#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব
” আমি তোমারো বিরহে রহিবো বিলীন,,
তোমাতে করিব বাস!
দীর্ঘ দিবসো, দীর্ঘ রজনী,,
দীর্ঘ বরোসোমাস!!
যদি আর কারে ভালোবাসো,,,
যদি আরো ফিরে নাহি আসো,,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,,
আমি যত দুখো পাই গো,,,,
আমারো পরানো যাহা চায়,
তুমি তাই গো তুমি তাই গো,,,,,
আমারো পরানো যাহা চায়!!”
পাশের বড় কক্ষ থেকে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসতেই চোখ দুটো পিটপিট করে তাকালো মিশরাত। বিকেলের দিকে হালকা চোখটা লেগে এসেছিল। হাই দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সুরকে অনুসরণ করে গুটিগুটি পায়ে এগোতেই খেয়াল করলো পাশের রুমে বাচ্চাগুলোকে রোজকার নিয়মমাফিক গানের ক্লাস করানো হচ্ছে। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিশরাত।
– ” কি ব্যাপার তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ফারাহ্?
ভেতরে চল, গিয়ে বাচ্চাদের সাথে জয়েন কর, ভালো লাগবে!”
সিদ্দিকা বেগমের কথা শুনে মিশরাত আলতো হেসে প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো,
– ” থাক না দিদা।
আমি তো এমনি গানের সুর অনুসরণ করে এসেছিলাম।
আমি বরং গিয়ে আশ্রমের বাগানটার ওদিক দিয়ে হালকা হেঁটে আসি!”
সিদ্দিকা বেগমের অনুমতি নিয়ে বাগানের দিকটায় পা বাড়ালো মিশরাত।
অপরাজিতা গাছটা ফুলে ফুলে সমারোহ। ঝোপড়া ঝোপড়া হয়ে ফুটে রয়েছে। গাছটার শক্ত ডালটায় দুটো রশি বেঁধে দিয়ে একটা দোলনা বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর মিশরাত গিয়ে দোলনা টায় বসে পড়লো।
– ” ফারাহ্ আপি, ফারাহ্ আপি!”
চিল্লাতে চিল্লাতে একটা পাঁচ ছয় বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আসলো মিশরাতের দিকে।
– ” কি হয়েছে রাই?”
– ” তুমি এখানে একা একা বসে কি করছো!
ওখানে দিদা তোমাকে ডাকছে? আজকে তো তিথি আপুর জন্মদিন! তুমি আমাদের সাথে থাকবে না?”
– ” কেন থাকবো না রাই? অবশ্যই থাকবো! চলো গিয়ে সবকিছুর আয়োজন করি!”
বলেই রাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো মিশরাত।
– ” হোয়াট! অরিন অফিস থেকে রিজাইন করেছে? মানে কি? কার পারমিশন নিয়ে তোমরা অরিনের রিজাইন লেটারে সাইন করেছো!!”
হুংকার দিয়ে উঠলো স্নিগ্ধ। তার অফিসের সব কর্মচারী ভয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
– ” কি হলো কেউ কথা বলছে না কেন?
আমার অনুপস্থিতিতে কে অরিনের রিজাইন লেটার সাইন করেছে কে?
টেল মি!!”
পুনরায় বলে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” স,স্,স্যার আমি!”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল অফিসের ম্যানেজার জাকির সাহেব।
– ” জাকির সাহেব, আপনি!!”
অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” ইয়েস স্যার, আমি। আসলে গতকাল রাতে ডিউটি শেষে অরিন ম্যাম আপনাকে না পেয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। জরুরী একটা কাজে তাকে এই জব থেকে রিজাইন নিতে হবে ইমিডিয়েটলি। আমি ব্যাপারটা আপনাকে জানানোর জন্য কয়েকবার কল ও করেছিলাম আপনাকে। বাট রেসপন্স পাই নি। তাই আপনাকে না জানিয়েই আমি সেটাতে সাইন করে দিয়েছি।”
নিচু হয়ে বলে উঠলেন জাকির সাহেব।
এখন প্রায় সবকিছুরই হিসাব মিলাতে পারছে স্নিগ্ধ।
– ” ড্যাম ইট!!
