ফিলোফোবিয়া পর্ব -৪৮

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

৪৮.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

শতাব্দ,

কোথা থেকে শুরু করি? চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছাবে। এই বাড়ি ছেড়ে আমি অনেক দূরে। জানি আপনি রাগবেন। বিরক্ত হবেন, ঘৃ*ণা করবেন। কিন্তু সত্যি এটাই যে, আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসিনি। আমার ভালোবাসার সমাপ্তি অনেক বছর আগেই হয়েছিল। এইযে আপনার কাছে ফিরে আসাটা, পুরোটাই আমার সাজানো ছিল।সহজ অর্থে নাটক ও বলতে পারেন। একবার আপনি আমাকে ছেড়েছিলেন, আমি আপনাকে নিজের কাছে টেনে, ছেড়ে দিয়ে।শোধ নিলাম। আমার ফিরে আসার পেছনের কারণটা ছিল রহস্য উদঘাটন। আমি আপনাকে এক মুহূতে’র জন্যও ভালোবাসিনি। গতরাতে আপনার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কা*টানোর পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল। মূলত ডিস্ট্রাকড করে। আপনার ফোনে ড্রাইভারের স্বীকারোক্তির ভিডিও নেওয়া। পুলিশ নিশ্চয়ই শাস্তি দিবে, কিন্তু অপরাধীদের আমি আমার মত করে শাস্তি দিতে চাই। আমার মায়ের আত্মহ*ত্যা ছিল না। তাকে খু* ন করা হয়েছিল। শোয়েব হক, ছবি বেগম এই সমাজ তাকে খু ন করেছে।তাদের তিক্ত ধারালো বুলি আত্মহ*ত্যা করতে বাধ্য করেছে। আইন প্রমাণ চায়। মানহানির কোন কঠোর শাস্তি নাই। তাই আমিও হাল ছাড়িনি। তাদের কঠোর শাস্তি দিতে চেয়েছি। অপমানের বদলে অপমান, হ*ত্যার শাস্তি মৃ*ত্যুদন্ড। ভাইয়া ও তার ডিটেকটিভ বন্ধুর সাহায্যে ছবি বেগম ও তার ছেলেমেয়েদের সব কুকীর্তির প্রমাণ জোগাড় করি। যদিও তা যথেষ্ট ছিলনা। তাই উষ্ণচর যেয়ে তুরফাদের সাথে দেখা করি। আমি জানতাম ছবি বেগম আঁচ পেলে আমাকে মে*রে ফেলতে চাইবে। তাই ঢাল বানিয়ে আপনার আড়ালে থেকে নিজের কাজ করতে থাকি। কারণ আমি জানতাম আপনাকে ডিঙিয়ে আমার অবধি পৌঁছানোর সাধ্যি নেই তাদের। সহজ কথায় নিজের সেফটির জন্য আমি আপনাকে ব্যবহার করেছি।
হয়তো আপনার ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিলনা। কিন্তু আমার দ্বারা আপনার সাথে থাকা সম্ভব না। একটা প্রশ্নের উত্তর আমার এখনো মিলেনি! সেই রাতে ইমান্দিপুর কেন গিয়েছিলেন আপনি? জানি উত্তরটা আপনি বলবেন না। আমিও আর জানতে চাইব না। তবে হ্যাঁ, কোন কিন্তু নিয়ে আপনার সাথে সংসার সাজাতে পারবো না। যেখানে ভালোবাসার বাস নেই, সেখানে কি করে সংসার সাজাই? জানি, আমাকে খুঁজে বের করা আপনার জন্য কঠিন না। পাতালে লুকালেও খুঁজে বের করবেন। কিন্তু আমি চাইনা আমাদের আবার দেখা হোক। আমার উপর কোনপ্রকার জোর খাটানোর চেষ্টা করলে, আমি অনর্থ ঘটাবো। আর আপনি জানেন এমনটা করতে আমার একটুও হাত কাঁপবেনা। আমাদের জন্য বিচ্ছেদ-ই শ্রেয়।আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি শতাব্দ। ভুলে যান আমাকে। অন্যকারো সাথে নতুন করে সংসার সাজান। আপনি অনেক ভালোবাসার প্রাপ্য। আপনার ভাগের ভালোবাসা গুলো অন্যকারো কাছে তোলা আছে এখনো। পরিশেষে বলল, মাফ করবেন। আমার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবেন।

