ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৪৫.
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
পুরানো খুবলে খুবলে উঠা মানিব্যাগের ভাঁজ থেকে একটা সাদাকালো ছবি বের করল শোয়েব। চোখের সামনে ভেসে উঠল আয়শার হাস্যোজ্জ্বল চন্দ্রপ্রভা মুখ। আনমনে শোয়েবের ঠোঁটের কোণে, মৃদু রেখা ভাসলো। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল পুরানো সেই দিন গুলো। গা জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ। আলতো হাতে আয়শার ছবিটায় ছুঁয়ে দিলো। অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে নিমিষ তাকিয়ে রইল। কান্নাভেজা অভিযোগ জুড়ে বলল,
‘ এত অভিমান এত ঘৃ*ণা আয়শা। কেন এমন করলে? আমার অন্যায়ের সাজা নিজেকে কেন দিলে! কেন ছেড়ে গেলে বহুদূরে। তোমার মৃ*ত্যু য*ন্ত্রণার চেয়ে, এই চোখের ঘৃ*ণা সহ্য করা আমার কাছে অনেক বেশি সহজ ছিল। নিজের লোভে সব হারিয়েছি। সারাজীবন শুধু ঘৃ*ণা কুড়িয়েছি। না রইলে তুমি, না রইল প্রিয়। প্রিয় সে যে তোমারি প্রতিচ্ছবি। তোমার মতই গভীর তার ঘৃ*ণার দৃষ্টি।’
বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে শোয়েব বিড়বিড় করছিল। ধুপধাপ পা ফেলে ছবি এলো। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ভেজা চোখ মেলে তাকাল। ছবিকে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকালো।
ছবি বাজখাঁই গলা করে বলল,
‘ উকিলের সাথে দেখা করেছিলে? সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ লিখে দিতে চাইছ ওই মেয়েটাকে? এতবড় সাহস তোমার। আমা্দের ভাগের সম্পত্তি লিখে দিবে ওকে। ওই ফ*কিন্নি’র বাচ্চাকে?’
রাগে চেঁচিয়ে উঠল শোয়েব,
‘ সাবধানে কথা বলো। প্রিয় আমার মেয়ে। আর আমি আমার সম্পত্তি কাকে দিবো, তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে কেন?’
ছবি বেগম রাগে গরগর করে উঠলেন। শোয়েবের পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরল। ক্রো*ধে রিরি করে বলল,
‘ অনেক হয়েছে, আর না। আজ যা কিছু আছে সব আমার জন্য। রাস্তার ফকিন্নি ছিলি। কু** ফিরে তাকাত না। আমার বাপ ভাইয়ের টাকা দিয়ে এখানে উঠেছিস। প্রথমে মা, এখন মেয়ে। সারাজীবন ওদের পেছনে কেন দাঁড়াতে হবে আমাকে? ছোট থেকে সবসময় কেন আয়শাই জিতে যায়।এত বছর আমার সাথে সংসার করেছিস, মনে মনে সবসময় শুধু আয়শাকেই চেয়েছিস। কেন? আমি যথেষ্ট ছিলাম না?’
ঝারি দিয়ে হাত ছাড়াল শোয়েব। রাগে গর্জিয়ে উঠল। বলল,
‘ তুমি সবসময় আয়শাকে হিংসা করতে। বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নিয়েও, আয়শার বরাবর কখনোই হতে পারোনি।ওর যা আছে তোমার তা চাই। তাই তো যখন মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে গ্রামে ফিরলাম, রাতে আমার ঘরে এসে আমাকে ফাঁসিয়েছিলে। লোক শালিস বসিয়ে বিয়ে করলে! তোমার ঈ*ষা সব জ্বা*লিয়ে দিয়েছে।’
‘ এখন সব দোষ আমার? মেয়ের পরিচয় জেনে পিতৃপ্রেম জেগেছে! র*ক্তের ঘ্রাণ টানছে। তাইনা? তুই যে আমার বাপের টাকা দেখে বিয়ে করলি, আয়শাকে ঠকালি। এখন চাপা পড়ে গেল সব? স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। সামনে আমার নির্বাচন ওই মেয়ের জন্য যদি কোন ঝামেলা বাঁধে নিজের হাতে খু*ন করবো ওকে। এবার ছাড় পাবেনা। শতাব্দও বাঁচাতে পারবেনা। আর যদি তুমি বাঁধা হও, ছাড় দিবোনা তোমাকেও।’
শোয়েব টনটনে আওয়াজ,
‘ তোমার বাপ ভাই যেই টাকা ধার দিয়েছিল, তার তিনগুন ফিরিয়ে দিয়েছি তাদের। এই ব্যবসা সম্পত্তি টাকা পয়সা সব আমার পরিশ্রমে গড়া। আর আমিও দেখবো কিভাবে ক্ষ*তি করো আমার মেয়ের! এবার আয়শার স্বামীর না, প্রিয়’র বাবার মুখোমুখি হবে। একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতটুকু গভীর যেতে পারে, জানো নিশ্চয়ই।’
রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেল শোয়েব। যাওয়ার দিক ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছবি বেগম। না, এভাবে আর চলবে না। আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে শোয়েব। সারাজীবন আয়শাকে স্বামীর সুখ থেকে বঞ্চিত রেখেছে। তার ভালোবাসার শোয়েবের সাথে ঘর বেঁধে দিনের পর দিন তিলে তিলে মে*রেছে। এরচেয়ে ভ*য়ানক প্রতি*শোধ আর কি হতে পারে? এখন আয়শা নেই। ম*রে গেছে। শোয়েবকে দিয়ে এখন আর কাজ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পত্তি ট্রান্সফার করার আগে। রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে হবে তাকে। যতদ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুপুর মাড়িয়ে বিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলের বিপরীত পাশের রাস্তাটায় গাড়ি থামিয়ে বসে প্রিয় শতাব্দ। দৃষ্টি হোটেলের গেটে। গেটের দিক তাকিয়ে প্রিয় সন্দিহান সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি শিয়োর বাবা আসবে?’
