিলিয়ে নিজের গালেও হলুদ মাখিয়ে নেয়। তরুনিমা পান্থর ছোয়া এবং এমন কথা চোখগুলো বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পুরো দেহ যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। শিরায় উপশিরায় বইছে এক অন্যরকম রেষ।
: এখন বুঝলাম কেন ভালো লগছে না?
কারো কন্ঠে পান্থ তরুনিমা উভয়েই চমকে উঠে। তারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে তিথি হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে মাহিমও। তরুনিমা পান্থর থেকে ছাড়া পেয়ে তিথিকে পাশ কাটিয়ে পালাতে নিয়ে মেহু ছাদের এসে আটকে দেয়। তরুনিমা এখন পারলে ছাদের সিমেন্ট ভেদ করে তার ভেতর ঢুকে যাবে এমন অবস্থা।
: এই অবস্থা! দুজনেই তো দেখি হলুদ হলুদান্বিত হয়ে আছো। ব্যাপার কি?
মেহু চোখ পাকিয়ে তরুনিম আর পান্থকে জিজ্ঞেস করলে দুজনেই খানিকটা ভ্রু কুচকায়। সাথে মিনহাজ পিছন থেকে ছাদের এসে সন্দেহ ভাজন কন্ঠে বলে উঠে-
: হলুদান্বিত? শব্দ কি নতুন নতুন আবিষ্কার করছো নাকি মেহু?
: এতো কিছু তোমার বুঝতে হবে না। সারাজীবন তো খুঁতই ধরে গেলা। এমন করে তো একটু রোমান্টিকও হতে পারলে না। শেখো কিছু আমার বন্ধুর কাছ থেকে!
মেহু খানিকটা রাগ দেখিয়ে কথাটা বলল। তিথিও তাল মিলিয়ে বলে-
: একদম ঠিক বলেছো মেহু আপু। এই যে আমার পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে একটা গরু। কেন যে বিয়ে করতে গেলাম?
: এহহহ… আমি গরু হলে তুমি গাভী। তোমার মতো গাভীর কপালে এই গরু জুটেছে এটাই অনেক।
: তার মানে তুমি শিকার করলে মাহিম যে তুমি একটা গরু।
মাহিম নিজেই নিজের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বোকা বনে যায়। এখন মাহিমের নিজেরই মনে হচ্ছে ও একটা গরু। তরুনিমা কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে চলে যায়। পান্থও তরুনিমার পিছু পিছু দৌড় দেয়। কারন এখন যদি সে এখানে নিজেও ফাসবে আর তরুনিমা ওকে চিবিয়ে খাবে।
#চলবে____
(বাস্তবিকতা ও কাল্পনিকতার সংমিশ্রনে গল্পটি সাজানো। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গুড লাক।)