আচ্ছা ও কোথায় গিয়েছে সেটা কিছু বলে গিয়েছে?”
– ” নো স্যার!”
– ” আচ্ছা ঠিক আছে!!”
বলেই স্নিগ্ধ কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।আর জাকির সাহেব সহ বাকিরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
– ” ফারাহ্ আপু, ফারাহ্ আপু! আমাকে ঐ বেলুনটা দাও না, প্লিজ!”
কারো কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই পেছন ফিরে তাকালো মিশরাত।
– ” কি হয়েছে রাই?”
– ” আপু আমাকে ঐ বেগুনি রঙের বেলুন টা দাও না! তুমি তো কত্ত লম্বা! আমি তো একটুখানি পুঁচকে মেয়ে। আমার হাত কি ওতদূর যায় বলো?”
পাশ থেকে বেগুনি রঙের বেলুন টা রাইয়ের হাতে দিতে দিতে হালকা হেসে মিশরাত বলে উঠলো,
– ” হয়েছে, হয়েছে এই নাও! নিজেকে পুঁচকে মেয়ে দাবি করে। আবার সেই পুঁচকে মেয়েরই কত পাকা পাকা কথা!”
মিশরাতের কথা শুনে রাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মিশরাতও বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দিল।
আশ্রমের বাচ্চাগুলোর মধ্যে আজকে তিথির জন্মদিন। সে উপলক্ষে মাঝারি পরিসরেই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।
অলিভ কালারের একটা লেহেঙ্গা, হাতে স্টোনের চুড়ি, কানে এক জোড়া ঝুমকা, আর কপালে মধ্যবিন্দুতে একটা ছোট টিপ। আনমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল মিশরাত। গ্যালারি থেকে ঘুমন্ত স্নিগ্ধর কয়েকটা ছবি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে সে। বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই ফোন থেকে সিম কার্ড খুলে নেয় সে।
-” আচ্ছা স্নিগ্ধ এখন কি করছে?
এখনো আমার উপর রাগ করে না না রাগ না ওটা ঘৃণা হবে!
আচ্ছা সেই তো বলেছিলেন যে ভালোবাসার মানুষটিকে নাকি চাইলেও কোনোদিন ঘৃণা করা যায় না! তাহলে? তাহলে কি স্নিগ্ধ আমাকে কোনদিন ভালোই বাসেনি?”
পেছন থেকে সিদ্দিকা বেগমের ডাক শুনে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে মিশরাত।
– ” কি হলো ফারাহ্! কোথায় হারিয়ে গেলি? এখানে আয়! এখানে এসে দাড়াঁ।”
সিদ্দিকা বেগম তাড়া দিতেই ফোনটা অফ করে উঠে দাঁড়ালো মিশরাত।
-” এই নাও তোমার তোমার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার টিকিট!
আগামী তিন দিন পর তোমার ফ্লাইট!
আর খবরদার স্নিগ্ধর কানে যাতে কোনোদিন না পৌঁছায় এসবের কথা!”
বলেই অরিন প্লেনের টিকিট ছুড়ে মারলো রবিনের সামনে!
-” আচ্ছা সুন্দরী ম্যাডাম, সেটা না নয় নাই জানলো! মাগার একটা জিনিস বুঝলাম না, ঐ ফারাহর জামাই স্নিগ্ধর সাথে আপনার কিসের শত্রুতা যে এত কিছু প্ল্যানিং করে দুজনরে আলাদা কইরা দিলেন!”
অরিনের দিকে সরু দৃষ্টে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো রবিন।
– ” দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস!”
