ফিলোফোবিয়া পর্ব -৪৩

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪৩.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

সমাবেশের ব্যাপারটা তাজা খবর হয়ে নিউজফিড়ে ঘুরঘুর করছে। ছোট বড় বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল গুলো ব্যাপারটা টেনে বড় ইস্যু বানাচ্ছে। আজেবাজে শিরোনাম দিয়ে বিরাট স্ক্যান্ডাল বাঁধাচ্ছে। কিছুকিছু সাংবাদিক প্রিয়’র চরিত্রেও দাগ লাগাচ্ছে। রাত থেকে পরিচীত অপরিচীত অনেকের ফোন আসছে। কেউকেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ আবার কা*টা ঘাঁ’য়ে ঘাঁটা দিচ্ছে। এসবের জন্য প্রিয় নিজেকে অনেক আগেই প্রস্তুত করে রেখেছে। সত্যিটা সামনে এলে, এমন বিব্রতকর পরিস্থীতির সম্মোখীন হতে হবে। তা সে জানত। হয়তো তার ক্যারিয়ারেও ধস নামবে। তবুও সত্যিটা সামনে আনার দরকার ছিল। অন্তত সবটা শেষ করার জন্য হলেও, এমনটা করার প্রয়োজন ছিল। নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। গতকাল কাজের সুবাদে লাইভে এলে, সেখানে মানুষজন অপ্রস্তুত, বিব্রতকর প্রশ্ন ছুঁ*ড়ে। প্রথমে শান্ত ভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেও, একটা সময় হাল ছেড়ে দেয়। অতিষ্ঠ হয়ে লাইভ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রিয়’র মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে, কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে প্রত্যাশা ম্যাম।

সকাল থেকে বাড়িতে প্রিয়। ক্লাস নেই। শতাব্দের’ও ছুটি আজ। ভোর সকালে বেরিয়েছে কোথাও। পাশের পার্কে জগিং-এ হয়তো। নাস্তা সেরে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিল প্রিয়। উজ্জ্বল সকালের চকচকে রোদ। ভেজা চুলের আড়াল হতে মুখে এসে লাগছে। চোখ খিঁচে অন্যদিক ঘুরে বসলো প্রিয়। চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই বাহিরের হৈচৈ আওয়াজ কানে এসে লাগল। অভিলাষা বেগম কারো উপর চিৎকার করছে। কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। অভিলাষা বেগমকে বরাবরই শান্ত স্বভাবের। কঠোর, বিচক্ষণ মানুষ। অত্যন্ত রেগে গেলেও খুব কায়দা করে শান্ত হয়ে সবকিছু মিটমাট করে। উনার উঁচু আওয়াজ শুনেনি কখনো। চেয়ার ছেড়ে উঠল প্রিয়। বড়বড় পা ফেলে দরজার সামনে দাঁড়াল। এবার পুরুষালি কান্নাভেজা আওয়াজে কানে এলো। ছটফট পা চালিয়ে ড্রইং রুমের দিক এগিয়ে গেল। শোয়েব হককে দেখেই থমকে গেল প্রিয়। দরজা ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল।

