প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১৩|
তিতকুটে এক গরমে ঘুম ছুটে গেল আমার। সারা গায়ে প্যাচপ্যাচে ঘাম। সুতি জামাটা ল্যাপ্টে আছে পেটে-পিঠে। আমি ডানহাতটা বাড়িয়ে গলার ঘাম মুছলাম। ভ্যাপসা গরম আর বিরক্তিতে কুঁচকে গেলো কপাল। ভাঁজ পড়লো দুই ভ্রুর সংযোগ স্থলে। ঘরটা ঝাপসা অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ জেগে উঠায় দিন কী রাত বুঝে উঠতে পারছি না। কিছুক্ষণ একভাবে শুয়ে থেকে পাখার দিকে অপলক চেয়ে রইলাম আমি। কোনো দৈব বলে পাখাটা ঘুরতে শুরু করলে ভালো হতো। ঘামটা শুকোতো। এমন ঘামের সাগরে ডুবে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। উঠে গিয়ে পাখার সুইচ চাপার শক্তিটুকুও নিঃশেষ প্রায়। উঠে যাওয়া যাবে না। বেশ কিছুক্ষণ পর মস্তিষ্কটা পুরোপুরি জেগে উঠতেই মাথায় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার হদিস পেলাম। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছুটে গেল তীব্র এক ব্যথা। কপালের উপর হাত বুলিয়ে বুঝলাম, জবরদস্ত এক চোট পেয়েছি। কপালের উপর আস্ত এক ব্যথার পাহাড়। দুর্বল শরীরটাকে টেনেহ্যাঁচড়ে উঠে বসতেই ভার হয়ে এলো মাথা। ঘাড়ের উপর থেকে টুপ করে খুলে পড়ে যাবে এমন ভারি মাথা নিয়েই থম ধরে বসে রইলাম আমি। চারদিকে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। কোথাও কোনো সাড়া নেই। উৎসুক মন শুধাল, এখন কী ভীষণ রাত? আমি উত্তর দিলাম না। বেশ কিছুটা সময় পর দরজার ভারী পর্দাটা দোলে উঠল। জমিলা আপা তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচালেন,
‘ আফা উইঠা পড়ছে। ও প্রিয়তা আফা? বড় আফা উইঠা পড়ছে।’
জমিলা আপার তীক্ষ্ণ কন্ঠটা মস্তিষ্কের ভেতর বলের মতো ঢপ খেতে খেতে ঝিমঝিমিয়ে তুললো শরীর। জমিলা আপা আজকাল আমায় ‘বড় আফা’ বলে ডাকছেন। এই ডাকটা তাকে শিখিয়ে দিতে হয়নি। ধ্রুব বড় ভাইজান বলে আমি অটোমেটিক বড় আফা হয়ে গিয়েছি। বড় ভাবী হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হয়নি। জমিলা আপা উভদলীয় মানুষ। একদিকে হেলে পড়ে অন্যদিকে কট খাওয়া যাবে না। জমিলা আপা আমায় বড় আফা ডেকে সেই কট খাওয়া বাঁচাচ্ছেন। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ আমার উঠে বসাটা কোনো ব্রেকিং নিউজ নয়, জমিলা আপা। আমি জীবন্ত মানুষ। যেকোনো সময় উঠে বসতে পারি। অযথা চেঁচামেচি করবেন না।’
জমিলা আপা আমার কথাকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না। আমার দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে থেকে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ আপনি হঠাৎ ফিট খাইছেন দেইখ্যা তো আমার কলিজাডা ফাল মারছিল বড় আফা। এক্কেবারে টাকি মাছের মতোন ফাল।’
আমি ভারি মাথা নিয়ে জমিলা আপার দিকে চাইলাম। জমিলা আপা কৃত্রিম উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
‘ আপনারে সিঁড়ির ওপর ফিট মাইরা পইড়া থাকতে দেইখা ভাবছিলাম, আকাম একটা ঘটাইয়া ফেলছেন।’
আমি তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলাম। জমিলা আপা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসলেন। আমার পায়ের কাছে চেপে এসে চাপা স্বরে বললেন,
‘ তয় আপনাগো লাইগা কাম-আকাম বইলা কিছু নাই। বড় ভাইজান এত্তোবড় অফিসার মানুষ। আকাম ঘটাইয়া পট কইরা বিয়েশাদি কইরা ফালাইলে মাছিডাও টের পাইতো না।’
জমিলা আপার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