অরিন সোজাসাপ্টা গলায় উত্তর দিল।
– ” কিছু তো গরমিল আছে! নাইলে এত সুন্দরী একটা মাইয়া হুদাই ঐ দুইজনের সংসার ভাইঙ্গা আবার ঐ ছেড়ারে ছাইড়া দিবো কেন?
সে যাই হোক, একদিক দিয়া আমারি ভালো হইছে! ঐ ফারাহর সব অহংকার ভাইঙ্গা চুইড়া গেছে!
খুব জোর গলায় বলছিলো না? হাহ্! সব শেষ হইয়া গেছে!!”
মনে মনে বিড়বিড় করে হেসে উঠলো রবিন।
————————-
– ” কিইইই!! মিশরাত তোমার বাড়িতে নেই মানে কি? এসব তুমি কি বলছো স্নিগ্ধ?”
অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে বলে উঠলেন মিস্টার আজীজ সাহেব। আজীজ সাহেব সহ পরিবারের বাকি সদস্যদের মুখেও একি বিস্ময়তার ছাপ!
আজীজ সাহেবের প্রশ্নোত্তর পেয়ে স্নিগ্ধর কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করলো। মিশরাত এখানে নেই মানে কি? সে কোথায় যাবে তাহলে?
– ” কি বলছেন বাবা? মিশরাত এ বাড়িতে আসে নি!!”
আরেক দফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” মিশরাত এ বাড়িতে কি করবে? ওর তো তোমার বাড়িতে থাকার কথা তাই না স্নিগ্ধ?”
পেছন থেকে মিসেস ইবনাত বলে উঠলেন।
স্নিগ্ধ ঠিক কি উত্তর দিবে এই প্রশ্নের তা বুঝে উঠতে পারছে না! তার কিই বা বলা উচিত? এটা যে না মিশরাত তার বাড়িতে নেই। তাকে ছেড়ে কোনো অদূরে হারিয়ে গিয়েছে?
– ” কি হলো কিছু বলছো না কেন স্নিগ্ধ? মিশরাত কোথায়?
তোমাদের মাঝে কি কিছু হয়েছে??”
আজীজ সাহেবের কথা শুনে ধ্যান থেকে ফিরে আসলো স্নিগ্ধ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
চিল্লাচিল্লি করার আওয়াজ পেয়ে উপরের সিড়ি বেয়ে নেমে আসলো মেহের আর ইরফান। নিচে স্নিগ্ধকে এভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মেহের।
মিনিট পাঁচেক পর স্নিগ্ধ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সবটা শুরু থেকে বলা শুরু করে আর সেটা কর্ণপাত হতেই আজীজ সাহেব সহ বাকি সবার চেহারাতেই বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
অনুষ্ঠান শেষ রহিম চাচার সাথে মিলে আশ্রমের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে মিশরাত। গোছগাছ শেষ হলে লাইট অফ করে রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। রুমে যেতেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠে সে।
– ” দিদা, তুমি এখানে? এত রাত পর্যন্ত জেগে আছো! ঘুমাও নি তুমি?”
রুমে প্রবেশ করতে করতে জিজ্ঞেস করে উঠলো মিশরাত।
– ” এমনি ঘুম আসছিলো না রে ফারাহ্। আয় আমার পাশে এসে বস দেখি!!”
মিশরাতও বাধ্য মেয়ের মতো গিয়ে সিদ্দিকা বেগমের পাশে বসে পড়লো।
– ” আমি জানি ফারাহ্! তুই এখানে এমনি এমনি আসিস নি। কিছু তো একটা হয়েছে। কেননা এখানে আসার পর থেকেই তোকে দেখছি কেমন জানি উদাসীন, মনমরা হয়ে বসে থাকিস এককোণে চুপচাপ!
কি হয়েছে? বল তো আমাকে! তোর আর স্নিগ্ধের মাঝে কি এমন হয়েছে যে কাউকে না জানিয়ে এখানে চলে এসেছিস!”
ভড়কে যায় মিশরাত। গলা শুকিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে।
– ” এখন কি করি? দিদা সবটাই বা জানলো কি করে!
