‘ফাগুন চেয়েছে মন’
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
সুধার প্রতি ঈর্ষা হয় ফাগুনের। মাঝেমাঝে রাগও হয়।কিন্তু কেন হয় সেটা বুঝতে পারে না।
সুধা পরোপকারী, মিষ্টভাষী। ফাগুনের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করে নি। ফাগুনের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে নি। শুধুমাত্র যে কাজ গুলো ফাগুন পারে না সেগুলোই সুধা করে দেয়। কিন্তু তবুও ফাগুনের সহ্য হয় না। সৃজনের মনের মধ্যে সুধার মতন এমন ভালোবাসার, স্নেহের জায়গা তারও চাই। সেটা পায় না বলেই এত আফসোস!
দিন সাতেক পরের কথা,
দুপুরবেলা নিচতলায় বসার ঘরে বসে সৃজনের পাঞ্জাবির বোতাম সেলাই করছিলো সুধা। সৃজন দুপুরের খাবার শেষে বসার ঘরের আলমারি থেকে কিছু একটা খোঁজাখুঁজি করছিলো।
কাজের চাপ কম থাকলে দুপুরবেলা খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয় ও। বেশিরভাগ সময়ই দোতলায় উঠে যায়। মাঝেমাঝে বসার ঘরেও রেস্ট নেয়।
কিন্তু আজকে কাজের চাপ বেশি। রেস্ট নেওয়ার সময় পেলো না। অনেকক্ষণ যাবত দোতলায় অপেক্ষা করে নিচে নেমে এলো ফাগুন। সুধার বোতাম সেলাই শেষ। পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে সেটা ইস্ত্রি করতে চলে গেলো।
ফাগুন আড়চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে সৃজনের দিকে দৃষ্টি দিলো। সৃজন ওর উপস্থিতি বুঝতে পারে নি। সেইজন্য দরজায় খটখট আওয়াজ করলো। আওয়াজ শুনে সৃজন দরজার দিকে চাইলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
‘কিছু বলবে?’
‘কি খুঁজছেন?’
‘একটা দরকারি ফাইল। কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না।’
ফাগুনকে বিশেষ বিচলিত দেখালো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা ছিলো।’
‘বলো।’
‘বিকালে বাবা আসবেন।’
সৃজন ফাইল খোঁজা থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে চাইলো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘এই কথা তুমি আমাকে এখন বলছো?’
‘বাবা একটু আগে ফোন করেছেন।’
ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো সৃজন। বললো,
‘ঠিক আছে। আমি কারখানায় হিসেবপত্র মনিরকে (ম্যানেজার) বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসবো। তুমি সুধার সঙ্গে আলাপ করে কি কি লাগবে একটা লিস্ট করে দাও। আমি ফেরার সময় নিয়ে আসবো।’
‘বাজার লাগবে না। বাবা আমাকে নিয়ে যেতে আসবেন।’
‘নিয়ে যেতে মানে?’
‘মা আমাকে দেখতে চাইছেন। সেইজন্য বাবা বলেছেন আপনার আপত্তি না থাকলে আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন।’
‘ঠিক আছে যেও। তুমি তোমাদের বাড়িতে যাবে এখানে আমার আপত্তি কেন থাকবে? কিন্তু বাজারের করতে বারণ করছো কেন?’
আপত্তি নেই! কথাটা যেন ভীষণ ভাবে আহত করলো ফাগুনকে!
সম্পর্কটা স্বাভাবিক থাকলে হয়ত ওর খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে ফাগুন খুশি হতে পারলো না। সৃজনের চেহারায় কোনো উতলা ভাব নেই। কত সহজে ফাগুনকে যেতে দিতে রাজি হয়ে গেলো! যেন ফাগুনের থাকা না থাকায় ওর কিচ্ছু আসে যায় না। সৃজনের প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘আব্বা থাকবেন না বলেছেন।’
‘উনি বলেছেন আর তুমি মেনে নিলে। জোর করে রেখে দেবে।’
ফাগুন আর কিছু বললো না। সৃজন ফাইল খুঁজতে খুঁজতে বললো,
‘তোমার কিছু লাগলে লিখে দিও।’
‘আমার কিছু লাগবে না।’
‘তোমার জন্য মানে তোমার আত্মীয়স্বজনদের কথা বলছি। এতদিন পর বাবার বাড়িতে যাচ্ছো শপিং লাগবে না?’
ফাগুন চুপ করে রইলো। ও যেটা চায় সেটা থেকেই ওকে বঞ্চিত করছে সৃজন! অন্যকিছুর প্রতি আর ফাগুনের আকর্ষণ নেই! সৃজন ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের প্রশ্ন করলো,
‘নাকি তুমি নিজে দেখে কিনবে?’
‘লাগবে না।’
‘ঠিক আছে। তাহলে আমিই নিয়ে আসবো।’
সৃজন ফের ফাইল খোঁজায় মনোযোগ দিলো। গোটা আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলেছে কিন্তু ফাইল কোথাও পেলো না। বিড়বিড় করে বললো,
‘কোথায় রেখেছি। কেন মনে পড়ছে না।’
ফাগুনের রাগ হলো! ও চলে যাবে আর সৃজন এখনো ফাইল নিয়ে পড়ে আছে। রাগের বশত মুখ দিয়ে কিছু অশোভন কথা বেরিয়ে গেলো। তিক্ত কন্ঠে বললো,
‘কেবল একজনের বেলাতেই আপনার সব মনে থাকে। সে ছাড়া আর কিছু আপনার মনে থাকে না।’
‘কিসের কথা বলছো?’