‘ এখন কী রাত জমিলা আপা? জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিন। দমবন্ধ লাগছে।’
জমিলা আপা চকচকে চোখে চাইলেন। জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই তীব্র আলোর ছটায় কুঁচকে গেল চোখ। মাথাব্যথাটা তীব্রভাবে জানান দিল তার অস্তিত্ব। আমি দু’হাতে মাথা চেপে ধরতেই আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন জমিলা আপা। উৎসাহে গদগদ হয়ে বললেন,
‘ বড় আফা? আমি হইলাম এক্সপেরেন্সড জমিলা। চোখ দেইখাই রোগ ধইরা ফেলার ক্ষমতা আমার। আফনের যে কাহিনি ঘইটা গেছে তা কিন্তু আমি বুঝছি। কিন্তু খালাআম্মায় বিশ্বাস দিলো না। তার পোলায় নাকি এক্কেরে জমজমের পানি। বলি, পুরুষ মানুষ আবার জমজমের পানি হয় কেমনে? এদের হইলো পেটে পেটে শয়তানী। মাইয়া মানুষ দেখলেই শরীর চুলকায়। মাথা নষ্ট হইয়া যায়। আপনের পোলায় আপনের সামনে সাধু থাকলেই কী বউয়ের সামনেও সাধু থাকবো নাকি?’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। এমন বিষাক্ত চিন্তার জমিলা আপার জন্য একটি ছোট্ট শব্দও নষ্ট করতে রুচি হলো না। মৃদুস্বরে বললাম,
‘ আপনার বড় ভাইজান সাধু নাকি অসাধু তা আমার জানার দরকার নেই, জমিলা আপা। তাকে নিয়ে কোনো রকম ফর্দ আমার সামনে টানবেন না। আর অবশ্যই আমায় বড় আফা ডাকবেন না। আমার নাম নিশু। ডাকতে হলে নিশু আফা বলে ডাকবেন।’
জমিলা আপা আমার কঠিন শব্দগুলোকে খুব একটা তোয়াক্কা করলেন না। আমি বিরক্তমুখে বসে রইলাম। এবারে দরজার ভারী পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। আমার শুকিয়ে আসা বিরক্ত মুখটির দিকে চেয়ে দুঃখী কন্ঠে বলল,
‘ তোর এতো জ্বর হয়েছে, আমায় কেন বললি না? সিঁড়ি থেকে কেমন বিপদজনকভাবে গড়িয়ে পড়েছিস জানিস? বড়সড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেলে কী করতাম আমি? জেঠু আর ভাইদেরই বা কী জবাব দিতাম?’
আমি উত্তর না দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাথার একপাশ চেপে ধরে বললাম,
‘ তোকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছিলাম না? আমার এই চালের বস্তার মতো শরীরটাকে কী করে তুলে আনলি?’
প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে থেকে বিষণ্ণ হাসল। আমার কাছে এসে কপালের উপর শীতল হাতটা ছুঁইয়ে উত্তর দিল,
‘ সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে আমাদের দরজার কাছেই পড়েছিলি। কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানিস? আমি আর জমিলা আপা কোনোরকমে উঠিয়ে এনেছি এ পর্যন্ত।’
তারপর একটু থামলো প্রিয়তা। আমার চোখের দিকে চেয়ে খুব বিষণ্ণ কন্ঠে বলল,
‘ আবির আর বাড়িওয়ালা আঙ্কেল এসেছিল তোকে দেখতে। আর কেউ আসেনি।’
‘আর কেউ আসেনি’ বাক্যটা যেন প্রিয়তার কানেই বেখাপ্পা শোনাল খুব। কে আসবে আর? আর কারো কী আসার কথা ছিল আদৌ? প্রিয়তা কী চেয়েছিল ধ্রুব আসুক? সিনেমার নায়কদের মতো আমার জন্য অস্থির হয়ে যাক? আমি হেসে ফেললাম। কৌতুক করে বললাম,
‘ আর কে আসবে?’
প্রিয়তা উত্তর দিল না। এই এতোক্ষণে ঠোঁটদুটো মৃদু প্রসারিত হলো আমার। মেয়েটা বড় অবুঝ। আমার প্রতি ভালোবাসাটা তার সুতীব্র। তাই বুঝি ধ্রুবর প্রতি এতো অভিমান? অথচ মেয়েটা বুঝতেই পারল না, ধ্রুব না আসায় আমি কতো আনন্দিত। চিরকৃতজ্ঞ। আমার সূক্ষ্ম আত্মসম্মানী মন অবচেতনেও তার সাহায্য নিতে কত নাখোশ। ভীষণ নারাজ। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ বাবাকে জানিয়েছিস?’