এখন কি দিদাকে সবটা বলা ঠিক হবে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খায় মিশারাতের। কিছুক্ষণ পর আচমকাই সিদ্দিকা বেগমের পায়ের উপর মাথা রেখে মেঝেতে বসে পড়লো সে। আর মিসেস সিদ্দিকাও হালকা হেসে মিশরাতের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলেন।
– ” তুমি এত বড় ভুল কি করে করতে পারলে স্নিগ্ধ?”
রাগে গজগজ হয়ে বলে উঠলো ইরফান। মেহের আর মিসেস ইবনাত তো এতটাই বিস্মিত হয়েছেন যে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না, নীরব দর্শকের মতো সবটাই দেখে যাচ্ছেন।
স্নিগ্ধর মুখেও কোনো কথা নেই!
– ” আমার বোনটাকে তোমার সাথে বিয়ে দেয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল! ইউ রিডিকিউলাস!!”
বলেই স্নিগ্ধর দিকে তেড়ে যেতে নেয় ইরফান। ওমনি মিস্টার আজীজ সাহেব হাতের ইশারায় থেমে যেতে বলেন ইরফানকে।
– ” মিশরাত যেমন আমার মেয়ে তেমনি সে তোমার স্ত্রী, স্নিগ্ধ। আমি তোমার কাছ থেকে এটা এক্সপেক্ট করি নি।
যাক সেসব কথা, এখন তোমার স্ত্রীকে খোঁজার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। তোমার নিজের ভুলের কারণেই যখন মিশরাত তোমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছে তবে তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব ও তোমার!
আশা করি এরপর তোমায় আর কিছু বলে দিতে হবে না!!”
শান্ত গলায় স্নিগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন আজীজ সাহেব।
স্নিগ্ধও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করে।……….
#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব
চারপাশ গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কোলাহলহীন নির্জন রাস্তায় মৃদু বাতাস এসে স্নিগ্ধর শার্টের কিছুটা অংশ ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে বারংবার।
শুনশান একটা ব্রীজের পাশ ঘেঁষে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্নিগ্ধ। এক ফালি চাঁদের হালকা আলোয় ব্রিজের নিচে বহেমিয়ান নদীর পানি চিকচিক করছে।
– ” মিশরাত তুমি কোথায়?
আমি জানি আমি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। তাই বলে এভাবে হুট করে হারিয়ে যাওয়া কী খুব প্রয়োজন ছিল? তুমি তো জানোই রাগের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে নিজের কন্ট্রোলে থাকতে পারি না আমি!
কোথায় তুমি!!”
পানির বহেমিয়ান স্রোতের দিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো স্নিগ্ধ।
পকেটে ফোনের ভাইব্রেশন টের পেতেই ভাবনার সুতো কাটে তার। পকেট থেকে ফোন বের করতেই সেখানে এসডি নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোন রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে যে কথাগুলো কানে এসে পৌঁছায় তাতে স্নিগ্ধর চেহারার রং পরিবর্তন হতে থাকে ধীরে ধীরে। যথেষ্ট পরিমাণ গাম্ভীর্য বজায় রেখে প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো,
– ” কিপ আইস অন হার! আ’ম কামিং হেয়ার!”
বলেই খট করে কল কেটে দিলো স্নিগ্ধ।
– ” আমি এর শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়বো! তোমাকে তো আমার কাছে ধরা দিতেই হবে মিস অরিন, সেটা যে করেই হোক! এত কিছু করার কারণটা কিভাবে অজানা রাখি বলো!”
আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই নিজে বলে উঠলো স্নিগ্ধ। মুখে রয়েছে স্মিত হাসি।
– ” ফারাহ্, এই ফারাহ্!”
কারো ডাক শুনে ঘুমের ঘোরেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে মিশরাত। আধো আধো চোখ মেলতেই সামনে সিদ্দিকা বেগমের চেহারা চোখে পড়ে তার।
– ” কি ব্যাপার, তুই এখানে মেঝেতে এভাবে ঘুমাচ্ছিস কেন ফারাহ্?”