শতাব্দের আত্মবিশ্বাসী আওয়াজ,
‘ আমি ডেকেছি অবশ্যই আসবে।’
‘ যদি না আসে?’
‘ এক্ষুনি চলে আসবে, নিজ চোখে দেখে নিও।’
অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে প্রিয়। তার অস্থির দৃষ্টি উঁচিয়ে বারবার গেটের দিক তাকাচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখছে। মিনিট দশেক যেতেই, জাফর সাহেবের গাড়ি থামতে দেখল গেটের পাশে। উৎসাহিত হয়ে প্রিয় বলল,
‘ বাবা এসেছে!’
প্রিয়’র মুখপানে একপলক তাকাল শতাব্দ। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ বলেছিলাম আসবে। ভাইয়াদের লাউঞ্জে আসতে বলেছিলে?’
ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,
‘ বলেছি। এবার কি হবে! ভাই আর বাবা মুখোমুখি হবে কিভাবে। আর হলেও যদি বাবা এড়িয়ে যায় ভাইকে।’
‘ থিংক পজিটিভ। উল্টোটাও ঘটতে পারে। হয়তো নাতিনাতনিদের দেখে বাবার মন গলতে পারে।’
প্রিয় ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকালো। কন্ঠে চাপা উত্তেজনা ঠেলে বলল,
‘ প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। বাবার সাথে তানিম ভাইকে সরাসরি দেখা করালেই হতো। এই নাটকীয়তার কি দরকার ছিল। যদি সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় এখন!’
শতাব্দ আশ্বস্ত সুরে বলল,
‘ নাটকীয়তার দরকার ছিল। তানিম ভাইকে বললে রাজি হতো না কখনো। বাবার সামনে দাঁড়ানোর তার সাহস নেই এখনো। কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়া, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হলে তার ট্রু ফিলিংসটা বেরিয়ে আসবে। আর তাছাড়া বাবার সাথে যতবার সময় কাটিয়েছি, বুঝতে পেরেছি ছেলের শূণ্যতা তাকে কতটা খাঁখাঁ করে পো*ড়ায়। তিনি হয়তো কখনো প্রকাশ করবেনা, তবে মনেপ্রাণে চায় ভাইয়া বাড়ি ফিরুক।’
‘ বাবার হয়তো এমনি। স্নেহ, ভালোবাসা আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন।’
প্রিয়’র উদাসীন আওয়াজ। ছলছল চোখ। শতাব্দের চোখে পড়ল। কথা এড়াতে বলল,
‘ অনেকক্ষণ হয়েছে, সব ঠিক আছে কিনা ভিতরে গিয়ে দেখবে?’
শতাব্দের আওয়াজে প্রিয়’র ঘোর কাটল। বলল,
‘ চলুন যাই।’
গাড়ি থেকে নেমে দুজন চলে গেল ভিতরে। হোটেলের লাউঞ্জে পৌঁছাতেই বাপ ছেলের আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না জড়িত আলিঙ্গন ভেসে উঠল চোখে। টলমল করে উঠল প্রিয়’র চোখ, এই দিনটা দেখার জন্য কতই না অপেক্ষা করেছিল। কাচের বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়। জাফর সাহেব নাতি নাতনিদের কোলে তুলে আদর করছে। চুমু খাচ্ছে। ইডিলি হাত জোড় করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলছে। দূরে থাকায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা। শতাব্দ ডাকল। বলল,
‘ ভিতরে যাবে?’