প্রিয়তা ঠোঁট উল্টালো। ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ে বলল,
‘ পাগল! তবে এখনও তোর জ্বর না কমলে কেঁপে কেঁপে হলেও জানিয়ে দিতাম। বড় ভাইয়া তো আমায় খুনই করে ফেলতো। তুই গোটা একটা দিন বেহুশের মতো পড়ে ছিলি। কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানিস? কেঁদেকেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলেছিলাম।’
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রিয়তা ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আই মিসড ইউ সো মাচ। আর কখনো এমন অসুস্থ হবি না। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে বলেছি দুইদিনের মাঝে বাসা খুঁজে বের করতে। বের করতে না পারলেই ব্রেকাপ। এই এলাকা থেকে অনেক দূরে থাকবো আমরা। এখানে সবাই খারাপ। শুধু শুধু মন খারাপ করে দেয়।’
আমি প্রিয়তার দিকে চাইলাম। তার চোখভর্তি টলমলে জল। আমি হেসে ফেললাম। প্রিয়তা হাতের বাঁধনটা আরও শক্ত করে একদম ল্যাপ্টে রইল গায়ে।
মাথার চোটটা একটু সারতেই কলেজ জয়েন করলাম আমি। ঘরের জিনিসগুলো অল্প অল্প করে গুছাতে গিয়েও ব্যস্ততায় তলিয়ে রইলাম ক’টা দিন। হয়তো-বা তলিয়ে রাখতে চাইলাম নিজেকে! প্রায় সপ্তাহখানেক একদম অদৃশ্যের মতো রইলাম বাসায়। তারপর একদিন খুব প্রয়োজনে পড়েই নীলক্ষেত যেতে হলো। বাসা থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা দিতেই পাঁচ তলার বাঁকে অপ্রত্যাশিত এক চেহারা দেখলাম। প্রথম দফায় চমকালাম। বুকের ভেতর ছলকে উঠল তাজা রক্ত। শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। নার্ভাস হলাম। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা সিঁড়ি পথে হাঁটা দিলাম। উপর থেকে দপদপ শব্দ তুলে একদম উড়ে এলো সে। ধ্রুব নয় আবির বুঝতে পেরেই সকল নার্ভাসনেস কেটে গেল আমার। তবুও একটুকু নরম না হয়ে দ্রুত পা চালালাম। আবির ছুটে এসে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ ভাবি কেমন আছো?’
আমি উত্তর দিলাম না। এতো কিছুর পরও ঠিক ধ্রুবর মতো দেখতে একটি ছেলের মুখে ‘ভাবী’ ডাক শুনে মন খারাপ হলো। আবির নাছোড়বান্দার মতো আবারও শুধাল,
‘ কেমন আছো?’
আমি উত্তরে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। আবিরের দিকে ফিরেও চাইলাম না। আবির দুঃখী কন্ঠে বলল,
‘ কথা বলবে না?’
আমি নিরুত্তর। আবির একা একাই বলল,
‘ আমি কী করেছি?’
এবারও কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ কালো করল আবির। প্রচন্ড জেদে এক লাফে আমার সামনে পথ আগলে দাঁড়াল। আবিরের লম্বা শরীর। আমার থেকে দুই ধাপ নিচুতে দাঁড়ালেও প্রায় আমার মাথা সমান লম্বা। আমি পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম। আবির মুখ গুঁজ করে বলল,
‘ মা ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখছে জানো?’
আমি এবার চোখ তুলে চাইলাম। মোলায়েম কন্ঠে বললাম,
‘ তো?’
আবিরের চোখে মৃদু বিদ্যুৎস্পন্দন খেলে গেল। রাগে লাল হলো তার চোখ-মুখ। পরমুহূর্তেই ঝুপ করে নিভে গিয়ে বলল,
‘ তো মানে বুঝতে পারছো না? ভাইয়া অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে ভাবী।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোখে একরাশ বিরক্তি টেনে এনে বললাম,
‘ তোমার ভাইয়া কাকে বিয়ে করবে তা আমায় কেন জানাচ্ছ আবির? পথ ছাড়ো। আমার কাজ আছে।’
আবির পথ ছাড়লো না। আমার মুখের দিকে স্থির চেয়ে থেকে হঠাৎ বলল,
‘ তোমাকে আমার ভালো লাগে, ভাবী।’
আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ চোখে চাইলাম। আবির প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলল,
‘ তোমাকে ছাড়া আর কেউকে আমি কক্ষনো ভাবী বলে ডাকব না। কল্পকেও ডাকতে দিব না।’
আমি বাক্যহারা হয়ে চেয়ে রইলাম। আবির আমাকে বিস্ময়ে স্তব্ধ রেখেই চুপচাপ নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। যাওয়ার সময় হাতের এপ্রোনটা খুব শক্ত করে আঘাত করল সিঁড়ির গায়ে। আমি তখনও হতবাক দাঁড়িয়ে আছি। মনে মনে, না চাইতেও, এই অদ্ভুত দুই ভাইয়ের কথা ভাবছি। এরা কী মোটেও স্বস্তি দিবে না আমায়? এদের কথাবার্তার ধরনে মনে হয় পৃথিবীর সকল কিছুর দায় কেবলই আমার। সারা মহল্লায় কে না কে প্রেমবার্তা ছড়াল সেই দায়ভার আমার। পৃথিবীর কে না কে বিয়ে করে ফেলছে সেই দায়ভারও আমার। কী আশ্চর্য! ধ্রুব বিয়ে করছে তো আমি কী করব? কী সম্পর্ক ওর সাথে আমার? করছে, করুক। হাজারটা বিয়ে করুক। হাজারখানেক বউয়ের আদরে ভেসে যাক। তাতে আমার বাপের কী?
#চলবে…..
[