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল মিশরাত। তাই তো! সে মেঝেতে বসে এতক্ষণ খাটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছিল।
– ” কিরে কথা বলছিস না কেন? কোথায় হারিয়ে গেলি?”
– ” আসলে দিদা, কাল রাতে এমনি একটা জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। কখন যে চোখ লেগে এসেছে তা টের পাইনি।”
সিদ্দিকা বেগমের কথায় আমতা আমতা করে বলে উঠলো মিশরাত। কিন্তু তার দৃষ্টি একটা জিনিস ই খুঁজে চলেছে!
– ” এটাই খুঁজছিস না তো?”
সিদ্দিকা বেগমের হাতে একটা হাতঘড়ি দৃশ্যমান। সেটা দেখে হালকা চমকে উঠে মিশরাত।
-” সেকি এই ঘড়িটা দিদা পেল কি করে? আমি তো এটা আমি ড্রয়ার টাতে রেখেছিলাম।”
– ” ভালোবাসার মানুষটার থেকে যখন দূরে থাকলেও স্মৃতি গুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, যখন চাইলেও দূরে সরে থাকতে পারবি না তাহলে অযথা দূরে থাকার বৃথা চেষ্টা কেন করছিস?
শান্ত গলায় মিশরাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন সিদ্দিকা বেগম। মিশরাতের মুখে কোনো শব্দ নেই। সিদ্দিকা বেগম তো ঠিকই বলছে। প্রতিনিয়ত নতুন করে স্নিগ্ধর স্মৃতি গুলো তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। তবুও বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত না করা অবধি সে যে স্নিগ্ধর মুখোমুখি হতে চায় না।
দুপুরের দিকে ছাদে ভেজা কাপড়গুলো মেলে এসে বাচ্চাদের খাবার আয়োজন করায় ব্যস্ত ছিলো মিশরাত। কলিং বেলের আওয়াজ কান অবধি পৌঁছাতে পেছন ফিরে তাকায় সে। এখন এই ভরদুপুরে কে আসবে?
দরজায় কড়া নাড়ার পেতেই সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে।
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলতেই চোখে মুখে বিস্ময়ের সীমানা ছড়িয়ে পড়ে তার।
– ” ভ,ভ্,ভা,ভাইয়া তুমি?”
অবাকের সুরে বলে উঠল মিশরাত।
– ” কেন কি মনে করেছিলি? তুই আমাদের থেকে লুকিয়ে থাকবি আর আমরা তোকে খুঁজে বের করতে পারবো না?”
থতমত খেয়ে যায় মিশরাত। তার এখানে থাকা সম্পর্কে তার ভাই ইরফান কী করে জানলো? তার তো জানার কথা নয়।
-” ভাইয়া তুমি এখানে কি করে এলে? আর তোমাকে এ জায়গার কথা কে বলেছে?”
উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল মিশরাত।
– ” তুই এত বড় হয়ে গিয়েছিস কবে মিশরাত যে নিজের কষ্ট গুলোকে চাপা দিয়ে একা একা সবার থেকে দূরে সরে এসেছিস?”
পাশ থেকে মেহেরের কন্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠলো মিশরাত। আরো এক দফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা দুটো মানুষের দিকে।
– ” বউমনি, তুমিও?”
– ” হ্যাঁ আমি! তোর সাহস হলো কি করে আমাদের না জানিয়ে এখানে এসে বসে আছিস!
ওদিকে যে সবাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে বেহাল দশা তার কি কোনো দাম নেই?”
মেহেরের হুংকারে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে মিশরাত।
– ” আমি তো চেয়েছিলাম তুমি আর ভাইয়া এই বিষয়ে না জানো! তোমার এই অবস্থায় কি করে এত বড় কথাটা বলতাম বলো? তাই ,,”
– ” আর তাই সবাইকে না জানিয়ে তুই দিদার কাছে চলে এসেছিস?