সৃজন সরাসরি ফাগুনের দিকে চাইলো। ফাগুন খানিকটা সংকোচ বোধ করলো। কিন্তু পরোক্ষণেই মনে হলো, যা হবার হবে আজকেই এর একটা বিহিত করে ছাড়বে। সৃজন কোনোদিন ফাগুনের কাছে একগ্লাস পানি চেয়ে খাওয়ার কথা বলে না অথচ সুধাকে দিয়ে পাঞ্জাবির বোতামটাও সেলাই করিয়ে নেয়। ওর সব কাজ সুধা করে দেয়! বউ হিসেবে মানতে না পারলে সরাসরি বলে দিক। ফাগুন একেবারেই চলে যাবে! কিন্তু এভাবে কেন কষ্ট দেবে! ক্ষোভের সহিত জবাব দিলো,
‘কেনো? যে আপনাকে আদরযত্ন করে বেড়ে খাওয়ায় তার কথা বলছি।’
সৃজন আলমারি বাদ দিয়ে আশেপাশের ড্রয়ারগুলোতে খোঁজা শুরু করলো। খুঁজতে খুঁজতেই শান্তস্বরে জবাব দিলো,
‘সুধা আমার বোন।’
ফাগুনের বুকে সত্যিই আগুন জ্বলছে। সুধার সঙ্গে যে সৃজনের অন্য কোনো সম্পর্ক নেই একথা ও জানে। কিন্তু নিজের প্রতি সৃজনের এত উদাসীন মনোভাব মেনে নিতে পারছিল না। যে কোনো প্রকারে সৃজনকে উত্তেজিত করতে চাইলো। কন্ঠস্বরে খানিকটা বিদ্রুপ ফুটিয়ে বললো,
‘সেই তো বোন! সারাক্ষণ খালি বোন আর বোন। এদিকে আবার নামেরও কি মিল। সুধা, সৃজন। সৃজন সুধা।’
সৃজনের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। কাগজ গোছাতে গোছাতে একবার দৃষ্টি দিলো ফাগুনের দিকে। তারপরই আবার কাগজ গোছানোয় মনোযোগ দিয়ে স্বভাব সুলভ ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ভাইবোন দেখেই তো নাম মিলিয়ে রেখেছি। প্রেমিক প্রেমিকা হলে তো আমার নাম থাকতো আসাদ আর ওর নাম ফাগুন।
ফাগুন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো! সৃজন এমন খোঁচা মেরে কথা বলতে পারে একথা ও স্বপ্নেও ভাবে নি। অন্তরের জ্বালা দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। কই আর কারো সঙ্গে তো এমন করে কথা বলে না সৃজন। ফাগুনের বেলাতেই যত ব্যতিক্রম!
‘আপনি আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছেন?’
সৃজন জবাব না দিয়ে হাসলো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘কেউ যদি ইচ্ছে করে খোঁচা শুনতে চায় তবে আমার কি দোষ?’
ফাগুন বিছানায় বসে রাগত চোখে সৃজনের চলে যাওয়া দেখলো। চোখে পানি নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,’ইচ্ছে করে খোঁচা শুনতে চায়, সেজন্য খোঁচা মেরে গেছে। আর ইচ্ছে করে যে সারাক্ষণ আশেপাশে ঘুরঘুর করি সেটা চোখে পড়ে না! খারাপ লোক! আর থাকবো না আমি এখানে!’
পরের দিন সকালে সত্যি সত্যিই বাবার সঙ্গের চলে গেলো ফাগুন। যাওয়ার সময় সুধা আর তাহেরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেও সৃজনের সঙ্গে কোনো কথা বললো না। সৃজন বিদায় জানালেও মুখ ফিরিয়ে নিলো।
এদিকে ফাগুন চলে যাওয়ার পর সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না সৃজনের! সারারাত বারান্দায় পায়চারি করলো।
রাত সাড়ে বারোটার দিকে সুধা দোতলায় উঠেছিলো ছাদের দরজা বন্ধ করার জন্য। সৃজনকে বারান্দায় পায়চারি করতে দেখে মুচকি হেসে বললো,
‘ফাগুনের বুকে আগুন লাগাতে গিয়ে দেখছি তোমার নিজের বুকেই আগুন লেগে গেছে?’
সুধার গলার আওয়াজ পেয়ে সৃজন থমকালো। জবাবে কিছু একটা বলতে গিয়ে হেসে ফেললো। মৃদু হেসে বললো,
‘চিঠি লিখে গেছে!’
সুধাকে কৌতূহলী দেখালো। ইশারায় জানতে চাইলো,
‘কি লিখেছে?’
সৃজন প্রথমে জবাব দিলো না। গলা খাঁকারি দিয়ে বাইরের দিকে চাইলো। সুধার ফের জিজ্ঞাসাবাদে মিটিমিটি হেসে বললো,
‘আর ফিরবে না বলেছে। আমার নামের মধ্যে জন থাকলেও আমি নাকি মানুষ নই। আমাকে নাকি রোবট মনে হয়।’
সৃজন ফের মৃদুশব্দ করে হাসলো। সুধাও হেসে ফেললো। বললো,’বেচারিকে রাগ সামলাতে না পেরে চিঠিতে লিখে গেছে!’
তারপর সৃজনকে ঘুমাতে বলে সুধা নিচে নেমে গেলো। সৃজন যে খুব বেশিদিন ফাগুনকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না একথা ও ঠিক বুঝে গেলো। তাই বেশিকিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না।
পরের দিন সকালবেলাই শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো সৃজন!