মৃদু হাসল প্রিয়। শতাব্দের দিক ফিরে তাকাল। বলল,
‘ ইচ্ছে করছে না। এইসময়টা একান্তই বাপ ছেলের। তাদেরই ইঞ্জয় করতে দিন।’
হাস্যোজ্জ্বল মুখ অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ নিয়ে গাড়িতে বসলো। আজ অনেক দিন পর বুকে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। অতি আনন্দে চোখে জল নামছে। এই দিনটার জন্য কতই না অপেক্ষা ছিল। কত শতবার ভাইয়ের আফসোস শুনেছে। আহাজারি কান্না দেখেছে। সবশেষে বাপ ছেলের মিলন তিথি এসেছে।
চোখে জল দেখে এগিয়ে এলো শতাব্দ। হাত বাড়িয়ে আলতো করে মুছে দিলো। দু’গালে হাত রেখে বলল,
‘ আমার সব খাটনি বৃথা গেল। এই চোখে জল না, আনন্দ দেখতে চেয়েছি।’
হেসে ফেলল প্রিয়। শতাব্দ আবার বলল,
‘ চলো, তোমার মন ভালো করার জায়গায় যাই।’
নাকচ করল না প্রিয়। ঠোঁট মেলে হাসল শুধু। আর কয়েকটা দিনই তো! তারপর পাল্টে যাবে সব। সে শতাব্দের সাথে প্রাণবন্ত হয়ে, খোলা আকাশের নিচে একটু বাঁচতে চায়। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চায়। কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করবে, যা ভেবে ভেবে এক জীবন পাড় করা যায়।
ইটপাথরের শহর ছেড়ে, কৃত্রিম আলোর আকাশ মাড়িয়ে। গাড়ি গ্রামের মেঠোপথে নেমেছে। নড়বড়ে রাস্তা দিয়ে, নদীর পাড়ে এসে থেমেছে। চারিদিকে অন্ধকার নামছে, কৃত্রিম আলো জ্বলতে শুরু হয়েছে। পাড়ের দিকের মানুষ কমতে শুরু হয়েছে। ঘাটপাড়ে নৌকা থেমেছে। হুড়মুড়িয়ে লোকজন উঠছে। পাশেই ঝালমুড়ি, আচার অন্যসব মুখরোচক খাবার নিয়ে বিক্রেতারা বসেছে। হুড়মুড় করে লোকজন ঝেঁকে ধরেছে। দোকানীদের বেশ বেচাকেনা চলছে। গ্রাম্যজীবনের এক ব্যতিক্রম পরিবেশ। মুহূর্তেই প্রিয়’র মন হালকা হয়ে এলো।
গাড়ি থেকে নেমে দুজন নিরিবিলি সিড়ির ধারে সবুজ ঘাসে যেয়ে বসল। নদীর শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। শরীর মনের ক্লান্তি কোথাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক শান্তি লাগছে। এলোমেলো বাতাসে শাড়ির আঁচল অগোছালো, চোখে মুখে খোলা কেশের ঝাপটা এসে লাগছে। এলোমেলো বাতাসে চোখ বুজে আসছে প্রিয়’র। বুকের বা পাশে হাত রেখে আঁচল সামলাতে চেষ্টা করল। আচমকা একজোড়া হাত থামিয়ে দিলো। পিটপিট দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাল প্রিয়। শতাব্দের গভীর দৃষ্টির নিমিষ চাহনি। নেশাতুর, অধৈর্য! দৃষ্টি নামিয়ে নিলো প্রিয়। শতাব্দের হাত ঠেলে দিতে চাইল। মানলো না শতাব্দ। প্রিয়’র কোমর টেনে মিশিয়ে নিলো। দমকা হাওয়ায় অগোছালো চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে প্রিয়কে বলল,
‘ তোমার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দেওয়ার অধিকার একমাত্র আমার। আর এই অধিকার থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পারবেনা কখনো!’
প্রিয় বিবস হয়ে নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দের চোখে। কি জানো এক অদ্ভুত যাদু আছে এই চাহনিতে। বারবার ডুবে যায় এই মন্ত্রবদ্ধ আঁখিতে।
ঘন্টা দুএক নদীর পাড়ে সময় কাটিয়ে। গাড়িতে বসলো দুজন। এতটা সময় এক সাথে থেকে কথা না হলেও, চোখেচোখে কথা হয়েছে দুজনের। কখনো কখনো মুখের কথার চেয়ে চোখের ভাষা অনেক গভীর হয়। হাতের হাওয়াই মিঠাই টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে প্রিয়। এই জিনিসটার প্রতি ছোট থেকে ভীষণরকম দুর্বলতা। একবার ইমান্দিপুরে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে শাদের সাথে ঝগড়া বেঁধেছিল তার। বিক্রেতার কাছে একটাই ‘হাওয়াই মিঠাই’। অথচ ভাগিদার দুজন। একটা সময় ঝামেলা বাড়ে, হাওয়াই মিঠাই নিয়ে টানাটানি শুরু হলে। চেচামেচির আওয়াজ পেয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে শতাব্দ। তখন তাকে প্রচন্ডরকম অপছন্দ ছিল প্রিয়’র। তাকে দেখেই কপাল কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গিতে বাড়ি ফিরে গেছিল। সেই কথাটা এতবছর পর মনে আছে শতাব্দ’র! তাইতো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে এলো।
ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠল। আনমনে হাওয়াই মিঠাই ছিঁড়ে মুখে দিলো। গাড়ি চলছে অন্ধকার গ্রামের মেঠোপথে। আচমকা গাড়ি থামল। কপাল কুঁচকে পাশে তাকাতেই, শতাব্দ নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আষ্টেপৃষ্টে গভীরে জড়িয়ে নিলো। কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিয়’র ঠোঁট জোড়া শুষে নিলো। বিহ্বল প্রিয় আবেশে চোখ বুজে নিলো। শতাব্দের এলোমেলো অবাধ্য হাত প্রিয়’র শাড়ির বেঁধ করে ফর্সা কোমর ছুঁয়ে দিলো। আরো শক্ত ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। অনুভূতিতে ঠকঠক কাঁপছে প্রিয়। নিশ্বাসের গতি উঠানামা করছে বারবার। গলা শুকিয়ে আসছে। মাথা ঝেঁকে বসেছে এলোমেলো অনুভূতিতে। মিনিট কয়েক কা*টল। ঠোঁটের কাছে লেগে থাকা হাওয়াই মিঠাই শুষে নিলো। প্রিয় তখনো ঠকঠক কাঁপছে। শরীর জুড়ে বইছে অদ্ভুত শিহরণ। চোখ ভিজে আসছে ভালো লাগার অনুভূতিতে। খানিক সময় এভাবেই পাড় হলো। শতাব্দের বলিষ্ট বুকে বিড়ালছানার মত চোখ বুজে পড়ে রইল। গায়ের পুরুষালি ঘ্রাণে মগ্ন হয়ে রইল। প্রাণভরে মিষ্টি সুবাসটা টেনে নিচ্ছে মনে। আরো কিছুক্ষণ এভাবে বুকের গভীরে জড়িয়ে রইল নিস্তেজ প্রিয়। আলতো স্বরে ডাকল শতাব্দ। সাড়াশব্দ করল না প্রিয়। লজ্জায় আরো জড়সড় হলো। একটু অপেক্ষা করে বুক থেকে টেনে তুলল শতাব্দ। দু গালে হাত ছুয়ে প্রিয়’র সুশ্রী মুখপানে চেয়ে রইল। নিকষ আঁধারে চন্দ্রসুধার মত চকচক করছে যেন। তার চোখেমুখে পড়ে থাকা চুল গুলো গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। সামনের চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে, গালে হাত রেখে মুখখানা উঁচিয়ে ধরল। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শতাব্দ। লজ্জা পাচ্ছে প্রিয়। নিজের স্বামীর সামনে এভাবে লজ্জা পাওয়াটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক? ভাবতে ভাবতেই কপালে উষ্ণ ছোঁয়ার অনুভব হলো। তারপর একএক করে চোখ গাল, ঠোঁট ছাড়িয়ে গলায় এসে থামলো শতাব্দ। শাড়ির আঁচল নিচে নেমে গেছে। ফর্সা কাঁধ, গলা স্পষ্ট ভেসে। শতাব্দের উন্মদনা যেন বাড়ল আরো। প্রমত্ত প্রেমিকের মত ঝাপিয়ে পড়ল। গভীর ভাবে নাক ঘষতে ঘষতে নিষ্প্রাণ, নেশাতুর সুরে বলল,
‘ প্রিয়! এই প্রিয়, ভালোবেসে কি কেউ পাগল হয়? আমি হচ্ছি। ভয়*ঙ্কর রকম কোন অঘটন ঘটাতে চাইছি। তোমাকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা পাগল করে দিচ্ছে আমায়। আর তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নাই।’
কেঁপে উঠলো প্রিয়। শতাব্দের গভীর আওয়াজ, শিহরণ তুলে দিচ্ছে প্রিয়’র। চোখ বুজেই শতাব্দের চুলে আঙুল ডুবিয়ে শক্ত মুঠিবদ্ধ করে নিলো।
( সরি, গল্পের সুবাদে কিছু জিনিস খোলামেলা লেখা হয়েছে। ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল)
চলবে……
( গল্প পৌঁছালে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। বানান ভুল চোখ পড়লে ধরিয়ে দিবেন)
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।
টাইপোগ্রাফি: Maksuda Ratna আপু❤️🌺ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৪৭.