দিদা যদি আমাদের না বলতো তাহলে তো আমরা টেরও পেতাম না যে তুই এখানে!!”
মেহেরের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল মিশরাতের।
– ” কি!! দিদা তোমাদের আমার ব্যাপারে বলেছে??”
-” হ্যাঁ আমিই বলেছি!!”
পেছন থেকে সিদ্দিকা বেগমের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে।
– ” সরি স্যার! আমরা তার উপর নজর ই রাখছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে একটা গাড়ি আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে ক্রস করতেই ম্যাম কে আমরা হারিয়ে ফেলি! আর গাড়িটার পিছুও বেশিদূর করতে পারিনি!”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে নিচু কন্ঠে বলে উঠল স্নিগ্ধ কে।
স্নিগ্ধ তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে ছেলেটার সামনে গেল।
– ” হোয়াট! এত টা ইরেসপন্সেবল কি করে হতে পারো তোমরা! তোমাদের একটা মাত্র কাজ দিয়েছিলাম আমি! ঐ মেয়েটার উপর নজর রাখতে বলেছিলাম! সেটাও তোমাদের দ্বারা হয় নি!
আমার অরিনের সম্পর্কে প্রত্যেকটা ইনফরমেশন আমার চাই!
আর সেটাও আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে!”
স্নিগ্ধর হুংকার শুনে সামনে থাকা ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আর সেখান থেকে চলে গেল।
-” ড্যাম ইট!”
বলেই পাশে থাকা চেয়ারটা মেঝেতে ফেলে দিল স্নিগ্ধ!
– ” রবিনের মুখ থেকে আসল সত্যিটা বের না করা পর্যন্ত আমি স্নিগ্ধর সামনে যাবো না!
সত্যিটা তো আমাকে জানতেই হবে কে আমার নামে এত ঘৃন্য ষড়যন্ত্র চালিয়েছে!
আচ্ছা ভাইয়া তোমার ঐ ডিটেক্টিভ বন্ধু আছে না? উনার সাথে কথা বললেই তো পাওয়া যাবে রবিন এখন ঠিক কোথায় রয়েছে!!”
মিশরাতের বলা কথা কর্ণপাত হতেই ইরফানের টনক নড়ে। হ্যাঁ তাই তো। মিশরাত তো ঠিকই বলছে। এই কথাটা তো তার মাথায় আগে আসে নি!!
পকেট থেকে ফোনটা বের করে কললিস্ট ঘেঁটে একসময় নম্বর টা পেয়েও যায় ইরফান। ইশরাক নাম দিয়েই সেভ করা নম্বরটা!
ফোনের রিংটোনের আওয়াজ আসতেই ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে সরু চোখে ফোনের দিকে তাকালো ইশরাক। বহু বছর পর চেনা একটা নম্বর চোখে পড়তেই মুচকি হাসলো সে। কানে লাগানো ব্লুটুথ অন করে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
– ” ইয়েস মিস্টার ইরফান!”
ইশরাকের কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই ইরফান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো,
– ” কেমন আছিস?”
– ” এইতো আলহামদুলিল্লাহ! হঠাৎ এত বছর পর মনে করলি আমায়!
– ” আমি জানি তুই আমার উপর রাগ করে আছিস, কিন্তু দেখা হলে বিশ্বাস কর সব খুলে বলবো!
তুই এখন কোথায়?”
ইরফানের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইশরাক। সামনে এগিয়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায় সে।
– ” আমি তো চট্টগ্রামে! কেন কিছু কি হয়েছে ওখানে?”
– ” কালকের মধ্যে একটু ঢাকা ব্যাক করতে পারবি?”
– ” ঠিক আছে, এমনিতেও হাতে কোনো কেস নেই আপাতত! তাই কোনো সমস্যা নেই! আমি কাল সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকা ব্যাক করবো। ডোন্ট ওয়ারি!”