অভিলাষার সামনে হাত জোর করে কান্না করছে শোয়েব হক। ‘ আমার মেয়েটার সাথে একটাবার দেখা করতে দে বোন’ বলে বারবার কান্নাভেজা আহাজারি করছে। অভিলাষা’র কঠোর শক্ত আওয়াজ,
‘ ও তোমার মেয়ে না ভাই। ও আয়শার মেয়ে। এতবছর যাদের কোন খবর নেওনি। জন্মের আগেই যার মাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলে তার উপর আবার কিসের অধিকার?’
শোয়েব হকের কান্নাভেজা আওয়াজ,
‘ আমি জানতাম না প্রিয় আমার মেয়ে। আয়শা বলেছিল, গর্ভেই আমার সন্তান মে*রে ফেলেছে।’
তাচ্ছিল্য হাসল অভিলাষা। বলল,
‘ তো কি করবে? তোমার মত কাপুরুষের কাছে সত্যি বলবে? যে একদিন অ*ন্যায় অপমান করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিল তাকে! তুমি মানুষের পর্যায় পড়ো না। তুমি একটা অমানুষ!’
কাতর দৃষ্টিতে তাকাল শোয়েব। নিস্তেজ কন্ঠে আওড়াল,
‘ ছবি আমাকে ফাঁ*সিয়েছিল। তোর সংসার বাঁচাতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সত্যিটা জেনেও তুই এভাবে বলছিস?’
অভিলাষা আরো তেতে গেল। চিৎকার করে বলল,
‘ আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সংসার বাঁচাতে ছবিকে বিয়ে করতে? আর কোন সত্যির কথা বলছো? আমার শ্বশুরের টাকা দেখে তুমি ছবিকে বিয়ে করেছিলে।’
‘ অভিলাষা!’
‘ চেঁচাবে না ভাই। এটা সত্যি। তুমি টাকার লোভে পড়ে আয়শাকে ছেড়ে ছবিকে বিয়ে করেছ। তোমার সব ভালোবাসা অভিনয় ঠুনকো ছিল। যেই মেয়েটা তোমাকে ভালোবেসে নিজের বাড়িঘর সব ছাড়ল। তুমি টাকার মহে পড়ে তাকেই ছেড়ে দিয়েছিলে ভাই। এমনকি যখন তোমার স্ত্রী ওদের গ্রামের লোকের সামনে অপদস্ত করল তুমি চুপ ছিলে। তখন তোমার বীরত্ব কোথায় ছিল? আয়শার মৃ*ত্যু শোকে তুমি এতবছর দেশের বাহিরে ছিলে। তাই বলে মরে যাওনি। যে তুমি আমার সহানুভূতি পাবে!’
শোয়েব হক অস্থির হয়ে পড়ল। তেজি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমার মেয়ে কোথায়? আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করব।’
অভিলাষা বিরক্তি কন্ঠে বলল,
‘ আমার মনে হয়না প্রিয় তোমার সাথে দেখা করবতে চাইবে। তোমাকে যথেষ্ট ঘৃ*ণা করে ওঁ।’
শোয়েব হক তড়িঘড়ি আওয়াজে বলল,
‘ ঘৃ*ণা করলে এত মানুষের সামনে আমার মেয়ে বলে নিজেকে কেন পরিচয় দিবে? ও আমার মেয়ে। অনেক হয়েছে। এতবছর আয়শা আমার থেকে আমার মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে। আর না। এবার আমি ওকে নিয়ে যাবো সাথে।’
অভিলাষা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘ যেই জানলে প্রিয় তোমার মেয়ে অধিকার খাটাতে চলে এলে। যখন আয়শা গ্রামে গিয়ে সম্পর্ক বাঁচাতে আহাজারি করছিল, তখন তোমার এই পিতৃপ্রেম কোথায় ছিল? যখন গ্রামের লোক তোমার মেয়েকে ব্যা* বলছিল তখন কেন চুপ ছিলে? জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। যোগ্যতা লাগে। যা তোমার নাই!’
অনুতপ্তার আগুনে শোয়েব পুড়ছে। চিৎকার করে বলল,
‘ আমি আভাস করেছিলাম প্রিয় আমার মেয়ে। কিন্তু তা যুক্তি’র সামনে বরাবরই পরাজিত। তখন আমি প্রতিবাদ করতে চেয়েও পারিনি। লুবনার ভবিষ্যৎ ভেবে! আমি প্রিয়’কে…’
এদিক সেদিক তাকাতেই শোয়েব চোখ আটকালো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়’তে। থরথর করে কাঁপছে। ভ*য়ে মুখ লুকিয়ে আছে। মেয়ের দিকে ছুটে গেল শোয়েব। হাত বাড়াতেই প্রিয় দু’কদম পিছিয়ে গেল। ভেজা টলমলে ঘৃ*ণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
কেঁদে ফেলল শোয়েব হক। কাঁপা কাঁপা হাত জোড়া উঁচিয়ে মেয়ের দিক এগিয়ে গেল। কান্নাভেজা কাঁপাকাঁপি কন্ঠে প্রিয় বলল,
‘ আমাকে ছুবেন না। আপনাকে ঘৃ*ণা হয় আমার!’
শোয়েব হক থমকে গেল। ব্যথাতুর কাতর দৃষ্টিতে মেয়ের ফিরিয়ে নেওয়া মুখখানায় চেয়ে রইল। কান্নাভেজা অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে একটা বাত বলার সুযোগ দে। আমার কথা একবার শুন মা।’
ঘাবড়ে গেল প্রিয়। প্রথমবার নিজের জন্মদাতা পরিচয়ে মানুষটাকে দেখে প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছে হয়তো।হাতপা কাঁপছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঝাড়ি দিয়ে হাত ঠেলে দিলো। অচেতন, উন্মাদের মত আচরণ করছে। চিৎকার করে বলছে,
‘ দুরে থাকুন আমার থেকে।’
শোয়েব হক শুনল না। এতবছর পর মেয়ের পরিচয় পেয়ে সাথে সাথে টিকেট কে’টে দেশে এসেছে। মেয়েটাকে একবার জড়িয়ে ধরবে বলে। ফ্লাইটের পুরোটা সময় ছটফট করে কাটিয়েছে। এই সময়টার কত অপেক্ষা করেছে। এখন এই কাঙ্ক্ষিত সময়টায় এসে কি করে পিছিয়ে যাবে সে?
একপ্রকার বোঝানোর জেদ ধরে এগিয়ে গেল মেয়ের দিকে। প্রিয় হাউমাউ করে কাঁদছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ঠ হচ্ছে তার। যেই শোয়েব হাত বাড়াবে, অমনি শতাব্দ এসে দাঁড়াল মাঝে। ভয়ে কাঁপতে থাকা প্রিয়কে জড়িয়ে নিলো বুকে। শোয়েবের দিকে আঙুল তাক করে ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ হাত বাড়াবেন না আমার বউয়ের দিকে।’
শোয়েব শুনল না। এগিয়ে আসতে চাইল। প্রিয় যেন আরো ঘাবড়ে গেল। জড়সড় হয়ে শতাব্দের বুকে লেপ্টে রইল। শোয়েবের কাঁধে হাত রেখে বাঁধা দিলো শতাব্দ। মাঝে এক হাত দূরত্ব রাখল। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ আমার বউয়ের থেকে দূরে থাকতে বলেছি।’
‘ প্রিয় আমার মেয়ে। ওর উপর আমার অধিকার বেশি!’
শোয়েবের অকপটে আওয়াজ। শতাব্দ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। প্রিয়’কে ছেড়ে দু’পা এগিয়ে শোয়েবের মুখোমুখি দাঁড়াল। ঝুকে এসে শোয়ের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে গম্ভীর শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ যখন ওদের আপনাকে প্রয়োজন ছিল, তখন এই অধিকার কোথায় ছিল! আপনি বাবা না কাপুরষ। না ভালো স্বামী হতে পেরেছেন, না ভালো বাবা। আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো জোর করে বের করতে বাধ্য হবো!’
শোয়েব আ*হত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেই ভাগিনা একটা সময় তার ভক্ত ছিল, আজ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে! নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে অগাধ ঘৃ*ণা। এত ঘৃ*ণা, অভিশাপ নিয়ে কি করে বাঁচবে সে? কোনদিন কি ক্ষমা মিলবে!
শোয়েব হক বেরিয়ে গেল।