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
গতকাল বিকালে পুলিশ ভাঙ্গা ব্রিজের খাঁদ থেকে শোয়েব হকের গাড়ি উদ্ধার করেছে। ভেতরে শোয়েব ছিল। দেহে প্রাণের স্পন্দন চলছিল। হাসপাতালে ভর্তি আছে, ধুঁকে ধুঁকে শ্বাস ফেলছে । আভিলাষা বেগম খবর পেয়ে কান্নাকাটি করে হুড়াহুড়ি বেরিয়ে যায়। যতই ঘৃ*ণা, দূরত্ব থাকুক। হাজার হোক শোয়েব তার ভাই। র*ক্তের টান। প্রিয় স্তব্ধ ছিল।মানুষটাকে তার প্রচন্ডরকম অপছন্দ। ভীষণ ঘৃ*ণা করে। শাস্তি চেয়েছিল, মৃ*ত্যু না! শোয়েব হক আইসিইউতে আছে। এখনো কোমায়। পুলিশ ভাষ্যমতে এটা এ*ক্সিডেন্ট না। এটেম টু মা*র্ডার। ট্রাকটা অনেক আগে থেকে শোয়েব হকের গাড়ি ফলো করছিল। তাদের সন্দেহ প্রিয়কে। কারণ শোয়েব হক প্রিয়’র সাথেই দেখা করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাছাড়া কিছুদিন যাবত চলতে থাকা ঝামেলায় প্রিয়’র দিকেই পুরোপুরি সন্দেহ। ছবি বেগমও প্রিয়কে দো*ষী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে বারবার। আগুনে ঘি ঢালছে। শতাব্দের হুমকি ধমকিতে চুপ হলেও দমছে না। ভেতরে ভেতরে পুলিশকে দিয়ে প্রিয়কে জিজ্ঞাসা বাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে। শতাব্দ কোনরকম ক্ষমতার জোরে আপাতত ছাড়িয়ে এনেছে। এখন ট্রাক ড্রাইভারকে খোঁজাখুঁজি করছে পুলিশ।
সারারাত জেলখানা, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে সকালে বাড়ি ফিরেছে প্রিয়। নির্ঘুম, দুশ্চিন্তায় রাত কা*টিয়ে শরীর, মন ভীষণ ক্লান্ত।
ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আনমনেই চোখের কোন গড়িয়ে জল পরে। বুক ভেঙ্গে চূড়ে কান্না আসছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ওই লোকটার জন্য একটু কাঁদলে কি, মায়ের প্রতি খুব বেশি অবিচার হবে তার।
প্রিয় ঘরে এলো শতাব্দ। চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়। চোখের কোন বেয়ে জল পড়ে বিছানার চাদর ভিজছে। ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে। ফোপাঁচ্ছে। ভেতরের কষ্ট প্রকাশ করতে না পারার য*ন্ত্রণায় ছটফট করছে। বিছানার দিক এগিয়ে গেল শতাব্দ। প্রিয়’র পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। চোখ খুলে তাকাল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই শতাব্দকে দেখল। তড়িঘড়ি হাতে চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারো সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না কখনো। শতাব্দ উপর দিক তাকিয়ে, গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ চাইলে কাঁদতে পারো। আমি বাঁধা দিবোনা আর তোমার মায়ের সাথেও অন্যায় হবেনা।’
প্রিয় থমকে গেল। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কতক্ষণ। মানুষটা তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ, য*ন্ত্রণা গুলো কি করে বুঝল। আচমকা শতাব্দের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। জাপ্টে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমি তার শাস্তি চেয়েছিলাম, মৃ*ত্যু চাইনি কখনো।’
‘ জানি প্রিয়! আমাকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।’
‘ আছে। আমি সত্যি এমনটা চাইনি। আ..আমি কিছু করিনি।’
‘ আমি জানি, বিশ্বাস করি।’
বলেই প্রিয়কে বুকে জড়িয়ে ধরল শতাব্দ। হাউমাউ করে কান্না করছে প্রিয়। চোখের জলে বুক ভিজচ্ছে শতাব্দের। বাঁধা দিচ্ছেনা। কাঁদুক, খুব করে কাঁদুক। মন হালকা করুক। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল শতাব্দ। আচমকাই খেয়াল হলো, প্রিয়’র শরীর প্রচন্ডরকম গরম। সারারাত দৌড়াদৌড়ি পেরেশানি ক্লান্তিতে জ্বর আসছে নিশ্চয়ই। ধীরেধীরে নিস্তেজ হচ্ছে প্রিয়। খানিক পর একদম চুপ। ঘাবড়ে গেল শতাব্দ। বুকে থেকে মুখ উঁচিয়ে ডাকল কয়েকবার। উত্তর দিলো না প্রিয়। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে।
শতাব্দের উচ্চ আওয়াজ শুনে জ্ঞান ফিরল প্রিয়’র। ফোনে কারো উপর রাগ ঝারছে। তটবটে রাগী গম্ভীর আওয়াজে বলছে,
‘ ওই ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি আমার চাই। মানে চাই। যেই করেই হোক।’
ফোনের অপর পাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। শতাব্দ রেগে গেল আরো। গর্জিয়ে বলল,
‘ কিছু বলছেনা। মানে কি? ওয়েট আমি আসছি।ওর জবানে কতক্ষণ তালা লাগানো থাকে আমিও দেখছি।’
ফোন কে*টে মোবাইলটা একপ্রকার সোফায় ছুঁড়ে ফেলল শতাব্দ। অকপটে পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল। মাথা চেপে বসল। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
পেছন থেকে প্রিয় ডাকল। বলল,
‘ কি হয়েছে?’