ইতি
প্রিয়,

দেয়ালের পিঠে যেন চিঠির লেখা গুলো ভেসে উঠছে বারবার।বাহিরে উজ্জ্বল দিন হলেও, ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। এলোমেলো চূর্ণবিচূর্ণ ঘর। ভাঙ্গাচুরা জিনিসে চারিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শান্ত অগ্নিগিরি হ্ঠাৎ বিস্ফোরণে যেমন তান্ডব হয়। ঠিক তেমন। শতাব্দের রাগের মাত্রা আজ আসমান ছুঁই ছুঁই। ক্রোধান্বিত গর্জনের ফোঁসফোঁস নিশ্বাস দেয়ালে দেয়ালে বারি খাচ্ছে। চাপা চিৎকার, উত্তেজনা, ক্রোধ তাকে খাঁখাঁ করে পো*ড়াচ্ছে। কোথাও চূর্ণবিচূর্ণ ধা*রালো কিছুতে হাত লেগে অনর্গল র*ক্ত ঝরছে। সে দিকে তার খেয়াল নেই, ধৈর্য যেন সীমা ছেড়েছে। সবকিছু বিনাশ করেই যেন ক্ষান্ত হবে আজ!

সারাদেশ তোলপাড়। বাতাসে বাতাসে শুধু একটাই গুঞ্জন’ ছবি বেগম তার সন্তানদের ফাঁ*সি চাই’। ভোর রাতের দিক অজানা এক পেজ থেকে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে লিমন হকের স্বীকারোক্তি আছে যে, সেই আর তার বন্ধুরা মিলে তদ্রাকে ধ*র্ষণ করেছে। নিশ্বাস তখনো চলছিল। দেহে প্রাণ ছিল। তা দেখে লুবনা ঘাবড়ে যায়। গলা টি* পে শ্বাসরোধ করে মে*রে ফেলে। তারপর পানিতে ভাসিয়ে দেয়। যখন লা*শ ভেসে উঠে, তখন ব্যাপারটা কুসংস্কারে ডেকে ফেলে। পানির নিচের খারাপ জিনিস তদ্রাকে মে*রেছে। সেই সাথে গ্রামে চলতে থাকা মা*দক ব্যবসা, চাঁদাবাজি সবকিছুর স্বীকারোক্তি আছে। উষ্ণচরের মানুষের উপর এতবছর অমানবিক নির্যাতন। সেই সাথে শোয়েব হকের এক্সিডেন্টের ব্যাপারটার ও খোলাসা হয়েছে। ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি ভিডিও প্রমাণ সহ সব ফাঁস হয়েছে। সবমিলিয়ে তারা পুরোপুরি ফেঁ*সে গেছে। টাকা দিয়েও কোন কাজ হচ্ছেনা। সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলছে বরাবর। মিনিটে মিনিটে শতশত লাইক, শেয়ার হচ্ছে। একটাই দাবি সবার ‘তাদের ফাঁসি চাই’। রাজনৈতিক দলও পিছিয়ে গেছে। ছবি বেগমকে সাহায্য করার জন্য আশেপাশে কেউ নেই। শাহরিয়ার হক সাহায্যের জন্য মুখের উপর নিষেধ করে দিয়েছেন। এদিকে শতাব্দ ফোন তুলছেনা। পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে। হাতের কাছে পেলেই এরেস্ট করবে। চারিপাশ থেকে অ*ন্যায়ের শিকড় যেন চেপে ধরেছে ছবিকে। মানুষের হাহাকার অভিশাপ যেন ফলে যাচ্ছে আজ। চারিদিকে শুধু অপমান আর অভিশাপ। এবার তার পালাবার কোন পথ নেই আর।