– ” ঠিক আছে! তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে।”
বলেই খট করে ফোন কেটে দিল ইরফান। মিশরাত ইরফানের দিকে বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
– ” ইশরাক কাল সন্ধ্যায় ঢাকায় চলে আসবে। তুই টেনশন করিস না।”
মিশরাতও বিনিময়ে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দেয়।
– ” কি মনে করেছো, স্নিগ্ধ? তোমাদের দুজনের মাঝে আমি প্রাচীর গড়ে দিয়েছি তাতেই আমার প্রতিশোধ নেয়া শেষ? উহু একদমই না! এখনো অনেক কিছু বাকি! আমি এত সহজেই তো সবটা ছেড়ে দিবো না। আমার প্রতিশোধ তো সেদিন পূর্ণ হবে যেদিন আমার সামনে তোমাকে এ কবরে রেখে আসা হবে!
এর আগে তো আমি তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি না।”
কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালে টাঙানো স্নিগ্ধর ছবিটা হাতে নিয়ে সেটাতে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো অরিন। মুখের কোণে রহস্যময় হাসি।
পরদিন বিকেলে,,
– ” সবকিছু শোনার পর তো মনে হচ্ছে রবিনের একার পক্ষে এটা করা কখনোই সম্ভব না। এর পেছনে অন্য কেউ মাস্টার মাইন্ড রয়েছে। এখন সেটা কে একমাত্র রবিনকে ধরতে পারলেই জানা যাবে!
আচ্ছা মিশরাত ঠিক মনে করার চেষ্টা করে দেখো তো গত দুয়েক মাসের ভেতর কি কোনোভাবে কোথাও তোমার রবিনের সাথে দেখা হয়েছিল?”
ইশরাকের প্রশ্ন শুনে মিশরাত খুব গভীর ভাবে চিন্তা করতে থাকলো! কিছুক্ষণ পর আপনাআপনি ই তার চোখ মুখে বিস্ময়ের আভা ফুটে উঠল।
– ” হ্যাঁ গত মাসের প্রথম দিকে একবার আমার রবিনের সাথে শপিং মলে দেখা হয়েছিল!”
উত্তর শুনতেই ইশরাকের মুখে আচমকাই হাসি ফুটলো!
– ” সেসময় আমার আর স্নিগ্ধের মাঝে কিছুটা সমস্যা চলছিল। হঠাৎ একদিন শপিং মলে রবিনের সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। আর আশ্চর্য জনক ভাবে সে আমার সামনে হাত জোর করে ক্ষমা চাইতে থাকে আর কিসব জানি উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছিলো!
কিন্তু এটার সাথে এই কেস কি কোনোভাবে রিলেটেড?”
– ” ইয়েস মিসেস মিশরাত ফারাহ্। আপনার সাথে রবিনের দেখা কোয়েন্সিডেন্সলি ভাবে হয় নি। এটা কারো প্ল্যানের একটা পার্ট ছিল মাত্র। আর এটাকে ইউজ করেই ওসব ছবি, ভিডিও বানানো হয়েছে। আই এম শিওর যেই বা এটা করছে না কেন তার উদ্দেশ্য শুধু আপনাদের মাঝে ডিসটেন্স তৈরি করা না! এর পেছনে আরো কোনো রহস্য আছে!………..
#চলবে 🍂
( আসসালামুয়ালাইকুম। সবাই কেমন আছেন। গল্প কিন্তু শেষের দিকে চলে এসেছে অনেকটাই। কি মনে হচ্ছে কি হবে সামনে।
কেমন হয়েছে আজকের পর্ব জানাবেন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)
#চলবে 🍂
( আসসালামুয়ালাইকুম। সবাই কেমন আছেন।
আমি আগেই বলেছি আমার পরীক্ষা। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাকি কয়েক পর্বগুলো আমি একদিন পরপর দিবো, যতদিন পরীক্ষা থাকে।
সর্বোপরি কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)