প্রিয়’র ডাকে টনক নড়ল। পেছন ফিরে তাকাল। বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে, কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্রিয়। শতাব্দ এগিয়ে গেল। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেশ টেনে সামনের চুল গুলো কানের কাছে গুছিয়ে দিলো। কপালে হাত ছুঁয়ে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ জ্বর কমেছে। এখন কেমন লাগছে?’
প্রিয়’র লঘু আওয়াজ,
‘ কিছুটা ভালো।’
একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল আবার,
‘ কোথাও যাবেন?’
‘ হ্যাঁ একটু বের হতে হবে।’
‘ কেন?’
‘ একটা জরুরি কাজ পড়েছে।’
কৌশলে কথাটা এড়াতে চাইছে শতাব্দ। কোনকিছু আর জিজ্ঞেস করল না প্রিয়। শতাব্দ উঠে দাঁড়াল, সোফা থেকে মোবাইল তুলে হাতে নিলো। ঔষধ বের করে বিছানার পাশে রাখতে রাখতে আনমনা হয়ে বলল,
‘ মা হাসপাতালে, সমুদ্র প্রভা গ্রামে। খালা সাথে থাকবে। খাবার খেয়ে, ঔষধ গুলো খেয়ে নিও।’
বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়াল প্রিয়। পাশে এসে বসল শতাব্দ। কপালে চুমু দিয়ে, গালে আলতো হাত ছুঁয়ে দিয়ে নিগূঢ় সুরে বলল,
‘ নিজের খেয়াল রেখো। খারাপ লাগলে ফোন করিও, চলে আসবো।’
প্রিয়’র শুকনো ঠোঁটে আলতো হাসি। আঁখি পল্লব নাড়িয়ে আওয়াজহীন উত্তর দিলো। যার অর্থ ‘আচ্ছা’
সন্ধ্যা নামছে। বেগতিক বাতাস বইছে। ঘন বর্ষণের পর আবার আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। চারিদিক অন্ধকার। বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। দূর আকাশে তার চোখ। কোন ভাবনায় মশগুল। আচমকা কলিং বেল বাজল। ঘোর কা*টল। ছিটকে উঠল। দ্রুত দরজার দিক পা বাড়াল। নুপুরের রিমিঝি্মি শব্দে ঘর মাতলো। দরজা খুলে দিলো প্রিয়। কাঁক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। চুল থেকে পানি বেয়ে একাকার।
মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ তুলে তাকাল শতাব্দ। প্রিয়কে দেখে থমকে গেল। পড়নে কুচকুচে কালো শাড়ি, খোলা কেশ। চোখে গাঢ় কাজল লেপ্টে, মেরুন লালে ঠোঁট রাঙিয়ে। ভয়*ঙ্কর সুন্দর, মায়াদেবীর রূপে সেজেছে। সামনে কে? কোন মানবী। নাকি স্বর্গ রাজ্যের অপ্সরী।
নিশ্বাস খানিকের জন্য থমকে গেল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নিগূঢ় চেয়ে রইল। আনমনেই বুকের বাঁ পাশে যেয়ে ঠেকলো হাত। কি বলবে ভুলে গেছে। মুহূর্তেই যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল।
প্রিয়’র ডাকে ঘোর কাটল। নড়েচড়ে উঠল শতাব্দ। কন্ঠে তাড়া দিয়ে প্রিয় বলল,
‘ ঠান্ডা বসে যাবে, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নিন।’
কিছু বলল না শতাব্দ। যন্ত্রের মত ভিতরে চলে এলো। প্রিয় শুকনো কাপড় বের করে হাতে ধরিয়ে দিলো। থমথমে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শতাব্দ। এটা সত্যি প্রিয় তো?
বাধ্য ছেলের মত ওয়াশরুমে চলে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরল। মাথা মুছতে মুছতে আড়চোখে তাকালো। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। ঘর জুড়ে অন্ধকার মাখানো। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি এখনো। বেলা শেষের অনুজ্জ্বল আলো। বাতাসে অদ্ভুত মাদকতা মেশানো। দমকা হাওয়ায় শাড়ির আঁচল উঁড়ছে প্রিয়’র। শাড়ি সরে দুধে-আলতা গা ভেসে। ঝলমলে খোলা কেশ তার চোখেমুখে পড়ছে। হাত উঁচিয়ে চুল গোছাতে চাইল। কাঁচের চুড়ি ঝনঝনিয়ে উঠল। শব্দটা বুকে যেয়ে বিঁধল শতাব্দের। চোখ লাগল গভীর ঘোর। দিন দুনিয়ার সব ভাবনা এড়িয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সেদিকে এগিয়ে গেল। শাড়ির আঁচল মাড়িয়ে, পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরল। নাক ঠেকলো, উন্মুক্ত পিঠে। গভীর করে, প্রিয়’র মিষ্টি সুভাস টানতে লাগল। টলটলে শরীর, মাতাল মাতাল মন। আবেশে শতাব্দের বুকে গা এলিয়ে দিলো প্রিয়। নিশ্বাসের গতি দ্রুত, শরীর কম্পন করছে প্রচন্ড। আলতো করে পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে শতাব্দ। পাগল, উন্মাদের মত আরো গভীর করে জাপ্টে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে অগোছালো, নিগূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ ডার্ক কালার পড়ে, চোখে কাজল লেপ্টে আমার সামনে আসতে বারণ করেছিলাম। এইযে আমি বদ্ধ উন্মাদ হলাম, এর দায়ভার কে নিবে এখন?’