গতরাতে শোয়েব হকের জ্ঞান ফিরেছে। শরীরের ক্ষত অনেক। তবে বিপদ মুক্ত হলেও অভিশাপ ছাড়েনি তাকে। হাঁটা চলার জন্য অক্ষম সে। হার্ট অ্যাটাক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে। মুখ বেঁকে গেছে, হাতপা সব অচল। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবেনা সে। যতদিন বাঁচবে, এভাবেই তাকে বাঁচতে হবে। অন্যের সাহায্য নিয়ে। আজ সাহায্যে জন্য কেউ নেই স্ত্রী সন্তান সবাই ছেড়ে গেছে। তাদের যতটুকু স্বার্থ ছিল সব গুছিয়ে কে*টে পড়েছে। আপাতত তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। দুদিন ধরে অভিলাষা বেগম একাই তার সাথে হাসপাতালে আছে।
আচমকা বাড়ি থেকে ফোন আসতেই নার্সদের দায়িত্ব দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল থেকে অভিলাষা বেরিয়ে গেছে। ওইদিকে বাড়িতে শতাব্দ হট্টগোল কান্ড বাঁধিয়েছে। যাওয়ার আগে বেশ কড়া করে বলে গেছে নার্সকে, কাউকে যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়। এমনিতেও পরিস্থীতি খারাপ। সাংবাদিকরা নতুন খবরের জন্য উসখুস করছে। এখানে এসে তারা ঝামেলা করতে পারে।
অভিলাষা বেরিয়ে যেতেই বোরকা পড়া কেউ এক ভেতরে এলো। নার্স চমকালো। বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কে আপনি? পেশেন্টের আত্মীয়।’
বোরকা পরিহীতা মহিলার স্বাভাবিক আওয়াজ,
‘ জি, আমি উনার বন্ধু। উনার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।’
নার্সের সন্দেহ হলো। বলল,
‘ সরি আমাদের অনুমতি নেই।’
‘ উনার বোনের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি চাইলে ফোন করে খোঁজ নিতে পারেন।’
নার্সের যেন খানিক বিশ্বাস হলো এবার। ফোন করে খোঁজ নেওয়ার মত এত সময় আছে কি তার? ছোট ছোট পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
নার্স বেরিয়ে যেতেই শোয়েব পাশে চেয়ার টেনে বসল তিনি। মুখের মুখোশ তুলে। আলতো স্বরে ডাকল,
‘ শোয়েব! শোয়েব!’
পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকাল শোয়েব। চাহনি স্পষ্ট হতেই থমকে গেল সে। মৃ*ত মানুষ কি কখনো ফিরে আসে? এটা কি সত্যি সে? নাকি তার আত্মা এসেছে! কুসংস্কার কথাবার্তা মাথা ঝেঁকে ধরেছে। অধৈর্য, অস্থির হয়ে কিছু বলতে চাইল। পারছেনা সে। মুখ থেকে বোবার মত গোঙ্গানি আওয়াজ বেরচ্ছে। মুখ থেকে লালা বেরিয়ে পড়ছে। সামনের মানুষটা টিস্যু দিয়ে মুখে দিলো। শোয়েবের দিক ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আমাকে চিনতে পেরেছ শোয়েব। আমি আয়শা।’
শোয়েব অধৈর্য্য হলো আরো। হাউমাউ করে খাবলে পড়ল, কিছু বলতে চাইল। পারল না।
আয়শা স্মিত হাসল। বলল,
‘ কি ভাবছ বেঁচে আছি কি করে? হয়তো আজ এই দিনটা দেখাবে বলে, বিধাতা দূত করে সেদিন পাঠিয়েছিল শতাব্দকে। সত্যি বিধাতা মহান। কর্মের ফল এই দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয় সবাইকে। দুনিয়াতে ‘রিভেঞ্জ অব নেচার ‘বলতেও কিছু আছে। যেই মানুষটার জন্য তুমি আমাকে ঠকিয়েছিলে। সেই মানুষটাই তোমার প্রাণ নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ কি অদ্ভুত তাইনা শোয়েব!’
শোয়েব থমকে আছে। চোখজোড়া থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু বলতে চাইছে। পারছেনা, নিয়তি আজ তাকে বোবা বানিয়ে দিয়েছে। জীবনের অন্তিম সিড়িতে দাঁড়িয়ে, অথচ ক্ষমাটাও চাইতে পারছেনা। কি অদ্ভুত ভাগ্য তার।
আয়শা আবার বলল,
‘তোমাকে দেখে একটু কষ্ট হচ্ছেনা আজ। এসব তোমার প্রাপ্য। একদিন আমাকে ঠকিয়েছিলে। তোমার কারণে আমি নিঃস্ব হয়েছিলাম। নিজের সন্তান, আমার প্রিয়কে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। এই উচ্চ সমাজের চক্ষু লজ্জার ভয়ে মা হয়েও তাকে নিজের কাছে রাখতে পারিনি। খাঁখাঁ করে পুড়েছি প্রতিদিন। আমাদের একটা সুন্দর গোছানো সংসার হওয়ার কথা ছিল অথচ তোমার অর্থলোভ, ধড়িবাজিতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তবুও তোমার শান্তি মিলেনি! তোমাদের কারণে আমি আর আমার মেয়ে সমাজে ব্যা** বনেছি। শেষমেষ নিজেকে আত্নগোপন করতে বাধ্য হয়েছি।’
শোয়েব কিছু বলতে চাইল। আয়শা তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
‘ কি বলতে চাও? তুমি এসব করতে চাওনি! তোমার কোন যুক্তি -ই আমার কষ্ট যন্ত্রণার সামনে খাটবে না। প্রচন্ড ঘৃ*ণা করি তোমাকে। আর এই ঘৃ*ণাটা তুমিই তৈরি করেছ। নিয়তির জবাব দেখেছ শোয়েব! প্রতি*শোধ আমি কোনদিন চাইনি। অথচ সব এলোমেলো হলো। তোমার স্ত্রী সন্তানদের অপকর্ম বেরিয়ে এলো দুনিয়ার সামনে। নিরীহ মানুষের অভিশাপ ফলেছে। হাজার হাজার মানুষের অপমান ঘৃ*ণায় জর্জরীত হচ্ছে। সাহায্যের জন্য কেউ নাই পাশে। আর এসব কে করেছে জানো? আমার মেয়ে! আমার প্রিয়। আমি জানতাম, একটা বাঘিনী জন্ম দিয়েছি। খানিকের জন্য চুপ থাকলেও, শিকারীদের শিকার ঠিক করবে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে খাবলে ছি*ড়েখুঁড়ে ফেলবে। আজ তোমাকে দেখে আমার একটু কষ্ট হচ্ছেনা শোয়েব। তুমি আমার কাছে অনেক আগেই ম*রে গেছ। যেদিন রাতে বাড়ি এসে হামতাম করলে। তোমার জন্য আমার নিষ্পাপ মেয়ের উপর দাগ লাগল। প্রতিবাদে তুমি চুপ ছিলে।সেদিন থেকেই তুমি আমার কাছে মৃ*ত। এসব তোমার প্রাপ্য ছিল।’
অঝোরে কাঁদছে শোয়েব। নোনা জলে চোখমুখ ভিজে। আয়শার পা ধরে বলতে চাইল, ‘ আমাকে ক্ষমা করো। একটু শান্তি দেও। এই অপ*রাধের দহনে কতকাল পুড়বো আর।’ কিন্তু পারলনা। তার অপ*রাধ ভাষা ছিনিয়ে নিয়েছে আজ।
আজ উঠল মুখের মুখোশ লাগাতে বলল,
‘ আসি আজ। আশাকরি আর কোনদিন দেখা হবেনা আমাদের। আমার মেয়ে থেকে দূরে থাকবে। এই জীবনের অফুরন্ত দুঃখ, বেদনা আর বিষন্নতার জন্য ধন্যবাদ। খোদা করুন কোনজীবনে যেন তোমার সাথে দেখা না হয় আর!’
ধপধপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল আয়শা। র*ক্তিম তার চোখ। কয়েক ফোঁটা পানি যেন গড়িয়ে পড়ল।
যাওয়ার দিকে নিমিষ তাকিয়ে রইল শোয়েব। যেই অর্থ সম্পদের লোভে সে সোনার হরিণ নামক সুখ ছাড়ল। আজ সব ছেড়ে সেই নব্বইদশকে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। সেই রঙিন দিন গুলোতে কি বাঁচা যাবে আবার? অন্তহীন আফসোসের নোনা জল গড়ালো। এই আফসোস যে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বইতে হবে তার। এরচেয়ে মৃ*ত্যু অনেক বেশি সুখের।