শতাব্দ প্রিয়’কে ঘরে নিয়ে এলো। বিছানায় বসালো। প্রিয়’র তখনো থরথর কাঁপছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। শরীর প্রচন্ড রকম ঠান্ডা। শতাব্দ পানি এগিয়ে দিলো। প্রিয় ঢকঢক করে পুরোটা পানি শেষ করল। প্রিয়’র হাত জোড়া ধরে, হাঁটু গেড়ে মুখোমুখি বসে আছে শতাব্দ। কপাল কুঁচকে চিন্তিত মুখ করে চেয়ে। প্রিয়’র এনজাইটির সমস্যাটা দিনদিন বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে আদৌ কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে প্রিয়? প্রিয়’র অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মুছে দিতেই। ভীতু কন্ঠে হুড়মুড়িয়ে প্রিয় বলল,
‘ ওই লোকটা কেন ফিরে এলো। কেন এসেছে উনি। উনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলুন। আমার ভয় হয় তাকে! প্রচন্ড ভয়..’
অনবরত অস্থির কন্ঠে, বিড়বিড়িয়ে বলে যাচ্ছে প্রিয়। শ্বাস কষ্ঠ হচ্ছে এখনো। শতাব্দ কাছে এসে জড়িয়ে ধরল। শতাব্দের মুঠোবন্দী হাতটা আরো শক্ত করে খা*মচে ধরল। শতাব্দ কানের কাছে চুমু দিলো। আস্বস্ত স্বরে বলল,
‘ শান্ত হও প্রিয়। আমি আছি। সবঠিক করে দিবো।’
চোখ বুজে শতাব্দকে আরো শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরল প্রিয়। ধীরেধীরে শান্ত হচ্ছে। নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিককে নামছে। প্রিয় জানে শতাব্দকে ঠকাচ্ছে সে। এই মানুষটা থেকে তার দূরে থাকা উচিত। কিন্তু পারছেনা। মানুষটা কাছে এলে এমন অদ্ভূতরকম শান্তি লাগে যে, সব ভুলে তাতেই ডুবে থাকে! অনুভূতিরা কি কোনদিন পরিবর্তন হবেনা। বারবার কেন শতাব্দ’তে আটকে যায়।

চলবে……

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।

টাইপোগ্রাফি: মুগ্ধ তা আপু❤️🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here