প্রিয় চুপ। তার ঘনঘন নিশ্বাস। প্রিয়’র বাহু টেনে নিজের দিক ফেরাল। দেয়ালের সাথে মিশিয়ে, কপালের সাথে কপাল মিশাল। চোখ বুজে আছে প্রিয়। শতাব্দের উষ্ণ নিশ্বাস মুখে পড়ছে তার। নিমিষ নেশাতুর হয়ে চেয়ে আছে শতাব্দ। অধৈর্য, অস্থির কন্ঠে বলল,
‘আমার তোমাকে চাই প্রিয়। প্রচন্ড ভাবে চাই।’
প্রিয় উত্তর দিলো না। শতাব্দ অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করল। থরথর কাঁপছে প্রিয়। শতাব্দ ঝুঁকে এলো। আলতো করে প্রিয়’র ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। বাঁধা দিলো না প্রিয়। শতাব্দের পাগলামোতে তাল দিলো। শতাব্দ যেন আশ্বাস পেল। ঝট করে প্রিয়’কে কোলে তুলে নিলো। বিছানার দিক পা বাড়াল। অন্ধকারে মিলিয়ে আসা ঘরে, দুজনের তপ্ত নিশ্বাস ভাসছে। কোন এক স্বর্গিয় সুখে, দুজন প্রেমময় বৈধ সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এতোবছরের অক্লান্ত এক অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। দুজন প্রেমিকের আত্মার পরিতৃপ্তি পেল। তাদের প্রেম ভালোবাসা পূর্ণতা এলো।
ঘড়িতে তখন রাত দশটা। অক্লান্ত বর্ষণের পর স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। মেঘেরা ঝরে গেছে। গোল ভরাট চাঁদটা, পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। চারিদিক স্পষ্ট। মাত্রই প্রিয় দোলনায় এসে বসেছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে। গা শিরশির করছে। স্লিভলেস নাইট গ্রাউনের কটিটা আরো আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়িয়ে নিলো। অমনি চায়ের কাপ হাতে শতাব্দ এলো। প্রিয়’র পাশে দোলনায় বসল। কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল,
‘ খেয়ে নেও, মাথা ভারী ভাব কমবে।’
চায়ের কাপে চুমুক দিলো প্রিয়। পরিবেশ পিনপতন নীরব। নীরবতা ভাঙ্গল প্রিয়। বলল,
‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’
চায়ের কাপে চুপ দিয়ে উত্তর দিলো শতাব্দ, ‘হু’
একটু চুপ থেকে প্রিয় বলল,
‘ যখন আমি ইমান্দিপুর ছিলাম, শোয়েব হক থেকে আপনি দূরে থাকতে বলতেন কেন? আপনি তো তখনো জানতেন না আমি উনার সন্তান।’
‘ তুমি উনার সন্তান না জানলেও, তোমার চেহারা হুবহু তোমার মায়ের মত। আমি জানতাম উনার প্রতি দুর্বলতা ছিল, সেই সাথে ভয়া*নক রকম আ*ক্রোশ ছিল। তাই আমার ভয় ছিল, উনার আ*ক্রোশ তোমার উপর না ফেলে আবার। যদি প্রতি*শোধ নেশায় তোমাকে আঘা*ত করে ফেলে। তুমি ছিলে উনার(আয়শার) কন্যা সমান।’
মৃদু হাসল প্রিয়।বলল,
‘ আপনি সবসময় আমার আশেপাশে ছিলেন, তাইনা? আমার কলেজ ভার্সিটির ছেলেদের সবসময় শা*সিয়ে রাখতেন। আপনার জন্যই তারা আমার থেকে দূরেদূরে থাকত। কি ভয় ছিল আপনার? আমি অন্যকারো হয়ে যাবো!’
ঠোঁট মেলে হাসল শতাব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। প্রিয়’র চোখে অদ্ভুত চমক। চোখে চোখ ডুবিয়ে বলল,
‘ উহু, সেই ভয় আমি পাইনা। আমি জানতাম তুমি চিরকাল শুধুই আমার। তোমাকে নয়, এই দুনিয়ার হিং*স্র মানব নামের পশুদের ভয় ছিল। কেউ ক্ষ*তি না করে দেয় আমার সরল প্রিয়’র।’
‘ আর আমার জন্মদিন, প্রত্যেক ইভেন্টে ফ্যানদের নাম করে দামি দামি গিফট, ফুলের বুকে গুলো আপনারই পাঠানো ছিল। সত্যি তো!’
উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ। মুচকি হেসে, চোখ ফিরিয়ে নিলো। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। নিগূঢ়, নিমিষ কন্ঠে বলল,
‘ আমি এক মূহুর্তের জন্যও তোমাকে ভালোবাসা বন্ধ করিনি প্রিয়। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা আমার নিশ্বাসের মতই সত্য!’
প্রিয় নিমিষ চেয়ে রইল। এত সুদর্শন, রূপবান, বিচক্ষণ একজন পুরুষ তার প্রেমে অন্ধ, বদ্ধ উম্মদ। সত্যি কি সে এতোটা ভালোবাসার যোগ্য? এই যে সে অপূর্ণ। এই অপূর্ণতা দিয়ে কি মানুষটার ভালোবাসার প্রতুত্তর দিতে পারবে কখনো। একটা সুখী সুন্দর জীবন গড়তে পারবে আদৌ। উহু, তা কখনো সম্ভব না।
এইযে আজ তার একটুখানি সুখের জন্য মানুষটাকে এলোমেলো করে দিলো। প্রাণ ভরে ভালোবাসলো। তার ভালোবাসার জোয়ারে নিজেকে ভাসালো। এতে কি খুব বেশি অপ*রাধ হয়ে গেল। মানুষটাকে কি ঠকালো!
কিন্তু এতে তার-ই বা কি করার ছিল! ভাগ্য বড্ড নি*ষ্ঠুর! চিরকাল শুধু তাকেই ঠকালো। যেখানে শতাব্দকে ভালোবেসে, সুখে সংসার সাজানোর কথা ছিল। সেখানে তার অপূর্ণতার জন্য ছেড়ে যেতে হবে। ভালোবাসার মানুষটাকে কি করে একটা অপূর্ণ আফসোসের জীবন দিবে? সত্যি জানার পর শতাব্দ কখনোই প্রিয়কে ছাড়বেনা। বরং আগলে রাখবে কিন্তু ওইযে তার নারীত্বের অপূর্ণতা! সারাজীবন শতাব্দকে পিতা না হওয়ার আফসোসে পোঁ*ড়াবে। তখন সেই দাহন প্রিয় নিজ চোখে কি করে সইবে। পৃথিবীতে কখনো কারো জীবন থেমে থাকেনা। প্রিয়’র জায়গায় নতুন কেউ আসবে। শতাব্দকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসবে। শতাব্দের আদর নিবে, তাকে পূর্ণ করে দিবে। একটা সুন্দর পরিবার হবে তাদের। থাকনা একটা অপূর্ণ প্রিয়’র গল্প। নাইবা পেল শতাব্দকে। চিরদিন এই মধুর রাতের স্মৃতি আগলে বাঁচলো।
সবকাজ প্রায় শেষ। জাল বিছানো হয়ে গেছে। কালকের দিনটা অন্যরকম হবে। তার এতবছরের প্রতি*শোধ, আক্ষেপ পূর্ণতা পাবে। অপরা*ধীদের শাস্তি মিলবে। রাত পোহালেই চলে যাবে। তার ভালোবাসার শতাব্দকে চরম ভাবে ঠকিয়ে যাবে। হয়তো চরম ঘৃ*ণা করবে, দূরে ঠেলে দিবে প্রিয়কে। আফসোস নেই এটাই চাইছে সে। যেখানে মানুষ যুগের পর যুগ সত্যিকারের ভালোবাসার অভাবে পু*ড়ে। সেখানে প্রিয় পেয়েও ছেড়ে যাবে। কি নিষ্ঠুরতম ভাগ্য তার। চোখ ভিজে এলো প্রিয়’র। শতাব্দের চোখে বাঁধল। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। কপালে হাত ছুঁয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘ জ্বর আসছে আবার। শরীর ব্যথা করছে? ঔষধ খেতে হবে, ঘরে চলো।’
উত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। অপলক তার প্রেমিক পুরুষের দিক চেয়ে রইল। প্রিয়’র কোনরূপ হেলদোল না পেয়ে কোলে তুলে নিলো শতাব্দ। ঘরে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো।
গভীর রাত চোখে ঘুম নেই প্রিয়’র। পাশ ফিরে মুখপানে চেয়ে আছে শতাব্দের। এত কাছ থেকে এই মুখখানা দেখার সুযোগ কোনদিন মিলবে কি আর! নিশ্বব্দ কান্নায় চোখ ভিজছে। বুকে প্রচন্ডরকম হাহাকার। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। আলতো হাতে শতাব্দের মুখখানায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ ভালোবাসি শতাব্দ। প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। আমি চিরকাল আপনার প্রিয় হয়েই বাঁচবো। হোকনা হাজার মাইলের দূরত্ব।’
চলবে…………
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।
গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন। আমার গ্রুপে চাইলে গল্প নিয়ে আলোচনা সমালোনা করতে পারেন। বানান ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন❤️
টাইপোগ্রাফি: Maksuda Ratna আপু❤️🌺