বাড়ি পৌঁছাতে না, পৌঁছাতে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো অভিলাষার। কোন এক বোরকা পরিহীতা অগ্যত মহিলার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে শোয়েব হক অস্থির। অসুস্থ! অভিলাষা থমকে গেল? অগ্যত মহিলাটাকে কে ছবি নয়তো। পুলিশ মিডিয়ার ভয়ে লুকিয়ে এসেছে। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না অভিলাষা। ‘আচ্ছা, আসছি’ বলে কে*টে দিলো ফোন। দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে ছেলের ঘরে গেল। ঘরে যেতেই থমকে গেল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। পুরোটা ঘর অগোছালো, এলোমেলো। মাটি, কাচের জিনিস গুলো ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ। ফ্লোরের জায়গায় জায়গায় র*ক্তের ফোঁটা লেগে। এই কি হাল করেছে তার ছেলে। একজন ধৈয্যশীল ম্যাচিউর মানুষটা যখন ধৈর্য হারায়। নিঃস্ব হয়। নিজের সর্বস্ব হারায়। তার অবস্থা বুঝি এমনি হয়! প্রিয়’র জন্য তার নিষ্ঠুর, জেদি ,অবাধ্য ছেলেটা নিজেকে বদলে নিয়েছিল। নিজের সবটা দিয়ে প্রিয়কে চেয়েছিল। আজ সেই প্রিয় কই? পাশে নেই কেন!
কাচের উপর ঝটপট পা চালিয়ে। ছেলের পাশে বসল। র*ক্তিম দৃষ্টিতে চিঠির দিক এখনো চেয়ে আছে শতাব্দ। হাতে জলন্ত সিগারেট। ফিল্টারে ফ্লোর বিছিয়ে। অভিলাষা ছেলের হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলো। বিষন্ন, অপ্রসন্ন, গম্ভীর ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। কেঁদে ফেলল। কান্নাভেজা কাতর কন্ঠে বলল,
‘ এসব কি আব্বা! কি হয়েছে তোর।’
শতাব্দ চুপ, গম্ভীর। দৃষ্টিতে এখনো ক্রোধ জলন্ত। অভিলাষা কান্না কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আবার বলল,
‘ প্রিয় কই?’
শতাব্দ চুপ। ছেলের চুপ থাকাটা অভিলাষার ভেতর নাড়িয়ে দিচ্ছে আরো। ভয় বাড়ছে প্রচন্ড। তিনি নিলেই কারণ খুঁজতে লাগল। শতাব্দের হাতের চিঠিটা টেনে নিলো। পড়তে শুরু করল। থমকে গেল। প্রিয় তার ছেলেটাকে এভাবে ঠকালো? এত ভালোবাসলো, বিনিময়ে এই দিলো! ছি!
অভিলাষা তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ কোথায় গেছে প্রিয়? আমি যাবো, বুঝিয়ে আনবো।’
শতাব্দের গম্ভীর আওয়াজ,
‘ আসবেনা ও। ভীষণ জেদি মেয়ে।’
অভিলাষা বিহ্বল সুরে বলল,
‘ তো এখন?’
শতাব্দ দেয়ালে মাথা ঠেকালো। ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নিলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ উড়ছে, উড়তে দাও। সময় হোক, ওর ঘাড়ে ধরে ফিরিয়ে আনবো।’

শতাব্দের বাড়ি ছেড়ে প্রিয় নতুন বাড়িতে উঠেছে আজ তিনদিন। বান্ধবী ইরা-ই সব ঠিক করে দিয়েছে। কাউকে যেন নতুন বাড়ির ঠিকানা না দেয়, অনেক খোসামোদ, আকুতি মিনতি করে ইরাকে রাজি করেছে। এক রুম এডজাস্ট বাথরুম, কিচেন ছোট ড্রইং স্পেস সহ ছোটখাটো এপার্টমেন্ট। জরুরী ভিত্তিতে উঠেছে কোনরকম। প্রথম দিন ইরা রান্না করে নিয়ে এসেছে। এরপর রান্নাবান্না করেনি আর। কিছু ভালো লাগেনা। ঘুম নেই, খুদা নেই। সারাক্ষণ শুধু শতাব্দ ঘুরঘুর করে মাথায়। আচ্ছা শতাব্দ এখন কি করছে? নিশ্চই তাকে ঘৃ*ণা করছে। প্রচন্ডরকম ভাবে। তাইনা? হয়তো তাই সে এখন অবধি তার বাড়িতে এসে হানা দেয়নি। নয়তো এতক্ষণে এসে তোলপাড় করে ফেলত। নিজের বেহায়া মনের উপর রাগ হচ্ছে, খুব। শতাব্দ থেকে দূরেও থাকতে চাইছে। আবার শতাব্দকেও চাইছে। অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দে ফেঁসেছে।
শুধু বুক ফেটে কান্না আসে। সারাদিন ঘরে কোনায়, এখানে সেখানে বসে শুধু কাঁদে। কতটা অসহায় হলে মানুষ ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও দূরে ঠেলে দেয়! নিজের প্রতি, জীবনের প্রতি সে বিরক্ত! প্রচন্ডরকম বিরক্ত। অশান্তি কেন পিছু ছাড়েনা তার!
প্রান্তরে দিন ডুবছে। একটু একটু করে অন্ধকার ডাকছে। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে প্রিয় দূর দিগন্তে চেয়ে। আচমকা ঘরের কলিং বেল বাজলো। এই অসময় কে এলো। ইরা? কপাল কুঁচকে দরজার দিক এগিয়ে গেল। দরজার অপর পাশের মানুষটাকে দেখে থমকে গেল। মৃ*ত মানুষ ফিরে আসতে পারে আদৌ! মুখ থেকে অফুটন্ত আওয়াজ বেরিয়ে এলো। বলল,
‘ মা!’

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here